somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাইকো

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘বৃষ্টির মধ্যে বাসায় যাবেন কিভাবে?’ প্রশ্ন করলেন ডাক্তার সোহরাব হোসেন।

বেহালাটা ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে তার দিকে তাকালাম আমি। বললাম, ‘চলে যাবো। বৃষ্টি আমার জন্য কোন সমস্যা নয়।’

‘আমি পৌছে দেবো?’ মৃদু হাসি নিয়ে বললেন তিনি, ‘আমার সাথে গাড়ি আছে।’

‘নো থ্যাংকস,’ পাল্টা হাসি উপহার দিলাম আমি, ‘ঠিক যেতে পারবো। আপনাকে আর কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। শোতে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ।’

ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে বেড়িয়ে এলাম আমি। মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে, অথচ বিকেল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টির কারনে গভীর রাত বলে মনে হচ্ছে।

*******

রিংটোনের তীক্ষ্ণ শব্দে চমকে উঠলাম আমি, আর সেইসাথেই ছিড়ে গেলো দুটো তার। একপ্রকার বিরক্ত হয়েই সেলফোনটা তুলে নিলাম চোখের সামনে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটা নাম।
অলীন!

কলটা রিসিভ করলাম আমি। অলিনের মিষ্টিস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে।

-‘কোথায় তুমি?’

-‘বাসায়। শো ছিল বিকেলে, সেটা শেষ করে সোজা বাসায় চলে এসেছি।’

-‘আমার এখানে আসতে পারবে?’

-‘কোথায়?’

-‘আমার বাসায়।’

-‘এসময়? কেন?’

-‘কাজ আছে। বলেছিলাম না, একটা রেকর্ডিং করবো তোমার সাথে, বেহালা আর গিটারের একটা কম্পোজিশন! সেটা নিয়ে বসতে চাইছিলাম।’

-‘ঠিক আছে, আসছি। বিশ মিনিট।’

রাত খুব একটা হয়নি। মাত্র ন’টা বাজে। এখনো বৃষ্টি থামেনি।

অবশ্য বৃষ্টি আমার জন্য অসুবিধে করতে পারেনি কখনোই। আমি বৃষ্টি ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বৃষ্টির দিনে বেহালা বাজাতে।

হাতে থাকা বেহালাটার দিকে তাকাচ্ছি আমি। এতক্ষণ বেশ ছড় টানছিলাম। দুটো তার ছিড়ে যাওয়ার এখন আর বাজানো সম্ভব নয় এটা। নতুন তার লাগবে।

বিশ মিনিটের জায়গায় তেইশ মিনিট লাগলো বিল্ডিংটার সামনে আসতে। কিচ্ছু করার নেই। বৃষ্টিভেজা রাতে রিক্সা পাওয়া সমস্যা।

অলীন থাকে আটতলায়। দ্রুত লিফটের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। লিফটে করে আটতলায় এসে দাঁড়ালাম ওর ফ্ল্যাটের সামনে। ভেজা হাতে কলিংবেলে চাপ দিলাম।

হাসি মুখে দরজা খুলে দিলো অলীন। ভেতরে ঢুকতে ইশারা করলো। শার্টটা একটু ঝাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমি।

পেছনে দরজা লাগিয়ে দেয়ার শব্দ পাওয়া গেলো এসময়। সামনে একজোড়া সোফা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে পা বাড়ালাম আমি।

ঠিক সেই সময় আমার ঘাড়ের পেছনে কি যেন বিঁধল। অনেকটা পিঁপড়ের কামড়ের মতো ব্যাথা অনুভব করলাম আমি। দ্রুত ফিরে তাকালাম পেছনের দিকে। সেখানে অলীন দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটা সিরিঞ্জ!

ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এলো আমার চোখের সামনে।

*******

ভোঁতা একটা শব্দে সচকিত হলাম আমি। একটু যেন কেঁপে উঠলাম, সেই সাথে চোখ খুলে তাকালাম।

এটা সম্ভবত অলীনের বেডরুম। খাটের পাশেই একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে আমাকে। সামনে একটা টেবিল। পুরো রুমে আমি ছাড়া আর কেউ নেই।

মাথার পেছনে চিনচিনে ব্যাথা করছে কেন যেন। ডান হাত উঠাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, কোথাও আটকে দেয়া আছে সেটা। বাহাত এবং দু পায়েরও একই অবস্থা।

পায়ের দিকে নজর দিলাম আমি। একটা ফ্লেক্সিকাফ দিয়ে আটকানো রয়েছে পা দুটো। হাতদুটো একটু নড়াতেই বুঝলাম, একই কাজ করা হয়েছে সেখানেও।

‘জ্ঞান ফিরলো তাহলে?’ অলীনের মিষ্টি কন্ঠটা শোনা গেলো এসময়। দ্রুত মাথা তুলে তাকালাম আমি। একটা ট্রে হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে টেবিলের উপর ট্রেটা রাখলো ও। তারপর আরেকটা চেয়ার টান দিয়ে বসলো।
ট্রে থেকে জিনিসগুলো একটা একটা করে টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে রাখছে ও। জিনিসগুলোর দিকে নজর দিলাম আমি। একটা সিরিঞ্জ, একটা অ্যাম্পুল, কাঁচি, স্ক্যালপেল, কয়েকটা পিটন, একটা বড় চাপাতি, একটা ছোট ছুড়ি, কয়েকটা আলপিন, একটা হাতুরী আর তিনটে বড় বোতল দেখা যাচ্ছে সেখানে।

‘কি হচ্ছে এখানে অলীন?’ দ্রুত বলে উঠলাম আমি, ‘আমাকে এভাবে আটকে রাখার কারন কি?’

ট্রে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। মুখে বললো, ‘কয়েকটা স্ট্রিং দরকার আমার।’

‘স্ট্রিং?’ অবাক হলাম আমি, ‘কিসের স্ট্রিং?’

‘আমার গিটারের জন্য,’ ওর বুক সেলফের উপর ট্রেটা রাখলো ও, তারপর একটা ডায়েরী বের করলো বইগুলোর মাঝখান থেকে, ‘আপাতত একটা হলেই চলে। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্যেও রাখতে হবে কিছু। তাই এতোকিছুর আয়োজন করছি।’

‘মানে কি?’ বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ছে আমার, ‘কি বলছো এসব?’

ডায়েরীটা হাতে নিয়ে আমার আগের চেয়ারটায় এসে বসলো ও। টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কলম বের করে ডায়েরীটা খুলে সেখানে কিছু একটা লিখে টেবিলের এক কোনায় রেখে দিলো সেটা। তারপর তাকালো আমার দিকে।

‘স্পষ্ট করে বলো তো,’ যতোটা সম্ভব শান্তগলায় প্রশ্ন করলাম আমি, ‘আসলে কি করতে চাইছো তুমি?’

‘বললামই তো,’ ভ্রু কুঁচকে উঠলো ওর, ‘আমার গিটারের জন্য কিছু স্ট্রিং দরকার।’

‘এর সাথে আমার সম্পর্ক কি?’ কাতর গলায় বলে উঠলাম আমি।

‘সম্পর্ক আছে,’ ঠান্ডাগলায় বললো ও, ‘গিটারের জন্য পারফেক্ট স্ট্রিং ব্যবহার করি আমি। আর সেগুলোর জন্য ব্যবহার করি মানুষের অন্ত্র।’

‘কি?’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘মানুষের অন্ত্র?’

‘হ্যাঁ,’ মৃদু হেসে উঠলো ও, ‘এতে এতো অবাক হবার কি আছে? মানুষের অন্ত্র দিয়ে বুঝি আগে কখনো বাদ্যযন্ত্রের স্ট্রিং বানানো হয়নি!’

‘আমি অন্তত শুনিনি,’ দাঁতে দাঁত চেপে বললাম আমি।

‘তাই?’ চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে ওর, ‘তাহলে শুনে নাও। গিটার বলো বা তোমাদের বেহালা, এগুলোর স্ট্রিং তৈরির জন্য মানুষের অন্ত্র পারফেক্ট। অবশ্য এখন আর মানুষের অন্ত্র ব্যবহার করেনা কেও। আগে ব্যবহার করতো এসব। প্রাচীন মঙ্গোলিয়াতে বেহালার মাথা তৈরির জন্য গাধার মাথার হাড় ব্যবহার করেছেন অনেকে, আর তারের জন্য পরাজিত যোদ্ধাদের অন্ত্র। অস্থির জিনিস হতো সেগুলো। একই জিনিস ব্যবহার করা হতো ভিয়েতনামেও, কিন্তু বিষয়টাকে বর্বরতা আখ্যা দিয়ে এখন ব্যবহার করা হয় মহিষের অন্ত্র। ভিয়েতনামে বিষয়টা শুরু করেন সম্রাট লি থান তঙ। তার এক ভৃত্য পরাজিত যোদ্ধাদের অন্ত্র দিয়ে বেহালা জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের তার তৈরী করে সেটা সম্রাটকে বাজিয়ে শোনান। জিনিসটা সম্রাটের এতোই ভাল লাগে যে, আরো কিছু বাদ্যযন্ত্র তৈরী করার নির্দেশ দেন তিনি। এখনো ভিয়েতনামের ভ্যান মিইয়ু বা টেম্পোল অব লিটারেচার-এ এরকম দুটো বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষিত আছে।’

এই বলে উঠে দাঁড়ালো ও। হেটে আবার শেলফের দিকে এগিয়ে গেলো। সেখান থেকে বের করলো পাঁচটা মোম আর কিছু কাপড়। তারপর আবার এসে বসলো চেয়ারটাতে।

‘তাই নাকি?’ দ্রুত বলে উঠলাম আমি, ‘জানা ছিল না তো!’

