বাবা যখন ছোটো : আদরের মেয়ের জন্যে লেখা বাবার বই।
লেখক : আলেক্সান্দর রাস্কিন
অনুবাদ : ননী ভৌমিক
রঙিন বল
বাবা যখন ছোটোটি , থাকতো পাভলভ-পসাদ নামে এক ছোট্ট শহরে , তখন ভারি সুন্দর, মস্ত একটা বল সে উপহার পেয়েছিলো। ঠিক যেন সূর্যের মতো বলতে। বলতে কি , সূর্যের চেয়েও সুন্দর। কেননা সূর্যের দিকে চোখ না কুচঁকে তো তাকানো যায় না , আর এ বলটাকে চেয়ে দেখতে হলে চোখ কোঁচকাবারও দরকার হতো না। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক চারগুণো সুন্দর সূর্যের চেয়ে – কেননা চার রঙে জ্বলজ্বল করত সেটা। আর সূর্যের তো কেবল একটা রং , তাও সেটা দেখা মুশকিল। একটা দিক লেডিকেনির মতো গোলাপী , আরেকটা দিক সবচেয়ে মিঠে চকলেটের মত খয়েরি , ওপরটা আকাশের মতো নীল , আর তল টা ঘাসের মতো সবুজ।
এমন বল সে শহরে কেউ কখনো দেখে নি। কিনে আনতে হয়েছিল একেবারে খোদ মস্কো থেকে। আর মস্কোতেও এমন বল কম বলেই আমার ধারণা। দেখতে আসত শুধু ছোটোরা নয় , বড়রাও।
‘একটা বলের মতো বল!’ বলতো সবাই।
সত্যি খাসা বল। বাবার বাড়ি গর্ব ছিল তাই নিয়ে। এমন ভাব করে যেন নিজেই সে বলত ভেবে ভেবে বানিয়েছে , চার রঙে রাঙিয়েছে খেলবার জন্যে বলটা নিয়ে গরব ক'রে বেরলেই ছুটে আসত সব ছেলেরা। বলত :
‘বাঃ , কি সুন্দর বল ! আয় না খেলি !’
বাবা কিন্তু বল আঁকড়ে ধরে বোলত:
‘দেবো না ! আমার বল ! এমন বল কারো নেই ! মস্কো থেকে কিনে এনেছে জানিস ! সরে যা! আমার বল কেউ ছুঁবি না বলে দিচ্ছি !’
ছেলেরা বলতো :
‘ইশ, কি হিংসুটে দ্যাখ ভাই !’
তা শুনেও বাবা কিন্তু বলটি আর দিত না। খেলতো একা একা। তবে একা একা কি খেলা জমে। আর হিংসুটে বাবা কিন্তু ইচ্ছে করেই বলতে খেলত ঠিক ছেলেগুলোর কাছাকাছি , যাতে হিংসে হয় ওদের।
ছেলেরা তখন বোলত :
‘ভারি কিপটে ছেলেটা। ওর সঙ্গে আমাদের বাড়ি !’
দু’দিন আড়ি চলল। তিন দিনের দিন ছেলেরা বললে :
‘বলটা তোর মন্দ নয় , তা ঠিক। বেশ বড়ো, খাসা রং করা , কিন্তু এতো চাল দেখাচ্চিস কিসের ? মোটর গাড়ি চাপা পড়লে যে কোনো বাজে বলের মতোই ফেটে যাবে। ’
‘কখখোন ফাটবে না !’ গর্ব করে বলে বাবা, অহংকারে ততদিনে তার মাটিতে আর পা পড়ে না , শুধু বল ই নয় , নিজেও যেন সে চার রঙে রাঙা।
‘ ফট করে ফেটে যাবে রে , ফেটে যাবে !’ হেসে ইঠল ছেলেরা।
‘না ফাটবে না !’
ছেলেরা বললে , ‘ ওই তো মোটর আসছে। কী , ছুড়ে ফ্যাল দেখি ? নাকি ভড়কে গেলি ?’
