আব্বাকে গত ০২.১২.২২ তারিখে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দীর্ঘ তিনমাস তিনি হাসপাতালে ছিলেন। ঢাকায় যত দিন ছিলেন ততদিন ইচ্ছা হলেই তাঁর সাথে দেখা করা যেত। এখন তিনি বাড়িতে আছেন।
অনেকদিন তার সাথে কোন বিষয়েই তেমন কোন আলোচনা হয়না।
আর্জেন্টিনা ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ পেলো সেটাও তিনি জানেন না। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। ভগ্ন সোভিয়েত হৃদয় ভ্লাদিমি পুতিন নিয়েও কথা হয় না । ক্রেমলিন শহরে শেষবারের মতো উড্ডীয়মান সোভিয়েত পতাকা নিয়েও কথা হয়না তার সাথে।
শেখ সাহেব , প্রেসিডেন্ট জিয়া কিংবা জেনারেল এরশাদ কাউকে নিয়েই তিনি নেতিবাচক কথা শুনিয়ে যাননি। ভালোটাই বলেছে। খারাপটা নাকি খুঁজে নেয়ার দায়িত্ব আমার। যেকোন নির্বাচনের আগে ডেকে কোনোটো বলেননি অমুককে ভোট দিয়ো। তিনি কাকে ভোট দিতেন কিংবা নির্দিষ্ট কোন দলের সমর্থক সেটাও আজ পর্যন্ত জানলাম না। রাজনৈতিক আলোচনা তাঁর সাথে জমেই নি। এড়িয়ে যান দেখে আমিও আগাইনি।
হাসানুল হক ইনু সাহেব যখন প্রথম মন্ত্রী হলেন। এক কোরবানির ঈদে আমরা কোরবানির মাংস বানাচ্ছি। এমন সময় গাড়ী বহর নিয়ে মন্ত্রী সাহেব হাজির। সেই সাথে মানুষের ঢল। আব্বার সাথে কুশল বিনিময় করে বললেন , "আপনার সাথে দেখা করতে এলাম। আপনিই তো সবার নেতা। বড় নেতা। "
ইনু সাহেব আব্বার ছাত্র ছিলেন না। তিনি রাঙামাটির চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী পেপার মিলস হাইস্কুল এর ছাত্র ছিলেন।
হঠাৎ মনে হলো , নেতা মানেই রাজনৈতিক নেতা নয়। নেতা হচ্ছে আব্বার মত মানুষেরা।
শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিলেও শিক্ষার সাথেই ছিলেন। মনে আছে , ২০১৪ তে তিনি অসুস্থ অবস্থায় কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হার্নিয়া জটিল অবস্থায় চলে গিয়েছিলো। বেডে শুয়ে ঘুমান ,মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে চলে যান। এই স্কুলের খবর নেন , ওই স্কুলের রেজাল্ট ভালো না বলে মাথা ঘামান , কোন ক্লাস ফাঁকা যাচ্ছে বলে শিক্ষক পাঠান। সবই ঘোরের মধ্যে।
আমি জেগে থাকি। জেগে থাকি আর শুনি। আমার মনে হলো দায়িত্ববোধ অবসরে গ্রহণের সাথে থেমে যায় না।
চলতেই থাকে আজীবন।
সেইবার বুকে হালকা ব্যাথার জন্য ঢাকাতে এলেন চেকআপে। ডাক্তারের সিরিয়াল নেন যেই লোক তিনি আব্বার দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলেন। আব্বাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। সালাম দিলেন।
আব্বা বললেন , তুমি কি আমার ছাত্র ?
উনি বললেন, না। ছাত্র না। কিন্তু আপনি আমার শিক্ষক ! প্রথম আলোর আলোকিত দক্ষিণে আপনার ছবি আর আপনার বিষয়ে পড়েছি কয়েকদিন আগে। মনে গেঁথে আছে।
আব্বা ডাক্তারের রুম থেকে বের হলেন। লোকটা আমাকে ডেকে বললেন। স্যারের বুকের কিছু টেস্ট করতে হবে। বুকে ব্যাথা হয়। শিক্ষক মানুষ তো... বুকে অনেক কিছু জমিয়ে রাখেন।
আমি ভাবলাম , সেই 'অনেক কিছুটা' কি ? অভিমান ?
