somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দাদার কাছে তাঁর দাদার নাম শুনুন, নিজের ইতিহাস লিখুন ও ইতিহাস পড়ুন

১৫ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ৭:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার আর আদিনাথ চন্দ্রগর্ভের শৈশবকাল কেটেছিল একই ভু-খন্ডে। আমি এখনো বেঁচে আছি কিন্তু ১০৫৩ সালে আদিনাথ মারা যায়। আদিনাথ শৈশবেই বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারার বিরল প্রতিভা দেখিয়েছিল কিন্তু আমি এখনো আমার ধর্ম ইসলাম আর অনইসলামের পার্থক্য বুঝতে পারিনি কারন আমি প্রকৃত জ্ঞানার্জনের সুযোগ পাইনি। এ ভূ-খন্ডে প্রকৃত জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্র আর নেই। প্রত্যয়ন পত্র পাবার বিদ্যা অর্জিত হয়েছে বটে তাই বড়জোর চাকরামী করার সুযোগ পেয়েছি। প্রত্যয়ন পত্র পাবার এই রীতিটি খুব বেশিদিনের পুরনো নয়, বাপ-দাদারা বলে বৃটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত হইসি আমি। লেখাপড়া করেছি এই রাষ্ট্রেরই পৃষ্ঠপোষকতা করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘নালন্দা’য় গিয়ে বহুদিন ধরে শাস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন। পরে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি পাঠদান করিয়েছিলেন। সে অনেক বছর আগের কথা, সালটা আনুমানিক ১০০০ সাল হবে। আদিনাথ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছিলেন ইতিহাস বলছে ( ৪২৭-৪৫০ সাল ) সেটি তৈরী হয়েছিল ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী করিম (সাঃ) এর জন্মেরও কমপক্ষে ১২০ বছর আগে।

পাল রাজাদের শাসন আমলে এমন আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যেমন,'সোমপুর' অর্থাৎ বাংলাদেশের নওগাঁয়, 'বিক্রমশীলা' ভারতের ভাগলপুরে, 'ওদন্তপুরী' ভারতের মগধে ( পাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অঞ্চল নিয়ে মগধ রাজ্য গঠিত ছিল) 'জগদ্দল' বরেন্দ্র অঞ্চলে অর্থাৎ বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নওগাঁ ও ভারতের মালদা নিয়ে গঠিত ছিল। 'তক্ষশীলা' পাকিস্তানে আবস্থিত ছিল যা বর্তমান ইসলামাবাদের ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ও রাওয়ালপিন্ডির কিছু উত্তরপশ্চিমে। প্রাচীন ভারতের অর্থশাস্ত্রের জনক বলে খ্যাত চাণক্য এখানেই লেখা পড়া করেন। এসব বিশ্ববিদ্যালয় একই প্রশাসনের অধীণে ছিল আর শিক্ষকরাও প্রয়োজনে ওসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া করে উন্নত শিক্ষার মান বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। সবই চলতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়।

এবার ফিরে আসি আদিনাথের বিশ্ববিদালয়ের কথায় চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এবং ভারতীয় ইতিহাসবিদ প্রজ্ঞাবর্মণ, গুপ্ত রাজা কুমারগুপ্তকে নালন্দা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করে গেছেন। খনন কার্যে প্রাপ্ত একটি সীলমোহর থেকেও এই দাবীর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। “নালন্দা” শব্দটি এসেছে “নালম” এবং “দা” থেকে। “নালম” শব্দের অর্থ পদ্ম ফুল যা জ্ঞানের প্রতীক রূপে প্রকাশ করা হয়েছে আর “দা” দিয়ে বুঝানো হয়েছে দান করা। তার মানে “নালন্দা” শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “জ্ঞান দানকারী”, প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮শ বছর ধরে জ্ঞান বিতরনের দুরূহ কাজটি করে গেছে নিরলস ভাবে। কেমন ছিল সেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়?

আগেই বলেছি পৃথিবীর প্রথম সারির পুর্নাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা। ইতিহাস বলছে, নালন্দা প্রাথমিক অবস্থায় ছিল একটি মহা বিহার। যেখানে মূলত বৌদ্ধ দর্শনের খুটি নাটি, বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের অনুশাসন বিষয়ে পাঠ দান চলত। তবে তৎকালীন শাসকরা বুঝতে পেরেছিলেন, স্থিতিশীল রাজ্য পরিচালনা, দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে একটি সভ্য, উন্নত ও প্রগতিশীল মনন সম্পন্ন জাতির বিকল্প নেই আর এজন্য শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। সেজন্য বৌদ্ধ ধর্মের পাশা পাশি তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার উপযোগী, সাহিত্য, সংষ্কৃতি ও আন্তর্জাতিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আরো অনেক শাখা যুক্ত করে তারা নালন্দাকে ধর্মের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। জানা যায়, মৌর্য সম্রাট অশোক ৩শ শতকের দিকে এখানে কয়েকটি সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। পরে গুপ্ত সম্রাটরাও কয়েকটি মঠ নির্মাণ করে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি করেন। মূলত কুমার গুপ্তের আমলেই এই মহা বিহারটির পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন ও বাংলার পাল সম্রাট গণ পৃষ্ঠপোষকতা করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যান।

