বটতলার মোড়ে বাইক থামাতেই হাঁসি মুখে জাহাঙ্গীর এগিয়ে এল। কিন্তু ক্ষুব্দ কন্ঠে বলল, ‘‘কিরে নীলু, আজকাল তো তোর ছায়াও দেখা যায় না। ওরে আমরা না হয় (খিস্তি) তোর কেউ না। তোর দিদির বাড়িতে একটু বেড়াতে আসতে পারিস। আমাদের কথা না হয় ভুলেই গেছিস।” জাহাঙ্গীর আমার বাল্যবন্ধু। রাজপাড়া গ্রামটি মাঝারি আকারের। এই গ্রামে আমার পিশির বাড়ি। আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি, তখন আমার বড় এবং একমাত্র বোনের বিয়ে হয় এই গ্রামে। এখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। তবে সব চেয়ে কাছের বন্ধু জাহাঙ্গীর। দু জনে অনেক দিন সারাদিন আড্ডা দিয়েছি। এক সাথে রাত কাটিয়েছি। কত শ্লীল-অশ্লীল গল্প করেছি। আমি বললাম, ‘‘ওরে আগের মত কি আর সময় পায়, বল। অফিসে কাজ, বাসায় কাজ, গ্রামের বাড়িতে কাজ। তুই তো বা..(খিস্তি) মৌজে আছিস। অফিস নেই, বাড়িওয়ালা নেই, হরতাল নেই, অবরোধ নেই, বিউটি পার্লার নেই, ডাস্টবিন নেই, দুর্গন্ধও নেই।” আমাকে থামিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীর বলল, ‘‘তুই থাম। সুখে আছিস তো এজন্য মুখে এতো ভাবের কথার বন্যা বয়ে যাচ্ছে।” বাইকের পেছনে চেপে বলল, ‘‘তো চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে আয়, দেখি তোর ভাব কোথায় থাকে। ” আমাকে বাইক চালু করার ইশারা দিয়ে আবার বলল, ‘‘ এদিকে কি লগড় শুরু হয়েছে শুনেছিস তো?” আমি খানিকটা অবাক হয়ে বাইক চালাতে চালাতেই জিজ্ঞাসা করলাম, কই না তো, কিসের লগড়?” হো হো করে হাঁসতে হাসতে বলল,‘‘সুমিতার ছেলেটাকে এক ওঝা মোবাইলের মাধ্যমে ঝাঁড়-ফুক দিচ্ছে।” আমি বেদম অবাক হয়ে বাইক থামিয়ে ওর দিকে চরম বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালাম। বললাম, ‘‘ বলিস কি রে?” জাহাঙ্গীর আরও বেদম জোরে হো হো করে হাঁসতে থাকল। সুমিতা আমার দিদির কাকাতো ভাশুরের মেয়ে। বছর তিনেক আগে মাত্র বার-তের বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিয়ের এক বছরের মাথায় সে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করল। মাস দুই আগে সে এক বিকলাঙ্গ পুত্র শিশুর জন্ম দিয়েছে। ছেলেটির মাথার আকার দেড়টা ফুটবলের মত। হাত-পা কঞ্চির মত চিকন। শরীরের কোন অঙ্গই স্বাভাবিক না। তার নাম রাখা হয়েছে অমিত। সুমিতা তার বিকলাঙ্গ পুত্র নিয়ে এখন বাবার বাড়িতে অবস্থান করছে। জাহাঙ্গীর বলল, ‘চল, প্র্যাকটিক্যাল লগড় তোর জন্য অপেক্ষা করছে’। আমি আবারও বাইক সচল করলাম।
