somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৩: হেট্রিংক্স

২২ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘তুমি তাহলে যাচ্ছো না?’ হতাশস্বরে বলে উঠলো রেইনা।
ওর চোখের দিকে তাকালাম আমি। দৃষ্টিতে এক প্রকার আকুলতা। একটা সময় এই চোখের মায়া দেখে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না। অথচ এখন আর সেটা হয়না কখনোই। এরকম নয় যে ভালোবাসাটা কমে গেছে। আসলে দায়িত্ব বলেও কিছু জিনিস থাকে। ভালোবাসাটা তখন কিছুটা ফিকে হয়ে যায়।
‘তুমি তো জানোই,’ ওর চোখে তাকিয়ে বললাম আমি, ‘কাজ। দুটো সপ্তাহ কাজ থেকে বাইরে থাকা যায় না। কোম্পানীটা আমার নিজের নয়।’
‘ঠিক আছে,’ মৃদু মাথা নাড়লো ও, ‘তাহলে আর কি করা!’
‘মন খারাপ করো না প্লিজ,’ ওর কাঁধের উপর হাত রাখলাম আমি।
‘মন খারাপ করিনি আমি,’ মুচকি হেসে বললো ও।
যদিও মুখে বললো মন খারাপ করেনি, তবুও ওর ভেতরের ব্যাপারটা জানি আমি। ভালোবাসলে এসব জানতে হয়।

*******
“ঈশ্বর তখন এঞ্জেলদের বলেন লিলিথকে ফিরিয়ে আনতে। নইলে প্রতিদিন ১০০ সন্তান মেরে ফেলার অনুমতি দিতে হবে লিলিথকে।
অ্যাডামের প্রথম স্ত্রী লিলিথ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হবার পর সে প্রতিদিন ১০০ সন্তান নষ্টের অনুমতি পায়। সাথে এই ক্ষমতাও পায়, ছেলে নবজাতককে ৮ দিন এবং মেয়ে নবজাতককে ২০ দিন রোগে আক্রান্ত করার। কিন্তু ঈশ্বরের নির্দেশে ঐ তিনজন এঞ্জেল তাকে ফিরিয়ে আনতে গেলে লিলিথ প্রতিজ্ঞা করে, যখন তাদের নাম কোন মাদুলিতে দেখবে তখন সে আর এমন করবে না।
স্বর্গ থেকে বিতাড়িত লিলিথ এখন একা, অতৃপ্ত। রাতের আঁধারে অবিবাহিত ঘুমন্ত ছেলেদের সাথে মিলিত হয়ে যাচ্ছে লিলিথ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। অতৃপ্ত লিলিথ নিজের যৌন ক্ষুধা মিটিয়ে যাচ্ছে এভাবেই। আর কথা মত, প্রতিদিন ১০০ শিশুর মৃত্যু ঘটছে এই যৌথ ক্রিয়ায়।”
গম্ভীর কন্ঠে থেমে থেমে উচ্চারন করছে রুদ্র। মাথাটা নিচু করে রেখেছে কেন যেন। চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে আসছে ওর।
হঠাত করেই দৃশ্যপট পাল্টে গেলো। রুদ্রের জায়গায় এখন বসে আছেন আংকেল ইথান। একইভাবে মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। বা হাত তুলে একবার নিজের চোখ মুছলেন। তারপর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেললেন।
“রেইনার ব্যাপারটা আমি ওর জন্মের পর থেকেই জানি। তোমারটা জানতাম না। নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো, তোমাকে ওর সাথে দেখে চমকে উঠি আমি। কারন, তুমি নিজেও এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। যাকে বলে অমানব বা ডেসিয়েরটু (desierto)।
তোমাদের দুজনের চোখের মণির রং কালচে বেগুনী। খুব ভালোভাবে না তাকালে যা ধরা পড়ে না। এগুলো হচ্ছে অমানব বা ডেসিয়েরটু (desierto) হবার প্রমান।
মজার কথা কি জানো? এই রকম পারফেক্ট মিল সচরাচর দেখা যায় না। প্রতি ছয়শত ছেষট্টি বছর পর পর এরকম দুটো বাচ্চা পৃথিবীতে জন্ম নিতে দেখা যায়। আর সেই হিসেবে তোমরাই সেই দুজন। তোমার জন্ম হয়েছে সন্ধ্যায়। রেইনার জন্ম সকালে। যার ফলে তোমরা দুজন দুজনের শত্রু। তোমরা দুজন কোনভাবেই এক হতে পারবে না কখনো। এটাই নিয়ম।’
আবার দৃশ্যপটে পরিবর্তন! ঠিক যেমন করে এসেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে মিলিয়ে গেলেন আংকেল ইথান। তার জায়গায় এখন আরেকজনকে দেখা যাচ্ছে।
চেহারাটা ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছে না। যেন কোন প্রকার কুয়াশায় ঢেকে আছে সে। অবয়বটা কোন মতে চেনা যাচ্ছে।
“প্রিপেয়ার সি আ মরোর। এসতো ভিনদো পারা তি। সি নন পদ অবতেইর আ রেসপোসতা, তেন ক্যু মরোর। এ য়্যু প্রমেতের কুই ভেই সের ও পেওর দা স ভিদা।’
এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেলো সে। ধীরে ধীরে তার চেহারার সামনে থেকে কুয়াশাটা কেটে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে তার চেহারা। যতোই স্পষ্ট হচ্ছে, ততোই বিস্মিত হচ্ছি আমি।
ঋতু?
