somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বোবা কান্না

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেক্ষন ধরে ডায়রি হাতে বসে আছেন গফুর সাহেব, চোখদুটো ভেজা। সকাল থেকেই মন খারাপ ছিল, ভেবেছিলেন পুরনো কিছু ছবি দেখলেই হয়তো মনটা ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু বিধি বাম! ডায়রির কভারে নিতুর ছবিটা দেখে বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল তার। নীল ড্রেস পড়া পাসপোর্ট সাইজেরএকটা ছবি, বছর সাতেক আগে তোলা। ছবিটা খুব ভাল হয়েছিল, তাই নিতু নিজ হাতে তা ডায়রির কভারে লাগিয়ে দিয়েছিল। কে জানত, সেই সুন্দর ছবিটাই আজ এতবছর এসে গফুর সাহেবের বুক তীরের মত বিদ্ধ করে ক্ষত-বিক্ষত করে দিবে?

একমাত্র মেয়ে নিতুকে নিয়ে দুইজনের ছোট সংসার গফুর সাহেবের। ডাকবিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, আয় খুবই সামান্য। এই আয় দিয়েই মেয়ে নিতুকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন তিনি, এক কথায় যাকে বলে মধ্যবিত্তের সুখ। নিতুকে খুব ভালবাসেন, তাই তার সব ইচ্ছেগুলো পূরন করার চেষ্টা করেন। অবশ্য মেয়ের ইচ্ছে পূরন করতে গফুর সাহেবকে কখনো তেমন কোন ঝামেলায় পড়তে হয় নি। কারন নিতু আর পাঁচটা সাধারন মেয়ের মত নয়, যে কিনা বাবার কাছে গিয়ে আবদার করবে, "বাবা, ঐ জামাটা কিনে দাও না , ঐ ট্যাডিটা কিনে দাও না ইত্যাদি ইত্যাদি। নিতুর আবদার গুলো সব ছোট ছোট, হয়তো খুব অল্প বয়সেই বাবার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে পেরে গিয়েছিল সে। তাইতো কোন এক বিকেলে অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে গফুর সাহেব বাড়ি ফেরার পর নিতু তার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে,
-বাবা, একটা আবদার রাখবে?
-কি আবদার?
-উহু, আগে বল রাখবে কিনা?
গফুর সাহেব জানে, তার মেয়ের আবদারগুলো কেমন হবে। তারপরেও মুখে কৃত্তিম চিন্তার ভাজ ফেলে বলেন,
-আচ্ছা বল, রাখব।
-কাল তো শুক্রবার, আমাকে একবার বেড়াতে নিয়ে যাও না। ঐযে বলেছিলে ময়ুরের কথা? একবার শুধু দেখব।

গফুর সাহেব হাসেন, শান্তির হাসি। বাবা হয়ে মেয়ের এতটুকু ইচ্ছে পূরনের সামর্থ্য তার আছে। স্ত্রীর ভালবাসা কি, সে সম্পর্কে গফুর সাহেব একেবারেই অনভিজ্ঞ। মাত্র দেড় বছর জাহানারার সাথে সংসার করতে পেরেছিলেন। এই দেড় বছরের প্রতিটা রাত দুইজন একসাথে মিলে নিজের জীবন নিয়ে অসংখ্য স্বপ্ন বুনেছেন। কিন্তু নিতুর জন্ম হবার পর যখন তাদের স্বপ্নটা আরো বিস্তৃত হবার কথা ছিল, ঠিক তখই তাকে একা করে স্ত্রী জাহানারা চলে গিয়েছিলেন। সেই থেকে মেয়ে নিতুকে আকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তিনি। আত্মীয়রা অবশ্য বলেছিলেন তাকে আরেকটি বিয়ে করার জন্যে, কিন্তু তিনি রাজী হন নি। তিল তিল করে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী নিতুকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে লড়ায় করেছেন।

অবশ্য জীবন সংগ্রামের এই লড়াইয়ে গফুর সাহেব কখনো একা ছিলেন না, বরং মেয়ে নিতু সবসময় তার পাশে ছিল। বুদ্ধি হবার পর থেকেই সংসার ও বাবার দায়িত্ব নিতু নিজের কাধে তুলে নিয়েছিল। তার সমস্ত জগত জুড়ে শুধু তার বাবাই ছিল। পৃথিবীর নির্মম বাস্তবতা সম্পর্কে কিছু বুঝতে না পারলেও বাবার মনের ভেতরের বাস্তবতাটাকে খুব অল্প সময়ের ভেতরেই বুঝে ফেলেছিল। আর তাই তো কখনো কোন আবদার নিয়ে বাবাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে নি নিতু। পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খুব ভাল করেই খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল সে। বিকেলে সমবয়সী বন্ধুরা যখন গলির মুখে কানামাছি খেলত, নিতু তখন অফিস ফেরত বাবার জন্যে পানি নিয়ে বসে থাকত।

