somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবাকে

১৯ শে জুন, ২০১৬ রাত ২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একসময় আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিলো বাবার সাথে ছেলেদের কোন আবেগপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারে না। ভাবতাম গৃহ যদি হয় একটা রাজ্য, বাবার ভুমিকা সেখানে কখনো শাসনকর্তার, আর কখনো বা কোতোয়ালের। আর সন্তানেরা সেখানে যখন তখন শুধুই অপরাধী। কেবল পান থেকে চুন খসার অপেক্ষা।

গম্ভীর মেজাজের বাবা যে আবার মা’র মতো তাঁর সন্তানদের অনেক আদর করেন বা করতে পারেন, এটা কোনোদিন বাস্তবে কল্পনা করা তো দূরের কথা, স্বপ্নেও ধরা পড়েনি আমার কাছে।

‘বাবাকে বলে দেবো’ কথাটা শুনলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো আমাদের তিন ভাইয়ের। মা দেদার ব্যবহার করতেন এই ব্রম্মাস্ত্রটা আমাদেরকে বাগে রাখতে। বিশেষত যখন আমাদের বাড়াবাড়ি নিজে আর সামাল দিতে পারতেন না।

তাই বলে বাবা কি কথায় কথায় আমাদের শাস্তি দিতেন! মোটেও কিন্তু না। কবে সর্বশেষ শাসনকর্তার অধিকার প্রয়োগ করেছিলেনে আমার উপর, একদম মনে করতে পারিনা। এসএসসি পরীক্ষার আগে একবার পড়ায় ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলতে লেগে গিয়েছিলাম। কোন কারণে সেদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছিলেন বাবা। ব্যাট করছি, হটাৎ দেখি দর্শকের ভিড়ে তিনি। একদৌড়ে পাশের আঁখের খেতে ঢুকে হারিয়ে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায়, কম্পিত বক্ষে বাসায় ঢুকি। নিশ্চিত ছিলাম, খবর আছে। আশ্চর্য, একটা কথাও বলেননি বাবা। (আজ নিজে বাবা হয়ে বুঝতে পারি, সেদিন রেহাই পেয়েছিলাম অন্য কোন কারণে নয়। সন্তানের ভীত সন্ত্রস্ত রূপ দেখে পুত্রবৎসল পিতার বুকটা হয়তো হাহাকার করে উঠেছিলো।)

হয়তো বাবা সন্তানদের আদর ভালোবাসা উজাড় করে দেবার সম্পূর্ণ এখতিয়ার দিয়ে রেখেছিলেন মা’কে। আর বাড়ির শৃঙ্খলা রক্ষার্থে গম্ভীর মেজাজের আড়ালে নিজের ভালোবাসাগুলো সংগোপনে লুকিয়ে রাখতেন।

মা’র কাছ থেকে দিনের পর দিন একেকটা আবদার আদায়, ঘুড়ি কেনা বা কবুতর পোষা, বগুড়ায় গিয়ে অরুন বরুণ কিরণমালা সিনেমা দেখে আসা, কি বোকা, একবারো ভাবিনি ভাইয়েরা, মায়ের প্রতিটি সন্মতির পিছনে বাবার মৌন অংশগ্রহণ ছিলো।

কি বুদ্ধুই না ছিলাম আমরা একেকটা ভাইগুলো! বুঝতেই পারিনি, ওই যে আমদের একাগ্রচিত্তে ভালোবেসে যেতেন মা, তার ভিত্তিটা তৈরী করে দিতেন আমাদের গম্ভীর মেজাজের বাবা, মা এবং আমাদেরকে ঘিরে একধরণের নিরাপত্তা বলয় নিশ্চিত করে। কি থ্যাঙ্কলেস দায়িত্ত্ব পালন করে জীবন পাড়ি দিয়েছেন আমাদের বাবা।

১৯৮০ সালে চাকরি নিয়ে বিদেশ যাবার সুযোগ হলো। এয়ারপোর্টে এসে আমাকে জড়িয়ে মা’র সে কি কান্না! ওদিকে আমাদের গম্ভীর মেজাজের বাবার নির্বিকার মুখ। ব্যস্ত রইলেন আমার বাক্স প্যাটরার তদারকিতে আর কোটের পকেটে পাসপোর্ট, অল্প কিছু ডলার আর বোর্ডিং কার্ডের ছহিসালামত অবস্থান নিয়ে।

পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার সময় আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা আরেক পশলা কাঁদলেন। বাবাকে সালাম করে উঠতেই চোখাচোখি হল তাঁর সাথে। একবারও চোখের পাতা কাঁপল না বাবার। বললেন, সাবধানে থাকবি কিন্তু। শাসনকর্তা যে শাসনের আওতা বিদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চান, বুঝে গেলাম।

তখন সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি টেলিফোন ব্যবস্থা ছিলো না। ডাক যোগাযোগই একমাত্র ভরসা। দিনদশেক পর বাড়ি থেকে চিঠি এলো। একটি খামে অনেকগুলো চিঠি। একটা বাবারও, আমাকে লেখা বাবার প্রথম চিঠি। নিশ্চয়ই শাসনকর্তার ফরমানে ভর্তি। তাই রেখে দিলাম খামেই।

মা লিখেছেন, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছিস তো বাপ। রাতে খেয়েটেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাবি। কোন অনিয়ম করবি না কিন্তু।
বড়ভাই জানিয়েছে, তোর ইস্তফা মঞ্জুর করেছে আইসিআই। নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে যা।

ছোটভাইটি লিখেছে, তোমার বিছানাটি এখন থেকে আমার দখলে। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছি।

ছোট বোনটি জানিয়েছে, বিচিত্রা ‘দুবাইওয়ালা’ প্রচ্ছদকাহিনী বের করেছে। বাসায় খুব হিট। মা বাবা পরস্পরকে ‘দুবাইওয়ালার বাবা’ এবং ‘মা’ বলে সম্বোধন করছেন। ইতিতে বোন নিজেও লিখেছে, ‘দুবাইওয়ালার বোন’।

মা আরো জানালেন, বাবা রাতে ঠিকমতো ঘুমাচ্ছেন না। না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে বিদেশে কে আমাকে জাগিয়ে দেবে, এই তাঁর চিন্তা। বোনটা লিখেছে, এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে আমরা সবাই বাবাকে লুকিয়ে চোখ মুছতে দেখেছি। ছোটভাইটিও লিখেছে, বাবার কাণ্ড দেখো, ডাইনিং টেবিলে তোমার চেয়ারটায় কাউকে বসতে দিচ্ছেন না।

মনটা আনমনা হয়ে গেলো। বাবার চিঠিটা বের করলাম। কল্পনায় তখনও চশমা পরা বাবার গুরুগম্ভীর প্রতিচ্ছবি।
প্রথম লাইনটা শুধু পড়তে পারলাম। বাকিটা ভেসে গেলো চোখের জলে। অনেক অনেক আদর জানিয়েছেন বাবা আমাকে। আমার সেই গম্ভীর মেজাজের বাবা।

ইন্দোনেশীয় সহকর্মীটা সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এলো। বললো, নিশ্চয় মাদার’স লেটার, রাইট?

ইট ইজ ফ্রম মাই ফাদার, বললাম তাকে। ফিসফিসিয়ে নিজেকে বললাম, বাবা, তুমি আমার অনেক প্রিয় বাবা।

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৬ রাত ২:০০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×