দিদি রান্না ঘরে ব্যস্ত। ওখান থেকেই বলল, ‘‘কিরে তোর আসতে এত দেরি হল কেন রে নীলু?” আমি বললাম, ‘‘কই দেরি হয়নি তো, ঠিক সময়েই এসেছি। দাদাবাবু কোথায়?” দিদি বলল,‘‘বাজার থেকে ফেরেনি। জাহাঙ্গীর বস, না খেয়ে যাসনে কিন্তু। নীলু প্রায় পাঁচ বছর পর এল। তুই বাড়ির কাছে আছিস, কিন্তু তুইও আসা ছেড়ে দিয়েছিস”। জাহাঙ্গীর কিছুটা থতমত খেয়ে আমতা আমতা করতে থাকল। আসলে সে আমার সাথেই এ বাড়িতে প্রথম ঢুকেছিল। আমি আসলে আমার সাথেই বেশিরভাগ সময় কাটাতো। আমার অনুপস্থিতিতে ও দিরি বাড়িতে খুব একটা আসে না। এ বাড়ির সবাই জানে মন্ত্র-তন্ত্র, ঝাড়ফুঁকে আমার ঘোর অবিশ্বাস আছে। বেশ আগের কথা। আমি এবং জাহাঙ্গীর মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ি। হঠাৎ একদিন বাবা অমরনাথ নামের এক তান্ত্রিকের আগমন ঘটল। সারা গ্রামে হৈ চৈ পড়ে গেল। তিনি অবিনাশ গোলদারের বাড়িতে উঠলেন। কাকতালীয়ভাবে আমিও তখন রাজপাড়ায় অবস্থান করছি। দেখতে গেলাম তাকে। ছ ফুট লম্বা। ধবধবে ফর্সা। মাথায় লম্বা কালো চুল। মুখে ঘন দাড়ি। লোমশ বুক। পরনে এবং গায়ে কমলা রংয়ের থান। তিনি সর্বরোগ হরণকারীর ভ’মিকায় অবতীর্ণ হলেন। বাবা অমরনাথ ঘোষণা দিলেন গ্রামের কোন মানুষের কোন রোগ-ব্যাধি থাকবেনা। কোন নারী বন্ধ্যা থাকবেনা। রাতারাতি অবিনাশের অবস্থান আকাশ ছুঁল। কিন্তু বাবা অমরনাথ কোন পদ্ধতিতে নারীদের বন্ধ্যাত্ব ঘুচাবেন সেটা ভেবে আমরা কতিপয় বিদ্যালয়গামী কিশোর বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। এদিকে সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই অমরনাথ একবোরে যাকে বলে রাজ্য জয় করে ফেলল। রবিন সাক্ষ্য দিল বাবা তার পেটে হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর সে আর দীর্ঘ দিনের পেটে ব্যাথা টের পাচ্ছে না। ঝাড়-ফুঁকের পর ভানু ঠাম্মা তাঁর বাতের ব্যাথা আগের মত টের পাচ্ছেন না। আশুতোষের সন্তানহীন বউকে নির্জন ঘরে নিয়ে ঝাড়-ফুঁক দিলেন। ঘোষনা দিলেন তার গর্ভবতী হওয়ার সম্ভবনা ১০০%। দুই-এক দিন যেতে না যেতেই আশপাশের গ্রাম থেকে দলে দলে লোকজন আসতে শুরু করল। বাবা অমরনাথ নিজ থেকে কারো কাছে কোন টাকা-পয়সা চাইতেন না। কিন্তু রোগমুক্তির আকাঙ্খী তার ভক্তকুল তাদের সাধ্যমত টাকা-পয়সা, জামা-কাপড়, নানা উপহারের বন্যা বয়ে দিল। গ্রামের এসব সরল-সোজা মানুষের সবাই ছিল অশিক্ষিত। আমি, জাহাঙ্গীর, সুবল এবং আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি কার্যকর উপায় খুঁজতে থাকলাম। হঠাৎ মাথায় একটি দুষ্টু বুদ্ধি এল। বললাম, ‘‘জাহাঙ্গীর তোকে বন্ধ্যা বউয়ের অভিনয় করতে হবে।” ও ধবধবে ফর্সা। তখনও দাড়ি গোঁফ ঠিকমত গজায়নি। গাঁয়ের বধূ হিসিবে ঠিক মানিয়ে যাবে। জাহাঙ্গীর আঁৎকে উঠে বলল, ‘‘এই আমি ওসব পারব না, অন্য বুদ্ধি বের কর।” আমি বললাম, ‘‘অনেক চিন্তা করে এই বু্িদ্ধ বের করেছি। তোকে বউ সাজতেই হবে। ভন্ড অমরনাথের মুখোস খুলতে এটাই হবে মোক্ষম মারণাস্ত্র। তুই না করিসনে।” সুবল বলল, ‘‘আরে বই সাজা তো অত সহজ না। শাড়ি পাবি কোথায়? আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতেই অমরনাথের ভক্ত গিজগিজ করছে। তাছাড়া বউয়ের মত শাড়ী ও পরতে পারবে নাকি?” আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। একটি