somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যীশুর পুনরুত্থান ও কিছু প্রশ্নবিদ্ধ মুখ

৩০ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভোরে কাকের দলের সাথে মানুষরাও জুটেছিল অন্ধ বিলের পাড়ে। এ বিলে একদা হয়তো শুধু মাছেরা বাস করত এখন তেমনটি নয়। এ বিলের জলে এখন মানুষ বাস করে- সাঁতরায়, ঘুমায়, ভাসে ভেলার মতো। শত শত মানুষ বিলের পাড়ে এসে ভিড় করে জলবাসিদের কেরামতি দেখতে। উপুড় হয়ে, চিৎ হয়ে ওরা ঘুমায় বিলের জলে। পড়শি কাকগুলো ওদের ভাসতে থাকা দেহের ওপর বসে কা কা… কোরাস ধরে। ওরা কোনো ভয় পায় না- জানে মানুষগুলো কত নিরীহ। জলবাসিদের এসব কেরামতি দলে দলে দেখতে আসা মানুষগুলো বিলের পাড়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। কাকগুলো কা কা করে, পাড়ের মানুষগুলো হা হা হা… হু হু হু…তাশ করে চলে। ভোরের কুয়াশা ঢাকা নীলচে আলোয় পাড়ের মানুষগুলো মৃতের মতো পাথর চোখে একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আজ যে জলবাসি অন্ধ বিলে সাঁতরাচ্ছিল তার সমস্ত দেহ চটে জড়ানো। বরাবরের মতো হাত-পা বাঁধা নিশ্চয়। চটের মধ্যে থাকায় বোঝা যাচ্ছিল না মানুষটা কে? পাড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে সে। আকাশও ফকফকা ফর্সা হয়নি এখনো। সাধারণত জলবাসি মানুষগুলো এ গ্রামের বা এ এলাকার হয় না। দূর দূর থেকে এনে এদের ভাসিয়ে দেয়া হয় অন্ধ বিলের জলে। অতঃপর তারা ভাসতে থাকে- ভাসতে থাকে যতক্ষণ না নবজাতক শিশুর কান্নার মত কুয়া কুয়া… আওয়াজ তুলে র‌্যাব- পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ায় বিলের পাড়ে। পাড়ের স্বার্থপর মানুষগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু জলবাসিদের কেরামতি দেখে- কেউ ওদের তুলে আনে না। কে ওসব ভাসমান বিপদে হাত দিতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবে? হাশরের ময়দান এটা। ‘ইয়া নাফসি’ ‘ইয়া নাফসি’ সবার বুকের ভেতর বাজে। কে জানে কার সামনে কোন বিপদ দাঁড়িয়ে আছে। তাই বিলের পাড়ের মানুষগুলো পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণ জলবাসিদের খুব কাছে এগিয়ে যায় না যতক্ষণ র‌্যার-পুলিশ জলবাসিদের ডাঙায় এনে সনাক্তর কাজ শেষ করে- মানুষটা আসলে কে? কী তার নাম? বয়স কত? সে নারী না পুরুষ? ভোটার আই.ডি নম্বর কত? তার পরনে কী আছে বা ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই একটা অস্থিরতা, আকুতি ও যন্ত্রণা নিয়ে মানুষগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকে পাড়ে।

অজো তেমনি দাঁড়িয়েছিল তারা। আজো যথারীতি পাড়া-গাঁয়ে কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে র‌্যাব-পুলিশের গাড়ি আসতে বিলম্ব করছে। বিষয়টা একটা রুটিনে চলছে গত কবছর, তাই সবার গা সওয়া হয়ে গেছে- এই নিয়ে কেউ তাই পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো উচ্চবাচ্য করে না। তাদের আলাপের বিষয় অন্য। ওরা নিজেরা নিজেদের গল্প বলে- নিজের গল্প মানে নিজের পরিবারের গল্প, নিজের বন্ধুদের গল্প, আত্মীয়-স্বজনের গল্প। এরা অনেক দূর দূর থেকে এসেছে। অন্ধ বিলে ভাসমান মানুষের খবর পেয়ে ছুটে এসছে। তারা একে অপরের সাথে গল্প করে চলে-

‘হামার ভাই!’ হু হু করে কেঁদে ওঠে আয়েশা। গত দশ দিন যাবৎ তার ভাইয়ের কোনো খবর নাই। কোথায় গেল, কে ধরে নিয়ে গেল, বেঁচে আছে না মরে গেছে তারা জানে না।

