(১)
আমার নাম মামুন। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। একটু আগে লঞ্চটা কাত হয়ে গেছে। আমি বসেছিলাম দোতলার কেবিনে। বের হবার অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। ওখানে অনেক মানুষ দৌঁডাদৌড়ি করছিল। তাদেরকে ঠেলে বেরিয়ে আসার সময় পাইনি। ডুবে গিয়েছি ধীরে ধীরে। আমার মেয়ের বয়স ২ বছর। অল্প কথা বলতে পারে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় সে বলেছে তার জন্যে কোরবানের ঈদে পুতুল নিয়ে যেতে। আমার বউ, সে অপেক্ষা করে আছে। মায়ের চোখে সামান্য সমস্যা, আমাকে নাকি পরিষ্কার দেখা যায় না। একটা ভালো ডাক্তার দেখিয়ে চশমা কিনে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তাদের কোনো ইচ্ছাই আর পূরণ করতে পারলাম না। আমার চলে যেতে হবে। আমার বাচ্চাটা আর পুতুল পাবে না, মা ঝাপসা চোখে আমার অবয়ব দেখবে না। আমি তলিয়ে যাচ্ছি, গভীরে আরো গভীরে..
(২)
আমার নাম মিতু। বাবা-মায়ের সাথে ঈদ কাটাতে এসেছিলাম। আমিও তলিয়ে যাচ্ছি পানিতে। আমি সাঁতার জানি না। আমি মাকে বলে এসেছিলাম, দোতলায় উঠে যাওয়ার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নদী দেখবো। আমার আর মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া হয়নি। আমার পছন্দের মানুষ আছে। কথা ছিল ফিরে এসে ওর সাথে দেখা করবো। তার সাথে দেখা হয়না কতদিন.. এবার গিয়ে তাকে একটা শার্ট উপহার দিবো ভেবেছিলাম। টাকা জমিয়েছি অনেক। কিন্তু তার সাথে আমার আর দেখা হবে না। আমি তলিয়ে যাচ্ছি, গভীরে আরো গভীরে..
(৩)
আমার নাম সায়েম। আমি বিড়ি ফুঁকতে গিয়েছিলাম ডেকের উপরে। মজাই লাগছিল, ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস। হঠাৎ দেখলাম লঞ্চটা কাত হয়ে গেছে। সবার চেঁচামেচি। অনেকেই লাফাচ্ছে পানিতে। আমিও লাফ দিতে চেয়েছিলাম। ডেকের কোণার বাচ্চাটার ওপর চোখ পড়াতে থেমে গেছি। তাকে একজনের হাতে তুলে দিলাম। সে সাঁতরে কোথায় গেল জানি না। আমি আর বের হতে পারিনি। তলিয়ে গেছি, গভীরে আরো গভীরে।
আরো আছে, চা বিক্রেতা রহিম। ঐ যে কালো করে নাম না জানা ছেলেটা। নতুন সংসার সাজানোর স্বপ্নে বিভোর ছেলেটা। তারা সবাই তলিয়ে গেছে। কোথায় লুকিয়ে আছে তারা আমি জানি না। তাদের লাশ নাকি ভেসে উঠছে নদীতে। রহিম কি জানে, তার মা এখন পদ্মা পাড়ে বসে আছে? তার মায়ের বিশ্বাস ছেলে সাঁতরে এসে বলবে এই দেখো মা আমি ফিরে এসেছি। কিন্তু ছেলে আসে না। অথবা আমিনা তলিয়ে যাওয়ার সময় তার কোলের সন্তানকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাটুকু করেছিল? আমাদের জানা নেই..
তারা সবাই তলিয়ে গিয়েছে, গভীরে আরো গভীরে..