উত্তরের অনন্ত শীতের পরে, গতপরশু দিনটি ছিল বড় সুন্দর যদিও বসন্ত চলছে অনেকদিন প্রায় শেষ হওয়ার পথে বসন্ত সময় কিন্তু এখনো হালকা পর্দার মতন লেগে আছে শীতের পর্দা। যাই যাই করে যাচ্ছে না। শীতের কাপড় খুলি খুলি করেও জড়িয়ে রাখতেই হচ্ছে। তবুও বেরিয়ে পরলাম হাঁটতে। প্রথমে একটু শীত শীতই করছিল তার কারণ হাওয়া। এই হাওয়ার জন্য শীতের তীব্রতা অনেক বেশি মনে হয়। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে শীতের তীব্রতা তেমন আর অনুভব করলাম না।
ঘাস কেবল মাথা তুলছে। এক মাঠ পেরিয়ে গাছের বনের ভিতর চলে গেলাম। অনেকটা জায়গা জুড়ে নানা রকম গাছ প্রতিযোগীতা করে লম্বা হয়েছে। নিজেদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কেউ গায়ে গায়ে লেগে আছে। কেউ একটু দূরে দূরে। বড় গাছের নিচে মাঝারি গাছের ডালপালা ছড়ানো। চলার পথে এরা দাঁড়িয়ে আছে প্রহরির মতন। একটু অসাবধান হলেই চোখে মুখে গায়ে খোঁচা দিবে । গুতা দিবে। পায়ে বেঁধে উল্টে পরে যাওয়ারও সম্ভাবনা। ওদের সাথে আছে অসংখ্য ভেঙ্গে পড়া গাছের ডাল। আর ঝরা শুকনো পাতার মর্মর।
সবার নিচে মাটি ঘেসে জেগে উঠছে কত রকমের লতা গুল্ম, ফার্ন, মুস, ঝোপঝাড় । পুরোদমে প্রকৃতিক একটা অবস্থা যেখানে সভ্য মানুষের হাত লাগেনি। আপন মনে তাদের বেড়ে উঠা জীবনাবসান। নতুন রূপের বৈচিত্র।
প্রতিবছর এই সময়ে কয়েকবার বনের ভিতর ঘুরতে যাই। আর অবিস্কার করি নতুন নতুন উদ্ভিদ, গুল্ম, ফুল, বুনো মাশরুম। ঠিক সময় মতন না যেতে পারলে সবার সাথে দেখা হয় না। নতুন ধরনের কিছু প্রতিবার আবিস্কার করি। সবার আগে ফোটে ভূঁইচাপা। জাফরান আর লিলি অফ দ্যা ভ্যালি। এত মিষ্টি গন্ধ এই লিলি অফ দ্যা ভ্যালির ছোটছোট ফুলগুলোতে। মনে হয় একটা পারফিউম বানিয়ে জড়িয়ে রাখি গায়ে সারাদিন। অথচ ও কে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না। ভীষণ রকম বিষাক্ত। যেমন আইভি নামের একটি লতাও বিষে ভরা।
বনভূমি বড় বেশি নির্জন। ভেবেছিলাম অনেক পাখির ছানা, হরিণ, তিতিরের দেখা পাবো। কিন্তু একটা খোরগোশ, কাটবেড়ালি পর্যন্ত নাই। সব শুনশান। দুটো পাখির বাসা দেখলাম বড় গাছের বেশ উপরে। অনেকক্ষণ পরে দেখলাম পাঁচটি সোনালী ডানার চিল উড়ছে। বড় বড় গাছের মাথার উপরে। এছাড়া আর কোন প্রাণীর সাথে দেখা হলো না।
নিচে আমার হাঁটার সাথে শুকনোপাতার নূপুর বাজে এ ছাড়া শুনশান নিরব।
প্রচুর রোদের আলো তাও অন্ধকার ভিতরে। একটা বিষয় দেখলাম বনের মাঝে এক এক জায়গায় এক এক ধরনের লতা গুল্ম গজায় সবাই এক জায়গায় গজায় না।
এবার পেলাম কিছু হলুদ ফুলের দেখা। অর্কিডের মতন পাঁচ পাপড়ির সুন্দর ফুলগুলো, মাটির একটু উপরে মাথা তুলো হাসছে। ওরা যেখানে মাথা তুলে আছে সেখানে সবুজ পাতার দল লিলি ফুলের মতন কিন্তু লক্ষ করে পেলাম হলুদ ফুলগুলো এই উদ্ভিদের নয়। হলুদ ফুলের গাছের পাতাগুলো পাতাবাহারের মতন ছাপাওলা। সারা বনভূমির ভিতর জুড়েই অনেক জায়গায় এই ফুলগুলো ফুটে আছে। এদের নাম সিলপিং বিউটি।
প্রথম জেগে উঠা ঘুমন্ত সুন্দরীদের আমি বনের ভিতর খুঁজে পেয়ে আপনমনে পুলকিত হলাম। অনেকটা সময় বিভোরতায় কাটালাম তাদের সাথে।
একপাশে অনেক লম্বা লম্বা বাঁশের গাছ মনে হলো জেগে উঠছে। কিন্তু এখানে বাঁশগাছ হওয়ার কথা না। ধরে দেখলাম এদের ভিতরটা পুরোই ফাঁকা, পাটকাঠির মতন এবং নরম। একটা অদ্ভুত পেয়াজ পাতার মতন ঘ্রাণ। সেগুলো আসছে লিলির মতন পাতাগুলো থেকে। বনের ভিতর কতরকম জীবন, নিজের মতন বৃদ্ধি পায় মরে যায় । বার্চ গাছের ছালগুলো খুলে পরছে। ভিতরে দারুণ একটা রঙ। সাপের খোলশ বদলের মতন এই গাছ নিজের খোলশ বদল করে নেয়।
অসংখ্য ম্যাপেলের চাড়া মাথা তুলছে লাল পাতার আভাস তাদের মাথায়।
ঘুরতে ঘুরতে মাশরুমের মতন কিছু পেলাম একটা ভাঙ্গা গাছের গুড়িতে কিন্তু সেগুলো মাশরুম নয় গাছের আঠা বেরিয়ে ঐ রকম রূপ ধরেছে। শক্ত পাথরের মতন মাশরুম রূপের এই জিনিসগুলো দেখে মনে পরে গেলো ক্যালিফোর্নিয়ায় দেখা পেট্রিফাইড ফরেস্টের কথা। যেখানে গাছগুলো পাথর হয়ে আছে।
প্রকৃতি একই জিনিসকে কত ভিন্নরূপে রপান্তরিত করে সময়ের অবগাহনে।
তাদের ফাঁকে ফাঁকে খুঁজে পেলাম কিছু ব্লুবেরি গত সামারে যা গজিয়ে ছিল। পাখিদের খাওয়ার পরও মাটি কিছু ধারন করে আছে। নতুন গাছ গজানোর জন্য।
পাতাহীন গাছের বন বেশ ফাঁকা ফাঁকা এখন। আর কিছুদিন পর ঘন পাতার ফাঁকে অন্ধকার হয়ে থাকবে সব। কিছু ফল হবে কিছু ফুল ধরবে। তখন হবে বনভূমির সবুজে ছাওয়া আরেক অনিন্দ্য সুন্দর রূপ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০২০ রাত ১০:০২