কাঁপছে। সবকিছু মনে হয় কাঁপছে। আমার জগতটা কাঁপছে। সেই সাথে তীক্ষ্ণ একটা সুর বাজছে। ধীরে ধীরে কাঁপুনিটা বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে শব্দের তীব্রতাও বেড়ে যাচ্ছে।
ভুমিকম্প শুরু হলো নাকি?
ধরমর করে উঠে পড়লাম আমি। বিছানায় বসে দ্রুত আশেপাশে তাকালাম। কিন্তু কোথাও তো ভুমিকম্পের চিহ্নও নেই। তাহলে?
এতোক্ষনে বুঝতে পারলাম কি ঘটেছে আসলে। সেলফোনটা আমার পিঠের তলায় পড়েছিল। ঘুমের ঘোরে সেটার ভাইব্রেশনকেই ভুমিকম্প বলে মনে করেছি আমি।
স্বপ্ন দেখছিলাম এতোক্ষন!
আবার তীক্ষ্ণস্বরে বেজে উঠলো সেলফোন। স্ক্রিনটা চোখের সামনে ধরতেই রেইনার নাম দেখতে পেলাম। রিসিভ করলাম আমি।

-‘হ্যালো?’
-‘ঘুম ভাংলো তোমার?’
-‘হ্যাঁ, ভেঙ্গেছে।’
-‘কেমন আছো?’
-‘এইতো, ভালই। তুমি কেমন আছো?’
-‘ভালই কাটছে দিন।’
-‘ঝামেলা শেষ করে তাড়াতাড়ি চলে এসো।’
-‘ঝামেলা প্রায় শেষের পথে। গত কয়েক মাসে ইথান আংকেলের বাড়িটার যে কি হাল হয়েছে, তা যদি তুমি দেখতে! উফফ! আমি ভেবেই পাচ্ছি না, মাত্র সাড়ে চার মাসে একটা বাড়ির এই দশা হয় কি করে!’
-‘খুবই খারাপ অবস্থা?’
-‘তা আর বলতে! তুমি তো এলে না। এখানে এলে নিজের চোখেই দেখতে পারতে।’
-‘সরি। কাজটাতে এমনভাবেই আটকে গেছিলাম যে...’
-‘সেজন্যই তো জোড় করিনি। যাই হোক। আমি কাল ফিরছি।’
-‘সত্যি?’