‘এখন জানলে,’ টেবিল থেকে সিরিঞ্জটা তুলে নিলো ও, ‘যাইহোক। এখন আমাকে আমার কাজ করতে দাও।’

‘মানে কি?’ ভ্রু কোঁচকালাম আমি, ‘তুমি কি এখন আমাকে কেটে আমার অন্ত্র বের করবে নাকি?’

‘হ্যাঁ,’ যেন খুবই অবাক হয়েছে ও, এমনভাবে বলে উঠল, ‘তাহলে শুধু শুধু তোমাকে ডেকে আনার কারন কি আমার? আর এতো কিছু সাজিয়ে রাখার কারনই বা কি?’

‘তুত-তু-তুমি?’ কথা আটকে যাচ্ছে আমার, ‘তুমি আমাকে কে-কেটে আমার অন্ত্র... পাগল হয়ে গেছো তুমি।’

‘পাগল না,’ মুখটা একটু বাঁকালো ও, ‘অবশ্য সাইকো বলতে পারো। আ পারফেক্ট সাইকো। আমার মধ্যে কিছু এবনর্মালিটি আছে। অবশ্য, ক্রেটিভ কাজগুলোতে একটু এবনর্মালিটি না হলে চলে না। পারফেক্টভাবে কাজ করতে চাইলে এটার প্রয়োজন আছে।’

‘তুমি তো এমনিতেই নামকরা গিটারিষ্ট,’ ধীরে ধীরে বলে উঠলাম আমি, ‘তাহলে এসবের কি প্রয়োজন?’

‘কে বললো প্রয়োজন নেই?’ অ্যাম্পুলটা তুলে নিয়ে দাঁত দিয়ে কামড় দিলো ও, তারপর ভাঙ্গা অংশে সিরিঞ্জটা ঢুকিয়ে ভেতরের তরল ভরলো সিরিঞ্জটাতে, ‘অবশ্যই প্রয়োজন আছে। আজ থেকে দুবছর আগেও আমি কিছুই ছিলাম না। কেউ কোন দাম দিতো না আমার কাজের। আই ওয়াজ আ বিগ জিরো দেন। আর আজ? নিজের ভেতর এই এবনর্মালিটিটা না থাকলে আজ এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না আমি। তুমি কি জানো কতো কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে এই পর্যায়ে আসতে? কতোজনকে শয়তানের কাছে বলি দিতে হয়েছে আমাকে এই কাজে? শয়তানকে খুশী না করলে কি আর আজ এই পর্যায়ে আসতে পারতাম আমি?’

‘তুমি?’ কথা খুঁজে পাচ্ছি না আমি, ‘তুমি, তুমি শয়তানের উপাসক? শয়তানকে খুশী করার জন্য এসব করে বেড়াচ্ছো?’

‘হ্যাঁ,’ যেন এটা কোন স্বাভাবিক বিষয় এমনভাবে বলে উঠলো ও, ‘তা নয়তো কি?’

‘এর আগে,’ শান্তভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম আমি, ‘আর কতোজনকে খুন করেছো তুমি?’

‘তা জেনে তুমি কি করবে?’ অ্যাম্পুল আর সিরিঞ্জ টেবিলের উপর রেখে দিলো ও, তারপর কাপড়গুলো মেঝেতে বিছিয়ে তার উপর মোমগুলো রেখে জ্বালিয়ে দিলো। তারপর বললো, ‘এসবের চেয়ে এখন তোমার সৃষ্টিকর্তার নাম জপ করো, সেটাই বরং তোমার জন্য ভাল হবে।’

সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে আলোর দিকে তুললো ও, তারপর ভেতরের তরলের পরিমাণ দেখতে লাগলো।

দ্রুত মাথা খাটাচ্ছি আমি। বেশী দেরী করা যাবে না। যা করার দ্রুত করতে হবে, তা না হলে মারা পড়বো। অলীন মেয়েটা যে এরকম সাইকো, তা আগে জানা ছিল না আমার। যেভাবেই হোক ছোটাতে হবে নিজেকে।

কিন্তু কিভাবে?

উঠে দাঁড়িয়েছে অলীন, চেয়ার টান দিয়ে ঘুরে আমার সামনে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে ঝুঁকছে আমার হাতের দিকে।

‘যা করার এখনই, নাহলে কখনোই নয়!’ মনের ভেতর এলার্ম বেজে চলেছে আমার।

দুহাতের তালু চেয়ারের মধ্যে রেখে ঝট করে পা দুটো উঁচু করলাম আমি, ইতোমধ্যেই পাদুটো বাঁকা করে একটা ফাঁসমতো বানিয়ে ফেলেছি। দুপায়ের তৈরী ফাঁসটা অলীনের ঝোঁকানো মাথার দুপাশ গলে ঘাড়ের কাছে গিয়ে আঘাত করলো। সাথে সাথে পাদুটোকে যতটা সম্ভব সোজা করলাম আমি, সেইসাথে আটকে গেলো ওর মাথা আমার দুপায়ের ভাঁজে। সাথে সাথে চেয়ারের উপরই পাশ ফিরলাম আমি। আমাকেসহ উল্টে গেলো চেয়ারটা, আর সেইসাথে মেঝের উপর পড়ে গেলো অলীন।

বেশ কিছুক্ষন একভাবে থাকার পর নড়ে উঠলাম আমি। পাদুটোর ভাঁজ একটু ঢিল দিতেই মাথাটা একদিকে হেলে পড়লো অলীনের। বুঝতে পারলাম, অজ্ঞান হয়ে গেছে ও। কিংবা...

এতোকিছু ভাবার সময় নেই আমার। পায়ের ভাঁজ থেকে ওর মাথাটা বের করে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তারপর টেবিলটার কাছে গিয়ে পেছন ফিরে ছোট ছুঁড়িটা তুলে নিলাম। দুহাতের ভাঁজে ফ্লেক্সিকাফে একটু একটু করে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিতে থাকলাম ছুড়ি দিয়ে। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাতলা প্লাষ্টিকের কাফ কেটে যেতেই পায়ের ক্লেক্সিকাফ কেটে দিলাম আমি। তারপর এক নজর তাকালাম ওর দিকে। এখনো মেঝেতে পড়ে আছে মেয়েটা!

মারা গেলো না তো?

এখানে আর বেশীক্ষন থাকাটা ঠিক হবে না। যদি মেয়েটা মারা গিয়ে থাকে, তাহলে তার দায় এসে পড়বে আমার উপর। বেড়িয়ে যেতে হবে এখান থেকে। এবং তা এখনই।

বেড়িয়ে যাবার আগে কি মনে করে যেন ওর ডায়েরীটা তুলে নিলাম আমি।

*******

বাসায় পৌছতে আধঘন্টার মতো লাগলো আমার। রুমে ঢুকেই দরজা জানালাগুলো ভাল করে আটকে দিলাম আমি। তারপর বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে নিলাম।

অনেক ধকল গেছে আজকে। মেয়েটা যে এরকম সাইকো টাইপ, তা জানা ছিল না আমার। আর একটু হলেই আর দেখতে হতো না। সাহস করে কাজটা না করলে এতোক্ষনে নিশ্চিত আমার অন্ত্র ব্যবহার করে গিটার বাজানো শুরু করতো ও।

গোসল করে বের হয়েই নিজের বেডরুমে চলে এলাম আমি। অলীনের ডায়েরীর মধ্যে কি আছে, সেটা জানতে হবে আমাকে।

এখন রাত একটা সতেরো। এখনো ঝির ঝির করে ঝরছে আবিরাম বৃষ্টি। এমন সময় এক সাইকোর ডায়েরী নিয়ে বসলাম আমি।

*******

মার্চ ৩, ২০১২

আমি অলীন, অলীন হায়দার। শখের গিটারিস্ট। পড়াশোনার পাশাপাশি গিটার বাজাই। গিটার বাজানো আমার প্যাশন, আমার নেশা। সবকিছু করতে পারি আমি এর জন্য। আশা আছে একদিন এদেশের অনেক বড় গিটারিস্ট হবার। স্বপ্ন দেখি, একদিন এদেশের বিখ্যাত গিটারিস্টদের সাথে আমার নাম নেয়া হবে। স্বপ্নপূরণ হবে কি না জানি না, তবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

অগাষ্ট ১৮, ২০১২

আজ একটা ব্যান্ডের কাছে গিয়েছিলাম। কন্ট্রাক্ট হলো তাদের সাথে। লীড গিটারিস্ট হিসেবে তাদের সাথে যোগ দিচ্ছি আমি। আমার স্বপ্নপূরণের হয়তো আর বেশী বাকি নেই।

আই ফিল লাইক দ্য কুইন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড!

নভেম্বর ৯, ২০১২

পৃথিবীর পুরুষগুলোর কি আর কোন কাজ নেই? সব পুরুষই একরকম! শালাদের মনে হয় মেয়ে দেখলেই লালা ঝরে। ব্যান্ডের মালিক সাঈদ থেকে শুরু করে ড্রামার গালিব পর্যন্ত! আর ভোকালিষ্ট মনিরকে অনেক ভাল ভেবেছিলাম, সেও একই রকম!

ব্যান্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম আজকে। কন্ট্রাক্ট ক্যানসেল।

ডিসেম্বর ২৯, ২০১২

আর পারছি না আমি। এতো স্ট্রেস নেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। দিন দিন আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে।

নতুন একটা ব্যান্ডের সাথে কন্ট্রাক্ট হবার কথা ছিল আজ, কিন্তু সেটা হলো না সাঈদের কারনে। শালাকে আমি শেষ করে দেবো। আমার স্বপ্নপূরণের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ও। খুন করে ফেলবো আমি ওকে।

জানুয়ারী ৯, ২০১৩

সাঈদ আসবে কাল। নতুন ব্যান্ডের কন্ট্রাক্ট হতে দেয়নি ও। বলেছে, ওর ব্যান্ডেই আবার যোগ দিতে। কালকে আবার নতুন করে কন্ট্রাক্ট করবো। কিন্তু সেটার জন্য আমার বাসায় কেন আসতে চাইছে ও?
কে জানে!