ছোট্ট বাবা বল ছুড়ে দিলে গাড়ির নিচে। এক মিনিট আড়ষ্ট হয়ে রইল সবাই। সামনের দুই চাকার তল দিয়ে গলে পেছনের ডান চাকার ধাক্কা খেলে বলটা। খানিক কেমন পিছলে গিয়ে বলটা ফেলে এগিয়ে গেল গাড়িটা। কিছুই হল না বলটার।
‘ ফাটে নি , দেখলি তো , ফাটে নি !’ চিৎকার করে বাবা ছুটে গেল বলটার দিকে। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই এমন জোরে শব্দ হল যেন কামানের তোপ পড়লো। বল ফাটার আওয়াজ আর কি। বাবা গিয়ে দেখলে পড়ে আছে ধূলোমাখা রবারের এক ন্যাতা , একেবারে সুন্দর নয় দেখতে। কেঁদে বাড়ি ছুটল বাবা। ছেলেরা একেবারে আকাশ ফাটিয়ে হাসতে লাগল।
‘ ফেটেছে ! ফেটেছে ! যেমন কিপটে, ঠিক হয়েছে তোর !’
বাবা বাড়িতে গিয়ে যখন বললে সে নিজেই অমন সুন্দর বলটা মোটরের তলে ছুঁড়ে দিয়েছিল , তখন প্রথম চড় খেলে ঠাকুমার কাছে। সন্ধ্যায় ঠাকুর্দা কাজ থেকে ফেরার পর আরো একদফা। ঠাকুর্দা বললেন :
‘ বলটার জন্যে মারছি না , মারছি তোর বোকামির জন্য ! ‘
অমন সুন্দর বল, গাড়ির তলে ফেলল কি বলে – এই ভেবে এর পরেও অনেক দিন সবাই অবাক হয়ে যেত।
একেবারে নেহাত আহাম্মুক না হলে কি আর কেউ এমন করে।
সবাই জ্বালাত বাবাকে , জিজ্ঞেস করতো :
‘কি রে , তোর সেই নতুন বলটি কোথায় ?’
হাসাহাসি করে নি কেবল জেঠু। গোড়া থেকে সব ঘটনাটা সে বাবার কাছ থেকে খুঁটিয়ে শুনলে। তারপর বললে ;
‘ না , বোকা তু্ই নোস্!’
শুনে ভারি আনন্দ হচ্ছিল বাবার।
‘ কিন্তু ভারি হিংসুটে তুই , অহংকারী , ‘ বললে জেঠু , ‘ তোর পক্ষে তার ফলতা কখনো ভালো হবে না। নিজের বল নিয়ে যে একা একা খেলতে চাইবে , তার সব ই যাবে। সেটা যেমন ছোটোদের বেলায় . তেমনি বড়োদের বেলাতেও। তোর স্বভাব না বদলালে সারা জীবন ই তোর এই হবে। ’
তখন ভারী ভয় পেয়ে গেল বাবা , ডাক ছেড়ে কাঁদলে , বললে হিংসুটেপনা করবে না সে , জাঁক করবে না। অনেকক্ষন ধরে কাদঁলে বাবা, তাই বাবার কথায় বিশ্বাস করে নতুন বল কিনে দিলে জেঠু। সে বল অবিশ্যি তত সুন্দর নয় , তবে পাড়ার সব ছেলেই সে বল নিয়ে খেলতে খেলা জমত চমৎকার , বাবাকে কেউ আর হিংসুটে ব'লে খোঁচাতো না।
পোষ মানানো
বাবা যখন ছোট , তখন একবার সে যায় সার্কাস দেখতে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব কটি কান্ডকারখানা। তবে সবচেয়ে তার ভালো লাগল বুনো জন্তুর খেলোয়াড়কে। যেমন সুন্দর তার সাজ পোশাক তেমনি সুন্দর তার নাম , বাঘ সিংহ সবাই তার ভয়ে থরহরি। সঙ্গে পিস্তল ছিল তার , হাতে চাবুক , কিন্তু সেগুলো সে প্রায় চালাচ্ছিল না। রঙ্গমঞ্চ থেকে সে ঘোষণা করলে :
‘ জানোয়ারে যে ভয় পায় , সেটা আমার চোখকে ! আমার চাউনি – এই হল আমার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ! বুনো জানোয়ার মানুষের চাউনি সইতে পারে না !’