-‘হ্যাঁ, সত্যি। এখন আমি রাখি। লাভ ইউ।’
-‘লাভ ইউ টু।’

কল কেটে দিলো ও। সেলফোনটা বিছানার পাশে রেখে আবার বালিশে মুখ ঢাকলাম আমি।

*******
‘আরিয়ান শুভ?’ প্যাডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো যুবক।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম আমি।
‘পার্সেল ফর ইউ,’ একটা কলম এবং হাতে থাকা প্যাডটা এগিয়ে দিয়ে বললো সে, ‘হেয়ার।’
দ্রুত কাগজে নিজের সিগনেচার দিতেই একটা পার্সেল বাড়িয়ে দিলো লোকটা আমার দিকে। পার্সেলটা হাতে নিয়ে দরজাটা আটকে দিলাম আমি। তারপর সোফায় এসে বসলাম।
পার্সেল প্যাকেটের ভেতর থেকে একটা ল্যাপটপ আর একটা কাগজ বের হলো। প্রথমেই কাগজটার দিকে নজর দিলাম আমি। সেখানে দুটো প্যারা লেখা। প্রথম প্যারার দিকে নজর দিলাম আমি,
‘para Lucifer, e tamén para Lilith, imos dedicar-lle. prepare-se a morrer ... se non pode obter a resposta correcta, vai perder Reina. 192.168.101.2’
‘মানে কি এর?’ ভ্রু কুঁচকে গেলো আমার। এটার দিকে নজর না দিয়ে পরের প্যারার দিকে নজর দিলাম আমি। সেখানে লেখা,
‘We've abducted Reina. To save her, open BLUESTONE and follow the instructions. ---LILIFER’
দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি। আবারও পড়লাম দ্বিতীয় প্যারা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লেও হয়তো এতোটা অবাক হতাম না আমি।
রেইনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে!
দ্রুত সেলফোনটা তুলে নিলাম আমি। কল করলাম রাইনার নম্বরে।
সুইচড অফ!
আবারও চেষ্টা করলাম। ফলাফল একই। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর সেলফোনটা পকেটে রাখলাম আমি। বুঝতে পারছি, মিথ্যে বলেনি ওরা।
মনের ভেতর একটা ক্রোধ দানা পাকিয়ে উঠছে আমার। ইচ্ছে করছে যে বা যারা এর সাথে জড়িত, তাদের সবাইকে ধরে চিড়ে ফেলতে। কিন্তু তা করতে চাইলে আগে এদেরকে সনাক্ত করতে হবে। মাথার মধ্যে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরছে আমার, কারা এরা?
অনেক কষ্টে নিজের ভেতর বেড়ে উঠতে থাকা ক্রোধটাকে থামালাম আমি। রেগে যাবার সময় নয় এটা। এখন মাথাটা ঠান্ডা রাখা দরকার। আমি জানিনা কাদের কাজ এটা। কিছু করার আগে ওদের পুরো ব্যপারটা বুঝতে হবে আমাকে।
কাগজটা তুলে নিলাম আমি। আবারও প্রথম প্যারাটা পড়লাম। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না এটার। ল্যাপটপে হয়তো কিছু থাকতে পারে। তাই সেটার দিকেই হাত বাড়ালাম আমি। অন বাটনটা টিপে দিলাম দ্রুত।
ল্যাপটপটা অন হতেই ভেতরে থাকা ফাইলগুলো দেখতে চাইলাম আমি, কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, হার্ডডিষ্কে বলতে গেলে কিছুই নেই, শুধুমাত্র কয়েকটা সফটওয়্যার ছাড়া। তবুও ইন্সটল করার পর সি ড্রাইভ ছাড়া আর বাকিগুলোতে কিছুই রাখা হয়নি।
কি করবো, কিছুই বুঝতে পারছি না।
আরো কিছুক্ষণ চিন্তা করে ল্যাপটপের সার্চ অপশনে গিয়ে BLUESTONE লিখে সার্চ দিলাম আমি। কিছুই নেই। চিন্তায় পড়ে গেলাম।
চিরকুটের দিকে নজর দিলাম আমি। প্রথম প্যারাটা আবারও পড়লাম। কিন্তু কিছুই বোঝা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। আচ্ছা, এটা দিয়ে সার্চ দিলে কি কিছু পাওয়া যাবে?
192.168.101.2
সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে একটা আইপি এড্রেস। কিন্তু কিসের?
আইপি এড্রেসটা দিয়ে ট্রাই করলাম, কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাহলে?
বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পরও মাথায় কিছু এলো না। কি করবো বুঝতে পারছিনা আসলে। তবুও ট্রাই করতে হবে আমাকে। আর সেটা করতে গিয়ে মনে হলো, পুরো প্যারাটা লিখে সার্চ দেওয়া দরকার।
আইপি এড্রেসটা বাদে পুরো প্যারাটা লিখে সার্চ দিলাম আমি। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, একটা ফাইল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো, ফাইলটা পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড।
জিনিসটা বুঝতে সময় লাগলো না আমার। পাসওয়ার্ড ওরা এর সাথেই পাঠিয়েছে। আমি যেটাকে আইপি বলে মনে করছিলাম এতক্ষণ, সেটাই আসলে পাসওয়ার্ড।
দ্রুত পাসওয়ার্ডটা টাইপ করে এন্টারে চাপ দিতেই ফাইলটা খুলে গেলো। একটা ভিডিও পাওয়া গেলো। ওপেন করলাম সেটা।
আটাশ মিনিটের ভিডিও এটা। পুরোটা দুবার করে দেখলাম আমি। কাহিনীটা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি এখন।
কাজটা লিলিফারদের। লিলিফার একটা গোত্রের নাম। শয়তানের উপাসকদের গোপন একটা সংঘ। তবে পার্থক্য হচ্ছে এই, এরা শয়তান লুসিফারের সাথে সাথে লিলিথেরও উপাসনা করে। এ কারনেই তাদের সংগঠনের নাম লিলিফার। লিলিথ আর লুসিফারের নাম অনুসারে।
রেইনাকে কিডন্যাপ করে কোথাও রেখেছে তারা, এখন মুক্তিপন দাবী করছে। মুক্তিপন বলতে কোন ক্যাশ নয়, ব্লুস্টোন নামের একটা পাথর দরকার তাদের, এবং সেই সাথে একটা টাস্ক কমপ্লিট করতে হবে।
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে আমার ইতোমধ্যেই। মস্করা করার একটা জায়গা আছে। এটা কি ধরনের বাতুলতা? লুসিফার এবং লিলিথ কখনোই একত্র হতে পারেনা এবং তারা কখনো সেটা চাইবেও না। ইভকে সৃষ্টির পর পরই সেই সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। অথচ এখন একটা সংঘ ঠিক এই কাজটাই করতে চাচ্ছে।
হঠাত করেই রিংটোনের শব্দে কিছুটা চমকে উঠলাম আমি। পকেট থেকে সেলফোনটা বের করলাম। একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে করল করা হয়েছে। কলটা রিসিভ করলাম আমি। ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর গলা কথা বলছে।
‘আশা করি ভিডিওটা দেখেছেন আপনি।’
‘কে আপনি?’ দৃঢ়কন্ঠে প্রশ্ন করলাম আমি।
‘তা জানানোর কোন প্রয়োজনবোধ করছি না,’ সকৌতুকে বলে উঠলো সে, ‘আপনাকে শুধু এটুকু জানানোর জন্যই ফোন করেছি যে, আগামী পাঁচ দিন হাতে আছে আপনার কাজটা করার জন্য। তাড়াতাড়ি কাজে নেমে পড়ুন। কাজটাতে পুরোপুরি সাহায্য পাবেন আমাদের পক্ষ থেকে।’
‘দেখুন,’ গলা চড়ছে আমার, ‘আপনাদের কোন কাজে আমি সহায়তা করতে পারবো না মোটেও। কে আপনি, স্পষ্ট করে বলুন। না হলে এসব আমি পুলিশকে দেখাতে বাধ্য হবো।’
‘ভুল করবেন,’ ওপাশ থেকে যেন ব্যাঙ্গ করা হলো, ‘সে ক্ষেত্রে রেইনাকে মেরে ফেলতে বাধ্য হবো আমরা।’
‘সামান্য একটা পাথরের জন্য এভাবে উঠে পড়ে লাগার মানেটা কি?’ আবারও প্রশ্ন করলাম আমি।
‘পাথরটা সামান্য নয়,’ গম্ভীরস্বরটা যেন আরো ভারী হয়ে এলো, ‘পাথরটা সামান্য হলে আপনাকে কষ্ট দেওয়ার কোন প্রয়োজন পড়তো না আমাদের। এই কাজটা সবার দ্বারা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র লুসিফার কিংবা লিলিথের বংশধররাই এই কাজটা করতে পারবে। অর্থাৎ, অমানব এবং অপমানবী ছাড়া সাধারণ কেউ এই কাজটা করতে পারবে না।’
‘মানে কি?’ অবাক হলাম আমি।
‘এক চান্দ্রমাসের মান ২৯.৫৩ দিন। ২৯.৫৩কে পূর্ণ সংখ্যায় ধরা হয় ৩০দিন। এই ৩০ দিনকে ৩০টি সমান ভাগে ভাগ করা হয়, এক একটা ভাগকে বলা হয় তিথি। তিথি হলো ১ চান্দ্রদিন। এবার প্রশ্নটা হলো, কেন?