এভাবেই চলছিল বাপ-মেয়ের দিনগুলো। নিতু যত বড় হচ্ছে, নিজের কাধে একটু একটু করে দায়িত্বের বোঝা বাড়িয়ে নিয়েছে। সামান্য কিছু টাকা বাঁচানোর জন্যে নিজে রান্না শিখে যেদিন কাজের বুয়াকে বিদেয় করে দিয়েছিল, সেদিন মেয়ের সামনে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষন কেদেছিলেন তিনি। সংসার চালানোর পাশাপাশি নিতু নিজের লেখাপড়াটাও ঠিকই চালিয়ে নিয়েছে। হাইস্কুল আর কলেজ জীবনের গন্ডি পেরিয়ে সে এখন অনার্সের ভর্তি হয়েছে। কিছুদিন আগে দূর সম্পর্কের এক বোন বলেছিলেন,
-নিজের লাইগ্যা আর কত মাইয়াডারে কষ্ট দিবি?
কথাটা শুনে লজ্বায় মাটিতে মিশে জেতে ইচ্ছে করছিল গফুর সাহেবের। আসলেই তো, একি করছেন তিনি? নিতু যঠেষ্ঠ বড় হয়ে গেছে। এবার একটা বিয়ে দেয়া দরকার। বুড়ো বাপের সাথে আর কতদিন? এবার তো একটু সুখ দরকার! মুখ লুকিয়ে কোনভাবে বোনকে বলেছিলেন,
-আপনারা তো আছেন। দেখেন কোন ভাল ছেলে পান কি না।

কিছুদিন পরই গ্রাম থেকেই সে বোনের ফোন,
-তোর মাইয়ার লাইগ্যা একখান ভালা পোলা পাইছি। শহরে ব্যাবসা করে, ইনকাম ম্যালা। পোলার পরিবারের কুন দাবী নাই, তই পোলার ব্যাবসা বাড়ানির লাইগ্যা লাখ পনের ট্যাকা দিলেই হইব। চিন্তা কইরা দ্যাখ, এমন পোলা লাখে মেলে না।
সাত-পাঁচ না ভেবে গফুর সাহেব রাজী হয়ে গেলেন। গ্রামের কিছু জমি আর পেনশন বিক্রি করে লাখ এগারো টাকা জোগাড় করা যাবে, বাকি টাকা নাহয় পরেই দিব। তবে নিতু রাজী হয় নি, তার এক কথা। আগে পড়া লেখা শেষ করবে। গফুর সাহেব মনে মনে ভাবেন, এই বুড়োটার সাথে থাকলে তুই পড়ালেখাও শেষ করতে পারবি না রে পাগলি। মুখে আর বলতে পারেন না। মেয়েরে অনেক কষ্টে শেষ-মেষ রাজী করানো গেল। মহা ধুমধামে নিজের জীবনের শেষ সম্বলটুকু দূরে সরিয়ে দিলেন।

বিয়ের মাস ছয়েক পরের ঘটনা। শুকনো মুখে নিতু এল বাবাকে দেখার জন্যে। মেয়েকে দেখেই গফুর সাহেবের বুকটা ধুক করে উঠল। নিতুর মুখটা থমথমে হয়ে আছে। কিছু একটা হয়েছে। অথচ গফুর সাহেব শত চেশটা করেও মেয়ের মুখ থেকে কিছু বের করতে পারেন নি। তার দুই দিন পরেই নিতু আবার শশুর বাড়িতে ফিরে গেল। কিন্তু গফুর সাহেবের মনটা খচখচ করতে লাগল। সেদিনই শশুর বাড়িতে খুঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, বিয়ের সময় যে চার লাখ টাকা বাকি ছিল, তার জন্যে নিতুর উপর চাপ দেয়া হচ্ছে। অথচ মুখ চাপা মেয়ে নিজে অপমান সহ্য করেও বাবার কাছে টাকা চাইছে না। সেদিনই রাতে নিতুকে ফোন দিলেন গফুর সাহেব। বললেন,
-মা আমার, চিন্তা করিস না। কাল আসছি আমি।

নিতুর বিয়ের সময় নিজের সব জমিই বিক্রি করে দিয়েছিলেন গফুর সাহেব। শেষ ছয় মাসে এটা ওটা করে লাখ খানেকের মত টাকা জমাতে পেরেছেন। বাকি তিন লাখ টাকা জোগাড় করতেই হবে। কারন নিতু যে তার বাবার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। শেষ পর্যন্ত চিন্তা ভাবনা করে নিজের শেষ সম্বল একমাত্র থাকার বাড়িটা মহাজনের কাছে উচ্চ সুদে বন্ধক দিয়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে ছোটলেন মেয়ের শশুর বাড়িতে। অথচ বাড়ির ভেতর ঢুকার আগ পর্যন্ত গফুর সাহেব ভাবতেও পারেন নি, ভেতরে তার জন্যে নিতু না, বরং নিতুর লাশ অপেক্ষা করে আছে।


২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×