‘কখন অপহরণ হলো?’ বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি বলে ওঠে। অনেক মানুষের মাঝে এ লোকটিই আয়েশার কান্নাটা অনুভব করার চেষ্টা করছিল।

‘দুঃখের কথা কী বলব ভাই।’ আয়েশা তার ভাইয়ের গল্প বলে, ‘ভাই হামার ট্যাম্পোর ড্রাইভার। ট্যাম্পো গ্যারেজে রেখে বাড়িতে এসে খালি খানা খেতে বসেছে। একটা বিশাল কালো জিপ গাড়ি এস্যা হামাদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। বুনো ষাঁড়ের দরজায় শিং মারার মতো ধাড়াম ধাড়াম শব্দ। রমজান দরজা খোল। হামি দৌঁড়িয়ে যেয়ে দরজা খুললাম। ভাইয়ে হামার পরে ছিল লুঙ্গি, খালি গা। মুখ-হাত ধুয়ে কেবলই খেতে বস্যাছিল। ঘাড়ে গামছাটা তখনো ঝুলছে।

রমজান কার নাম? ওদের একজল কোহল।

আমার নাম, কেনে? কথাটা ভাই বুলে শেষ করতে পারেনি- অমনি ভাইয়ের গলার গামছা ধরে টেনেহিঁচড়ে ভাইকে লিয়ে জিপে তুলল। ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হামার আত্মা শুকিয়ে গেছিল। গামছায় ফাঁস লেগে তখুনি ভাই হামার মরে যাছিল। সে কি আতঙ্ক ভাইয়ের চোখ দুখানে! অসুস্থ মা বিছানায় শুয়ে শুধু আকুতি করছিল, ছেলেটারে ভাতটা খেতে দেন তারপর লিয়ে যেয়েন। সারা দিন গাড়ি চালিয়েছে ঠিক মতো খাওয়া হয়নি। একটু খ্যাতে দেন।… সেই যে ভাইকে লিয়ে গেল। তারপর থেকে ভাইয়ের খবর নাই।

-‘হুম। আসলেই কষ্টের।’ লোকটা আয়েশার গল্প শুনে বলে।

আয়েশা আবার বলে, ‘সেই যে ভাই গেল। আর কোনো খবর নাই। মা খালি কান্দে আর কহে, ছেলেটাকে হামার ভাতটা খেতে দিল না। মায়ের মুখ দিয়ে ভাত নামে না। সবুজ চেকের লুঙ্গি। টাঙ্গাইলের মালেক মিলের- ঈদে যখন ভাই লুঙ্গিটা কিনে হামি নতুন লুঙ্গির গা থেকে চিকচিকা টিকেটটা তুলে দরজায় লাগিয়েছিলাম। আর গামছাটা ছিল লাল। দেখলই চিনতে পারব। বিলের কালা পানিতে সে গামছায় কি আর লাল রঙ থাকবে?’

আয়েশার চোখ আবারো ভিজে উঠল কিন্তু আঁধারে সে লোকটা দেখতে পেল না। লোকটার নাম হল নিতাই। নিতাই বলল, ‘হুম! বোন কী বলব তোমাকে আমার বউ হিরণবালা। হিরণবালার আমার সোনার বালার বড় শখ ছিল কিনে দিতে পারিনি। তারপরও হিরণবালা তার শাখায় হামার নাম খোদাই করিয়েছিল। পচা পানির জলে চেহারা যদি নষ্ট হয়ে যায় শাখা দেখলে চিনতে পারব আমার হিরণবালাকে।’ নিতাইয়ের চোখ ক্ষীণ আশায় বড় হয়ে ওঠে।

‘কী হয়েছিল আপনার বউয়ের?’ আয়েশা জিজ্ঞেস করে।

‘ঐ তো সরকারি দলের ক্যাডাররা উঠিয়ে নিয়ে গেল। এনজিও অফিসে গেছিল প্রতিদিনের মতো চাকরিতে। আর বাড়ি ফিরল না আমার হিরণবালা।… অনেকেই দেখেছে উঠিয়ে নিতে। কিন্তু কেউ সাক্ষী দিল না। এদিক-ওদিক কত দৌড়াদৌড়ি করলাম কোনো কাজ হল না। টাকা থাকলে হয়তো কাজ হতো….। টাকা নাই, প্রশাসনে পরিচিত লোক নাই। আমার হিরণবালা খুব সুন্দর ছিল গো, জ্যোস্নার মতো ঘর আলো করে রাখত। ওই রূপই ওর কাল হলো। কথায় আছে না- আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।’

পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে নিতাইয়ের কথা শুনছিল তারেক। সে বলে উঠল, ‘টাকা থাকলেও ওদের বালও বাঁকা করতে পারবেন না- ওরা এটা ভালো করে জানে বলেই আপনার বউকে তুলে লিয়েছে খান্ডালায়। এই যে আমাদের মালিক হারেস মিয়া। এ তল্লাটের নামকরা ঠিকাদার। বাপের চেয়ে বড় আপন ছিল হামার। ওই যে ফকির পাড়ার রাস্তার কাজটা… সরকারি দলের পেঁয়াজ মুন্সী- পেঁয়াজের আড়তদার, চিনেন মনে হয়- ওকে টেক্কা দিয়ে হামাদের মালিক কাজটা ধরল সেই থেকে শত্রুতা। ডাইরেক আমাদের মালিককে মুন্সীর লোকেরা শাসিয়েছিল, কাজের ভাগ দেন না তো এমন জায়গায় পাঠাব কেউ খুঁজে প্যাবে না। থানাতে জি.ডি. করার দুদিন পর থেকে হামার মালিক হারেস মিয়ার কোনো খবর নাই। মালিকের ছেলে দুটা বিদেশে থাকে। হামি বেটার মতো পাশে পাশে থাকতাম।’

তারেকের কথা বলার ধরনটা নিতাইয়ের ভালো লাগে না। সে তারেকের কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

পাশ থেকে একজন তারেককে বলে, ‘হারেস মিয়া তো সরকারি দলের লোক। গত নির্বাচনে এমপির জন্য কাড়িকাড়ি টাকা ঢেলেছে। তারপরও এ অবস্থা?’

‘বাডার কথা বুলেন না তো। দলফলের গুষ্টি চুদে নাকি কেহু। সবই পয়সার খেলা। যাইলে বেলা বুঝে সবাই ঠেলা।’

লোকটা বিরক্তির স্বরে বলে, ‘মানে?’

‘পেঁয়াজ মুন্সী আর হামাদের হারেস মিয়া দুজনই এমপির লোক। পেঁয়াজ মুন্সীর ঢাকার লাইনটা বেশি শক্ত। এমপিকে সে বাডা দিয়ে পুছে না। এমপি হারেস মিয়াকে কাজটা দিল বলেই না যত বিপত্তি, বাপ হামার জানটা হারাল।’ বিড়ি ধরায় তারেক। বারুদের স্ফুলিঙ্গে সে আয়েশার বেঝা চোখ দুটা দেখতে পায়। সে বিন বিন সুরে কাঁদছে। তারেক আয়েশাকে বলে, ‘আরে বোন তুমি ক্যানে এখানে এসেছে? বাড়িতে কোনো বেটা ছেলা নাই- তাদের পাঠাতা খোঁজ লিতে? দ্যাশের অবস্থা তো ভালই জানো- তোমার ভয় ডর নাই নাকি?’

‘না নাই।’ উত্তরে ঝড়ো উচ্চারণে আয়েশা বলে। তারেক বুঝতে পারে না, কী নাই আয়েশার- বাড়িতে পুরুষ মানুষ, নাকি ভয়-ডর?

‘বাড়িতে যখন আপনজন ফেরে না তখন ঘরে কি বসে থাকা যায়?’ বোরকা পরা একটি মেয়ে বলে ওঠে। ‘আমার বাবা তো কোনো অপরাধ করেনি। সে কবিতা লেখতে ভালোবাসত, আর ভালোবাসত দেশকে।’

মেয়েটির কথা শুনে এক যুবক বলে ওঠে, ‘ক’দিন আগেও তো বকুলগঞ্জ সদরের কবি, স্থানীয় সোনার দেশ পত্রিকার সম্পাদক তপন বাগচীকে দুর্বৃত্তরা পত্রিকা অফিস থেকে ধরে নিয়ে গেছে। তারপর থেকে তাঁর কোনো খবর নাই।’

আমি তারই মেয়ে। আমরা তিন বোন। ছোট বোনটা এখনো জানে বাবা তার জন্য সুকুমার রায়ের রচনা সমগ্র কিনতে বাইরে গেছে। কেনা হলেই বাড়ি ফিরবে। হয়তো বকুলগঞ্জে বইটা পায়নি তাই দূরে কোথাও খুঁজতে গেছে। পেলে ঠিক ফিরে আসবে। সে অভিমানী ভেজা চোখে বলে, বাবা কি বোকা! না পেলে নাই পেল। আমি বায়না করেছি বলে না কিনে বাড়ি ফিরবে না?

যুবকটি অবাক হয়। হিন্দু মেয়ে বোরকা পরেছে কেন?

ভোরের আলো তখনো আলসেমি ছাড়েনি- র‌্যাব-পুলিশের গাড়ি একসাথে এসে দাঁড়াল। নেমেই ওরা অন্ধ বিলের রাস্তা বন্ধ করে দিল। মাইকে ঘোষণা দিল, ‘আপনারা যে যেখানে আছেন সেখানেই দাঁড়ান। কেউ নড়া চড়া করবেন না। আমাদের কাজে সাহায্য করুন।’ র‌্যাবের ইউনিট অধিনায়ক কর্নেল কাসিম স্থানীয় থানার ওসি অহিদকে বলল, ‘আগে একটা চার্জশিট তো তৈরি করতে হবে। কিছু সন্দেহভাজন দরকার। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে প্রেস, ইলেকট্রনিকস মিডিয়া এসে জমা হবে। তাদের বলার মতো কিছু তো দরকার।’

‘সে হবে স্যার, আগে লাশটা উঠানোর ব্যবস্থা করি।’ ওসি বলেন।
খানিক দূরে দুজন কনস্টেবল গল্প করছিল, ‘ভাই বলেন শীত চলে এসছে সেই কবে কাঁচা বাজারে এখনো আগুন।’

‘ঠিক বলেছেন। আবার দেখেন সরকার নতুন পে স্কেল ঘোষণা করেছে মাত্র, এখনো হাতে পাইনি, সব কিছুর দাম তর তর করে কেমন বেড়ে যাচ্ছে।’

‘পাঁচটা বছর কোর্ট পুলিশ ছিলাম পয়সা কিছুই করতে পারিনি। এখান কটা পয়সার মুখ দেখতে শুরু করেছি। এখানে টিকতে পারব কদিন জানি না- যে উপরের চাপ।’

‘অনেক দিন পর আজ রাইতে বাড়িতে গেছিলাম। মাঝ রাতে হঠাৎ ফোন- বউ গেল ক্ষেপে, আরে বাই উপরের চাপ, নিচের চাপে নাস্তানাবুদ অবস্থা।’

‘এই যে আপনারা এখানে গল্প করছেন। বাপের বিয়ে খেতে এসেছেন নাকি? ডোম কই?’ ওসি কনস্টেবল দুজনকে ধমকে বলে।

‘খবর তো দিয়েছি স্যার আসার নাম নাই।’ একজন কনস্টেবল উত্তরে বলে।

‘ধুর আপনাদের দিয়ে কোনো কাম হবে না। সব সময় আমার ঘাড়ে সব নাদান কনস্টেবল পড়ে।’ ওসি একজন সাব ইন্সপ্যাক্টরকে ফুসর ফুসর করে কী যেন বলে। সাবইন্সপ্যাক্টর তৎপর হয়ে বিলের পাড়ে যায়। ‘এই এখানে মাঝি-জেলে কারা আছে এখানে?’ জোরে চিৎকার দেয় সে। ছোট্ট কয়েকটা মাছ ধরা ডিঙ্গি বিলের পাড়ে বাঁধা ছিল তাতে বেশ কজন জেলে বসে ছিল। তারা ভয়ে চুপসে কুঁচে মাছ হয়ে যায়। ‘এই এদিকে আসো।’ তাদের কাছে আসার আদেশ দেয় সাবইন্সপ্যাক্টর।

‘ক্যান রে স্যার? হামরা তো এখনই আইলাম। হামরা কিছুই জানি না। এক্ষুনি আইলাম।’

‘যা বলছি তাই শোন। তাহলে তোদের ভয় নাই। তোমাদের কোনো ঝামেলায় জড়ানো হবে না।’

ওরা এগিয়ে আসে- ‘বলেন স্যার।’

‘তোরা লাশটা উঠিয়ে নিয়ে আয়।’

জলবাসি তখন পাড়ের সামান্য দূরে কচুরিপনায় আটকে ছিল। কৈবর্ত সম্প্রদায়ের এই প্রতিনিধি বিমর্ষ মনে নৌকা নিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। ওদের একজন তোরিকত। সে আজ বিলে মাছ ধরতে আসতে চায়নি। সকাল থেকে বাম চোখটা তড়পাচ্ছিল তার- কি না জানি বিপদ আছে কপালে! কিন্তু বের হতেই হলো। বাড়িতে এক মুঠো দানা ছিল না। এদিকে পাঁচ পাঁচটা খানেওয়ালা। পেটেরটা বেরুলে হবে ছয়টা। বছর কয়েক আগে জলে লাশ ভাসাতে দেখে ফেলেছিল বলে তাদের পাড়ার এক মাছুয়াকে গুলি করে অন্ধ বিলের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল খুনিরা। তাই এখন ওরা গুচ্ছ গুচ্ছ দলে মাছ ধরে। আজ আল্লায় জানে কী ঝামেলায় পড়েছে তোরিকত ও তার দল! যখন পুলিশ বলে, ঝামেলায় তোদের জড়াবো না তখন আরো বেশি করে জড়িয়ে দেয়। একবার তো পাঝরা পাড়ার হারুন মাছুয়াকে হত্যার দায়ে জেলে পুরেছিল ওরা, পাড়ার সবাই জানত সে নির্দোষ- এমনকি সেটা ওরাও ভালো করে জানত। ছমাস হাজত খেটে বেরিয়েছে হারুন। ওই মামলার অন্য আসামিরা পয়সা খরচ করে চার্জশিট থেকে নিজেদের নাম কাটিয়ে নিয়েছিল। এমনকি সত্যিকারের দোষীও ছুটে গেছিল পয়সার জোরে। আর হারুন! ওর সেই এক কথা, দোষ করিনি তো পয়সা কেনে? শালা গুয়ারতুমির জন্য ছমাস জেল খাটল। শালার বাপ-দাদারা হয়ত কোনো ভালো কম্ম করেছিল তাই ফাঁসির দড়ি থেকে বেঁচেছিল। পয়সা খাবার জন্য অহেতুক চার্জশিটে দু-চার-দশ জনের নাম ঢুকিয়ে দেয় ওরা। পয়সা দিয়ে নাম কাটাতে হয়। তাই তোরিকত কিছুই বলতে পারছে না তাদের ভাগ্যে আসলে কী আছে আজ? তাদের যদি সাক্ষীও বানিয়ে দেয় তবুও কোটে গিয়ে ডেটে ডেটে গিয়ে সাক্ষী দিতে হবে- কাম-ধান্দা বন্ধ। পরীবারের মুখগুলো পুঁটি মাছের মতো হাঁ করে বসে থাকবে। এটাও কি কম বড় শাস্তি? তারপরও নিরুপায় তোবারকরা অনুগতর মতো লাশটা নৌকোয় তোলে।

এরই মধ্যে দুয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক এসে জড়ো হয়েছে। তাদের মধ্যে হত্যার মটিভ নিয়ে কথা হচ্ছে, ‘দেশ তো এখন শান্ত। এটা পলেটিক্যাল মার্ডার মনে হচ্ছে না।’

‘এমনও তো হতে পারে, রাজনৈতিক অঙ্গনকে অশান্ত রাখার জন্য এসব পলেটিক্যাল মার্ডার।’

‘হতে পারে। এ দেশে সবই সম্ভব।’

‘নদীর বালু দখল নিয়েও তো এখানে সরকারি দলের গুণ্ডাদের নিজেদের মধ্যে রেষারেষি চলছে। এ কারণে তো পর পর তিনটা মার্ডার হলো।’

‘সব হয় উপরওলার ইশারায়- উপরওয়ালা সব জানে।’

‘গুম, হত্যা তো এখন কমন খবর। এবস খবরে আর টিভি চ্যানেলের টিআরপি বাড়ে না।’

‘অপহরণ করে টাকা ডিমান্ড। না দিলে মেরে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া…।’

‘অনেক সময় টাকা দিয়েও তো ভিকটিমের জীবন বাঁচানো যায় না।’

‘সত্য কী আর পুলিশ কী বলছে তার মধ্যে হয়তো আকাশ জমিন পার্থক্য থাকবে।’

‘ভাই ওদের দোষ দিয়ে কী করবেন। তাদেরও তো চাকরি বাঁচাতে হবে।’

সূর্যের আলো ফুটতে শুরু করেছে তবু সমবেত সবাই সম্মুখে অন্ধকার দেখে। সেই অন্ধকার সূর্যালোকের আগমনের সাথে সাথে যেন আরো ঘনিভূত হতে থাকে। অতঃপর জেলেরা লাশের বস্তার বাঁধন খুলতে ইতস্তত করলে ওসি সাহেব ধমকে ওঠে, ‘খুন করার সময় তো সঙ্কোচ হয় না। এখন কেন এত ভালোমানুষি করস তোরা?’