নালন্দাকে তাঁরা গড়ে তুলে ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা হিসাবে। যে কেউ ইচ্ছে করলেই নালন্দায় লেখা পড়ার সুযোগ পেত না। এজন্য প্রয়োজন হত শিক্ষার্থীর যোগ্যতার। শিক্ষার্থী সত্যিই নালন্দায় লেখাপড়া করার যোগ্য কিনা তা প্রমানের জন্য প্রবেশ দ্বারে দিতে হত মৌখিক পরীক্ষা। সাফল্যের সাথে ভর্তি পরীক্ষায় উতরে গেলেই মিলত বিদ্যা লাভের নিশ্চয়তা। বলা হয়, তৎকালীন সময়ে নালন্দায় বিদ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ তাদের শিক্ষাদান করতেন আরো প্রায় ২,০০০ শিক্ষক। গড়ে প্রতি ৫ জন ছাত্রের জন্য ১ জন শিক্ষক ছিল। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির বিশাল খরচ চালাতে বা অর্থনৈতিক সংকট তৈরী হলে যাতে নালন্দার প্রশাসনকে কারো উপর নির্ভরশীল হতে না হয় এজন্য ২শ গ্রামকে শুধুমাত্র নালন্দার ব্যয় মিটানোর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন বিদ্যা উৎসাহী বৌদ্ধ শাসকরা। ঐ গ্রামগুলো শুধু নালন্দার আশে পাশেই ছিল না, ছিল পুরো বিহার রাজ্যের ৩০টি জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গ্রামগুলো চিনতে বিশেষ চৈত্য বা স্তূপ তৈরী করা হয়েছিল যাতে অনান্য গ্রাম থেকে এসব গ্রাম আলাদা করা যায়। ওইসব গ্রামের করের টাকা থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকদের খাদ্য দ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় সব খরচ দেয়া হোত। এছাড়া বাইরের পরিবেশ যেন জ্ঞানার্জনের পথে বাধা না হয় সেজন্য উঁচু লাল ইটের বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা ছিল গোটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। সেখানে ছিল ৮ টি আলাদা আলাদা চত্বর, শ্রেণী কক্ষ, ধ্যান কক্ষ এবং দশটি মন্দির। শিক্ষার প্রাকৃতিক পরিবেশ কোমল রাখতে গোটা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে তৈরী করা হয়েছিল বিচিত্র ফুলের গাছে ভরা উদ্যান। গোসল ও প্রয়োজনীয় পানির সুবিধার জন্য খনন করা হয়েছিল কয়েকটি দীঘি। প্রতিটি ছাত্রাবাসে পানীয় জলের অসুবিধা দূর করতে তৈরী করা হয়েছিল বেশ কিছু কুয়ো। আর পাঠাগারটি ছিল একটি নয়তলা ভবন যেখানে পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হত অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। তৎকালীন জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই চর্চার সুযোগ থাকায় সুদূর কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য এবং তুরস্ক থেকে জ্ঞানী ও জ্ঞান পিপাসুরা এখানে ভীড় করতেন। চীনের ট্যাং রাজবংশের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক জুয়ানঝাং সপ্তম শতাব্দিতে নালন্দার বিস্তারিত বর্ণনা লিখে রেখে গেছেন। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর মতে, এখানে যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাদের জ্ঞানের খ্যাতি প্রসারিত ছিল বহুদূর ব্যাপি, চারিত্রিক দিক দিয়েও তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ চরিত্রের অধিকারী। নির্লোভী এই শিক্ষকরা ভাল করেই অবগত ছিলেন বহুদূর দূরান্তের ছাত্ররা বন্ধুর পথের কষ্ট মাথায় নিয়ে তাঁদের কাছে ছুটে আসতেন বিদ্যা পিপাসায়। তাই তাঁরাও আন্তরিকতার সাথে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন। লাইব্রেরীর প্রতিটি ভবনের