সত্যি ই , সিংহের দিকে শুধু একবার চাইছে মাত্র , সিংহ ও অমনি টুলে বসছে , লাফিয়ে যাচ্ছে পিপের ওপর , এমন কি মড়ার মতো শুয়ে পড়ছে , চাউনি ওর সইতে পারছে না।
অর্কেষ্ট্রায় ঝংকার উঠলো , লোকে হাততালি দিলে , সবাই চেয়ে রইল খেলোয়াড়ের দিকে :
লোকটা বুকে হাত রেখে চারিদিকে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করলে। একেবারে জমজমাট ব্যাপার ! বাবারও ইচ্ছে হল সে বুনো জন্তু পোষ মানাবে।
ঠিক করলে প্রথমে এমন কোন জন্তুকে চোখ দিয়ে বশ করা যাক , যে ও হিংস্র নয়। বাবা তো তখন ছোট , বাঘ সিংহের মতো বড়ো বড়ো জানোয়ার কে এঁটে ওঠা যে তার সাধ্যের বাইরে সেটা বাবা জানতো। শুরু করা ভালো কুকুর দিয়ে , তাও খুব বড় কুকুর হলে চলবে না। কেননা বড়ো কুকুর মানে তো প্রায় ছোট্ট এক সিংহই। তাই ছোট্ট এক কুকুর হলেই সুবিধা
শিগগির ই তেমন একটা সুযোগ মিলল.
ছোট্ট শহর পাভোলভ – পসাদ , ছোট্ট একটা পার্ক ও ছিল সেখানে। এখন সেখানে অবিশ্যি মস্ত এক সংস্কৃতি ও বিরাম উদ্যান , কিন্তু ঘটনা যে অনেক দিন আগের। আর ছোট্ট বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এই পার্কে একদিন বেড়াতে গেলেন ঠাকুমা। বাবা খেলছে , ঠাকুমা বই পড়ছেন , একটু দূরে সাজসজ্জা ক’রে ব’সে আছেন এক মহিলা , সঙ্গে কুকুর। উনিও বই পড়ছিলেন। কুকুরটা ছোট্ট , সাদা রং , বড়ো বড়ো কালো চোখ , বড়ো বড়ো সেই চোখ দিয়ে যেন ছোট্ট বাবার কাছে মিনতি করছিলো কুকুর টা, ‘ ভারি বশ মানার সখ আমার ! এই ছেলে, বশ মানাও না আমায়। লোকের চাউনি আমি একেবারে সইতে পারি না !’
ছোট্ট বাবাও অমনি গোটা পার্কটা পাড়ি দিলে কুকুরকে বশ করতে। ঠাকুমা বই পড়ছিলেন , কুকুরের গিন্নিও বই পড়ছেন , কেউ সেদিকে নজর করে নি। বেঞ্চের তলে শুয়ে ছিল কুকুরটা , বড়ো বড়ো কালো চোখে হেঁয়ালি নিয়ে চেয়ে ছিল ছোট্ট বাবার দিকে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিলো বাবা ( তখন তো বাবা খুব ই ছোট্ট ) , ভাবছিলো , ‘ নাঃ , আমার চাউনিতে দেখছি কুকুরটার কিছু হচ্ছে না ...সিংহ দিয়ে শুরু করলেই কি তাহলে ভালো হতো ? কুকুরটা দেখছি বেশ মানাবে না ঠিক করেছে। '
ভারি গরম পড়েছিলো সেদিন , বাবার পরনে হাফপ্যান্ট , পায়ে স্যান্ডেল। এগিয়ে আসছে বাবা , আর চুপ ক'রে শুয়েই আছে কুকুরটা। কিন্তু একেবারে কাছে আসতেই হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কুকুরটা কামড়ে দিলে বাবার পেটে। ভয়ানক হৈচৈ বেধে গেল চারিদিকে। বাবা চিৎকার করছে , ঠাকুমা চিৎকার করছেন , কুকুর গিন্নিও চিৎকার জুড়েছেন। আর সেই সঙ্গে প্রচন্ড ঘেউ ঘেউ শুরু করেছে কুকুর ।
বাবা চেঁচাচ্ছে :
‘উহুরে , কুকুরে কামড়েছে আমায়!’
