এই গল্পটি শুনেছিলাম আমার এক বন্ধু হীরার গ্রামের বাড়ির এলাকার একজন বুড়োর কাছ থেকে। তার বক্তব্যকে অনেকেই সত্যি বলে রায় দিয়েছিলেন। তার মত করেই গল্পটি আপনাদের বলার চেষ্টা করছিঃ
ব্রিটিশরা তখন ছাড়ি ছাড়ি করছে, সেই সময়ে এই এলাকার থানার দায়িত্বে ছিলেন এক বাঙালী পুলিশ অফিসার তপন মিত্র। প্রত্যন্ত অঞ্চলের থানা, তাই তার খুব একটা তর্জন-গর্জন ছিলোনা। তবে দারোগা বাবু লোক হিসেবে যথেষ্ট ভালো ছিলেন। বেশিরভাগ মামলাই শেষ পর্যন্ত শহরে কোর্টের এজলাসে পৌঁছাত না, এখানেই সমাধান হোত। তবে বড় কোন ঝামেলা হলে শহর ছাড়া আর গতি কি? সেরকমই ঘটনা ঘটল একদিন!!
মাঘ মাসের হাড় কাপানো এক দিনে আম গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল এক ষোড়শীর মৃতদেহ। হইচই পড়ে গেল সবখানে। ছুটে এল সবাই, পুলিশের লোক এসে নামালো সেই মেয়েটির লাশ।
সকলেই মন্তব্য করলো যে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু বেকে বসলেন মেয়ের বাবা। তার কথা তার মেয়েকে মেরে ফেলেছে কেউ। তপন বাবুও আবিষ্কার করলেন মেয়েটির গালে, পিঠে ও বুকের পাঁজরে আচড় ও জখমের চিহ্ন!! চিন্তায় পড়ে গেলেন দারোগা বাবু। মার্ডার কেস হতেই পারে!!
ময়না তদন্তের জন্য শহরের হাসপাতালে লাশ নিতে হবে। শহরে যাবার দ্রুত পথ হচ্ছে নদীপথ। এদিকে শীতের দিন। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হোল।
রাত আটটার দিকে দুজন প্রহরি নিয়ে নৌকায় উঠলেন তপন বাবু। সাথে মেয়েটির লাশ ও মেয়েটির বাবা ও কাকা।
কুয়াশায় ঢাকা চাঁদের ঘোলাটে আলোয় ভেসে চলেছে নৌকা শহরের দিকে। সব ঠিক থাকলে সকাল নাগাদ পৌছবে শহরে। মাঝি দুজন। সব মিলিয়ে ৭-৮ জন মানুষ। ডাকাতের ভয়তো আছেই, আবার কুয়াশায় রাস্তা হারানোর আশংকাও রয়েছে, তাই কিছুটা নদীর পাড় ঘেঁষেই চলেছে নৌকা।
রাত বাড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছেন প্রহরি, দারোগা বাবু সহ প্রায় সবাই। মেয়ের বাবা আধোঘুমে মাঝে মাঝেই বিলাপ করে উঠছেন অবোধ্য ভাষায় বিড়বিড় করে, সান্তনা না পেয়ে আবার ঝিমিয়ে পড়ছেন। মাঝিরা পালা করে দাঁড় বেয়ে চলেছে ছপাত-ছপাত নিরন্তর শব্দে। এ ছাড়া আর কোন শব্দই শোনা যায়না কান পেতে থাকলেও।
এ শব্দকে ছাপিয়ে গা গুলানো শব্দটা সবার আগে খেয়াল করলো নৌকার পেছনে বসা মাঝি। এদিক সেদিক উৎসের অনুসন্ধানে তাকিয়ে ব্যার্থ হয়ে আবার দাঁড় টানায় মন দিতে যাবে, এমন সময় সে দেখলো প্রায় উলঙ্গ বড়-বড় চুল ওয়ালা কালো গরিলা টাইপ কিছু একটা লাশের উপর হামলে বসে আছে!! থাবা দিয়ে খুব্লে নেবার চেষ্টা করছে মেয়েটির শরীর!!
ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার দিল মাঝি বেচারা, চিৎকার শুনে জেগে উঠে সবাই বুঝলো পরিস্থিতি কি। কিন্তু সবার হাত-পা জমে অসাড়। কি করবে এই অচেনা বস্তুটিকে, কি করা যায়??
কেউ কিছু করবার আগেই গরজে উঠলো দারোগাবাবুর মাস্কেট। অজানা ভাষায় আর্তনাদ করে পানিতে ঝাপ দিলো সেই অজানা ভয়ংকর শবখেকো!! দারোগাবাবু মাঝিদের নির্দেশ দিলেন কোন লোকালয়ে নৌকা ভেড়াতে। মাঝিরা প্রান-পন দাঁড় বেয়ে লোকালয়ের খোজে চলেছে। কিন্তু পিছু ছাড়েনি ভয়ংকর সেই জীব। নদীর পানি তোলপাড় করে চলেছে। আরো দু'বার গোলা ছুড়লেন তপন বাবু। গুলির শব্দে জেগে উঠেছে পাড়ের মানুষ। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে নিভু-নিভু কেরোসিন বাতির আলো। সেই দিকে নৌকা ছুটালো মাঝিরা। অবশেষে পাড়ে উঠে এলো সবাই, কোন রকমে পাড়ে নামানো হোল কিশোরীর লাশ। দেখা গেল, তার মুখ থেকে খাব্লে নেয়া হয়েছে বেশ খানিকটা অংশ!!
সে রাতে ওখানেই থেকে পরদিন দিনের আলোয় যাবার সিদ্ধান্ত হোল। এবং ময়না তদন্ত শেষে মেয়েটিকে গ্রামেই এনে দাহ করা হয়।
এই ঘটনার চার দিন পরে মেয়েটির বাবা পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যান, এবং বছর খানেক পরে মারা যান।
(অনুলিখন)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১২ রাত ১:০৬