উচ্চতা ছিল সুবিশাল প্রায় ৯ তলা বিশিষ্ট দালানের সমান। এত বিশাল ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরী বর্তমান শিক্ষা সংষ্কৃতি ও ছাপাখানা প্রযুক্তির সহজ লভ্য যুগেও সচরাচর দেখা যায় না। প্রায় ৮শ বছর ধরে লাইব্রেরী গুলো ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়েছিল হাজার হাজার পুঁতি, ধর্মীয়, জ্ঞান বিজ্ঞানের বই, চিকিৎসা শাস্ত্র, ও নানারকম গবেষনা লব্ধ মূল্যবান বই দিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লিখিত জ্ঞান বিজ্ঞানের বই গুলো ওখান অনুদিত হত অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান গরিমা আর পান্ডিত্যে যারা সে সময়ে উচ্চ পর্যায়ের ছিলেন তাঁরাই ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নালন্দায় সন্মিলিত হয়েছিলেন জ্ঞান আহরন ও বিতরনের জন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সবাই এখানে সমবেত হওয়ার কারনে, ভিন্নতা ছিল তাদের ভাষায়, ভিন্নতা ছিল তাদের ধর্মে, ভিন্নতা ছিল তাদের সংষ্কৃতিতে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। এই উদ্দেশ্যই তাদের করেছিল বিনয়ী ও একতা বদ্ধ। মুসলিম ধর্মে বলা হয়, জ্ঞানার্জনের জন্য সূদুর চীন যাবার কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়টি একাধিকবার আক্রমনের শিকার হয়। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খৃষ্টাব্দে) মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। হানরা ছিল প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। তখন বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধরেরা পরে পূণর্গঠন করেন। এর প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে নালন্দা এবার নেতৃত্ব দেন বাংলার শাসক শশাঙ্ক। হর্ষবর্ধনের সাথে তার বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাসই এই ধ্বংসযজ্ঞের কারন বলে ধরা হয়। শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার অন্তর্গত গৌড়'র রাজা। তার রাজধানী ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ আর রাজা হর্ষবধন প্রথমদিকে শৈব (শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা মানা) ধর্মের অনুসারী হলেও পরে বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। কথিত আছে, সে সময়ে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহও নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন হর্ষবর্ধন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক ও এর একান্ত অনুরাগী। ওইসময় রাজা শশাঙ্কের সাথে বুদ্ধের অনুরক্ত রাজা হর্ষবর্ধনের যুদ্ধও হয় । রাজা শশাঙ্ক যখন মাগ্ধায় প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোকে ধ্বংস করেন, খণ্ড-বিখণ্ড করেন বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’কে। চৈনিক পরিভ্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬২৩ সালে গুপ্ত রাজাদের শাসনামলয়ে নালন্দা ভ্রমণ করেছিলেন তখন তিনি নালন্দা ধ্বংসের ইতিহাস লিখে গেছেন। হর্ষবর্ধন পরে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযান করেছিলেন এবং বাংলার কিছু অংশ তিনি তার দখলেও নিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় রাজা যিনি চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।

