সময়ের সাথে সাথে কত কিছুই তো হারিয়ে যাচ্ছে - কে আর তার খবর রাখছে এসব বিলুপ্তপ্রায় ধ্বংসাবশেষের ! দ্রুত এগিয়ে চলা আধুনিক জীবনের চাহিদা মেটাতে যৌথ পরিবার ভেংগে একক পরিবার হচ্ছে, যত্র-তত্র ইচ্ছেমত নির্মিত হচ্ছে ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা, অফিস-আদালত; চলছে ভূমির খন্ড-বিখন্ডতা । আর এভাবেই এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম এসে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে পূর্বের সব নির্মাণ, স্মৃতিচিহ্ন, ইতিহাস ।
খুব ছোটবেলা থেকে দেখে আসছিলাম প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমির উপর পুরানো আমলের মোটা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই আড়ৎবাড়িটি; যা প্রথম থেকেই আড়ৎবাড়ি নামেই পরিচিত ছিল । ভেতরে তখন চার/পাঁচটি পরিবার বাস করত । বাড়িগুলোও গ্রামের অন্যান্য সাধারন বাড়ির মতই ছিল । কারণ, নামে আড়ৎবাড়ি হলেও বৃটিশ আমলে নির্মিত চারদিকের মোটা প্রাচীর আর কয়েকটি গেট ছাড়া তখন কিছুই অবশিষ্ট ছিল না । তার মানে ইংরেজ আমলের শেষ পর্যায়ে আড়ৎবাড়িটি তৃতীয় মালিকানায় হাত বদলের পর ভেতরের সব ঘর ভেংগে গ্রামের অন্য সাধারন মুসলমানের বাড়ির মত করে তৈরী করা হয়েছিল ।
আজ ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে দেখা যাচ্ছে প্রায় দু'শ ত্রিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৭০০ সালের প্রথম দিকে নির্মিত এই আড়ৎবাড়িটির অবশিষ্ট অংশ বলতে আছে মাত্র বার/চৌদ্দ ফুট মত প্রাচীর । যুগের পরিক্রমায় বাকী সবকিছু গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । কে জানে, কয়েক বছর পর হয়ত প্রাচীরের এই অংশটুকুও আর থাকবে না । এ প্রজন্মের কেউ জানবে না, এখানে ইংরেজ আমলে নির্মিত একটি আড়ৎবাড়ি ছিল !
যাইহোক, আড়ৎবাড়িটির ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তা হলো ইংরেজ আমলে একজন বণিক আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাড়িটি নির্মাণ করেন । পরবর্তি কালে ভূপতি নামের অন্য আরেকজন বণিকের কাছে বাড়িটি বিক্রি করে দেন । ভূপতির বাণিজ্য ছিল কোলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত । কোলকাতা থেকে মাথাভাঙ্গা নদী দিয়ে নৌকাযোগে বিভিন্ন ধরণের খাদ্যপণ্য নিয়ে এসে এই বাড়িতে মজুত করে রাখতেন এবং এলাকার কৃষকেরা ফসল উঠার আগে যখন খুব অভাবগ্রস্থ্য হয়ে পড়ত, তখন তিনি তাদের মাঝে ডাবল লাভে খাদ্যপণ্য বিতরণ করতেন; অর্থাৎ কেউ যদি আধামণ ধান কিংবা গম নিত, ফসল উঠার পর তাকে একমণ করে দিতে হত ।
কৃষকের দুঃসময়ে তাদেরকে এভাবে খাদ্যপণ্য দিয়ে সাহায্য করা হলেও এটা অনেকটা শোষণের মতই ছিল । কারণ, এক মণের জায়গায় কোন কৃষক ফসল উঠার পর যখন দু'মণ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করত, তখন আর ঐ কৃষক কোন দিনই স্বাবলম্বী হতে পারত না । তাই, কৃষকদের দুঃসময়ে সাহায্যের নামে এই শোষণ চলত বছরের পর বছর ধরে ।
এ ছাড়া এলাকায় ফসল উঠার পর ভূপতি তার লোকজনের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে এসব ফসল অভাবি কৃষকের কাছ থেকে কিনে নিত এবং তা মজুত করে রাখত । জানা যায় এর একটা অংশ সে কোলকাতায়ও নিয়ে যেত । এভাবেই চলছিল ভূপতির দীর্ঘ বছরের ব্যবসা । যাকে আধুনিক ভাষায় মজুতদারি বলা হলেও তৎকালীন সময়ে এটাকে আড়ৎদারি বলা হত । আর এ কারণেই সম্ভবতঃ এই বাড়িটির নাম আড়ৎবাড়ি হয়ে থাকতে পারে ।
শেষ পর্যন্ত যে কারণেই হোক, ১৯২০ সালের পর কোন এক সময় ভূপতি তার বাড়িটি স্থানীয় ইজদ্দি নামের এক ব্যাক্তির কাছে বিক্রি করে দেয় । পরবর্তি কালে ইজদ্দি বাড়িটির চারদিকের মূল প্রাচীর ও চার/পাঁচটি গেট রেখে ভেতরের ঘরগুলো ভেংগে ফ্যালে এবং তার মত করে বাড়ি নির্মাণ করে । তবে আগের ঘরগুলো ভেংগে ফেললেও ভূপতির ব্যবহার্য কিছু জিনিস এখনো রয়ে গেছে; যা সেই যুগকে স্মরণ করিয়ে দেয় । এরকমই কয়েকটি পাথরের তৈরী থালা, গ্লাস ও পানদানি দেখতে পেয়েছি মরহুম জসিম উদ্দীনের বাড়িতে গিয়ে এবং সেগুলোর ছবিও নিতে সক্ষম হয়েছি ।
ইজদ্দির ছেলের নাম ছিল মেজু । পরবর্তিকালে উত্তরাধিকার সূত্রে আড়ৎবাড়িটি মেজু পায় । মেজু ও আরো বেশ কয়েটি পরিবার এই আড়ৎবাড়ির ভেতর বসবাস করত । সেই মেজুও মারা গেছে অনেক বছর আগে । এখন প্রায় বার/চৌদ্দটি পরিবার বাস করে এই আড়ৎবাড়ির ভেতর । কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী আড়ৎবাড়ির সেই আমলের চুন-শুরকি দিয়ে গাঁথা মোটা প্রাচীরের শেষ চিহ্নটুকুও । এরপর হয়ত আর কেউ জানবে না, এখানে আড়ৎবাড়ি নামের একটি বাড়ি ছিল ।
দক্ষিণ দিক থেকে আড়ৎবাড়িটি নাটনাপাড়া নামক একটি ছোট্র গ্রামের শুরুতেই অবস্থিত । এর পশ্চিমে এখনো বয়ে চলেছে ক্ষীণ ধারায় মাথাভাঙ্গা নদী । আর নাটনাপাড়া গ্রামটি দৌলতপুর উপজেলার কুষ্টিয়া জেলায় অবস্থিত ।
দৌলতপুর, কুষ্টিয়া
তারিখঃ ২৬.০৮.২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:২২