অমাবস্যা কে আদি তিথি বা ১ম দিন ধরা হয়। যখন চন্দ্র ও সূর্য্যের একই সরলরেখায় মিলন হয় তখন অমাবস্যা হয় । সুতরাং তিথি= ১ চান্দ্রদিন।
অমাবস্যার পরের দিন প্রতিপদ বা প্রথমা এবং শুরু শুক্লপক্ষ। সুতরাং অমাবস্যার পরের দিন শুক্লপক্ষের প্রতিপদ বা প্রথমা। চন্দ্র, সূর্যের সাপেক্ষে ১২ ডিগ্রী কৌণিক দূরত্ব অতিক্রম করলেই প্রতিপদ বা প্রথমার শেষ এবং শুক্লা দ্বিতীয়ার আরম্ভ।
পক্ষ ২টি। শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষ। পক্ষ সাধারণত ১৫ দিনের। অমাবস্যা থেকে পরের ১৫ দিন পর পূর্ণিমা। এই ১৫ দিন শুক্লপক্ষ । আবার পূর্ণিমা থেকে পরের ১৫ দিন পর অমাবস্যা। এই ১৫ দিন কৃষ্ণপক্ষ। সুতরাং ১ চান্দ্রমাসের ১ম ১৫ দিন শুক্লপক্ষীয় এবং ২য় ১৫ দিন কৃষ্ণপক্ষীয়। তিথি, যে কোন দিনাঙ্কের যে কোন সময়ে শুরু হতে পারে; দিনে অথবা রাত্রিতে।
সাধারণত পঞ্জিকার যে কোন দিনাঙ্কের সূর্যোদয়ের সময় যে তিথি চলছে সেটাই সেই সৌরদিনের তিথি হিসাবে গণ্য হবে। তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। এর কারণ চন্দ্রের জটিল গতি। চন্দ্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে এক কক্ষপথে ঘুরে চলেছে, এটা আমরা সবাই জানি। কক্ষপথটি কিন্তু উপবৃত্তাকার। যার ফলে চন্দ্রের গতি সেই কক্ষপথে সব জায়গায় সমান নয়। কখনো ধীরে, কখনো জোরে। আর সেই জন্যেই তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘন্টা পর্যন্ত হয়।”
‘জ্ঞান কম দিন,’ শীতল কন্ঠে বলে উঠলাম আমি, ‘আসল কথাটা ঝাড়ুন।’
‘আপনার জন্মটা হয়েছিল,’ ধীরে ধীরে উচ্চারন করলো সে, ‘১০ই নভেম্বর, ১৯৯১। ৬ই নভেম্বর ছিল অমাবস্যা। সে হিসেবে ১০ই নভেম্বর ছিল শুক্লপক্ষের চতুর্থদিন। একইভাবে শুক্লা প্রথমার চতুর্থদিন। ৬৬৬ বছর পর জন্ম হয়েছিল একজন অমানবের। সেই হিসেবে আপনিই সেই ব্যক্তি।’
‘মানে কি?’ চমকে উঠলাম আমি। এ কথা ফোনের ওপাশের লোকটা জানলো কিভাবে?
‘আমি সবই জানি,’ হাসির শব্দ পাওয়া গেলো তার, ‘ইথান করবেট যেদিন মারা যান, তার আগেরদিন রাতেই আমাদেরকে জানিয়েছিলেন বিষয়টা। কারন, তিনিও ছিলেন লিলিফারের একজন সম্মানিত সদস্য। গত ২০ জুন আমাদের একটা মিটিং হবার কথা ছিল লাসভেগাসে। কিন্তু সেদিন সকালেই একটা এক্সিডেন্টে মারা যান তিনি।’*
কোন কথা বের হলো না আমার মুখ থেকে। কি বলবো বুঝতে পারছিনা। ইথান আংকেল লিলিফারের সদস্য ছিলেন?