হর্ষবর্ধন মারা যাবার পর ভারতের স্বর্নযুগ শেষ হয়ে শুরু হয় অন্ধকার যুগ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গোটা ভারত চলে যায় ব্রাহ্মণ রাজপূতদের কাছে। শুরু হয় মাৎস ন্যায়।

এবার আসি পরের আক্রমনের কথায়, নবী করিম( সাঃ) মৃত্যুর চার বছর পর খলিফা ওমরের শাসনামলে ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় সীমান্তীয় থানা অঞ্চলটি আক্রমণ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে ভারতে ইসলামের হামলার সূচনা হয়। পরবর্তীতে খলিফা হযরত ওসমান, হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার সময়ে এরূপ আরো আটবার লুণ্ঠন অভিযান চালানো হয়। এসব প্রাথমিক আক্রমণে কখনো কখনো লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ড ছাড়াও লুণ্ঠনদ্রব্য ও ক্রীতদাস সংগ্রহ করা হত, কিন্তু সবগুলো অভিযানই ভারতে ইসলামের স্থায়ী পদাঙ্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়। খলিফা আল-ওয়ালিদের আর্শীবাদপুষ্ট হয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধুতে উবায়দুল্লাহ ও বুদাইলের নেতৃত্বে দুটি অভিযান প্রেরণ করেন। উভয় অভিযানই চরমভাবে ব্যর্থ হয় মৃত্যুর মাশুল দিয়ে, নিহত হয় উভয় সেনাপতি। অন্তরে ক্ষতবিক্ষত হাজ্জাজ এরপর ৬ হাজার সৈন্যের নেতৃত্বে ১৭-বছর-বয়স্ক তারই ভাতিজা ও জামাতা কাসিমকে প্রেরণ করেন। মোহাম্মদ বিন কাসিম ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধুর দেবাল বন্দর জয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইসলামের শক্ত ও স্থায়ী ভিত্তি রচনা করে। বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ আল-বিরাদুরী লিখেছেন: ‘দেবাল আক্রমণ করে সেখানে তিনদিন ধরে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালানো হয়; মন্দিরের যাজকদের সবাইকে হত্যা করা হয় আর নারীদের নিয়ে যাওয়া হয় দাস করে। ওই যুদ্ধে হিন্দুরাজা দাহিরের মৃত্যুর পর তার বউ রাণী লাদীকে বিয়েও করেন কাশিম। সেবার হাজার হাজার নারীকে কৃতদাস করে নিয়ে যান মুসলমানরা। প্রথমবারের মতো সিন্ধও উমাইয়াদ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। আরব মুসলিমরা সিন্ধ দখল করার পর সে অঞ্চলে ইসলামেরও ব্যাপক প্রসার ঘটতে শুরু করে। তবে আরব মুসলিমদের অভিযানের পরও ১০০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিকই ছিল। তবে ১০০০ সালের পর যাযাবর তূর্ক-আফগানদের ভারতবর্ষ আক্রমণের সাথে সাথে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে।
এমনই একজন তূর্ক আফগান সম্রাট হলেন গজনীর মাহমুদ। তিনি ভারতীয়দের বিশাল সেনাবাহিনীর বিপক্ষে ঝটিকা আক্রমণ বেশী চালাতেন। তিনি রাজপূতদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেন যার প্রধান লক্ষ্য ছিল তার নিজের সাম্রাজ্যকে সুরক্ষা করা। তবে তার শাসনামলেও রাজ্যবিস্তারের প্রতি সামান্যই আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়, আর শুধু ধর্মবিস্তারকে উপলক্ষ্য ধরাটা অস্বাভাবিক। অবশ্য পরে গজনীর আরেক শাসক মোহাম্মদ ঘোরী তার রাজ্যের সীমানা বাড়াতে মনস্থ করেন এবং পৃথ্বীরাজের রাজপূত সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেন। এদিকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ব্যাপারে মুসলিমরা অগ্রগামী হওয়া সত্ত্বেও সেসময় ভারতে ধর্মান্তরিত হওয়া প্রায় সকলেই সিন্ধু, যার শাসক ছিল আরব মুসলিম। প্রথম দিকে তুর্ক-আফগানরা ধর্মান্তরিতকরণে কোন ভূমিকা রেখেছেন বলে জানা যায় না। অন্যদিকে তুর্ক-আফগানরা ইসলাম গ্রহণ করলেও নতুন এই ধর্মের ব্যাপারে তাদের বোঝার ক্ষমতা প্রথমদিকে ছিল সীমিত। আরবরা ধর্মীয় কারণে তুলনামূলকভাবে ছিল ন্যায়পরায়ণ, তাছাড়া ব্যবসায়িক যোগাযোগের কারণে এ উপমহাদেশের সংস্কৃতির প্রতি ছিল শ্রদ্ধাশীল ও এক ধরণের সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতো। সেখানে তূর্ক-আফগানরা ছিল তুলনামূলকভাবে ঔদ্ধত ও ধ্বংসাত্নক। সেই ঔদ্ধত ও ধ্বংসাত্নক তুর্কি শাসক মোহাম্মদ ঘোরীর সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি।
১১৯৩ সালে তুর্কির সেই সেনাপতি নালন্দ মহাবিহারটি পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলেন। এই ঘটনাটি ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের সূচক হিসেবে গণ্য করা হয়। পারস্যের ইতিহাসবিদ মিনহাজ তার 'তাবাকাতে নাসিরি' গ্রন্থতে লিখেছেন যে হাজার হাজার বৌদ্ধ পুরোহিতকে ওই সময় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় কিংবা মাথা কেটে ফেলা হয়। খিলজি এভাবে এই অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্মকে উৎপাটন করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। নালন্দার লাইব্রেরীতে বইয়ের পরিমান এত বেশী ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল মূল্যবান বই গুলো পুড়ে ছাই ভষ্ম হতে(জনশ্রুতি আছে ছয় মাস) ওই সময়ই শেষ হয়ে যায় একটি জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য বই যা থেকে আমরা জানতে পারতাম সে যুগের ভারত বর্ষের শিক্ষার অবকাঠামো, তৎকালীন সামাজিক-সাংষ্কৃতিক অবস্থা ও প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে।