জানুয়ারী ১০, ২০১৩

খুন করেছি আমি! সাঈদকে খুন করেছি। খুব বাড় বেড়েছিল ওর। আমার বাসায় এসে আমার গায়েই হাত তোলে ও! যে পুরুষের নারীদের প্রতি লোভ থাকে এরকম, তাদের সবাইকে ধরে ধরে শেষ করে দেওয়া উচিৎ।

ছাড়িনি আমি। শেষ করে দিয়েছি। ওর লাশটা এখনও আমার বেডের নিচে পড়ে আছে। পুলিশের ঝামেলা হতে পারে। অবশ্য একসময় না একসময় পুলিশ জানবেই যে সাঈদ আমার এখানে এসেছিল। তখন ভজংভাজং কিছু একটা বলে দিলেই হবে। বাংলাদেশের পুলিশ, মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছুই নেই শালাদের।

সাঈদের লাশটা গুম করে ফেলতে হবে। কিন্তু কিভাবে?

লাশটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললে কেমন হয়? সাইকো কিলারদের মতো? তারপর ফ্রিজে তুলে রাখলে?

দুররর! এটা কোন ভাল আইডিয়া না। ওর শরীরের ওজন হবে প্রায় পয়ষট্টি কেজির মতো। কেটে টুকরো টুকরো করে শুধু মাংস রেখে দিলেও অন্তত চল্লিশ কেজি তো হওয়ার কথা!

না, এটাই ভাল বুদ্ধি। বাথরুমে নিয়ে রক্ত-টক্ত ফেলে দেয়া যাবে। তারপর ফ্রিজে নিয়ে তুলে রাখবো। প্রতিদিন একটু একটু করে বাইরে গিয়ে ফেলে আসা যাবে।

ফেব্রুয়ারী ১৩, ২০১৩

আনলাকি থার্টিন কি সত্যিই নাকি? কে জানে!

আজ সুপ্তির সাথে এক জায়গায় গিয়েছিলাম। জায়গাটা মিরপুর-২ এ। এক ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানের কাছে। তাকে সবাই গুরুজি বলে ডাকে।

অনেক স্ট্রেস সহ্য করেছি আমি, আর নয়। এবার একটা কিছু করতেই হবে। নিজেকে যেভাবেই হোক বদলাতেই হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ব্ল্যাক ম্যাজিক শিখবো আমি।

হ্যাঁ, শয়তানের উপাসনা করবো আমি। তাতেও যদি নিজের প্যাশন পূর্ণ করতে পারি আমি!

ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০১৩

আজকে একটা জিনিস শিখলাম। শিখলাম মানে, জানলাম আর কি। আদিম যুগে মানুষ তার জাতীয় বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে মানুষের অন্ত্র ব্যবহার করতো। বেহালার তার বা স্ট্রিং তৈরিতে এসব ব্যবহার করতো তারা। জিনিসটা শুনতে এখন অবাস্তব মনে হলেও সেগুলোর সুর নাকি ছিল স্বর্গীয়। এখন অবশ্য এসব করা হয়না। কারন, এগুলো করলে এখন মানুষকে বর্বর আখ্যা দেয়া হবে। মানবাধিকার কমিশনে আটকে দেবে।

অবশ্য অনেক জায়গায় বেহালা বা গিটারের তার তৈরিতে পশুর অন্ত্র ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকাতে অনেকে মহিষের অন্ত্র দিয়ে স্ট্রিং তৈরী করে। মেক্সিকোতেও গিটারের স্ট্রিং তৈরিতে গরুর অন্ত্র ব্যবহার করে অনেকে। এমনকি এখনো ভিয়েতনামের ভ্যান মিইয়ু বা টেম্পোল অব লিটারেচার-এ এরকম অনেক বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষিত আছে, যার মধ্যে দুটোর তার মানুষের অন্ত্রের তৈরী।

অবশ্য লুসিফারের সান্নিধ্য পেতে হলে আমাকে মানুষ খুন করতেই হবে। মানে, বলি দিতে হবে আর কি। যদি আমি বলি দেওয়ার পর তাদের অন্ত্র কেটে রেখে দিই, তাহলে তো তেমন কোন হেরফের হবার কথা নয়।

ব্যাপারটা নিয়ে গুরুজির সাথে আলোচনা করতে হবে।

মার্চ ৮, ২০১৩

খুন করেছি আবার। এবারের শিকার ড্রামার গালিব। সাঈদের ব্যান্ডে ছিল ছেলেটা। সাঈদ মারা যাওয়ার পর অন্য আরেকটা ব্যান্ডে যোগ দিয়েছিল ও। আজকে এসেছিল আমাকেও ওদের নতুন ব্যান্ডে যোগ দেয়ার কথা বলতে। সেইসাথে আরো কিছু আশা করছিল সে। ওর আশা তো আমি পূরণ করতে দিইনি, উল্টো ওর অশ্লীল ইঙ্গিতের জন্য শেষ করে দিয়েছি ওকে।

লাশটা এখনো আমার বাথরুমে পড়ে আছে। এবার ওর অন্ত্র দিয়ে স্ট্রিং বানাবো আমি। নেট থেকে কার্যপ্রণালী লোড দিতে হবে, তারপর কাজ শুরু করবো। হয়তো কিছু কেনাকাটা করতে হতে পারে। বিকেলে গিয়ে কিনে আনবো সব।

আচ্ছা, রাত বারোটার দিকে এই বিশেষ কাজে নামলে কেমন হয়?

মার্চ ৯, ২০১৩

এখন ভোর সাড়ে চারটা।

অনেক কষ্ট করলাম। প্রথমে গালিবের কাপড়গুলো টেনে টেনে ছিড়েছি। তারপর ওকে চিত করে শুইয়ে দিয়েছি। নেট থেকে পুরো ডিটেইলস জোগাড় করেছি আমি, বিকেলে মার্কেটে গিয়ে কিছু যন্ত্রপাতি কিনে এনেছিলাম।

প্রথমেই শাওয়ার ছেড়ে ওকে ধুয়ে নিয়েছিলাম আমি। তারপর একটা শুকনো তোয়ালে দিয়ে ওর শরীরটা মুছে আবার শুইয়ে দিয়েছি ফ্লোরের মধ্যে। তারপর স্পিরিট দিয়ে ওর পেটের কাছটা ভাল করে মুছে নিয়েছি। নিজেকে ডাক্তার ডাক্তার মনে হচ্ছিল আমার এসময়।

একটা স্ক্যালপেল বের করে ওর পেটটা চিড়ে দিয়েছি আমি। তারপর মোট ছয়টা পিটন দিয়ে কাটা চামড়া দুপাশে সরিয়ে নিয়ে ভেতরে হাত দিয়েছি। ডাক্তাররা রবারের গ্লাভস ব্যবহার করে এসব কাজে, কিন্তু আমি কোন অপারেশন করতে চাইনি। তাই খালি হাতই ঢুকিয়ে দিয়ে ওর পেটের ভেতর।

হাত ঢুকিয়ে ওর নাড়িগুলো যখন বের করছিলাম, অসহ্য লাগছিল আমার কাছে। একইরকম অবস্থা হয়েছিল সাঈদের সময়ও। কিন্তু তখন কিছুই করার ছিল না আমার। কাজটা এক প্রকার বাধ্য হয়েই করতে হয়েছে।

পুরোটা বের করার পর কয়েকবার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিয়েছিলাম আমি সেগুলো। ছুড়ি দিয়ে যত্ন সহকারে নাড়িগুলোকে ভালোভাবে কেটে ফালি ফালি করে ফেলি। তারপর একটা বড় বোলের মধ্যে নিয়ে রেখে দিয়েছিলাম বাথরুমের মধ্যেই। আসল কাজটা বাকি ছিল তখনও।

বিকেলেই দোকান থেকে সালফার ডাই অক্সাইড, অলিভ অয়েল আর সোডিয়াম কার্বনেট কিনে এনেছিলাম আমি। সেগুলো কাজে লাগবে এখন।

রুম থেকে এগুলো নিয়ে আবার বাথরুমে যাই আমি। নাড়িগুলোকে প্রথমে অলিভ অয়েল দিয়ে ভালোভাবে পরিস্কার করি, তারপর এগুলোর উপর সালফার ডাই অক্সাইড আর সোডিয়াম কার্বনেট দিয়ে ভালোভাবে মাখাই। ফালিগুলোকে এখন শুকাতে হবে ভাল করে। কাজটা পরেও করা যাবে।

অন্ত্রের ফালিগুলোকে বোলে করে রান্নাঘরে রেখে আসি আমি। তারপর লেগে যাই গালিবের শরীরকে টুকরো টুকরো করার কাজে। কোন প্রমাণ রাখা যাবে না এ কাজের।

পুরো তিনঘন্টা লাগে আমার এই কাজে। কাটা মাংসের টুকরোগুলোকে পলিথিনে পেঁচিয়ে ফ্রিজের মধ্যে রেখে দিয়েছি আমি। তারপর এসে বসেছি ডায়েরী লিখতে।

ভয় হচ্ছে আমার। ভুতের ভয় নয়, এটা পাই না আমি। ভয় হচ্ছে আমার ডায়েরীটা নিয়ে। এখানে সবকিছুই লিখে রাখছি আমি। অন্যকোন প্রমাণ না থাকলেও এটা থেকেই যাবে। যদি কখনো এটা কোন মানুষের হাতে পরে যায়?