ভুল করেছি আমি। বিরাট বড় একটা ভুল। হঠাত করেই পুরো বিষয়টা আমার মাথার মধ্যে এসে গেলো। ইথান আংকেলকে মারার আগে একবারও আমার একথাটা মনে হয়নি।
জ্যু ইয়েসন মাউন্টেনের নিচে সেই বাড়িটাতে ইথান আংকেলের সাথে কথা বলার পর পরই একটা কল এসেছিল তাঁর সেলফোনে। কলটা পাওয়ার পর পরই আমাকে উনি বলেছিলেন কি একটা জরুরী কাজে তাঁর লাসভেগাসে যাওয়া প্রয়োজন।
জরুরী প্রয়োজনটা তাহলে এই ছিল? আগেই লিলিফারের অন্য সদস্যদেরকে আমার বিষয়ে জানিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কনফার্ম হবার জন্যই আমার সাথে ভোরে সেই লুকানো বাড়িটাতে কথা বলেছিলেন। তারপরই লাসভেগাস যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেন। কিন্তু সেখানে যেতে পারেননি তিনি। তার আগেই তাকে মেরে ফেলতে বাধ্য হই আমি। পুরো ব্যাপারটা এক্সিডেন্ট হিসেবে সাজিয়েছিলাম আমি।
‘বুঝলাম,’ ঠান্ডা কন্ঠে বললাম আমি, ‘এখন আসলে আমার করনীয়টা কি? ভিডিওটাতে পাথর উদ্ধারের কথা বলা আছে। মানে, ব্লুস্টোন। সেটা কোথায় পাওয়া যাবে, এবং পরে কি টাষ্ক কমপ্লিট করতে হবে, সেটা পরিস্কার করা নেই।’
‘আগামীকাল,’ আবারও বলতে শুরু করলো সে, ‘মানে ৬ই নভেম্বর এই দেশে পূর্ণিমা। ইউকে’র ক্ষেত্রেও এটা খাটে। সে হিসেবে ১০ই নভেম্বর কৃষ্ণা প্রথমার চতুর্থ দিন। আপনাকে যেতে হবে স্টোনহেঞ্জে। সেখানেই পাবেন ব্লুস্টোন। ৯ তারিখ সন্ধ্যের আগেই সেটা উদ্ধার করতে হবে আপনাকে। তারপরই আমরা পরবর্তী নির্দেশ দেবো। ভিডিওতে সব বলা নেই। ওটা শুধু বিষয়টা সম্পর্কে একটা ধারণা দেবার জন্য পাঠানো হয়েছিল।’
‘আপনারা নিজে কেন করছেন না কাজটা?’ খানিকটা রেগে বলে উঠলাম আমি, ‘আমাকে আর রেইনাকে কেন টেনে আনছেন এর মধ্যে?’
‘এটা সাধারন মানুষের কাজ নয়,’ আবারও হাসির আভাষ পাওয়া গেলো তার কন্ঠে, ‘আগেই বলেছি আমি। কাজটা শুধুমাত্র ডেসিয়েরটু বা লিলিথেরা হিজার দ্বারাই সম্ভব। মানে অমানব এবং অপমানবীর দ্বারা সম্ভব। সাধারন মানুষ সেই পাথরকে স্পর্শ করা তো দূরে থাক, সেটা সাধারন চোখে দেখতেও পাবে না।’
‘অমানব হিসেবে জন্ম নেয়ার কুফল,’ মনে মনে বলে উঠলাম আমি। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার।
‘আপনার সবকিছু রেডি করে রাখা হয়েছে,’ আবারও বলে উঠলো লোকটা, ‘আজ রাতের ফ্লাইটে ইউকে যাচ্ছেন আপনি। এয়ারপোর্টের বাইরে আমার লোক থাকবে। সে সব বুঝিয়ে দেবে আপনাকে। কোন প্রকার চালাকী করবেন না, তাহলে রেইনাকে হারাতে হবে আপনার।’
এই বলে কলটা কেটে দিলো লোকটা।
প্রচন্ড আক্রোশে সেলফোনটা মেঝেতে আছড়ে ফেললাম আমি।

*******
৮ নভেম্বর।
হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে সাধারণত পৌনে দু’ঘন্টার মতো লাগে স্টোনহেঞ্জে পৌঁছতে। অবশ্য এবার সময়টা একটু কমই লেগেছে, দেড় ঘন্টা।
সন্ধ্যে নেমে এসেছে পুরো উপত্যকা জুড়ে। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে ডানদিকে তাকালাম আমি। অস্তমিত সূর্যের লাল আলোতে অদ্ভুত লাগছে স্টোনহেঞ্জকে দেখতে। প্রাচীন সুউচ্চ স্থাপনাটা যেন ব্যঙ্গ করছে আমার দিকে তাকিয়ে। হা হয়ে তাকিয়ে আছি আমি স্থাপনাটির দিকে।
‘আমি কি চলে যাবো?’ ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথায় হুঁশ ফিরলো আমার। তাকালাম আমি তার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি বললেন?’
