"দীনের মাজারে কেউ জ্বালাবে না দীপ
ভালোবেসে কেউ বুকে রাখবে না ফুল,
পতঙ্গ আসবে না পোড়াতে নিজেকে,
কলতানে মেতে উঠবে না বুলবুল।"
মুঘল রাজপরিবারের বহু মহিলাই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গিয়েছেন। কিন্তু যে কয়েকজন নিজের স্বাধীন পরিচয় গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, তাঁদের একজন হলেন শাহজাদী জেব-উন-নিসা বা জেবুন্নেসা (১৬৩৮-১৭০২ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন বাদশাহ আওরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা। চিরাচরিত ইতিহাসে জেব-উন-নিসাকে নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তাঁর সম্পর্কে সর্বজনবিদিত তথ্যটি হল, জীবনের শেষ ২০ বছর কাটিয়েছিলেন দিল্লির লালদুর্গের অন্তর্ভুক্ত সেলিমগড় প্রাসাদে, নিজের পিতার বন্দি হিসেবে।
ছোটবেলা থেকেই নিজের অনন্য মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন শাহজাদী জেব-উন-নিসা। মাত্র তিন বছরে সমগ্র কুরআন মুখস্ত করে সাত বছর বয়সেই তিনি কুরআনের হাফিজা-য় পরিণত হয়েছিলেন। সেই আনন্দে বাদশাহ আওরঙ্গজেব সমগ্র সাম্রাজ্যে দুই দিনের ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি তাঁর কন্যার শিক্ষিকাকে ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার হিসেবে দান করেছিলেন। ছোট্ট জেব-উন-নিসাও তিনি ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন।
শৈশব থেকেই বিদ্যানুরাগী জেব-উন-নিসা বড় হয়ে অনেক বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তিনি কবিতা লিখতে পছন্দ করতেন, মাখফি (অর্থ, যে লুকিয়ে রয়েছে) ছদ্মনামে তিনি বহু কবিতা লিখেছিলেন। জেব-উন-নিসার বিভিন্ন লেখনীতে তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাবের স্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বেশকিছু লেখা সংগ্রহ করে একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছিল, যার নাম দিওয়ান-ই-মাখফি। এই বইতে প্রকাশিত ৪২১টি গজলই জেব-উন-নিসার লেখা।
জানা যায়, মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই বহু ফার্সি কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন জেব-উন-নিসা। তাঁর শিক্ষক-শিক্ষিকারাও কবিতার প্রতি শাহজাদীর আগ্রহ দেখে তাঁকে আরও উৎসাহ দিতেন। শুধু কবিতাই নয়, দর্শন, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যাতেও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। বিভিন্ন ভাষাশিক্ষায় আগ্রহী জেব-উন-নিসা দক্ষ ছিলেন ফার্সি, আরবি এবং ঊর্দুতে। নিজের পিতার মতো তিনিও দক্ষ ছিলেন ক্যালিগ্রাফি-তে।
অসামান্য কবি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বাদশাহ আলমগীর কন্যা জেব-উন-নিসা। তাঁর লেখা কবিতা গভীর অর্থ ও তাৎপর্য সমকালীন অন্যান্য কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ছিল সমুজ্জ্বল।
জেব-উন-নিসা কবিতাচর্চায় সময় ব্যয় করায় তার পিতা আওরঙ্গজেব আলমগীর একজন দায়িত্বশীল সম্রাট হিসেবে আশা করতেন যে, তার মেয়ে কবিতা লেখার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ দিক।