না, এটা হতে দেওয়া যাবে না। ডায়েরীটাকে লুকিয়ে ফেলতে হবে। এরপর থেকে শুধু এসব কাজের সাক্ষী হয়েই থাকবে আমার এই ডায়েরী। এসব ছাড়া আর কিছুই লিখবো না আমি এখানে।

মার্চ ১০, ২০১৩

দুরররর! মেজাজ খারাপ।

কোন কাজেই আসলো না। যেটা করতে চেয়েছিলাম, সেটা হয়নি। গালিবের অন্ত্র দিয়ে স্ট্রিং তৈরী করতে চেয়েছি, কিন্তু হয়নি। কয়েকবার বাজানোর পর পরই ছিড়ে গেছে তার। আরো ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হবে এই ব্যাপারে। আরো ডিটেইলস জানতে হবে।

মার্চ ১৬, ২০১৩

ভুলটা আমারই। কাজটা করার জন্য টাইমিংয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হয়। পারফেক্ট টাইমিং না হলে কাজে দেবে না। একারনেই গালিবের অন্ত্রের স্ট্রিং কোন কাজে আসেনি।

পারফেক্ট স্ট্রিং দরকার আমার, সেজন্য আরো অনেক অন্ত্র দরকার। আর পারফেক্ট স্ট্রিং তৈরী করতে লাগবে অনেক অনেক প্র্যাক্টিস, তার জন্য প্রয়োজন আরো মানুষ।

আচ্ছা, আমি কি সিরিয়াল সাইকো কিলার হয়ে যাচ্ছি?

*******

আর পড়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। অনেক হয়েছে। মাথা ভন ভন করছে। একজন মানুষ এতো নির্মমভাবে কাউকে খুন করতে পারে, জানা ছিল না আমার।

ঘড়ির দিকে তাকালাম আমি। মাত্র পনেরো মিনিট সময় লেগেছে আমার এটুকু পড়তে।

অলীনের জন্য চিন্তা হচ্ছে আমার। কি যে করছে মেয়েটা, কে জানে! এ পর্যন্ত কতোজন ওর প্যাশনের বলি হয়েছে, আল্লাহ মালুম!

কারো সাথে কথা বলা দরকার এটা নিয়ে। ডাক্তার সোহরাবকে কি ফোন দেবো?

নাহ, এতো রাতে উনাকে ফোন করে জাগিয়ে তোলা ঠিক হবে না। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে আলাপ না করা পর্যন্ত ঠিক থাকতে পারছি না আমি।

আরো কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করার পর ডাক্তার সোহরাবকেই ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।

দুবার রিং হতেই রিসিভ করলেন তিনি।

-‘আরে, শুভ যে! কি খবর? এতোরাতে কল দিলেন যে?’

-‘একটু সমস্যায় পড়ে গেছি ভাই।’

-‘কি সমস্যা?’

সংক্ষেপে পুরো বিষয়টা তার কাছে খুলে বললাম আমি। সব শুনে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি আসছি আপনার বাসায়। ঠিকানাটা ইনবক্স করুন।’

‘এতো রাতে আসার কি দরকার?’ মৃদু কন্ঠে বলার চেষ্টা করলাম আমি, কিন্তু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন ডাক্তার, ‘ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেষ্টিং লাগছে আমার কাছে। গাড়ি আছে আমার, এখনই আসছি। আপনি শুধু ঠিকানাটা ইনবক্স করে দিন।’

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলেন তিনি। মাথা নেড়ে তাকে আমার বাসার ঠিকানা ইনবক্স করলাম আমি।

আবার বসলাম ডায়েরীটা নিয়ে।

*******

জুন ২, ২০১৩

অবিস্মরনীয় দিন বলা যায় আজকের দিনটাকে। মাঝখানে অনেকদিন ডায়েরী লেখা থেকে বিরত ছিলাম। আসলে নতুন কিছু লেখার মতো ছিল না আমার। শুধু স্ট্রিং বানানোর ক্ষেত্রে সফলতা ছাড়া।

হ্যাঁ, সফল হয়েছি আমি আমার কাজে। অবশ্য এজন্য আরো তিনজনকে বলি দিতে হয়েছে লুসিফারের উদ্দেশ্যে।

আজকের দিনটাকে অবিস্মরণীয় বলার কারন, আজকে এমন একটা কাজ করেছি আমি, যেটা আগে কখনো করিনি। আজকে একজন জীবিত মানুষকে কেটে তার নাড়ি বের করেছি আমি।

লোকটা আমার নতুন ব্যান্ডের ম্যানেজার ছিল। শফিকুল ইসলাম। ও হ্যাঁ, লেখা হয়নি, লুসিফারের আশীর্বাদে আমি দিন দিন উন্নতি করে চলেছি। গত মাসে একটা বেশ বড় কন্ট্রাক্ট পেয়েছি আমি, ‘গাংচিল’ নামের একটা ব্যান্ডের সাথে। তারই ম্যানেজার ছিল শফিকুল।

প্রথম থেকেই শফিকুলকে পছন্দ করতাম না আমি। কেমন যেন ছোঁকছোঁক করতো লোকটা। আজকে বাসায় এসেছিল একটা কাজের ছুতোয়, সুযোগ পেয়ে বেয়াদবী করেছে আমার সাথে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল আমার। মাথার মধ্যে বাড়ি মেরে কাঁচের জগটার বারোটা বাজিয়েছি আমি।

বাড়ি খেয়েই অজ্ঞান হয়ে গেছিল শফিকুল। ওকে ধরে বেডরুমে নিয়ে যাই আমি। তারপর ফ্লেক্সিকাফ দিয়ে দুহাত আর দু’পা ভাল করে আটকে নিই চেয়ারের সাথে। তারপর একটা টেবিলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো এনে সামনে রাখি ওর।

বেশ কিছুক্ষন পর জ্ঞান ফেরে ওর। জ্ঞান ফেরার পর আমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর কিছু বাছা বাছা অশ্লীল খিস্তি বের করে মুখ থেকে। অবশ্য দু’গালে দুটো চড় খাওয়ার পরই অশ্লীল গালিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ওর মুখের ভেতর একটা রুমাল গুজে দিয়ে স্কচটেপ দিয়ে আটকে দিই আমি, যাতে আর কথা না বলতে পারে।

প্রথমে ওর শার্টের বোতামগুলো একটা একটা করে খুলে ফেলি আমি। তারপর একটা কাঁচি দিয়ে ওর শার্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি কেটে সরিয়ে দিই ওর শরীর থেকে। ওর লোমশ বুকটা দেখে ঘৃণায় মুখটা কুঁচকে যায় আমার। মানুষের বুক এতোটা কুৎসিত হতে পারে! তাছাড়া, লোমগুলো ওর বুক ছাড়িয়ে পেটের দিকেও নেমে এসেছিল।

এবার যে কাজটা করি আমি, কাঁচি দিয়ে একটা একটা করে ওর পেটের উপরের লোমগুলো ছেটে ফেলি। না হলে পিটন লাগাতে অসুবিধা হতো আমার। তারপর একটা তুলোর মধ্যে স্পিরিট নিয়ে ওর পেটের কাছটা পরিস্কার করে ফেলি।

বিস্ফারিত চোখে আমার কাজ দেখছিল শফিকুল। মুখে রুমাল গুজে থাকায় কিছুই বলার জো ছিল না ওর। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, আতঙ্কে ভেতরে ভেতরে সিটকে গেছে ও।

মনে মনে কয়েকবার মহান লুসিফারের নাম ধরে ডাকলাম আমি। লুসিফারের সন্তুষ্টির জন্যই ওকে খুন করতে যাচ্ছি আমি। মহান লুসিফার সহায় না হলে কাজটা করা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে।

ওর বিস্ফারিত চোখের সামনেই ওর পেটের চামড়ায় পিটন লাগালাম আমি। চামড়া টান টান হয়ে গেলে স্ক্যালপেলটা অ্যালকোহলে ভালোভাবে ধুয়ে নিলাম আমি। তারপর ধীরে ধীরে স্ক্যালপেল চালালাম ওর পেটের চামড়ার উপর। খুবই সুক্ষ্ণভাবে চিড়ে গেলো ওর পেট, একটু পর সাদা চর্বির নিচ থেকে খুব ধীরে ধীরে বেড়িয়ে এলো রক্ত।

পেটটা চিড়ে যেতেই অমানষিকভাবে গুঙ্গিয়ে উঠলো শফিকুল। ফ্লেক্সিকাফের জন্য নড়তে পারছিল না ভালোভাবে, আর মুখে রুমাল গুজে রাখার কারনে পারছিল না মনের সুখে চিৎকার করতে। শুধু বন্যপশুর মতো বিকটভাবে গুঙিয়ে যাচ্ছিল।

এই প্রথম এধরনের কাজের মধ্যে মজা খুঁজে পেলাম আমি। নিজের ভেতরটা কেন যেন বাঁধভাঙ্গা খুশীতে ভরে উঠছিল আমার। মনে হচ্ছিল যে, আরো কাটি, আরো রক্ত ঝরাই, তা না হলে পূর্ণ শান্তি পাবো না মনের ভেতর।

বহুকষ্টে নিজেকে সামলে রাখলাম আমি। শান্তি পাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার উদ্দেশ্য লুসিফারকে খুশী করা এবং আমার গিটারের জন্য স্ট্রিং বের করে আনা।

ধীরে ধীরে আরো গভীরভাবে স্ক্যালপেল চালালাম আমি। ক্ষতটা বাড়ছে, সেইসাথে বাড়ছে রক্তপাতের মাত্রা। বসে বসে খেয়ে ভালই চর্বি জমিয়েছে শালা, তাই কাটতে বেশী সময় লাগছে আমার।

এক মুহূর্তের জন্য ওর দিকে তাকালাম আমি। কাঁদছে শফিকুল। অঝোর ধারায় পানি পড়ছে ওর দু চোখ বেয়ে।

‘আগে মনে ছিল না?’ শান্তকন্ঠে বললাম আমি, ‘আমাকে টীজ করার সময় মনে ছিল না যে টিজিং জিনিসটা খারাপ? আমার গায়ে হাত দেবার সময় মাথা ঠিক ছিল না, তাই না? এখন কাঁদছিস কেন? এখন তো কেঁদে কোন লাভ নেই। তারচেয়ে এখন নিজের সৃষ্টিকর্তাকে ডাক, এখন একমাত্র তিনিই পারেন তোর কষ্ট কমাতে।’