ঠাকুমা চেঁচাচ্ছেন :
‘ওই মাগো , কুকুরে কামড়েছে ওকে !’
আর কুকুরের গিন্নি চ্যাঁচাচ্ছেন :
‘ও কুকুর যে একেবারেই কামড়ায় না ! কুকুরকে জ্বালাতন করছিলো ছেলেটা !’
আর কুকুরটা যে কি করছিল সে তো বুঝতেই পারছো।
যত রাজ্যের লোকজন ছুটে এসে চ্যাঁচাতে লাগল :
‘কি জঘন্য ব্যাপার ! কি জঘন্য ব্যাপার !'
এই সময় পাহারাওয়ালা এসে হাজির হল , জিজ্ঞেস করলে :
‘ কি রে খোকা , কুকুরটাকে খোঁচাচ্ছিলি ?’
‘ না তো,’ বাবা বললে , ‘ আমি ওকে বেশ করছিলাম !’
সবাই হেসে উঠল . পাহারাওয়ালা বললে :
‘ কিন্তু বশ করছিলি কি দিয়ে ?’
বাবা বললে :
‘ একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছিলাম। দেখছি মানুষের চাউনি ও সইতে পারে না। '
ফের হেসে উঠলো সবাই .
মহিলাটি বললেন :
‘দেখলেন তো , ছেলেটার নিজের ই দোষ। কে ওকে বলেছিল আমার কুকুর কে বশ করতে ?'
আর আপনাকে ,’ ঠাকুমার দিকে ফিরে বললেন , ‘ জরিমানা করা দরকার আপনাকে , ছেলেমেয়েদের সামলে রাখতে পারেন না !’
ঠাকুমা এমনিতেই অবাক হয়ে গেলেন যে কিছুই বললেন না , একেবারে থ’মেরে গেলেন।
পাহারাওয়ালা তখন বললেন:
‘দেখছেন তো , নোটিশ ঝুলছে : কুকুর আনা নিষেধ ! যদি নোটিশে থাকতো : ছেলেমেদের আনা নিষেধ ! তাহলে ছেলের মাকেই জরিমানা করতাম।অতএব এবার আপনাকেই জরিমানা দিতে হবে। সরে পড়ুন কুকুরটি নিয়ে। ছেলেরা খেলছে , কুকুর কামড়াচ্ছে। খেলা করা এখানে চলবে , কিন্তু কামড়ানো চলবে না ! তবে খেলতেও হয় বুদ্ধি ক'রে । কেন তুই কুকুরটার দিকে এগুচ্ছিলো সেটা তো আর কুকুরটা জানে না। বলা তো যায় না , তুই হয়ত কামরাতেই আসছিস , কুকুরটা তো আর সেটা জানে না , বুঝেছিস ?’
বাবা বললে :
‘ বুঝেছি। ' জানোয়ার বশ করার কোনো সাধ ই আর তখন তার ছিল না। আর পাছে কিছু আবার একটা হয় এই ভেবেই বাবাকে যে সব ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল তার পরে তো বাবার একেবারেই ও পেশায় ঘেন্না ধরে গিয়েছিল।
আর মানুষের দৃষ্টি সইতে পারে না পারা নিয়ে বাবার তখন একেবারেই অন্য মত। পরে একটা ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বাবার। দুজনের মতের কোনো গরমিল দেখা যায় নি। মস্ত এক বদরাগী কুকুরের চোখের পাতার লোম চেরার চেষ্টা করেছিল সে। কুকুরটা যে ছেলেটার পেটে কামড় দেয় নি , তাতে কিছু এসে যায় না , কেননা সঙ্গে সঙ্গেই সে তার দুই গালেই দাঁত বসায়। ছেলেটার মুখের দিকে চাইলে সেটা দিব্যি বোঝা যায়। তাহলেও ইনজেকশন কিন্তু তার পেটেই দেয়া হয়েছিল।
------------------------------------------------------------------------------------------------------
আটাশটা গল্প নিয়ে ' বাবা যখন ছোটো ' বইটা। ধীরে ধীরে পোস্ট করার ইচ্ছা আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:১০