জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই বাবা মা বুঝতে পারলেন তাদের বাচ্চাটির মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা রয়েছে। আর দশটা বাচ্চার মতন সে নয়। চিকিৎসকও জানালেন বাচ্চাটির সমস্যার বিষয়ে। বাচ্চাটি জন্ম নিয়েছে কিছুটা অস্বাভাবিকতা নিয়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে অটিজম বলে।
অটিজম একটি মস্তিষ্কের ব্যাধি। শারীরিক সঠিক বিকাশে সমস্যা হয় যা স্নায়ু বা স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও পরিবর্ধন জনিত অস্বাভাবিকতার ফলে হয়। যোগাযোগের ক্ষমতা, নিজেকে প্রকাশ করতে তাদের অসুবিধা হয়। যোগাযোগের বিষয়টা অটিজম আক্রান্তরা বুঝতে পারে না। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে অসুবিধা হয়। অটিজমের কারণে কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। আবার অনেকক্ষেত্রে শিশুর মানসিক ও ভাষার উপর দক্ষতা কম থাকে।
একজন স্বাভাবিক মানুষের ভাবনার সংকেতগুলো মস্তিস্ক যে ভাবে পাঠায়। অটিজম আক্রান্ত মানুষটি, মস্তিস্কে সে ভাবে সংকেত পাঠাতে পারে না। তাদের সংকেতটি একটা জায়গায় আটকে যায় এবং ফিরে আসে। চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। প্রকাশটা সঠিক ভাবে করতে পারে না।
এজন্য দেখা যায়। অটিজমরা, একই কথা বারবার বলছে। বা একই কাজ বারবার করছে। এবং তারা অনেক বেশি অস্থির হয়ে উঠে সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে না পেরে। পুনরাবৃত্তি আচরণ করতে থাকে। সাধারণত অটিজম ব্যক্তির যোগাযোগ, অন্যদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং সঠিক ভাবে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। যোগাযোগের ক্ষমতাকে মূলত প্রভাবিত করে, নিজের প্রয়োজনগুলি প্রকাশ করার জন্য ভাষা ব্যবহার করার অক্ষমতা । এছাড়া শারীরিক বিকাশেও প্রভাব রাখে।
প্রত্যেক, অটিজম ব্যাক্তির, নিজের মতন সমস্যা থাকে। একই রকম সমস্যা সবার হবে এমন ভাবার কোন কারণ নাই। সাধারণত তিন বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে লক্ষণ গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্ভবত জেনেটিক এবং পরিবেশ উভয়ই ভূমিকা রাখে আর্টিজম হওয়ার জন্য।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার নামে পরিচিত। এসপেরাগার সিন্ড্রোম, রেট্ সিন্ড্রোম, ডাউনসিন্ড্রম এমন কয়েকটি ভাগ করা হয়েছে বিশেষ লক্ষণ দেখে। কিন্তু সর্বপরি তাদের সমস্যা তারা সংযোগ করতে পারে না।
উন্নতদেশগুলোতে শিশু বয়স থেকে এই বাচ্চাদের প্রবল অনুভুতি সম্পন্ন ত্বক, সংবেদনশীল, স্পর্ষকাতর শারীরিক অবস্থা এবং মানসিক শক্তি যোগানোর দিকে শুরু থেকেই নানা রকম চিকিৎসা নেয়া হয়। মস্তিস্কের সঠিক ব্যবহার না করতে পারার জন্য তাদের শারীরিক গঠনেও প্রভাব পরে। অনেকে হাঁটতে পারে না। খেতে পারে না। শিশু বয়স থেকে সঠিক সাহায্য ব্যয়াম ইত্যাদি করিয়ে স্পর্শকাতর ভাব কমিয়ে আনা হয়। এবং মস্তিস্ক ব্যবহারে অভ্যস্থ করা হয়। এটা অবশ্যই দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু শুরু থেকে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। অনেকটা সঠিক ভাবে ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে উঠে অভ্যাসের দ্বারা। অনুউন্নত, উন্নয়নশীল দেশে বাচ্চাটি যে অটিজম আক্রান্ত, সঠিক ভাবে বুঝতে পারে না অনেকেই। এই বিষয়ে অভিভাবকও বুঝতে পারে না। বরং সঠিক ভাবে চলতে ফিরতে ব্যবহার করতে না পারার জন্, তাকে বিশেষ যত্ন চিকিৎসা না দিয়ে অবহেলা এবং অত্যাচারও করা হয়।