শাড়ি দরকার। শাড়ী কোথায় পায়। তারপর আবার গাঁয়ের বধূও মত করে শাড়ী পরার ঝামেলা। জাহাঙ্গীর কি শাড়ী ঠিকঠাক পরতে পারবে? মহা ঝামেলা তো। অমরনাথের উপর রাগটা যেন আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ উত্তর পাড়ার আশাদিও কথা মনে পড়ে গেল। তিনি আমাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি খুব গুছিয়ে শাড়ী পরেন। কিন্তু তিনি কি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন? ও বাড়িতে কি ভন্ড অমরনাথের ভক্তকুল নেই? জাহাঙ্গীরকে বললাম ‘চল আশাদির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।সুবল বাড়ি চলে গেল। আশাদি সব শুনে রাজি হয়ে গেলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোরা কি পারবি সব ঠিকমত করতে? শেষে আবার লেজে গোবরে না করে ফেলিস’। দিেিক আশ্বস্ত করে চলে এলাম।
উত্তেজনায় রাতে ঘুম হল না। পরদিন সকাল নয়টায় আশাদির ঘরে পৌছলাম। জাহাঙ্গীর আজ জীবনের প্রথমবার শেভ করেছে। ওকে দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। ওকে শাড়ি পরাতে আশাদি আধা ঘন্টা সময় নিলেন। তিনি বললেন, ‘তোদেও সাথে আমিও যাব। দেখি শেষমেষ কি হয়। তোরা আবার প্যাদানি খাস কি না সেটাই ভয়। জাহাঙ্গীর লম্বা ঘোমটা টেনে আশাদিও ঘর থেকে বের হল। কপালে লাল টকটকে সিঁদুরের ফোটা। আমি যেন কেম প্রেম প্রেম অনুভব করলাম। আশাদির মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও কে রে আশা?’ আশাদি উত্তর দিলেন, ‘ও আমার পানপ্রামের বান্ধবী লতা। ও এমনিতেই লাজুক, তারউপর নতুন বিয়ে হয়েছে। মা আমি ওকে একটু এগিয়ে দিতে যাচ্ছি।’ বাড়িতে থেকে বেরিয়ে আমাকে বললেন, ‘নীলু, খুব সাবধান। ভুল হলে মার একটাও মাটিতে পড়বে না। তুই তো অন্য গাঁয়ের ছেলে। আমাদের তো এ গাঁয়েই থাকতে হবে।’ আমি বললাম, ‘তোমার কথা আলাদা। তুমি তো কয় দিন পর বিয়ে করে অন্য গাঁয়ে চলে যাবে।’ আশাদি বললেন, ‘ইয়ারকি রাখ। মাথা ঠিক রাখিস। জাহাঙ্গীর, মেয়েলি কন্ঠে কথা বলিস।’
সকাল দশটার মধ্যে অবিনাশের বাড়ি পৌছালাম। সুবল, সুমন, কামরুল আগেই উপস্থিত ছিল। ইতিমধ্যেই কয়েক শ লোক হাজির চিকিৎসাসহ নানা সমস্যা সমাধানের আশায়। একজন মহিলা এসেছে পরকীয়া প্রেমিকার হাত থেকে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য। ভন্ড চরিত্রহীন অমরনাথ তার দিকে তাকিয়ে শরীরের গড়ন দেখছিল। আমি এবং জাহাঙ্গীর আলাদাভাবে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিলাম। ওরা আমার কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিওে, জাহাঙ্গীর কোথায়?’ আমি বুঝলাম চমৎকার মেকাপ হয়েছে। বন্ধুরাই ওকে চিন্তে পারছে না। মহিলার সমস্যার সমাধান দেওয়ার আগেই জাহাঙ্গীর হঠাৎ মেয়েলি কন্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা, বাবা আমাকে বাঁচান।’ আমি বন্ধুদের ইশারা দিলাম। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম জাহাঙ্গীর রীতিমত কাঁদছে। ওর অভিনয় দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ভন্ড অমরনাথ ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোর কি হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন?’ জাহাঙ্গীর কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘আমার তিন বছর বিয়ে হয়েছে। এখনো বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। শ্বশুর বাড়ির লোকজন অত্যাচার করে। আমার স্বামী আমাকে মারে। ওরা আমাকে কাল বলেছে তিন মাসের মধ্যে পেটে বাচ্চা না এলে আমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেবে, আর আনবে না। আমার স্বামীকে আবার বিয়ে দেবে। বাবা আমার কি হবে?’ সবাই একসাথে চুপ মেরে গেল। সবার দৃষ্টি এখন জাহাঙ্গীরের দিকে। আমার বুকের মধ্যে ঢেকির আওয়াজ পেলাম। পরিস্থিতি এখন ক্লাইমেক্সের দিকে যাচ্ছে। বাবা অমরনাথের চোখ বোধ হয় লোভে চক চক করে উঠল। তিনি বললেন, ‘তোর কোন ভয় নেই। একমাসের মধ্যে তোর পেটে বাচ্চা আসবে। তোকে স্পেশাল মন্ত্র দিয়ে ঝেড়ে দেব।’ চারিদিকের আওয়াজ আবার ফিরে এল। সবাই বাবার কৃপা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত। বাবা অমরনাথ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তিনি কাজে মন দিতে পারছেন না। কারো সমস্যাই মন দিয়ে শুনছেন না। হঠাৎ তিনি জাহাঙ্গীরকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর নাম কি? তোর স্বামীর নাম কি? কোন গ্রাম থেকে এসেছিস?’ জাহাঙ্গীর উত্তর দিল, ‘আমার নাম শ্যালী দত্ত। আমার স্বামীর নাম অসিত দত্ত’। অমারনাথ পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোদের গোত্র কি?’ জাহাঙ্গীরের উত্তর, ‘গোত্রের নাম জানি না।’ বাড়ি ভরতি মানুষ। এর মধ্যেই ভন্ড অমরনাথ জাহাঙ্গীরকে বললেন, ‘আই মা।’ এই বলে তাকে একটি ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। চারিদিকে এক ধরণের নীরবতা নেমে এল। এক মিনিট যেতে না যেতে ঘরের মধ্য থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ আসতে শুরু হল। জাহাঙ্গীরের গলা শোনা গেল, ‘শুয়োরের বাচ্চা ভন্ডামী আজ ছুটিয়ে দেব। তোর কত বড় সাহস তুই আমাদের গ্রামে এসেছিস তোর বদমাইশী খায়েশ মেটাতে।’ হঠাৎ দরজা খলে গেল। জাহাঙ্গীর ডাকল, ‘নীলু, সুবল এদিকে আয়।’ দরজায় জাহাঙ্গীর দাঁড়িয়ে। পরণে মেটে রংয়ের আন্ডারপ্যান্ট।গায়ে আশাদির লাল ব্লাউজ। শাড়ী খুলে ফেলেছে। এখনো কপালে লাল সিঁদুরের টিপ জ্বলজ্বল করছে। ওদিকে ভন্ড অমরনাথের দেখার মত একখানা চেহারা হয়েছে। ভয়ে মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপছে। বারবার বলছে, ‘বাবারা, আমাকে মেরো না। আমাকে যে যা দিয়েছে সব ফেরত দিয়ে দেব।’ রাগান্বিত লাল চোখে তাঁর দিকে এগোতেই আমার পা জড়িয়ে ধরল। আমরা তিন বন্ধু ওকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলাম। চারিদিকে ব্যাপক চিৎকার-চেচামেচি শুরু হল। তবে মনে হল সবাই ভন্ড তান্ত্রিক বাবা অমরনাথের অপরাধ বুঝতে পারল। কেউ তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে এল না। তাঁকে বেদম উত্তম মধ্যম দিয়ে জুতোর মালা পরিয়ে গ্রাম থেকে বের কওে দেওয়া হল। সেই থেকে এই গ্রামের সবাই জানে আমি কতটা ঝাড়-ফুঁকের বিরোধী।
কোন এক পাগলা বাবা যিনি ইতিমধ্যেই মেবাইল বাবা নামে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন, তিনি অমিতকে প্রতিদিন নিয়ম করে দু’বেলা ঝাঁড়ফুক দিচ্ছেন। প্রথমবার সকালে এবং দ্বিতীয়বার সন্থ্যায়। ঝাড়-ফুকের সময় মেবাইল ফোনটি অমিতের গাঁয়ে ছুঁয়ে রাখতে হয়। মেবাইল বাবার নির্দিষ্ট কোন ফি নেই। মোবাইল রিচার্জ, মেবাইল ব্যাংকিং কিংবা সশরীরে তাঁর কাছে যেয়ে যে যা দেয় তাই তিনি নেন। অমিতের ঝাড়-ফুকের ফি হিসেবে একদিন পর পর মেবাইল রিচার্জ দেওয়া হয়। অমিতের দাদু আমাকে জানাল ঝাড়-ফুঁক চলাকালীন অমিত বিশেষভাবে নড়াচড়া করে এবং তাতে বোঝা যায় কাজ হচ্ছে। তাঁর কথায় আমি হো হো করলে তিনি বললেন, ‘অবিশ্বাস করবেন না দাদা, এখনো পৃথিবীতে অনেক কিছু আছে যা বোঝা মানুষের অসাধ্য।’ জাহাঙ্গীরও হাঁসছিল। হঠাৎ আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এল। আমি বললাম ‘তা ঠিক। কত কিছুই তো অজানা আছে। কিঠাছে তাহলে সন্ধ্যায় এই মেবাইল বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েন তো।’ জাহাঙ্গীরকেও সন্ধ্যায় আসতে বললাম। সন্ধ্যা সাতটা থেকে অমিতের দাদু মোবাইল বাবার মেবাইলে সংযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কল ওয়েটিং। ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীর উপস্থিত হয়েছে। প্রায় কুঁড়ি বার চষ্টোর পর সংযোগ পাওয়া গেল। অমিতের দাদু প্রথমেই কুশল বিনিময় করে বললেন, ‘বাবা আমার এক আত্মীয় আপনার সাথে কথা বলবে।’ সম্ভবত ওপাশ থেকে সম্মতি জানানো হল। এবার শুরু হল ঝাড়-ফুঁক। মেবাইল ফোনটি লাউড স্পিকারে দিয়ে অমিতের গাঁয়ের সাথে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। আরবীতে ঝাড়-ফুঁক চলছে। আমি তার মথা-মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। প্রায় তিন মিনিট চলল। আমিত অন্য সময়ের চেয়ে বেশি নড়াচড়া করছিল। খুবই স্বাভাবিক। মেবাইলের শব্দ তরঙ্গই এর কারণ। ঝাড়-ফুঁক শেষ হলে মেবাইলটি আমার কাছে দেওয়া হল। আমিও বাবাকে সালাম দিয়ে আলাপ শুরু করলাম। বললাম ‘পৃথিবীটা বড় কষ্টের জায়গা বাবা।’ বুদ্ধিমান ভন্ড মেবাইল বাবা আমার কেসটা ধরে ফেলল; বলল, ‘আমি জানি তোর বুঁকের ভিতর কি হচ্ছে। কোন সমস্যা নেই। তোর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’ আমি বললাম, ‘বাবা আমি আপনার সাথে একটু নিরিবিলি কথা বলতে চ্ইা।’ বাবা বললেন, ‘ঠিকাছে তুই আমাকে অন্য এক সময় ফোন করিস। তোর নাম কি?’ আমি বললাম, ‘আমার নাম সুনীল রায়। সবাই আমাকে নীলু বলেই চেনে। আপনিও আমাকে নীলু বলে ডাকতে পারেন।’ বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে তুই তাহলে পরে ফোন করে সব খুলে বলিস’। তিনি সংযোগ কেটে দিলেন। আমি তাঁর মেবাইল নম্বরটা আমার মেবাইলে সেভ করলাম। জাহাঙ্গীর হাঁসি ঠেকানোর জন্য মুখ চেপে ধরে আছে। ওকে বললাম দোস্ত এবারের কেস একটু ভিন্ন। এ ব্যাটা তো দূরে থাকে। তাঁর আস্তানায় যেয়ে আঘাত করা সহজ হবে না। তবে আগে তাঁর সঠিক ঠিকানা বের করতে হবে।’ আমি অমিতের দাদুর কাছে মেবাইল বাবার ঠিকানা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেও তাঁর সঠিক ঠিকানা জানে না। শুধু বললেন বাবা মাগুরায় থাকেন। এর বেশি জানেন না। তিনি তাঁর মেবাইল নম্বও পেয়েছেন তাঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে। জাহাঙ্গীর বলল, ‘আগে তাাঁর ঠিকানাটা জান তারপর দেখা যাক কি করা যায়। জাহাঙ্গীর ব্যস্ত ছিল। ও চলে গেল। রাত সাড়ে এগারটায় ভন্ড বাবাকে ফোন করলাম। ফোন রিসিভ করেই প্রায় ৩০ সেকেন্ড তিনি আরবীতে কি সব বকে গেলেন।’ এরপর সালাম দিলেন। আমি সালাম দিলাম। বললাম, ‘বাবা আমি তো শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার এ জীবনের কোন মূল্য নেই।’ আমি কি বলতে চাচ্ছি তা বুঝে নিয়ে মেবাইল বাবা বুঝে নিয়ে বললেন, ‘ওওে তুই সব ফিরে পাবি। আমার কাছে যখন এসইে পড়েছিস আমার উপর ভরসা রাখ।’ আমি অসায় কন্ঠে বললাম, ‘ কোন উপায় আছে বাবা?’ তিনি বললেন, ‘তোকে একটি পাথর ধারণ করতে হবে।’ আমি বললাম, ‘সে পাথর আমি কোথায় পাব বাবা?’ তিনি বললেন, ‘ওরে আমার কাছে সব আছে। আমি কামাক্ষা থেকে পাথর নিয়ে এসেছি।’ আমি বললাম, ‘সে পাথরের কি অনেক দাম বাবা?’ তিনি কিঞ্চিত হেসে বললেন, ‘দাম আছে। তবে আমি তো কোন লাভ করি না, এর কেনা দাম ১০০০০ টাকা।’ আমি বললাম, ’ঠিক আছে বাবা, আমাকে কোথায় আসতে হবে?’ মনে মনে বললাম তোর জারিজুরি শেষ দিকে পৌছে যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘মাগুরা পানপাড়ার উত্তরপাশ ঘেষে নদীর নবগঙ্গা নদীর ধার দিয়ে একটি রাস্তা গেছে। ঐ রাস্তায় এসে আমার নাম বললেই যে কেউ আমার আস্তান দেখিয়ে দেবে। আমার নাম খলিলুদ্দিন পাটোয়ারী। তবে ঐ নামে আমাকে কেউ চেনে না। মেবাইল বাবা নামেই সবাই চেনে।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে বাবা, কাল দেখা হচ্ছে। গুড নাইট।’ তিনি বললেন, ‘খোদা হাফেজ।’