তিনি তার মেয়ের কবি-প্রতিভা পরীক্ষা করার জন্য দরবারের ফার্সি কবিদের নির্দেশ দেন। যদি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাকে আর কবিতা লিখতে দেওয়া হবে না।
কবিরা স্পষ্টতই বুঝতে পারছিলেন যে, জেব-উন-নিসাকে পরীক্ষায় তাদের হারাতে হবে। তারা তাকে একটি অসম্পূর্ণ بيت (কবিতা) দিয়ে একটি সম্পূর্ণ بيت (কবিতা) তৈরি করার জন্য নির্দিষ্ট সময় দেন:
"دُر ابلق کسے کم دیده موجود"
“দুররে আবলাক কাসে কমদিদা মওজুদ”
অর্থাৎ- "শ্বেতশুভ্র আর ঘোর কৃষ্ণবর্ণের সমষ্টি বর্ণিল মুক্তোর প্রত্যক্ষদর্শী বিরল"
(অনুবাদ: লেখক)
জেব-উন-নিসা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে بيت (কবিতা)টি সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
তিনি তার বিশ্বস্ত ও স্নেহময়ী দাসীকে তার জামাকাপড় এবং ভ্রমণের সরঞ্জামাদি গুছিয়ে তৈরী হওয়ার নির্দেশ দেন। কারণ, তিনি ভেঙে পড়েছিলেন এবং তিনি তার পিতা, দরবার ও দেশ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন।
তার বিশ্বস্ত দাসী জামাকাপড় গোছানোর সময় নীরবে কাঁদছিল। কান্নার সময় তার চোখের অশ্রু কাজলের (সুরমা) সাথে মিশে তার মুখে গড়িয়ে পড়ছিল আর তা অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল।
জেব-উন-নিসা তার দাসীর চোখের অশ্রু দেখে বলে ওঠেন, "থামো। আমি লিখছি, যা আমার লেখা উচিত ছিল:
"مگر اشک بتانِ سرمه آلود"
"মাগার আশকে বুতানে সুরমা আলুদ ৷"
অর্থাৎ- "তবে কাজলকালো চোখের সুরমামিশ্রিত অশ্রুবিন্দু এ মুক্তোর সার্থক উদাহরণ"
(অনুবাদ: লেখক)
এভাবে জেব-উন-নিসা তার দ্রুত বুদ্ধি ও কবিতা প্রতিভা দিয়ে তার পিতা ও দরবারের সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন।
যদিও এ কাহিনির বিপরীতে আরেকটি কাহিনি প্রচলিত আছে। সেটি এমন:
কথিত আছে যে, একবার পারস্যের বাদশাহ স্বপ্নের মধ্যে একটি কবিতার ছত্র মুখস্ত করেন!
"دُر ابلق کسے کم دیده موجود"
"দুররে আবলাক কাসে কমদিদা মওজুদ"
বাদশাহ এই লাইনটির সাথে মিলিয়ে আরেকটি লাইন লেখার জন্য তখনকার সময়ে সে দেশের বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের তার দরবারে আহবান জানালেন। সবাই এলেন কিন্তু বাদশার মনঃপূত হয় এমন কোনো ছত্র বা লাইন কেউই বাদশাহর সামনে পেশ করতে পারলেন না। অবশেষে স্বপ্নে পাওয়া সেই কবিতার ছত্রটি বাহক মারফত দিল্লীর মোগল রাজদরবারে প্ররণ করলেন পারস্যের বাদশাহ। দিল্লীর দরবারের সভাকবিরাও জুতসই কোনোকিছু লিখতে পারলেন না। অবশেষে এটি পাঠানো হলো অন্তঃপুরে সম্রাটকন্যা বিদূষী জেব-উন-নিসার কাছে। জেব-উন-নিসা এক নিমিষেই সেই কবিতার ছত্রের সাথে মিলিয়ে আরেকটি ছত্র লিখে দেন:
"مگر اشک بتانِ سرمه آلود"
"মাগার আশকে বুতানে সুরমা আলুদ”
সম্রাট কন্যা জেব-উন-নিসার লেখা এই ছত্রটি রাজদরবারের সব জ্ঞানী-গুণী, কবি-সাহিত্যিকদের বিমোহিত করে। সবাই জেব-উন-নিসার অসামান্য প্রতিভার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। পারস্যের বাদশাহর কাছে এটি পৌঁছুলে তিনি জেব-উন-নিসার কবি প্রতিভায় বিমুগ্ধ হন। পারস্যের সেই বাদশাহর সঠিক নাম জানা যায় না। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে তার নাম আল-ফারুক।
এরপর জেব-উন-নিসার গুণমুগ্ধ ও প্রণয়াকাঙ্ক্ষী পারস্যের বাদশাহ নিজের লেখা কবিতার মাধ্যমে জেব-উন-নিসাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিল্লীর দরবারে দূত প্রেরণ করেন:
"ترا اے مهجبیں بے پرده دیدن آرزو دارم"
"তুরা অ্যায় মেহজাবীঁ বে-পরদা দিদান আরজু দারাম"
অর্থাৎ- "হে অসামান্য সৌন্দর্যের অধিকারিণী, আমি পর্দার বাইরে আপনার দর্শন প্রত্যাশী।"
জবাবে জেব-উন-নিসা লিখেন:
"بوی گلدار برگ گل پوشیده ام در سـخــن بـیـنـد مـُـرا"
"বুয়ে গুলদার বারগে গুল পুশিদা আম দর সখুন বীনদ মুরা"
অর্থাৎ- "পুস্পের ঘ্রাণের মতো আমিও পুস্পেই লুকিয়ে আছি; আমাকে যে দেখতে চায় সে যেন আমার লেখাতেই আমাকে দেখে।"
নিজের জ্যেষ্ঠ কন্যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন আলমগীর। কোমল মনের অধিকারী জেব-উন-নিসা ছিলেন অত্যন্ত দরদী। কারও আচরণে বা কাজে ক্ষুব্ধ বাদশাহ কড়া শাস্তির নিদান দিলেও বহুক্ষেত্রে প্রিয় কন্যার অনুনয় রক্ষা করতে সেই সাজা মওকুফ করেছিলেন। গাছের প্রতিও গভীর ভালোবাসা ছিল জেব-উন-নিসার। লালকেল্লা সংলগ্ন বিশাল বাগানে বহু গাছ নিজের হাতে রোপণ করেছিলেন তিনি। পরে যখন লাহোরে থাকতে শুরু করেন, তখনও নিজের প্রাসাদের সামনে বাগান তৈরি করেছিলেন তিনি। বাস্তবের রূঢ় আঘাত থেকে বাঁচতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই বাগানেই প্রিয় গাছেদের সাথে সময় কাটাতেন শাহজাদী।
কথিত আছে লাহোরের গভর্নর আকিল খান তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। লোকে রটনা রটিয়েছিল যে, শাহজাদী গভর্নরের প্রেমে পড়েছেন। আরও কিছু রাজনৈতিক কারণে ১৬৮১ সালে দিল্লিতে নিয়ে এসে বন্দি করে রাখা হয়েছিল শাহজাদীকে।
চিরকুমারী এই নারীকে জীবনের শেষ ২০ বছর কারাগারে বন্দি অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল। একাকীত্বের সেই দুঃসহ দিনগুলিতে তিনি লিখেছিলেন অনেকগুলো কবিতা। তার মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি পঙ্ক্তি:
"برمزارِ ما غریباں ، نے چراغے نے گُلے"
"نے پرِ پروانہ سوزد ، نے صدائے بلبلے"
"বর মাযার-এ মা গরীবাঁ নে চেরাগে নে গুলে"
"নে পর-এ পরওয়ানাহ সুযদ, নে সদায়ে-বুলবুলে"
"দীনের মাজারে কেউ জ্বালাবে না দীপ
ভালোবেসে কেউ বুকে রাখবে না ফুল,
পতঙ্গ আসবে না পোড়াতে নিজেকে,
কলতানে মেতে উঠবে না বুলবুল।"
(কাব্যানুবাদ: লেখক)
আপনজনদের দেওয়া আঘাতে আহত নির্জন কারাবাসের সময় জেব-উন-নিসা বুঝতে পেরেছিলেন এই পৃথিবীতে তাঁর আপন বলতে কেউ নেই। এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর কেউ তাঁর সমাধিতে বাতি জ্বালাতে আসবে না, আসবে না ফুল দিতেও। আর এ কথা ভেবেই তিনি লিখেছিলেন এমন হৃদয়ভারাক্রান্ত পঙ্ক্তি।
তাঁর পঙ্ক্তিগুলোর ভেতর লুকিয়ে রয়েছে একবুক হাহাকার, ব্যথা আর আক্ষেপ। এই ব্যথা আর আক্ষেপ নিয়েই ৬৫ বছর বয়সে নিরবে-নিভৃতে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি। তারপর পাকিস্তানের লাহোরে চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে আরও অনেক বিভ্রান্তিমূলক কাহিনি প্রচলিত আছে। সেগুলোর সত্যতা সম্পর্কে কেউ অথেনটিক সোর্স দিতে পারেননি।
ছবি ও তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন আর্টিকেল, লেখক কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত।
ফার্সি পঙ্ক্তিগুলো লেখক কর্তৃক অনূদিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪৪