somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৬ষ্ঠ শ্রেণীর যোদ্ধারা

২৬ শে জুন, ২০১১ রাত ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি আমার স্কুল জীবন অনেক মিস করি। শুধু আমি না, আমার মনে হয় যে কোনো মানুষের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় সময় তার স্কুল জীবন। অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। সে যাই হোক। আজ সেই তর্কে যাবো না। আজ আমার স্কুল জীবনের একটি ঘটনা লিখব। আমি ছিলাম গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল এ। স্কুল এ থাকতে বুঝতে পারিনি সময়টা কত সুন্দর! ১০টা বছরই ঘটনাবহুল ছিল। কে কবে কোন স্যারের বাসায় গিয়েছে, কার বাবা হেডস্যারের রুম থেকে বের হয়েছেন, কে পরীক্ষার হলে কার খাতা দেখে লিখেছে, কোন স্যার কাকে নাম্বার বেশি দিয়েছে, সাময়িক পরীক্ষার আগে- কোন স্যার কোন বিষয়ের প্রশ্ন করেছেন, সাময়িক পরীক্ষার পরে- কোন স্যার কোন বিষয়ের খাতা দেখছেন এমনই আরও কত কিছু! এমন কি কোন আন্টি কোন আঙ্কেলের বাইকের পিছনে চড়েছেন তাও আমাদের কানে আসতো। এগুলো গেল ক্লাসের বাইরের কথা। এই বিষয়গুলোর সাথে ছাত্রদের সম্পৃক্ততা কম এবং গার্ডিয়ানদের সম্পৃক্ততা বেশি। কিন্তু ক্লাসের ভেতরের বিষয়; সেগুলোতো আমাদের আর আমাদের শ্রদ্ধেও স্যারদের নিয়েই।


আমরা তখন ক্লাস সিক্সে। আমি ‘ক’ শাখায় ছিলাম। আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন কাইয়ুম স্যার। বাংলার শিক্ষক ছিলেন তিনি। বেশ জ্ঞানী মানুষ। কলেজ হওয়ার পর এখন কলেজেও ক্লাস নেন। স্যার এর বাংলা শব্দ চয়ন যে কতটা ‘নির্মম সুন্দর’ সেটা স্যার এর নোট এর ভূমিকা বা উপসংহার পড়লেই বুঝতে পারবেন। কোনদিন সুযোগ হলে স্যার এর নোট থেকে ২-৪ লাইন ব্লগে লিখব। শর্ত হল দাঁত ভাংলে তার দায় আমি নিব না। যাই হোক, আসল ঘটনায় আসি। সেই সময় আমরা প্রাথমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করে হাই স্কুল এ উঠেছি। কিন্তু তাতে কি? বয়সতো আর বেশি হয়নি। তাই বাচ্চা শয়তানিগুলো তখনো রয়ে গেছে আমাদের মাঝে। আমরা অনেক নতুন নতুন খেলা বের করতাম। যত দূর মনে পরে, কলম ফাইট আমাদের আবিষ্কার। এই খেলা এখন অনেক স্কুলের ছেলেমেয়েরাই খেলে থাকে। আমাদের আবিষ্কৃত তেমনই একটা খেলা ছিল টাকার রাবার দিয়ে কাগজের বুলেট মারা। বুলেট যত শক্ত আর মোটা হবে সেটা তত ভালো কাজ করবে। এই কাজটা করে আমরা খুব মজা পেয়েছিলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই এই খেলা ক্লাসের ৬৫ জনের প্রায় সবার মাঝে ছড়িয়ে পরল। সবাই অতি আগ্রহ নিয়ে প্রতিদিন ক্লাসে কয়েকটা রাবার আর অসীম সংখ্যক বুলেট নিয়ে আসা শুরু করল। কি মজা! ক্লাসে ঢুকেই যোদ্ধার মত আমরা আমাদের অস্ত্র বের করতাম এবং নিয়মিত বিরতিতে আমারা যুদ্ধ করতাম। প্রথম পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে যুদ্ধ শুরু হত। সপ্তম পিরিয়ড পর্যন্ত চলত। মাঝে টিফিন পিরিয়ড এ ঘটত মরণ লড়াই। আর ক্লাস টাইমে চলত যুদ্ধ বিরতি। এভাবে ৩-৪ দিন চলল। স্যাররা- বিশেষ করে টিফিন পিরিয়ডের পর যে স্যারদের ক্লাস থাকতো তারা- এশে ক্লাসের মেঝেতে, বারান্দায় আমাদের যুদ্ধের অবশেষ দেখতে পেতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন গুলির খোসা পাওয়া যায়, ছেড়া কাগজের টুকরোগুলোকেও আপনি সেই রকম কিছুই মনে করতে পারেন।


এভাবে কয়েক দিন গেল। ক্লাসের ছাত্ররা এই খেলা নিয়ে বেশ আনন্দেই ছিল। মাঝে মাঝে ২ গ্রুপে যুদ্ধ হত। গায়ে বুলেট লাগলে ব্যাথা লাগত আবার মজাও লাগত। এই খেলাটা কোন গোপন খেলা ছিল না। তাই স্যারদের চোখে পরতেও সময় লাগলো না। প্রথম দিকে স্যাররা তেমন একটা পাত্তা দিলেন না। কিন্তু এটা কয়েকদিনের মধ্যেই এমন ভাবে ছড়িয়ে পরল যে স্যাররা একটু নড়েচড়ে বসলেন। ব্যাপারটা আমাদের ক্লাস টিচার কাইয়ুম স্যারের শান্ত মস্তিষ্কেও আটকা পরল। কিন্তু কাইয়ুম স্যার মানুষটা বেশ নির্ভেজাল। তাই তিনি সরাসরি action নিলেন না। আমাদের তিনি প্রথমে ওয়ার্নিং দিলেন। ছাত্রদের একটু টনক নড়ল। তাতে কি? এমন মজার খেলা কি আমরা এত সহজে ছেড়ে দিব? কক্ষনো না! কাইয়ুম স্যারের নজরে যেন না পরে- এটাই বড় কথা। আমরা তারপর থেকে প্রথম পিরিয়ড পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকতাম। কাইয়ুম স্যারের ক্লাস শেষ আর আমাদের যুদ্ধ শুরু। এভাবে প্রায় হপ্তাখানেক চলল। চলতে চলতে হঠাৎ একদিন বিনা নোটিসে আমাদের খেলা বন্ধ হয়ে গেলো। সেদিনের কথা বলি।


আমাদের স্কুলে একজন ড্রয়িং টিচার ছিলেন নাম বদিউজ্জামান। কোন ল্যাবরেটিরয়ান যদি এই মুহূর্তে ব্লগটি পড়ে থাকেন তবে তাকে একটু clear করি। আমি বদিউজ্জামান স্যারের কথা বলছি। তিনি ড্রয়িং টিচার ছিলেন। তিনি খুব সম্ভবত ২০০২ বা ২০০৩ এ আমাদের স্কুল এ join করেন। দয়া করে বদরুজ্জামান স্যার (যিনি ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং পরবর্তীতে আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হয়েছিলেন) এর সাথে বদিউজ্জামান স্যারকে গুলিয়ে ফেলবেন না। এই ২ জন শিক্ষক একই সাথে আমারা স্কুল থেকে বের হওয়ার ১ বছর আগ পর্যন্ত মর্নিং শিফটে শিক্ষকতা করেন। একটা কথা না বললেই নয় যে বদরুজ্জামান স্যার নিজেও একদিন নিজেকে বদিউজ্জামান স্যারের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। সেটা অন্য ঘটনা। পরে একদিন বলব। আগের কথায় ফিরে যাই। সেইদিন টিফিন পিরিয়ডের পর ছিল বদিউজ্জামান স্যারের ক্লাস। ঐদিন খুব সম্ভবত আমদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা একটু বেশি ‘টান টান উত্তেজনা’য় রুপ নেয়। তাই স্যার ক্লাসে আসার পরও অনেকে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলো। তখনই ঘটলো ঘটনা। তাও আবার যেনতেন ঘটনা নয়। ঘটলো ‘ক্রসফায়ার’ এর ঘটনা। শিকার হলেন ছোটোখাটো গাঁট্টাগোট্টা টাকওয়ালা বদিউজ্জামান স্যার। ব্যস! আসল কর্ম এইবার স্যার সম্পাদন করলেন। এর আগে আমরা এই স্যার এর মার খাইনি। সেইদিনই প্রথম। তবে হ্যাঁ, কেউ ক্লাস এ অমনোযোগী থাকলে স্যার তাঁর নিজস্ব স্টাইলে তাকে শাস্তি দিতেন। স্যারের শাস্তিটা ছিল এই রকম,


যে কথা বলবে তাকে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে হবে এবং তার ২ হাত নামাযে যেভাবে হাত বাঁধে সেভাবে বাঁধা থাকবে।


এই শাস্তির মাহাত্ম আমার জানা নেই। হয়তো স্যার ভাবতেন এই নামায স্টাইলের শাস্তি শুধু দেহকেই না বরং মনকেও প্রভাবিত করবে এবং স্যারের ছাত্ররা আর কখন এই ভুল করবে না।

সে যাই হোক। স্যারের শাস্তি ঐদিন তার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলো। স্যার ঐদিন আমাদের আঘাত করলেন। স্যারের অস্ত্র ছিল ১২” স্কেল। তবে একটা না, স্কেল ছিল ২ টা। নতুন ধরনের অস্ত্র। স্যার ২ টা কাঠের স্কেলের সমতল অংশ দুটি মুখমুখি লাগিয়ে ২ টা টাকার রাবার দিয়ে দু’ পাশে শক্ত করে আটকালেন। তারপর সেই অস্ত্র দিয়ে আমাদের ‘কোমল’ পশ্চাৎদেশে সজোরে আঘাত করলেন। ২ হাত ছিল পেটে বাঁধা। তাই হাত নাড়িয়ে আমারা স্যারের গতিবেগে কোন পরিবর্তন আনার চেষ্টা পর্যন্ত করতে পারিনি। লাইন ধরে ক্লাসের সামনে আমাদের দাঁড় করানো হয়েছিলো। পাকিস্তানি সেনারা যেভাবে ব্রাশ ফায়ারের আগে বাঙ্গালীদের লাইনে দাঁড় করাত অনেকটা সে রকম। সেই লাইনের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত সেনাদের কমান্ডার হাতে একটা স্টিক নিয়ে হেঁটে বেড়াতেন। স্যারও তাই করছিলেন এবং বলা বাহুল্য যে তাঁর মধ্যেও জাঁদরেল ভাব এসেছিলো। হঠাৎ করেই আঘাতের শব্দ পাওয়া যেত। তখন বুঝতাম কারো পশ্চাৎদেশে জোড়া স্কেল পরেছে। মজার বেপার ছিল, যখন কেউ মার খেত তখন তার পাশের জনও মার খেত। কারন, সেই বয়সে কাউকে মার খেতে দেখে যে নির্মল আনন্দ আমরা পেতাম তাতে হাসি চেপে রাখা সম্ভব হত না। এই হাসিই তখন নিয়ে যেত মারের দোরগোড়ায়। এভাবেই ক্লাস শেষ হল। সেই ক্লাসে স্যার তার ১০”/১০” রুমাল ভর্তি করে নিয়ে গিয়েছিলেন অসংখ্য কাগজের বুলেট এবং রাবার। সেই রুমাল তিনি submit করেছিলেন আমরদের কাইয়ুম স্যারের কাছে। আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন সৌম্য স্যারের সাথে গিয়েছিল। ওর কাজ ছিল রুমালটা বহন করা। ওর মুখে শুনতে পাই, বদিউজ্জামান স্যার টিচারস কমন রুমে সব টিচারদের সামনে ওই রুমালটা কাইয়ুম স্যারের হাতে তুলে দিতে দিতে বলেন, “দেখেন, আপনার ক্লাস থেকে কি উদ্ধার করসি (হা হা হা)”।


প্রিয় পাঠক, এর পরের অংশ আর লিখলাম না। শুধু বলি এর পরের কাজটা ছিল কাইয়ুম স্যারের। শান্ত প্রকৃতির কাইয়ুম স্যার পরের দিন সকালে আমাদের সাথে যা করলেন তা ছিল তার নোটের উপসংহারের মতই ‘নির্মম’। তবে খুশির কথা, স্যারের এই উপসংহারের পর কেউ আর নতুন ভূমিকা খোঁজার সাহস করেনি।




(লেখাটি উৎসর্গ করলাম রাসয়াত রহমান জিকোকে , যিনি একজন ল্যাবরেটরিয়ান। স্কুল জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটা লেখা পড়ে আমি উৎসাহিত হয়েই আজ এই ব্লগটি লিখলাম।)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:০৯
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×