আগের প্রশ্নটাই আবার করলো ড্রাইভার। জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলাম আমি, ‘এখান থেকে উইন্টারবোর্ণ স্টোক কতো দূর?’
‘তিন কিলোমিটারের মতো,’ জবাব দিলো ড্রাইভার।
‘গুড,’ মাথা নাড়লাম আমি, ‘আমি এখানে ঘন্টা দেড়েক থাকতে চাই। যদি তখনও ফ্রি থাকো, তাহলে আমাকে নিতে এসো এখানে। না হলে হেটে ওখানে চলে যাবো আমি। ওখান থেকে লন্ডন যাবার ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না?’
‘অন্য ট্যাক্সি লাগবে না,’ নিজের দাঁত দেখালো ড্রাইভার, ‘ঠিক দেড় ঘন্টা পরই আপনাকে নিতে আসবো আমি।’
‘ঠিক আছে,’ নিজের হাত উঁচু করে নাড়লাম আমি। আমার হাত নাড়া দেখে আর দাঁড়ালো না ড্রাইভার। সোজা গাড়ি ছোটালো।
ট্যাক্সি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতেই জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকালাম আমি। সেখানে একটা কাগজে আমার পুরো টাস্কটা বর্ণনা করা আছে। হিথরো এয়ারপোর্টে নামার পরই এক লোক এটা আমার হাতে তুলে দিয়েছে।
ট্যাক্সিতে একবার দেখেছিলাম কাগজটা। তবুও আবারও দেখতে হচ্ছে। ভালোভাবে পুরোটা দেখে তারপর সেটাকে আবারও জ্যাকেটের পকেটে ভরে রাখলাম আমি। তারপর পা বাড়ালাম স্টোনহেঞ্জের দিকে।
স্টোনহেঞ্জের ভেতরে প্রবেশ করে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম আমি। জিনিসটাকে সবসময়ই বৃত্তাকার ভেবে এসেছি, কিন্তু এটা তা নয়। অনেকটা পঞ্চমীর ভাঙ্গা চাঁদের মতো। হয়তো কোন এক সময় এটা বৃত্তাকারই ছিল।
আমাকে শুরু করতে হবে বাঁ পাশ থেকে। বাঁ পাশ থেকে বাইরের সারির তেরো নাম্বার বৃহৎ উলম্ব পাথরটা।
দ্রুত গুণতে শুরু করলাম আমি। বেশী সময় হয়তো পাওয়া যাবে না এখন। সূর্য ডুবতে বসেছে। সূর্যাস্তের আগেই পাথরটা আমাকে পেতে হবে।
তেরো নাম্বার উলম্ব পাথরটার কাছে এসে দাঁড়ালাম আমি। তারপর আবারও জ্যাকেটের পকেট থেকে কাগজটা বের করলাম। এখানে প্রাচীণ হিব্রুতে লেখা আছে, לשמו של שטן ולילי অবশ্য নিচে এর ইংরেজীও লেখা আছে, “মহান লুসিফার এবং লিলিথের নামে”। সেই সাথে হিব্রু লাইনটার উচ্চারণ।
আমি এখনো জানি না কি খুলবে। তবে আমাকে বলা হয়েছে, তেরো নাম্বার পাথরটার গায়ে ঠিক এই লেখাটাই খোদাই করা হয়েছে প্রাচীণ গ্যালিশিয়ানে। তার একটা নমুনাও দেওয়া আছে কাগজটাতে। সেই লেখাটাই খুঁজতে হবে আমাকে।
বেশ কয়েকবার চক্কর কাটলাম আমি পাথরটাকে ঘিরে। কিন্তু দৃষ্টিসীমার ভেতর কোনরূপ লেখা নজরে পড়লো না। অথচ লেখাটা থাকার কথা। তাহলে কি আমি ভুল পাথরের চারপাশে চক্কর কাটছি?