কথাগুলো শুনে যেন কান্নার বেগ বেড়ে গেলো ওর। দুচোখে মিনতি দেখতে পেলাম। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই আমার। নিজের কাজটা শেষ করতে হবে আমাকে। তাই ওর দিক থেকে নজর সরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলাম আমি।

অবশেষে ওর বুকের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত কেটে ফেলতে পারলাম আমি। পিটনগুলোকে খুলে আবারও নতুনভাবে লাগালাম পেটের চামড়ার সাথে। এখন পেটের মাঝে একটা গহ্বর তৈরী হয়েছে ওর।

স্ক্যালপেল ছেড়ে একটা কাঁচি তুলে নিলাম আমি এবার। একটা হাত ঢুকিয়ে দিলাম শফিকুলের পেটের ভেতর। একহাতে নাড়ি টেনে ধরে অন্যহাতে কাঁচি দিয়ে কেটে নিলাম মাপমতো। একটা একটা করে পিস পিস নাড়ি একটা বোলের ভেতরে অ্যালকোহলে ডুবিয়ে রাখছি, আর বারবার ওর চোখের দিকে তাকাচ্ছি। দৃষ্টি বিস্ফারিত করে আমার কাজ দেখছে ও। ধীরে ধীরে চোখের জ্যোতি কমে আসছে ওর। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, বেশীক্ষন আর টিকবে না।

নাড়িগুলো কাটা শেষ হলে বোলটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম আমি। অ্যালকোহলে ডোবানো ছিল এগুলো এতোক্ষন। অ্যালকোহল থেকে উঠিয়ে আরেকটা বোলে তুলে নিলাম আমি সেগুলো। তারপর একটা ছুড়ি দিয়ে লম্বালম্বিভাবে কেটে নিলাম। এবার এগুলোকে অলিভ অয়েল দিয়ে ভালোভাবে ধুতে হবে।

অলিভ অয়েল দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে সেগুলোর উপর সালফার ডাই অক্সাইড আর সোডিয়াম কার্বনেট মাখাই আমি। তারপর সেগুলো নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে যাই। গ্যাসের চুলোটা জ্বালিয়ে তার উপর টানানো তারের উপর সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখি নাড়িগুলো। মোট তিন ঘন্টা লাগবে এগুলো শোঁকাতে।

নাড়িগুলো শোঁকাতে দিয়ে আবার বেডরুমে ফিরে আসি আমি। শফিকুলের মাথাটা একদিকে হেলে আছে। বুঝতে পারলাম, মারা গেছে ও। এবার আমার শেষ কাজটা করতে হবে।

লাশটাকে ফ্লেক্সিকাফ থেকে ছুটিয়ে বাথরুমে নিয়ে গেলাম আমি। তারপর একটা চাপাতি দিয়ে পিস পিস করে কাটতে লাগলাম। কাজটা আগেরমতোই।

ঘন্টা তিনেক পর পলিথিনের ব্যাগে করে আমার ফ্রিজে জায়গা করে নিলো শফিকুলের ডেড বডি, আর আমি পেলাম একেবারে আনকোরা কিছু স্ট্রিং।

*******

কলিং বেলের শব্দে চমকে উঠলাম আমি। ডায়েরীর মাঝে এতোটাই মগ্ন হয়ে গেছিলাম যে, হঠাত বেলটা বাজায় ভয় পেয়ে গেছি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডায়েরীটা খাটের একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ালাম।

দরজা খুলতেই ডাক্তার সোহরাব হোসেনের কাকভেজা চেহারাটা দেখতে পেলাম আমি। শার্টটা একটু ঝাঁকি দিয়ে মৃদু হাসলেন ভদ্রলোক, তারপর ঢুকে পড়লেন ভেতরে।

ড্রয়িং রুমের সোফায় উনাকে নিয়ে বসলাম আমি। তারপর এপর্যন্ত যা জেনেছি ডায়েরী থেকে, তা খুলে বললাম উনাকে। পুরো ব্যাপারটা শুনে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন ডাক্তার। মাথা নিচু করে কি যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর মুখে তুলে তাকালেন আমার দিকে।

‘যতটুকু বুঝতে পারলাম,’ ধীরে ধীরে উচ্চারন করলো সে, ‘মেয়েটা আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। ২০১৩ এর জুন মাস পর্যন্ত জানতে পেরেছেন আপনি ডায়েরী থেকে, এখন ২০১৪ এর সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে ওর মেন্টাল কন্ডিশন আরো খারাপ হবার কথা। এতোদিনেও মেয়েটা কারো চোখে সামান্য সন্দেহের উদ্রেক না করে কিভাবে কাজগুলো করে যাচ্ছে, এটাও চিন্তার বিষয়।’

‘আমিও তাই ভাবছি,’ মাথা নাড়লাম আমি, ‘মেয়েটাকে প্রথম দেখি আমি একটা শোতে, গিটার বাজাতে। খুবই ভাল গিটারিস্ট সে। তারপর আরো অনেকবার দেখা হয়েছে তার সাথে, কিন্তু কখনোই এরকম বলে মনে হয়নি আমার কাছে। সবসময় স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে। ওর মধ্যে যে এতোটা এবনর্মালিটি থাকতে পারে, সেটা কল্পনাও করিনি আমি।’

‘এটাই ওদের বৈশিষ্ট্য,’ একইভাবে মাথা নাড়লেন ডাক্তার, ‘সাইকোদের বৈশিষ্ট্যই এটা।’

‘এক সেকেন্ড,’ ধীরে ধীরে বললাম আমি, ‘আমি ওকে ঠিক সাইকো বলতে পারছি না। কারন, আমার মনে হয়, ওর এধরনের কার্যকলাপ করার কারন হচ্ছে ওর প্যাশন। ওর মধ্যে আর কোন এবনর্মালিটি নেই। শুধু নিজের কাজের ব্যাপারেই এরকম ও। আর নিজের প্যাশন বজায় রাখার জন্যই এগুলো করে বেড়ায় বলে আমার ধারণা।’

‘অবশ্যই ও সাইকো,’ জোড় দিয়ে বলে উঠলেন ডাক্তার, ‘নিজের খেয়াল, মানে প্যাশনের বশবর্তী হয়ে এভাবে মানুষ খুন করলে তাকে সাইকোই বলে সবাই।’

‘আপনি যখন বলছেন,’ হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে বললাম আমি, ‘তাহলে তাই হবে। পৃথিবীতে মানুষের কতো আজব রকমের খেয়ালই না থাকে! আর সেইসব খেয়ালের বশবর্তী হয়ে অনেকে এমনসব কাজ নির্দ্বিধায় করে ফেলে, যা সাধারণের চোখে ভয়াবহ অপরাধ। এধরনের কাজ যারা করে, তাদেরকে আমরা নির্দ্বিধায় ‘সাইকো’ উপাধি দিয়ে বসি। ‘তারা তো সাইকো,’ এটুকু বলেই থেমে যাই। তাদেরকে মানষিক বিকৃতির শিকার বলে ঘোষণা দিয়ে ফেলি। কিন্তু কখনো ভেবে দেখিনা তার সাইকো হবার কারণ।’

‘কারন যাই হোক,’ গম্ভীরস্বরে বললেন তিনি, ‘সেটা দেখার বিষয় নয়। দেখার বিষয় হচ্ছে, আসলে মেয়েটা সাইকো।’

আমি আর কথা বাড়ালাম না। ডাক্তার মানুষ তিনি, মানুষের মেন্টাল বিষয় তিনি যতটা বুঝবেন, আমার পক্ষে ততোটা বোঝা সম্ভব না। তাই অফ গেলাম।

‘মেয়েটা কোথায় এখন?’ বেশ কিছুক্ষন চুপ থাকার পর প্রশ্ন করলেন ডাক্তার।

‘জানি না,’ মাথা নেড়ে বললাম আমি, ‘মারা গেছে মনে হয়। আর মারা না গেলেও অজ্ঞান হয়ে গেছিল, এতোক্ষনে জ্ঞান ফিরে এসেছে বোধহয়। যদি জ্ঞান ফিরে আসে, তাহলে নিশ্চিত গা ঢাকা দিয়েছে কোথাও।’

‘আমাদের গিয়ে দেখে আসা উচিৎ,’ মৃদুস্বরে বললেন সোহরাব হোসেন, ‘বেঁচে আছে কি না মরে গেছে, কনফার্ম হওয়া জরুরী।’

‘এতো রাতে?’ ভ্রু কুঁচকে বললাম আমি, ‘বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে তো।’

‘তাতে কি?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘আমি তো এতো রাতে এই বৃষ্টির মাঝখানেও চলে এসেছি মিরপুর থেকে। আর তাছাড়া, রাতের বেলাতেই সাইকোদের জন্য সুসময়। কি থেকে কি ঘটিয়ে ফেলবে মেয়েটা, তার কোন গ্যারান্টি নেই। তারচেয়ে চলুন ওর বাসায় গিয়ে দেখে আসি। বেঁচে থাকলে কোন মানসিক হাসপাতালে নেয়া যাবে। সেখানে ট্রিটমেন্ট পেলে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে মেয়েটি।’

‘তা ঠিক,’ কথাটা মনোপুত হলো আমার। ঠিক বলেছেন ডাক্তার সোহরাব হোসেন।

এমনসময় কলিংবেলের শব্দে দ্বিতীয়বারের মতো চমকে উঠলাম আমি। এসময় কে আসতে পারে!

‘দেখি কে এলো,’ মৃদুস্বরে কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালাম আমি।

দরজাটা খুলতেই ধাক্কা খেলাম আমি। আক্ষরিক অর্থে এবং উপমা হিসেবে, দুটোই। প্রথমত, দরজার বাইরে কাকভেজা হয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে একজন মেয়ে, এবং আমার খুবই পরিচিত একজন।
অলীন!