শিক্ষক আন্দোলন চলেছে। আমি তখন কোলে কোলে থাকি। অল্প অল্প হাঁটি। ঢাকাতে প্রভাত ফেরি , আমি আম্মার কোলে। শিক্ষক আন্দোলনে আব্বা আম্মার সাথে আমিও। আমার আব্বা আম্মা দুজনেই শিক্ষক। আমার পাশে যারা আছেন তারাও শিক্ষক, সাদা সাদা মানুষ । সবাই আন্দোলনে এসেছেন।
সেই ভোরের কথা যেন আমার স্পষ্ট মনে আছে। থাকার কি কথা ? নাকি কল্পনায় গেঁথে নিয়েছি ভীষণ আবেগে।
তবে আম্মা বলেন তখন আমি নাকি ফিডার খেতাম। এতো কম বয়সে কজন আন্দোলন করেছে আমার জানা নেই। যদিও সেই আন্দোলন সফল হয়নি।
বড় হয়ে আব্বাকে বলেছিলাম , তোমার যে সুযোগ সুবিধা , বেতনাদি বিষয়কে যে আন্দোলন করলে সেটা কি সফল হয়েছিল ?
তিনি হ্যা -না কিছুই বললেন না। শুধু বললেন , আমরা আন্দোলন করেছিলাম অধিকার আদায়ে। আমরা পাইনি কিন্তু পরবর্তীরা নিশ্চয় পাবে।
আমি আর কথা বাড়াইনি। মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে এভাবেই বলেন , না মেডেল না সার্টিফিকেট না সম্মাননা। শুধু ভালো থাকতে চাওয়া। ভালো থাকতে চাওয়াটাই সম্ভবত 'অধিকার'।
না , আব্বার সাথে আর কোন আলোচনাই করা হয় না। না শিক্ষক না কৃষক না সোভিয়েতের ভাঙ্গন না বার্লিনের দেয়াল। কোন কিছুই না।
উপসাগরীয় যুদ্ধটা বিবিসি বাংলা রেডিও শুনতে শুনতে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যেতাম । সেই বিবিসি বাংলা রেডিও চিরতরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেটাও তিনি জানেন না। ৮০ বছররের এই রেডিও নিশ্চয় অনেক স্মৃতি জমা করে রেখেছে। না , কোন কিছু নিয়েও কোন আলোচনা নেই বহুদিন।
রেডিওতে নাটক শুনতে শুনতে আব্বা পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন। বিড়বিড় দিতেন। আমি ঘুমিয়ে যেতাম। আমার প্রতিদিনকার রুটিন। আব্বা সকাল হলেই স্কুলে চলে যাবেন। তারপর অপেক্ষা। আব্বার ফিরে আসার অপেক্ষা। বিকেলের আলো কমতেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা। তাই রাতের সেই ঘুমানোর সময়টা ছিল ভয়ঙ্কর রকমের অনুভূতিশীল।
ইদানিং আমার ছেলে বলে , বাবা পিঠে বিলিবিলি দিয়ে দাও আমি ঘুমাবো।
আমি ছেলের পিঠে বিড়বিড় দিতে দিতে ভাবি ,
“When you teach your son, you teach your grandson.”
আব্বা যেটা শিখিয়েছেন সেটাই তো আমার ছেলে শিখবে।
গতকাল খবর পেলাম আব্বা আবার স্ট্রোক করেছেন। অনেককেই চিনতে পারছেন না। আব্বার এক প্রিয় ছাত্র দেখা করতে গিয়েছিলো। তাকে চিনতে পারেননি।
"স্যার , আপনার ক্লাসে ইংরেজিতে কথা বলিনি বলে আমার হাতে মেরেছিলেন। এবার চিনেছেন স্যার ?"
আব্বা কিছু বলেন নি। তাকিয়ে থাকেন শুধু।
বাড়ি যাবো , আব্বা কি আমাকে চিনতে পারবেন ? হয়তো পারবেন না।
তিনি শুয়ে শুয়ে ভাবেন। কি ভাবেন জানি না। উনার ভাবনায় কি কোন ভোরের ট্রেন থাকে ? হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলা এক ট্রেন! যেই ছুটন্ত ট্রেন ধরে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ভেড়ামারা থেকে সুদূর তেঁতুলিয়ায়। মাত্র ২১ বছর বয়েসে - হেডস্যার হিসেবে ! হেডস্যার তিনি তখনো ছিলেন। আজীবন থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:৫৩