একটু বিকৃত আকৃতির চেহারা, শারীরিক বৈশিষ্ট দেখলে মানুষ তাকে অপদস্থ, বুলি করতেই পছন্দ করে। সে মানুষটির অপরাগতাকে বুঝতে পারে না।
এখন মানুষের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা আসছে। তবু সঠিক শিক্ষা চিকিৎসা যত্ন সবাই পাচ্ছে না।
কিছুদিন আগে একটা ডকুমেন্টারিতে দেখেছিলাম। বাংলাদেশের একজন মহিলা যখন বুঝতে পারলেন তার তিন বছরের বাচ্চাটি নর্মাল না, আটিজম আক্রান্ত। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন। বাচ্চার জন্যই বিদেশে যেতে হবে। নিজের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা না করে তিনি আমেরিকায় পড়ালেখার জন্য আসার এ্যাপ্লাই করেন। সৌভাগ্য বসত আসতে পারেন।
আমেরিকা আসাটা উনার নিজের পড়ালেখার চেয়েও অনেক বেশি সহায়ক হয় উনার বাচ্চার জন্য। যে বাচ্চাটি উঠে দাঁড়াতে পারত না তিন বছর পর্যন্ত । আমেরিকায় আসার পর তার যথেষ্ট উন্নতি হয়, শারিরীক এবং মানসিক ভাবে। ফিজিও, ব্যায়াম, মানসিক শক্তির নানা রকম অনুশীলনের মাধ্যমে। বাচ্চাটি কথা বলতে পারে না কিন্তু সে আগের মতন অস্থির এবং রাগী না। অনেক মনের ভাব সে প্রকাশ করতে পারে। এমন কি লিখেও। আর্টিজম বাচ্চাদের কোন বিশেষ কিছু করার প্রতি ঝোঁক থাকে। এই বাচ্চাটির ঝোক বাজনায়। সে এখন পিয়ানো শিখছে। এবং এই বাজনার মাঝে খুঁজে পাচ্ছে সে নিজের বহি প্রকাশ, শান্তি।
বাচ্চাটি একদিন ম্যানহাটনের ভীড়ের মধ্যে মায়ের হাত ছেড়ে হারিয়ে গিয়েছিল। মা অস্থির হয়ে খুঁজে এক সময় শুনতে পান কোথাও বাজনা বাজছে। এবং সেই বাজনার জায়গায় গিয়ে দেখেন বাচ্চাটি দলের মাঝখানে ঢুকে নাচছে বাজনার সাথে। মায়ের এই উলব্ধির পর মা ওকে নিয়ে যান একটি মিউজিক ইন্সট্রুমেন্টের দোকানে এবং নিজের পছন্দে সে একটি পিয়ানো দেখে সেখানে বাজাতে বসে যায়। মা তাকে সেই পিয়ানটি কিনে দেন।
এই মহিলার বাচ্চাটি যখন ছোট তখন আর কেউ কিছু বলার আগে বাড়ির কাজের মহিলাটি বলে ছিল। আপনার বাচ্চাটা স্বাভাবিক না।
উনি বিদেশে আসার আগে, কাজের মহিলাটি উনাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখায় ওর একটি ভাই আছে। আঠার উনিশ বছরের ছেলেটিকে, সারা জীবন একটি ঘরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। ঐ ঘরে ওকে খেতে দেয়া হয়। ছেলেটি বেশির ভাগ সময় চুপচাপ থাকে। ছোট একটা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু মাঝে মাঝে খুব রেগে যায়। তখন ঘরের দেয়ালে, দরজায় মাথা ঠুকে। ওকে থামাতে ওরা তখন ওকে অনেক মারে।
গত বছর থেকে ফলো করছিলাম, কানাডার আটিজম অস্টিন, রিলির জীবনের বেড়ে উঠা। অস্টিন রিলি অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার লক্ষণ ধরা পড়েছিল, শিশু বয়সে।
অস্টিন রিলে গাড়ি পছন্দ করত। গাড়ির গতির মধ্যে থাকলে সে ভালো অনুভব করত। যত গতি তত আনন্দ। গাড়ি দ্রুত বেগে চালাতে তার কোন অসুবিধা হয় না। বরং এই সময়ই সে যেন সব চেয়ে স্বাভাবিক এবং ভালো থাকে।
গাড়ির সবগুলো লাইসেন্স নেয়। এবং লাইসেন্স নিয়েই শুধু ক্ষ্যান্ত নয় সে রেসিং কার চালায়, বারো বছর বয়স থেকে। সে ২০০৭ সাল থেকে মাইক্রো অ্যান্টিঅক্সি অটিজম কার রেসিং শুরু করে।
অনেকগুলো রেসিংয়ে পুরস্কার পেয়েছে অস্টিন রিলি। টরন্টো থেকে উইনিপেগ পর্যন্ত গাড়ির রেস করছিল অস্টিন রিলি। রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। তার সে অসহায় এবং অস্থিরতার মুখ দেখেছিলাম।
গত বছর আঠারো সালে আঠার বছর বয়সী অস্টিন রিলি, অ্যান্টিঅক্সির প্রথম ব্যক্তি যে রেসিং লাইসেন্স পেয়ে কানাডার পেশাদার মোটর স্পোর্ট সিরিজের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পায়।
বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করা, সেই উত্তেজনায় সে ভালো থাকে। বাবা জেসন রিলি, ছেলের গাড়ির প্রতি ঝোঁক দেখে অনেকটা নিজের দায়িত্বে ছেলেকে গাড়ি চালানো শিখতে দেন। এবং আবিস্কার করেন। গতির ভিতরই অস্টিন ভালো থাকে বেশি।
পিতা জেসন রিলির নির্দেশনায়, অস্টিন কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকটি প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার অর্জন করেছে। জেসন রিলে, অস্টিজমের রেসিং উইথ অটিজম প্রতিষ্ঠা করেন। এটি অটিজম সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়ানোর জন্য উত্সর্গিত সংস্থা, যা অস্টিনের অফিসিয়াল কার রেসিং দল।
অস্টিন এবং রেসিং উইথ অটিজম সম্পর্কে জানার পর, নিসান মাইক্রা কাপের, প্রতিদ্বন্দ্বী মেটড টপোলনিক এবং তার স্ত্রী মারি ক্রিসাইন বিদার্ড, অটিজম সচেতনতা সমর্থন করে,অস্টিন রিলিকে কাপে প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণের জন্য নিয়ে আসে।
রেসকার চালানো তার শৈশবের স্বপ্ন যেন বাস্তবে ধরা পরে আন্তরিক সহযোগী অভিভাবকের সহযোগীতায়। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের পিছনে তার দক্ষতা, চেষ্টর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা পায়। গত বছর রেসিংয়ের জন্য ড্রাইভিং, মিক্রার কাপে অস্টিন রিলে ৫৯ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। এবং চূড়ান্ত ড্রাইভারের অবস্থানের মধ্যে ১৭ তম স্থান পেয়েছিলেন। অস্টিন এই মৌসুমে, নিসান সমর্থিত সিরিজ প্রতিযোগিতায় ফিরে আসবে আবার।
গাড়ি চালানোর গতি ছাড়াও সঙ্গীতের বিটও আস্টিনকে আচ্ছন্ন করে। নিজেকে দ্রুত বিট তালের সাথে প্রকাশ করতে পছন্দ করে।
সঙ্গীতও সবসময় অস্টিনের জীবনের একটি বিশাল অংশ হয়ে আছে। এবং সঙ্গীত তার চারপাশের বিষয় মোকাবেলা করতে সহায়তা করে।
এপ্রিল জাতীয় অটিজম সচেতনতা মাস । তার মানে এই নয় এপ্রিল শেষ হয়ে গেলে আমরা আর এ বিষয় নিয়ে ভাবব না। আমাদের সারা বছর ধরেই সচেতন থাকতে হবে। যে শিশুটি বা মানুষটি বুঝতে পারে না সহজে। তাকে অত্যাচার না করে ভালোবাসা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা উচিত সাবারই, কেন সে বুঝতে পারছে না। তারা বুঝতে পারে না সঠিক ভাবে তাদের শারীরিক বিন্যাস হয়নি বলে। অথচ অনেকে তাদের না বুঝে অত্যাচার করে তাদের কি সুস্থ বলব।
অসহায় মানুষগুলোকে সাহায্য না করে আমরা হাসাহাসি করতে পারি। খুব সহজ। কিন্তু নিজেদের মানবিক গুণের কাছে আমরা হেরে যাই নিজেদের ব্যবহারে।
সুযোগ পেলে এবং সঠিক ভাবে জানতে পারলে শিখাতে পারলে তারা সব কাজই করতে পারে। তাদের একটু সময় বেশি লাগে।
কিছু বিষয় তারা দ্রুত ধরতে পারে না। মাথার ভিতর সিগন্যালটা অনেক সময় ঠিক জায়গায় পৌঁছায় না। তখন তারা অস্থির হয়ে যায়। তাদের সাহায্য না করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুস্থ মানুষরা রাগ দিয়ে তাদের কন্ট্রোল করতে চান। যা ভালোর চেয়ে মন্দই করে বেশি। তারা না থেমে আঁচড়ে কামড়ে দিতে পারে। তখন তাদের পাগল বলতে কোন অসুবিধা হয় না সুস্থ মানুষের। চিকিৎসার নামে ঘুমের ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করে দেয়া হয়।
এখানে একটি বিজ্ঞাপন দেখায় টিভিতে, আগে জানতাম শহরে একজন আটিজম আছে। তারপর দেখলাম পাড়ায় এখন আমার ঘরেও একজন আছে। আটিজম বাড়ছে অথচ সচেতনতা সে তুলনায় শূন্যের কোঠায় আছে। কিছু উন্নত দেশের আটিজম মানুষ শিক্ষা চিকিৎসা। সমর্থন সহযোগিতা পায়। বাকি সব অবহেলায় থাকে। অটিজম নিয়ে রেসিং অস্টিন রিলির গল্প আমাদের সফলতার কথা বলে। ওরা সব পারে ওদের একটু অন্য ভাবে শিখাতে হয় আদরে যত্নে ভালোবাসায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:১৯