ডান হাত দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়েই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো মেয়েটা। ওর ধাক্কা খেয়ে মেঝের উপর পড়ে গেলাম আমি। মেঝের উপর পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আমার বুকের উপর উঠে বসলো ও। দুহাতে আমার মাথাটা চেপে ধরলো শক্ত কংক্রিটের উপর। নাক মুখ দিয়ে গরম নিঃশ্বাস বেরুচ্ছে তার।

‘কি ভেবেছিলে,’ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো অলীন, ‘এতো সহজেই আমার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে? এতো সোজা নয় শুভ। আমার আসল রুপ দেখে ফেলেছো তুমি। তোমাকে এতো সহজে আমি পাড় পেতে দেবো না। মরতে হবে তোমাকে।’

‘অলীন,’ চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করলাম আমি, ‘অলীন, শুনো, অলীন...’

এমনসময় থ্যাপ করে একটা শব্দ হলো। সাথে সাথেই অলীনের হাতের চাপ কমে গেলো। বুঝতে পারলাম, ওর পেশী শিথিল হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ একভাবে থাকার পর ঢলে পড়লো ও একদিকে।

‘সরি,’ ধীরে ধীরে বলে উঠলেন ডাক্তার সোহরাব হোসেন, ‘দেরী হয়ে গেলো। আসলে ফুলদানীটা আনতে গিয়ে...’

‘বুঝেছি,’ নিজের মাথা চেপে ধরে বললাম আমি। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম, ‘দেখুন তো মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে কি না।’

‘বেঁচে আছে,’ মৃদু হাসি দেখা গেলো ডাক্তারের মুখে, ‘বাড়িটা মেপেই মেরেছি। অজ্ঞান হয়ে গেছে আর কি।’

‘থ্যাঙ্ক গড,’ মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে বললাম আমি, ‘এখন?’

‘এখন আর কি,’ অলীনের দিকে তাকিয়ে বললেন ডাক্তার, ‘মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আমার সাথে গাড়ি আছে। অসুবিধা হবে না আশা করি।’

‘আমিও যাবো আপনার সাথে,’ দ্রুত বলে উঠলাম আমি।

‘যাবেন?’ কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি, ‘চলুন। এতে আমার জন্য ভালই হবে। মাঝপথে জেগে উঠলে কন্ট্রোল করা যাবে মেয়েটাকে। আমি ফুলদানীটা রেখে আসি। আপনি তৈরী হয়ে নিন।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যে বের হলাম আমরা। অলীনের অচেতন দেহটা ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এলাম, তারপর সোহরাব ডাক্তারের গাড়ির পেছনে বুটে তুলে নিলাম।

*******

‘এখন কন্ডিশন কেমন ওর?’ মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলাম আমি।

আমি বসে আছি ডাক্তার সোহরাব হোসেনের চেম্বারে। গতরাতে অলীনকে হাসপাতালে রেখে বাসায় ফিরে গিয়েছিলাম আমি। সারারাত আর ঘুমাতে পারিনি। তাই বসে বসে ওর ডায়েরীটা শেষ করেছি। সকালের দিকে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম হঠাত, দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে ঘুম ভাঙতেই গোসল সেরে রেডি হয়ে বের হয়েছি। সোজা চলে এসেছি ডাক্তারের চেম্বারে।

‘কিছুটা স্টেবল,’ হালকা হাসির আভা দেখা গেলো ডাক্তারের চেহারায়, ‘তবে পুরোপুরি নয়। যেই বুঝতে পেরেছে, হাসপাতালে আছে ও, তখন থেকেই চুপ হয়ে গেছে একেবারে। একটা শব্দও বের করা যায়নি ওর ভেতর থেকে।’

‘হুম,’ মাথা নেড়ে বললাম আমি, ‘তা কি করবেন ওকে নিয়ে এখন? কোন মেন্টাল হসপিটালে পাঠিয়ে দেবেন?’

‘দেখি,’ একটু ভেবে জবাব দিলেন ডাক্তার, ‘তবে আমি ভাবছি, কয়েকটা দিন ওকে পর্যবেক্ষণ করবো আমি। তারপর ওর পরিবারের সাথে আলাপ করে কিছু একটা করা যাবে। ভাল কথা, ওর পরিবারের কাউকে খবর দিয়েছিলেন?’

‘না,’ মাথা নাড়লাম আমি, ‘আমার জানামতে, ওর পরিবার বলতে তেমন কেউ নেই। মা-বাবা মারা গেছে ছোটবেলাতেই। মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে ও। বাবা মারা যাবার আগে ব্যাংকে বেশ কিছু টাকা জমা রেখে গিয়েছিলেন, ওর মামাই এতোদিন ব্যবহার করেছেন সেগুলোর ইন্টারেষ্ট। উনিশ বছর বয়েস হতেই চলে আসে সেখান থেকে। তারপর থেকে পড়ে আছে এই শহরে। ব্যাংক থেকে যা ইন্টারেষ্ট পায়, তার কিছু অংশ মাসে মাসে তুলে চলতো ও। আর এখন তো নিজেই আয় করে গিটার বাজিয়ে, তাই ওভাবেই পড়ে আছে সব।’

‘আপনি এতোসব জানলেন কি করে?’ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার।

‘কিছুটা অলীনের কাছ থেকে,’ শান্তভাবে জবাব দিলাম আমি, ‘কিছুটা ওর বান্ধবী সুপ্তির কাছ থেকে। আসলে, অলীনের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে দুর্বল ছিলাম আমি।’

‘হুম,’ মাথা নেড়ে বললেন তিনি, ‘আচ্ছা, সুপ্তি, মানে অলীনের বান্ধবীকে খবর দেয়া যায় না?’

‘না,’ প্রস্তাবটা নাকচ করে দিলাম আমি, ‘অলীনের ডায়েরী পড়ে একটা কথা জানতে পেরেছি আমি। অলীনের শয়তানের উপাসক হওয়ার পেছনে এই মেয়ের হাত ছিল। সেই ওকে গুরুজি নামের সেই ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এই অবস্থায় এখন সুপ্তিকে কিছু বলতে যাওয়া আর অলীনের জীবন শেষ করে দেওয়া সমান কথা।’

‘বুঝলাম,’ সংক্ষেপে উত্তর দিলেন তিনি।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম আমি। তারপর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা, এখন অলীনকে দেখা যাবে?’

‘অফকোর্স,’ দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার, ‘চলুন। তবে, বেশীক্ষন সময় নেয়া যাবে না। বুঝতেই পারছেন, আপনার উপর রেগে আছে মেয়েটা।’

‘বুঝতে পারছি,’ ডাক্তারের দেখাদেখি উঠে দাঁড়ালাম আমিও।

ডাক্তারের পাশাপাশি হেটে দুতলার একটা কেবিনের সামনে হাজির হলাম আমি। দরজার কাছে না গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম আমি। ভেতরে বসে আছে সুপ্তি।

গত কয়েক ঘন্টায় যেন একেবারেই মুষড়ে পড়েছে মেয়েটা। দুপায়ের ভাজে মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে আছে চুপ করে। আমি জানালায় একটা টোকা দেয়াতে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো মেয়েটা। স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি, দপ করে জ্বলে উঠলো ওর দুটো চোখ। কিন্তু যে কারনেই হোক, একেবারেই নিরব রইলো।

বেশ কিছুক্ষন ওর দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলাম আমি। তারপর ঘুরে দাঁড়ালাম।

সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার, ‘লাঞ্চ করেছেন? এখন কিন্তু লাঞ্চ টাইম।’

‘লাঞ্চ!’ মৃদুস্বরে বললাম আমি, ‘এখনো ব্রেকফাষ্টই করা হয়নি।’

‘তাই নাকি?’ যেন আঁতকে উঠলেন ডাক্তার, ‘তবে চলুন আমার সাথে। একসাথেই খাবারটা সেরে নেয়া যাবে।’

‘না থাক,’ মাথা নেড়ে বললাম আমি, ‘আপনাকে আর শুধু শুধু কষ্ট দিতে চাই না। রাতের বেলায় এমনিতেই অনেক কষ্ট করেছেন আপনি।’

‘এটা কোন সমস্যাই নয়,’ মুচকি হাসলেন ডাক্তার, ‘আর তাছাড়া, আমি এমনিতেও এখন বের হতাম লাঞ্চের জন্য। চলুন না, একসাথেই খেয়ে নেয়া যাক।’

উপায়ান্ত না পেয়ে কাঁধ ঝাঁকালাম আমি, ‘চলুন।’

*******

একটানা ছড় টেনে চলেছি আমি। তালের দিকে কোন খেয়াল নেই আমার। বৃষ্টির টিপ টিপ তালে এক নাগাড়ে টেনে যাচ্ছি বেহালার ছড়।

আজকেও সারাটাদিন বৃষ্টি ঝরেছে। বৃষ্টির দিনগুলোতে সাধারনত মন ভাল থাকে। কিন্তু আজ কেন যেন ভাল লাগছে না আমার। কেমন একটা গুমোট ভাব বিরাজ করছে মনের মধ্যে।

দু’সপ্তাহ কেটে গেছে এরইমধ্যে। অলীনকে এই দু’সপ্তাহ নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা হয়েছিল। অবশ্য পুলিশ প্রথমে মানতে চায়নি, কিন্তু ডাক্তার সোহরাব হোসেন সব সামলে নিয়েছেন। পুলিশকে জানানোটা জরুরী ছিল, তাই জানিয়েছিলেন ডাক্তার। ডায়েরীটা বর্তমানে পুলিশের কাছ আছে। মোট পনেরোটা খুনের হোতা অলীন।

কাল একটা মেন্টাল হসপিটালে ট্রান্সফার করা হবে অলীনকে। দু’সপ্তাহে ওর কাছ থেকে কিছুই বের করতে পারেননি ডাক্তার। তাই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অবশ্য এতে ওর কোন উপকার হবে কি না, সেটা নিয়ে আমার নিজের মধ্যেই সন্দেহ আছে।

সেলফোনের তীক্ষ্ণ শব্দে মনোযোগ ছুটে গেলো আমার। বেহালাটা একদিকে কাত করে রেখে ফোনটা তুলে নিলাম আমি। স্ক্রিনটা চোখের সামনে নিতেই ডাক্তার সোহরাব হোসেনের নামটা চোখে পড়লো আমার।

কল রিসিভ করলাম আমি।

-‘হ্যালো?’