এবার আসি মূল গল্পে, এত সুবিশাল একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেছিলেন বাংলাদেশের সন্তান শীল ভদ্র। যিনি ছিলেন হিউয়েন সাঙ এর গুরু। প্রায় ২২ বছর হিউয়েন সাঙ তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চান্দিনাতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। আরো একজন বঙ্গীয় স্বনাম ধন্য পন্ডিত ব্যক্তির কথা উল্লেখ না করে উপায় নেই তিনি হলেন ঢাকার বিক্রমপুরে বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করা অতীশ দীপঙ্কর তারই শৈশবের নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। বর্তমানে অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান “নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা” নামে পরিচিত।

১০৪০ খ্রিস্টাব্দে তিববতের রাজা চ্যাং চুব (চ্যান-চাব) জ্ঞানপ্রভ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিববত ভ্রমনের আমন্ত্রন জানান। অতীশ দীপঙ্কর কয়েকজন বিশিষ্ট পন্ডিতসহ বিহারের পথে তিববত যাত্রা করেন। সেখানে পৌছলে তিববতের রাজা চ্যং চুব এক রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেই রাজকীয় সংবর্ধনার চিত্রটি একটি প্রাচীন মঠের দেয়ালে আজও আঁকা রয়েছে। জীবের প্রতি দয়া নিয়ে অহিংস, পরমত সহিষ্ণু এক ধর্মের সংস্কারের শ্রমসাধ্য কাজ করতে করতে আদিনাথের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। অবশেষে ৭৩ বছর বয়সে তিববতের লাসা নগরের কাছে লেথান পল্লীতে ১০৫৩ সালে ভারতে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠার আগেই মারা যান আদিনাথ। শুনেছি তিব্বতেও বোদ্ধরা ভালো নেই। নিজের গায়ে আগুন দিয়ে মারা যায়। দেশের যা অবস্থা হয়তো আমাদেরও সেই সুযোগ আসবে।

আসল কথায় আসি, এতসব ইতিহাস যারা জানেন তাদের বলা হয় ব্লগার। যারা জানেন, প্রাচীন ভারতের আদি ইতিহাস, একটি সমৃদ্ধ শান্ত জাতির আক্রমনের শিকার হয়ে ধর্মান্তরিত হবার নীপিড়নের ইতিহাস। জানেন, গোলা ভরা ধান, গলা ভরা গান আর পুকুরভরা মাছের গল্প। জানেন, নদীঘেরা পুর্ব বঙ্গের আদি ইতিহাসটাও। দিল্লি যখন মুসলিম শাসনের অধীন চলে যায় তার পরের গল্পটাও জানা ব্লগারদের। পুর্ব বাঙ্গালায় নিযুক্ত নায়েব গন দিল্লির অধীনে থাকার পরও কেন দিল্লির সুলতানদের ট্যাক্স দিতোনা তাও তাদের জানা আছে। বাংলার বারো ভুইয়া, ইশা খাঁ, মুসা খাঁদের কি ছিল অস্ত্র অন্যদিকে দিল্লির তুর্কি মুসলমানরা এতো দুর্ধর্ষ হবার পরও কেনইবা পুতুপুতু হয়ে ছিল তাও জানা আছে ব্লগারদের। তবে এই বঙ্গে ধর্ম কিভাবে আসলো সেই গল্প অন্য একদিন শুনবো শাহ জালাল, শাহ পরান আর খান জাহান আলীদের কাছ থেকে কিংবা লালন সাইয়ের কাছ থেকে।

একই বইয়ের ক্রমানুসারি পাতার মতো ভাজে ভাজে রাখা যায় প্রতিটি ঘটনা ফলে হাল আমলের বোমাবাজি ও হত্যার সাথে ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ কি সুতোয় গাঁথা... কেনইবা এদেশে তুরস্কের মুসলিম ব্রাদারহুড গোপন বৈঠক করে কিংবা হিজবুত তাহরির কিংবা লস্কর-ই তৈয়বা কিংবা আল কায়েদার আনাগোনা শুরু হয় কাদের ইশারায় কিংবা স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত ইসলাম নামের সংগঠনটি টিকে থাকতে পারে তাও পরিস্কার হবে সেদিন... তার আগে আসুন প্রথম ভারতীয় চা পানকারী আদিনাথের মতো এক কাপ চা খেয়ে নিই।
(লেখাটি উইকিপিডিয়া, ইতিহাসের বই ও বিভিন্ন ব্লগের ব্লগারদের লেখা থেকে নেয়া, বানান ভুল মার্জনীয়)

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:৩০
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×