somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শাওন আহমাদ
স্বপ্নপূরণই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।তাই বলে স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়,তাকে সঙ্গে নিয়ে চলি।ভালো লাগে ভাবতে, আকাশ দেখে মেঘেদের সাথে গল্প পাততে, বৃষ্টি ছুঁয়ে হৃদয় ভেজাতে, কলমের খোঁচায় মনের অব্যক্ত কথাগুলোকে প্রকাশ করতে...

মায়ার নদীতে বিষাদের ঢেউ

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইট-কাঠের নিঃসঙ্গ শহরে জীবন যখন একঘেয়েমির ভারে ক্লান্ত হয়ে উঠছিল, তখন একদিন রাতে নুরুদ্দিন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এলো টুনিকে। টুনি তখন খুবই ছোট। মুখে তুলে খেতে পারত না। জীর্ণশীর্ণ শরীর, হাঁটতে গেলেও পা জড়িয়ে পড়ে যেত ফ্লোরে। আমরা পালাক্রমে ওর যত্ন নিতে শুরু করলাম। প্রথম দিকে গুঁড়ো দুধ গুলিয়ে, নাহয় দুধের সঙ্গে বেশ করে ভাত মেখে মুখে তুলে খাওয়াতাম। এভাবে ধীরে ধীরে টুনি খাবার খাওয়া শিখে গেল। জীর্ণশীর্ণ শরীরে ফিরে এলো প্রাণ। শুরু হলো টুনির দৌড়ঝাঁপ আর লুকোচুরি।



অফিস শেষে যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম, দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ছাদের কোনো এক কোণ থেকে দৌড়ে এসে পা জড়িয়ে ধরত। মিউমিউ করে যেন সারাদিনের কুশল বিনিময় করত, কিংবা না-বলা নানা গল্প বলত। ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যেতাম, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যেত। রান্নার জন্য কাটাকুটি করতাম, গায়ের উষ্ণতায় গা মিশিয়ে বসে বসে দেখত। যতটা সময় রান্না করতাম, পায়ের কাছে ঘুরঘুর করত, ট্রাউজার বেয়ে কোলে উঠে আসত।



যখন সকল ব্যস্ততা শেষে একটু ফ্রি হতাম, তখন শুরু হতো ওর অহ্লাদ। হাতে মোবাইল দেখলে পা দিয়ে আঘাত করে ফেলে দিত। এমনভাবে নখগুলো গুটিয়ে আলতোভাবে আঘাত করত, যেন ব্যথা না পাই। এরপর বুকের ওপর উঠে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। কী নিষ্পাপ ছিল সেই চাহনি! কী অপার আদরে ভরা ছিল সেই মুখ! মোবাইল ফেলে ওর সাথে কথা বলা শুরু করলে, ও কানের কাছে, গলার কাছে মুখ ডুবিয়ে আদর করত। মৃদু স্বরে যেন অভিযোগের সুরে বলতে চাইত: "সারাদিন কোথায় ছিলে? একা একা ভীষণ মিস করেছি তোমাকে।"



কখনো কখনো ভয় দেখানোর জন্য ছাদজুড়ে লাগানো ফুলগাছের টবের আড়ালে, দরজার ফাঁকে, জুতোর বাক্সে, বুকশেলফের ভেতরে লুকিয়ে থাকত টুনি। ডাকলেও সাড়া দিত না। যখন ডাকতে ডাকতে গলার স্বরে চিন্তার ভাঁজ পড়ত, তখন লাফিয়ে এসে আমাদের গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। এদিক-ওদিক আলতো করে কামড় দিত।

অফিস থেকে ফেরার পথে যখন ওর জন্য চিকেন নিয়ে যেতাম, ও ঠিক টের পেয়ে যেত। রুমে এসে ব্যাগ রাখার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে দৌড়ে গিয়ে ব্যাগের চেইন খোলার চেষ্টা করত। খাবার বের করে খেতে দিলে একবার গিয়ে খাবারে মুখ দিত, আবার ফিরে এসে আমাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুমু দিত। খাবার শেষ হওয়া অবধি চলত এ আহ্লাদ। এটা ছিল তার ভালোবাসা প্রকাশের এক ভিন্ন ভাষা।




এই পাষাণ শহরে আমার অফিস শেষে বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া ছিল না, অবশ্য আমার জন্য অপেক্ষা করারও কেউ ছিল না। কিন্তু টুনি আসার পর সব পালটে গেল। অফিস শেষে টুনির জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতাম, আর টুনিও এদিকে খাবার না খেয়ে আমাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় না খেয়ে বসে থাকত। যদিও আমরা অফিসে যাওয়ার আগে ওকে খাবার দিয়ে যেতাম, কিন্তু একটু খাবারও মুখে তুলত না। আমরা বাড়ি ফিরে এলে, তবেই সে খাবারে মুখ দিত।
কখনো কখনো অফিসে যাওয়ার পথ আগলে দাঁড়াত। মিউমিউ করে বলতে চাইত, "আজ অফিসে না গেলে হয় না? আজ থেকে যাও। চলো আমরা লুকোচুরি খেলি।" দিন যত গড়াচ্ছিল, আমরা টুনিতে আর টুনি আমাদের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছিল। অদৃশ্য এক মায়ার বাঁধন শীতের রাতের উষ্ণ কম্বলের মতো পেঁচিয়ে নিচ্ছিল আমাদের।



কিন্তু হঠাৎই টুনির জীবনে এক ভয়ানক রাত নেমে এলো, যে রাত আমাদের মায়ার শান্ত নদীতে বিষাদের ঢেউ তুলল, নাড়িয়ে দিল আমাদের ভেতর-বাহির। টুনি পাশের ফ্লাটের কিচেনে দেওয়া তেলাপোকার বিষ খেয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। ভোরবেলা ওর নিথর দেহ খুঁজে পেলাম কিচেনের ফ্লোরে। বরফ-শীতল নিথর দেহ! করুণ চাহনি নিয়ে মায়াবী চোখ দুটো স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে, যেন শেষবারের মতো বলছে, "আমি তোমাদের সঙ্গে আরও অনেকটা দিন বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু..."



টুনিকে ময়লার গাড়িতে তুলে দিয়ে অফিসে গেলাম। কিন্তু মোটেও আমার অফিস কাজে মন বসছে না। বিড়াল মরে যাওয়ার শোকে যদি অফিস কামাই করার সুযোগ থাকত, তাহলে অফিসে বসে আমাকে বিষাদমাখা মন নিয়ে কীবোর্ডে বিরক্তিকর খটখট আওয়াজ করতে হতো না। সন্ধ্যায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছি, চারদিকে একদম সুনসান নীরবতা। মনে হচ্ছিল, টুনির মৃত্যু শোকে আজ আকাশেরও মন খারাপ।



যখন রুমের কাছে এলাম, মনে হচ্ছিল, টুনি মিউমিউ করে ডাকছে। মুহূর্তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম, এ আমার মনের ভুল। রুমের তালা খুলছি, টুনি এসে পা জড়িয়ে ধরছে না। রান্না করছি, ওয়াশরুমে যাচ্ছি; কোত্থাও টুনিকে দেখতে পাচ্ছি না। টুনি কোত্থাও নেই।
আমাদের বাড়িতে এখন শোকের মাতম। বাড়ির প্রতিটি জায়গায় টুনির স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মায়া বড় অদ্ভুত এক বন্ধন, একবার হৃদয়ে জড়িয়ে গেলে সহজে তার মুক্তি মেলে না।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৩০
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×