-‘শুভ ভাই, সমস্যা হয়ে গেছে একটা।’

-‘কি হয়েছে।’

-‘অলীন পালিয়েছে।’

-‘মানে কি? কখন?’

-‘এই কিছুক্ষণ আগে এক নার্স এসে খবর দিলো আমাকে। আধঘন্টা আগেও নিজের কেবিনেই ছিল মেয়েটি। কিভাবে পালালো, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।’

-‘দাড়ান, আসছি আমি।’

-‘আপনার আসার দরকার নেই। আমার মনে হয়, আপনার ওখানে যাবে ও। আপনি বাসা থেকে নড়বেন না। আমি আসছি আপনার বাসায়।’

-‘ঠিক আছে।’

কলটা কেটে যেতেই হতভম্ভের মতো কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে থাকলাম আমি সেলফোনের দিকে। তারপর উঠে দাঁড়ালাম।

কি করা উচিৎ এখন, বুঝতে পারছি না আমি। মেয়েটা যে এভাবে পালিয়ে যাবে, তা ভাবতেও পারছি না আমি। কিভাবে কি হয়ে গেলো, কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার।

ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে চুপচাপ বসলাম আমি। মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তা ভীর করছে আমার। অপেক্ষা করছি ডাক্তার সোহরাব হোসেনের জন্য।

ঘন্টাখানেক পর কলিং বেল বেজে উঠলো। দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি। ডাক্তার এসেছেন সম্ভবত।

দরজা খুলতেই হা হয়ে গেলাম আমি। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে অলীন। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার সোহরাব হোসেন। হতভম্ব ভাবটা কাটার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়লো অলীন আমার উপর।

ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি। দ্রুত আমার উপর উঠে বসলো অলীন। তার পিছু পিছু একটা ব্যাগ হাতে রুমে ঢুকলেন ডাক্তার সোহরাব হোসেন। অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি।

‘কি ভেবেছিলে?’ আমার মুখের কাছে মুখ এনে বললো অলীন, ‘আমার হাত থেকে এতো সহজেই বেঁচে যাবে? এতো সহজ নয় শুভ। তোমাকে খুন করবো আমি। তারপর হারিয়ে যাবো এই শহর থেকে, এই সমাজ থেকে। আর আমার পালিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করবেন গুরুজি।’

‘মানে কি?’ বিস্ময় বাড়ছে আমার, ‘গুরুজি? সোহরাব ভাই, আপনি?’

‘হ্যাঁ,’ মৃদু হেসে বসে উঠলেন ডাক্তার, ‘আমিই গুরুজি। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান।’

ব্যাগ খুলে দুটো ফ্লেক্সিকাফ বের করলেন ডাক্তার, বাড়িয়ে দিলেন অলীনের দিকে। দ্রুত আমার দু’হাত আর দু’পা ফ্লেক্সিকাফে আটকে দিলো অলীন। তারপর দুজনে মিলে আমাকে ধরে দাড় করালো। আমি কিছু করার আগেই একটা সোফার উপর ছুঁড়ে ফেললো আমাকে।

‘কিছুই বুঝতে পারছি না আমি,’ ধীরে ধীরে বলে উঠলাম আমি, ‘অলীন আর আপনি... কিভাবে?’

‘এতোকিছু বুঝে লাভ নেই তোমার,’ গম্ভীরসুরে বলে উঠলেন সোহরাব, ‘শুধু এটুকু বুঝে নাও, কিছুক্ষনের মধ্যেই মহান লুসিফারের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হবে তোমাকে। তৈরী হও সেজন্য।’

কিছু একটা করা দরকার আমার, কিন্তু কিছু করার আগেই আরো কয়েকটা ফ্লেক্সিকাফ বের করলেন সোহরাব হোসেন। অলীন গিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে এসে রাখলো আমার সামনে। তারপর দুজনে মিলে আমাকে ধরে বসিয়ে দিলো চেয়ারের মধ্যে। চেয়ারের হাতল আর পায়ার সাথে আমাকে পুরোপুরি আটকে দিলো ফ্লেক্সিকাফ দিয়ে। এখন আর সামান্যতমই নড়বার উপায় নেই আমার।

‘সৌভাগ্যবান তুমি,’ ধীরে ধীরে বলে চলেছে অলীন, ‘মহান লুসিফারের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হচ্ছে তোমাকে। এমন ভাগ্য সবার হয়না।’

‘বাল আমার,’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘এটা সৌভাগ্য না, এটা আমার চরম দুর্ভাগ্য যে শয়তানের নামে বলি হচ্ছি আমি। সৌভাগ্য তোমাদের, কারন হাত পা বাঁধা আমার। নাহলে এতোক্ষনে বের করে ফেলতাম তোমাদের ভরং।’

বিরক্তভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন সোহরাব। দ্রুত পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার হা করা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর একটা স্কচটেপ দিয়ে আটকে দিলেন।

এখন আর কিছু বলার উপায় নেই আমার। এমনকি টু শব্দটাও করতে পারবো না আমি।

ব্যাগ থেকে কিছু জিনিস বের করে মেঝেতে সাজিয়ে রাখতে লাগলো ওরা দুজন। পাঁচটা মোমবাতি, কিছু পশম, কোন পশুর হাড়, এসব সাজিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে সেদিকে ইঙ্গিত করলো।

‘পেন্টাকল,’ বলে উঠলেন ডাক্তার সোহরাব, ‘সুন্দর না?’

কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই আমি। তাই কথা বলার চেষ্টা করে শক্তি খরচ করার ঝামেলায় গেলাম আমি। চুপচাপ তাকিয়ে আছি ওদের দুজনের দিকে। কি করে, এটাই দেখার বিষয়।

এমনসময় একটা ‘দুম’ করে শব্দ শুনতে পেলাম। দ্রুত চমকে গিয়ে শব্দের উৎসের দিকে তাকালাম আমি। যা দেখলাম, তাতে আবারও অবাক হলাম আমি।

আমার বাসার দরজা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ভাঙ্গা দরজা দিয়ে রাইফেল উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো কয়েকজন কনস্টেবল, আর তার পেছন পেছন এখানকার লোকাল থানার ওসি। তবে সবচেয়ে অবাক হলাম যাকে দেখে, তাকে এখানে আশাও করিনি আমি।

‘সুপ্তি!’ মনে মনে বলে উঠলাম আমি, ‘ও এখানে কি করছে?’

ঘরে ঢুকেই হুংকার ছাড়লেন ওসি সাহেব, ‘এই দুইটাকে এরেষ্ট করো।’

*******

ভাঙ্গা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। খুবই ক্লান্ত লাগছে। ধীরে ধীরে সোফায় গিয়ে বসলাম। আমার ঠিক পাশেই এসে বসলো সুপ্তি।

চোখ বন্ধ করে ভাবছি আমি। মাথাটা ব্যাথা করছে কিছুটা। কাহিনী কিছুটা জট পাকিয়ে গেছে।
অলীন আর সোহরাব হোসেন পালিয়ে গেছে। পুলিশ এসে ওদেরকে এরেষ্ট করেছিল ঠিকই, কিন্তু বাইরে ওদের যে আরো কয়েকজন লোক অপেক্ষা করছিল, সেটা জানা ছিল না কারো। বিল্ডিংয়ের বাইরে বের হতেই পুলিশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা এবং ছিনিয়ে নিয়ে যায় ওদের দুজনকে। কিছুই করার ছিল না আসলে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘটনাটা ঘটে যায়।

অবশ্য ওরা পালিয়ে যাওয়ার পর পরই সক্রিয় হয়ে উঠেন ওসি সাহেব। সাথে সাথেই ওয়্যারলেসে আরো কয়েকজনকে জানিয়ে দেন ঘটনাটা। পুরো শহর চষে ফেলার হুকুম দিয়েছেন উনি। পনেরোটা খুনের আসামী অলীন, আর সোহরাব হোসেন একজন শয়তানের উপাসক। ওসি সাহেব কথা দিয়েছেন, এতো সহজে ছাড় দেবেন না ওদের।

এ বাসায় থাকাটা আপাতত নিরাপদ নয় আমার জন্য। নতুন বাসা খুঁজতে হবে। কিন্তু এতো রাতে অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভবও নয়। যা করার কাল সকালে উঠে করতে হবে। কথাটা ওসি সাহেবকে বলতেই দুজন কনস্টেবলকে ফ্ল্যাট পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করে গেছেন উনি। যতোদিন না নতুন বাসায় উঠছি, পালা করে দুজন করে কনস্টেবল পাহারা দেবে আমার বাসায়।

সুপ্তির ব্যাপারটা এখনো পরিস্কার হয়নি আমার কাছে। আমার জানামতে, সেই অলীনকে নিয়ে গিয়েছিল সোহরাব হোসেইন ওরফে গুরুজির কাছে। ও নিজেও শয়তানের পুজা করতো বলে জানি আমি। কিন্তু হঠাত করে ওদের বিরুদ্ধে চলে গেলো কেন মেয়েটা, তা বুঝতে পারছি না আমি।

‘কাহিনী কি?’ চোখ খুলে প্রশ্ন করলাম আমি, ‘হঠাত বান্ধবীর বিপক্ষে চলে গেলে যে?’