হাফিজ খুব নরম স্বভাবের মানুষ। ও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। ও থাকতো জহুরুল হক হলে আর আমি জগন্নাথ হলে। তবুও ওর পুলিশের চাকরি হয়ে গেল বিসিএস-এ। বর্তমানে ও মাগুরা পুলিশের একজন এএসপি। রাত সাড়ে বারটায় ওকে ফোন করলাম। ও ফোন রিসিভ করলে আমি বললাম, ‘কি রে ঠুলা। এখনো ঘুমোসনি? টিভি দেখিস নাকি।’ ও বলল, ‘কেমন আছিস দোস্ত? আমার অফিসে আসতে চেয়েও আসলি না। বদলি হয়ে দূরে চলে গেলে। তখন আফসোস করিস।’ আমি বললাম, ‘কাল আসব। আচ্ছা তুই কি মাগুরা শহরের মেবাইল বাবাকে চিনিস? ও হাহা করে হাসতে হাসতে বলল, ‘না তো, এরকম কোন নাম তো শুনিনি।’ আমি বলল, ‘তা তো শুনবি না। এজন্যই বাংলাদেশের আইন-শৃঙখলার এই অবস্থা। একটা লোক দিনের পর দিন মানুষ ঠকাচ্ছে আর তু শালা ঠুলা তার নামই জান না। তুই কাল পুলিশি প্রস্তুতি নিয়ে থাকবি। আমি আমি আসলে মেবাইল বাবার কাছে যেতে হবে।’ হাফিজ বলল, ‘ঠিক আছে। দেখা যাক বিষয়টা কি’। আমি গুডনাইট বলে সংযোগ কেটে দিলাম। সকালে জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করে ওকে আমার সাথে মাগুরায় যেতে বললাম। ওর বিশেষ কাজ থাকায় ও যেতে পারল না। দিদিওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লোকাল বাসে উঠলাম। সাড়ে এগারোটায় হাফিজের অফিসে পৌছালাম। ও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। চা পর্ব শেষ হতেই বলল ‘চল তোর মোবইল বাবার কাছে’। আমরা রাস্তায় চলে এলাম। আমি বললাম, ‘কি রে ফের্স নিবি না।’ ও আমার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘তুই চল।’
মেবাইল বাবার চেহারাটা শুকনো। গাঁয়ের রং কাল। মনে হল গাঁজা টানার অভ্যাস আছে। কাঁচা-পাঁকা লম্বা দাঁড়ি, তবে খুব ঘন নয়। গোঁফ আছে। গাঁজার ধোঁয়ায় নাকের নীচের গোঁফ তামাটে বর্ণ হয়ে গেছে। পরণে সাদা লুঙ্গি। গাঁয়ে একটি সাদা ওড়না জাতীয় কাপড় পেচানো। তিনি মেঝেতে জায়নামাজ পেতে বসে আছেন। তাঁর সামনে শতরঞ্চির উপর তাঁর ভক্তকুল বসে আছে। আমি আর হাফিজও শতরঞ্চিতে বসলাম। হাফিজ সাদা পোশাকে আছে। ভক্তরা বাবার কাছে তাদের সম্যার কথা জানাচ্ছে। হাফিজ আমাকে ইশারা দিল। আমি নাটকীয় ভঙ্গিতে কিছুটা ব্যঙ্গাত্বক সুরে বললাম, ‘বাবা আমি নীলু, আপনার মহামূল্যবান পাথর নিতে এসেছি।’ আমার বাচন ভঙ্গিতে তিনি কিছুটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে আমার দিকে তাকালেন। বাম পাশে থাকা থলি থেকে একটি বেগুনি রংয়ের প্লাস্টিক বস্তু বের করে আমার দিকে ছুড়ে দিলেন। হাফিজ বস্তুটি হাতে নিয়ে বলল, ‘এই ব্যাটা চিট, এই প্লাস্টিকের দাম দশ হাজার টাকা?’ মেবাইল বাবার কতিপয় সাগরেদ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু তারা আমাদের কাছে পৌছানোর আগেই ভক্তদেও কয়েকজন ওদেরকে ধরে ফেলল। তারা রীতিমত ব্যাগ থেকে শটগান বের করল। মেবাইল বাবাকে গ্রেফতার করা হল। বুঝলাম ওরা সাদা পোশাকের পুলিশ। হাফিজ ওদের আগেই ভক্তের বেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি হাফিজকে বললাম, ‘এদেশে পুলিশ, গোয়েন্দা থেকে কি হবে? তোরা কি আসলে কোন কাজের?’ ও বলল, ‘বাসায় চল সীমা তোর জন্য অনেক কিছু রেঁধেছে।,
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১২ রাত ১২:১৭