‘কী যে বলেন স্যার। আমরা নিরীহ মানুষ এই বিলে মাছ ধরে খাই। মানুষ খুন করতে যাব কেন?’ মাছুয়াদের একজনের এসব বলতে গিয়ে কণ্ঠ অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে ওঠে।

‘বস্তার মুখ খোল তারপরে বুঝব খুনি কে আর সাধু কে?’ ওসি সাহেব প্রায় চিৎকার করে ওঠে। পাশে নাকে রুমাল দিয়ে র‌্যাব কমান্ডার দাঁড়িয়ে ছিল।

‘ওসি সাহেব এদিকে আসেন।’ র‌্যাবের কর্নেল কাসিম ওসিকে কালো জিপের আড়ালে ডেকে নিয়ে যায়। কর্নেল ফিস ফিস করে ওসিকে বলে, ‘আমার সোর্স এলাকার গণ্যমান্য ধনী লোকদের একটা তালিকা আমাকে দিয়েছে। দেখেন তো প্রাথমিক অবস্থায় কার কার নামে চার্জশিটটা দাখিল করা যায়?’ কমান্ডার সাহের তালিকাটা পড়তে থাকে, ‘তাজেম আলি, চালের আড়তদার, আলহাজ সাদেক হোসেন…।’

ওসি কমান্ডারকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘থামেন থামেন, আলহাজ সাদেকের বিরুদ্ধে অলরেডি অন্য একটা কেসে একটা চার্জশিট দেয়া হয়েছে। তাজেম আলি দশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে। গত বছর এসেছিল ঈদে। পোস্টার-টোস্টার লাগিয়ে এলাকাবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছে। সামনে বার ইলেকশন করবে মনে হয়। কাতারে নাকি তার বিশাল সেলুন আছে।…’

ওসির এতো ডিটেলে কমান্ডার বিরক্ত হয়, ‘ওর নামে চার্জশিট দেয়া যাবে না। এই তো? বাকিদের নামটা একটু চেক করেন।’ কর্নেল লিস্টটা ওসির হাতে দেয়।

ওসি ওটা হাতে নিয়ে বলে, আগে দেখি লাশটা শনাক্ত করা যাই কি না সেটা দেখে তারপর চার্জশিট দেয়া যাবে।

‘ঠিক আছে চলুন।’ তারা দুজনে মগজের গোড়ায় এক জটিল সমীকরণ নিয়ে জলবাসির দিকে এগিয়ে যায়।

এরই মধ্যে দুজন ডোম এসেছে। সাব ইন্সপ্যাক্টর তাদের বকাবকি করছে, ‘হারামজাদারা। তোদের খবর পাঠিয়েছি সেই তিনটা, এতক্ষণে এলি? ঝামেলাটা ভালই ভালই মিটুক তারপর তোদের দুজনকে দেখছি আমি।’

‘কী করবু সাহেব? র‌্যাতে ট্রেনে কাটা এক ছুড়ির লাশ কেট্যাছি। তারপর মাল খ্যাইয়ে যেই না ঘুমাইবার গেছি আপনার ডাক। নিশা কাটেনি এখনো সাহেব।’

‘তোরা শালা মানুষ হবি না কোনো দিন।’ সাবইন্সপ্যাক্টর ক্ষোভে যেন ফেটে পড়বে- ডোমদের এই বিলম্বের কারণে তাকে কত যে জবাবদিহি করতে হবে উপরে তা কে জানে?