‘ভুল করেছিলাম আমি,’ মৃদুস্বরে বলে উঠলো মেয়েটা, ‘প্রথমে ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রতি একটা ফ্যাসিনেশন কাজ করছিল আমার। কিন্তু একা একা কাজটা করা ঠিক মনে করিনি আমি। সেই কারনেই আমার সাথে অলীনকে নিই আমি। কিন্তু যতোই দিন যেতে লাগলো, এর উপর বিরক্তি ধরে গেলো আমার। ঠিক করলাম, বের হয়ে আসবো এখান থেকে। কিন্তু বের হওয়াটা সহজ ছিল না আমার জন্য। একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম আমি। আজকে সেই সুযোগটা এসে গেলো। তাই আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করিনি আমি।’

‘আজকে কিভাবে সুযোগ আসলো?’ একই সুরে প্রশ্ন করলাম আমি।

‘ফোন করেছিল অলীন আমাকে,’ দ্রুত উত্তর দিলো সুপ্তি, ‘সোহরাব ডাক্তারের চেম্বার থেকে। আজকে পালাবে বলেছিল, আর তার আগে তোমাকে উৎসর্গ করবে লুসিফারের উদ্দেশ্যে। জিজ্ঞেস করেছিল, আমার ওখানে দুটো দিন থাকতে পারবে কি না। তখনই সিদ্ধান্ত নিই যে, ওর প্ল্যান সফল হতে দেবো না আমি। আর তাই সরাসরি পুলিশ নিয়ে চলে এসেছি এখানে।’

‘বুঝলাম,’ মাথা নাড়লাম আমি।

যদিও কিছু প্রশ্ন এখানে থেকে যায়, তবুও এখন অনেককিছুই পরিস্কার আমার কাছে।

খুবই ক্লান্ত আমি। একটু ঘুমানো দরকার। এতো রাতে বাসায় ফিরে যেতে পারবে না সুপ্তিও। তাই ওকে আমার বেডরুম ব্যবহার করতে দিয়ে সোফার উপরই শুয়ে পড়লাম আমি।

*******

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। হঠাত করেই কানের কাছে কয়েকজন মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম। আর তাকাতেই বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো আমার। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন লোক। ছয়জন যুবক এবং দুইজন তরুণী। তাদের মধ্যে তিনজনকে চিনি আমি।

অলীন, সুপ্তি এবং ডাক্তার সোহরাব হোসেন!

‘এবার শুভ!’ মুচকি হেসে বলে উঠলো সুপ্তি, ‘কোথায় যাবে তুমি? তোমার পাহারায় থাকা কনস্টেবলরা চা খেতে গেছে, এই সুযোগে তোমাকে পুরোপুরি গুম করে ফেলবো আমরা।’

ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। দ্রুত ছুট লাগালাম ভাঙ্গা দরজা লক্ষ্য করে। কিন্তু মাঝপথেই আমাকে ধরে মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ডাক্তার সোহরাব হোসেন আর কয়েকজন যুবক। দড়াম করে মেঝের মধ্যে পড়ে গেলাম আমি। পড়ে গিয়েই গড়ান দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ইস্পাতের মতো কয়েকটা শক্ত হাত মেঝের সাথে চেপে ধরলো আমাকে।

আবারও আটকা পড়লাম আমি।

‘এর আশাতেই ছিলাম আমি,’ এমনসময় একটা গুরুগম্ভীর স্বর শুনে যেন চমকে উঠলো রুমের সবাই, সেইসাথে আমি নিজেও কম চমকাইনি। ভাঙ্গা দরজায় একটা পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ওসি সাহেব।

ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন ওসি সাহেব। তার পেছন পেছন রাইফেল হাতে ঢুকলো দশ বারোজন কনস্টেবল। একে একে সবাইকে ধরেই দাড় করিয়ে দিল, তারপর হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিলো সবার হাতে।

ছাড়া পেয়ে উঠে দাড়িয়েছি আমি। হা করে তাকিয়ে আছি সবার দিকে। মনের ভেতরে অনেওগুলো প্রশ্ন জমা হয়েছে আমার।

আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই হয়তো মুখ খুললেন ওসি সাহেব, ‘বুঝতে পারছি। সবই খুলে বলবো আপনাকে, কিন্তু তার আগে এদের একটা ব্যবস্থা করে আসি। আপনি রিল্যাক্স করে বসুন, দশ মিনিটের মধ্যেই ফিরছি আমি।’

সবাইকে গরুর মতো করে খেদিয়ে বাইরে নিয়ে গেলো কনস্টেবলরা। তাদের পিছু নিলেন ওসি সাহেব। ধীরে ধীরে সোফায় গিয়ে বসলাম আমি। কিছুক্ষণ পরই আবার ফিরে এলেন ওসি। আমার পাশেই আরেক সোফায় বসে পড়লেন তিনি।

‘পাঠিয়ে দিয়েছি ওদেরকে,’ মৃদু হেসে বললেন তিনি, ‘সঙ্গে বিশজন কনস্টেবল নিয়ে এসেছিলাম আমি। এবার আর কোন ভয় নেই।’

‘আপনি বলেছিলেন,’ ধীরে ধীরে বলে উঠলাম আমি, ‘দুজন কনস্টেবল আজ রাতটা পুরোটা সময় পাহারা দেবে আমার ফ্ল্যাট। কিন্তু কিছুক্ষণ পাহারা দেয়ার পর ছিল না তারা।’

‘ওটা আমারই নির্দেশ ছিল,’ হাসিটা বিস্তৃত হলো উনার, ‘এরা যে কি মনে করে আমাদেরকে! পুলিশকে পাবলিক সারাটা জীবনই গাধা ভেবে এসেছে।’

‘আমি নিজেও ভাবি,’ মনে মনে আউড়ালাম আমি।

‘সুপ্তি মেয়েটা যখন আমার কাছে এসে সবকিছু খুলে বলে,’ বলেই চলেছেন তিনি, ‘তখনই আমার সন্দেহ হয়। তাছাড়া, আমরা, মানে পুলিশ যে আসবে এখানে, তা জানার কথা নয় ডাক্তার সোহরাবের। অথচ ঠিকই বাইরে লোক রেখেছিল সে। আমরা যখন ভেতরে ঢুকি, তখনও বাঁধা দেয়নি ওরা। কেন? এই প্রশ্নটাই আমার মাথায় ঘুরছিল। এ কারনেই কনস্টেবল দুজনকে নির্দেশ দিই আমি, আপনি ঘুমিয়ে পড়লে যেন চলে আসে এখান থেকে। তখন চলে যাওয়ার ভাব করলেও আসলে যাইনি আমি। তার বদলে আরো কয়েকজন কনস্টেবলকে এখানে আসতে বলি। ধারণা করেছিলাম, ওরা আবারও আসবে এখানে। যাকে একবার টার্গেট করে ওরা, তাকে যেকোন মূল্যেই প্রয়োজন ওদের। আর দেখুন, আমার ধারণা সঠিক ছিল।’

বলেই জোড়ে হেসে উঠলেন তিনি।

‘এখন?’ একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করলাম আমি।

‘এখন আর কি,’ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হাসিমুখেই বললেন, ‘কাল সকালে একটু থানায় আসতে হবে আপনাকে। কেসটার বিবরণ নথিভুক্ত করতে হবে। বোঝেনই তো। যাইহোক, আপনি ঘুমান। আমি এখন যাই। ও হ্যাঁ, দুজন কনস্টেবল থাকবে আপনার ফ্ল্যাটের সামনেই। এবার সারা রাত পাহারা দেবার নির্দেশ থাকবে ওদের উপর।’

‘ধন্যবাদ,’ মৃদু হাসলাম আমি নিজেও।

এখন আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না আমার। প্রচন্ড ক্লান্ত আমি। একটা শান্তির ঘুম প্রয়োজন আমার।

*******

বাইরে বেড়াল-কুকুর বৃষ্টি হচ্ছে, মানে ক্যাট এন্ড ডগস আর কি। সন্ধ্যা থেকে একটানা ঝরছে তো ঝরছেই।

অবশ্য বৃষ্টি কখনোই কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি আমার জন্য। আমি বৃষ্টি ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বৃষ্টির দিনে বেহালা বাজাতে।

সোফার পাশ থেকে বেহালাটার ব্যাগটা তুলে নিলাম আমি। চেইন খুলে ভেতর থেকে বের করলাম বেহালাটা। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে ছড় টানতে লাগলাম। এলোমেলোভাবে!

ইতোমধ্যেই এক বছর কেটে গেছে। অলীন, সুপ্তি আর ডাক্তার সোহরাবকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখনো হাজতি হিসেবেই আছে ওরা। বিচারকাজ চলছে ওদের। মাসে একবার করে গিয়ে আদালতে হাজির হতে হয় আমাকে। যেকোনদিন রায় দিয়ে দেওয়া হবে ওদের।

ওদের ব্যাপারে আমার আর কোন আগ্রহ নেই। এমনকি অলীনের ব্যাপারেও না। এটা ঠিক যে, অলীনের প্রতি দুর্বল ছিলাম আমি, কিন্তু সেই মোহ কেটে গেছে আমার। এখন আর এসব নিয়ে ভাবি না আমি। এখন আমার ধ্যানজ্ঞান শুধু এবং শুধুমাত্র বেহালা বাজানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

বাইরে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ছে ঝির ঝির করে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমার হাতে বেহালার ছড়গুলোও কাঁপছে। এলোমেলোভাবে ছড় টানছি আমি।

আচ্ছা, আমার বেহালার ছড়গুলোও যদি কোন মানুষের অন্ত্র দিয়ে তৈরী হয়, তাহলে কেমন হবে? সত্যিই কি স্বর্গীয় সুর বের হয় মানুষের অন্ত্রের তৈরী স্ট্রিং থেকে?

ভাবনাটা মাথায় আসতেই কেন যেন খুশী হয়ে উঠলাম আমি। বুঝতে পারলাম, ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে আমার।

রহস্যময় হাসি!
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×