‘হা হা হা, কী যে কহেন সাহেব। মানুষ কোনটা আর লাশ কোনোটা এখন চিনতে পারি না। কখন জিন্দা মানুষকে মরা ভ্যাবে পোসমটেম কর‌্যা ফেলি সেই ভ্যাবো মরি। বাপ-মা মানুষ করেনি তো এখন মানুষ হয়ে করবটা কীসের বাল?’ বিধুর নেশা যেন এখনো কাটেনি। বক বক করে চলে সে।

‘এত কথা কীসের রে বিধু? বস্তা খোল।’ সাবইন্সপ্যাক্টরের মেজাজ নরম হয়ে আসে।

‘সাহেব গন্ধ শুকে কইতে পারি লাশের অবস্থা ভালো না। আস্তে সুস্তে বস্তা কাটতে হোবে। পরে আবার তখন হামাকেই বকবেন।’ কানু ডোম বলে। কানু বিধুর মতো বেশি বকে না কাজের সময়।

‘খোল, খোল, তাড়াতাড়ি খোল।’ ওসি এসে সেই তাগাদা দিতে থাকে। ভীষণ উত্তেজিত সে। লাশ শনাক্ত করা গেলে চার্জশিট তৈরি করা সহজ হবে। ওসির কথায় কান না দিয়ে কানু বিধুকে সাথে নিয়ে জলবাসি মানুষটির গায়ে জড়িয়ে থাকা চটের বস্তাটা খুব সাবধানে কাটতে থাকে। এমনভাবে কাটে যেন জলবাসির মানুষটির ঘুম ভেঙে না যায়। কানু এ লাইনে বিশ বছর। সে জানে একটু অসতর্ক হলেই ঘটনার আলামত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। লাশই হলো হত্যামামলার সবচেয়ে বড় আলামত। অবশেষে বস্তা সরিয়ে লাশটা উন্মুক্ত করা হয়। ভনভন ভনভন…বারমাসি গায়তে গায়তে মাছির দল এসে লাশটাকে ঘিরে ধরে।

কই দেখি দেখি…স্বজন হারা মানুষগুলো র‌্যাব পুলিশকে উপেক্ষা করে লাশের চারিপাশে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে, ‘এটা আমার ভাইয়ের লাশ নাকি? দেখেন তো গায়ে কোনো জামা আছে?’

‘জামা নাই খালি গা।’ উত্তর আসে।

‘হারামিরা ভাইকে মেরে বিলেই তাহিলে ফেলে দিয়েছে?’

‘আরে এটা মেয়ে মানুষ।’

‘তাইলে কি আমার বউ দেখেন তো। লাল পেড়ে শাড়ি নাকি।’

‘শাড়ি নাই গায়ে। ছায়া পরে আছে।’ উত্তর আসে।

‘আরে ওটা পেটিকোট না- লুঙ্গি। চোখে বাল ঢুকেছে নাকি বুঝতে পারো না?’

‘তাহিলে এটা কে?’

‘আমার মালিক মুনে হয়। হাতে দামি ঘড়ি মুনে হোছে?’

‘তোর মালিক, মুন্সী সাহেবের তো দাঁড়ি ছিল । এ লাশের তো দাড়ি নাই।’

‘এই যে সবাই দূরে সরেন।’ ওসি হ্যান্ড মাইকে কান ফাটানো চিৎকার দেয়। পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে লাশের চারিপাশ থেকে ভিড় সরানোর চেষ্টা করে। র‌্যাব মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে- ‘লাশ কয়েক দিনের পুরনো সুুতরাং এভাবে শনাক্ত করা যাবে না। আপনারা নিশ্চিত থাকেন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ল্যাবে নিয়ে বডিটা শনাক্তের ব্যবস্থা করা হবে। এতে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে।’ এরপরও পাড়ে জমা হওয়া লোকগুলোকে দমানো যায় না। ওসি লাঠিচার্জের নির্দেশ দেয়।

পুলিশের লাঠির আঘাতকে তুচ্ছ করে স্বজনহারা মানুষগুলো জলবাসিকে ঘিরে ধরেছে। তারা ওকে ছেড়ে যেতে চায় না। অন্ধ বিলের পানি ঢুকে জলবাসি মানুষটির শরীর শুশুকের মতো গোল হয়ে গেছে। তাকে শনাক্ত করা মানুষগুলোর জন্য ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবুও মানুষগুলো তাদের চোখের ভেতরে যে চোখের বসবাস, তাতে নানা প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন স্টার সানডেতে পুনুরুত্থিত যীশুর মতো হঠাৎ মানুষটি ঘুম ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে এবং তাদের সবার প্রশ্নগুলোর ঠিক ঠিক জবাব দেবে।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৪
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×