মেজাজ গরম হয়ে গেছে আমার। লেখাটা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সূর্যাস্তেরও বেশী সময় বাকি নেই।
আরো দুটো চক্কর কাটলাম আমি পাথরটাকে ঘিরে। তারপর নজরে পড়লো লেখাটা। অবশ্য লেখাটা এই জায়গায় থাকবে আমি ভাবিওনি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টি বরাবর থাকবে। কিন্তু লেখাটা একেবারেই নিচের দিকে।
লেখাটা চোখে পড়ামাত্র একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম আমি। যাক, পাওয়া গেলো অবশেষে। এবার শুধু এটা উচ্চারণ করা বাকি।
সূর্যের দিকে তাকালাম আমি। দূর দিগন্তে অস্ত যাচ্ছে সেটা। আর দেরী করা যায় না।
একটা হাত পাথরে লেখাটার উপর রাখলাম আমি। তারপর উচ্চারণ করলাম, “ঈমে সাতান ঈ লিলিথে।”
কথাটা শেষ করা মাত্রই একসাথে দুটো ঘটনা ঘটলো যেন আমার সামনে। হঠাত করেই পাথরটা যেখানে আমি হাত রেখেছিলাম, সেটা ফেটে যেতে লাগলো। দ্রুত নিজের হাতটা সরিয়ে নিলাম আমি। লক্ষ্য করলাম, লেখাটা মুছে যাচ্ছে জায়গাটা থেকে, তার বদলে একটা ছোট খুপরীর মতো খুলে যাচ্ছে জায়গাটা।
একই সাথে আরেকটা জিনিস ঘটছে। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে, এরকম মনে হতে লাগলো আমার। আমি লক্ষ্য করলাম, হঠাত করেই যেন পাথরগুলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে, অবশ্য তেরো নাম্বার পাথরটা বাদে। এক এক করে নড়তে শুরু করেছে সেগুলো, স্থান পরিবর্তন করছে।
কয়েক সেকেন্ড পরই সব থেমে গেলো। শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে যেন এখানে আবারও।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমি, চারদিকে একটা মিষ্টি আলোতে ভরে গেছে। দ্রুত পশ্চিমে তাকালাম আমি। সূর্যটা নেই, ডুবে গেছে একটু আগেই। তাহলে এই আলোর উৎস কি?
আলোর উৎস খুঁজে পেতে দেরী হলো না আমার। আসলে আলোর উৎস একটা নয়, দুটো। একটা তেরো নাম্বার পাথরের যে খুপড়ি তৈরী হয়েছে, সেটার ভেতর থেকে আসছে, আরেকটা এই মাত্র অন্য সব পাথর সরার ফলে যে গহ্বরটা তৈরী হয়েছে, তার নিচ থেকে আসছে।
তেরো নাম্বার পাথরটার খুপড়ির ভেতর হাত ঢোকালাম আমি। হাতটা বের করতেই অবাক হয়ে গেলাম।
আমার হাতে এখন সেই ব্লুস্টোন!
অবাক হয়ে পাথরটার দিকে তাকালাম আমি। সম্পূর্ণ নীল রঙের অদ্ভুত একটা আলো বের হচ্ছে এটা থেকে। দেখতে অনেকটা নীল আগুনের অঙ্গারের মতো।
হা করে তাকিয়ে আছি আমি পাথরটার দিকে। পারিপার্শ্বিক দিকে খেয়াল দেবার কথা মনেই নেই। আর তাই চোখের কোণে একটা নড়াচড়ার আভাষ পেয়ে চমকে উঠতে হলো আমাকে। ঝট করে ফিরে তাকালাম আমি। কিন্তু সেখানে কিছুই নেই।
‘মনের ভুল,’ নিজেকে বোঝালাম আমি। হয়তো বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়েছি আমি।
কিন্তু জিনিসটা যে মনের ভুল নয় মোটেও, সেটা ঘাড়ের উপর অতিরিক্ত শীতল একটা হাতের স্পর্শ পড়তেই বুঝতে পারলাম আমি, সেই সাথে নাকে এলো একটা কেমন যেন বোটকা গন্ধ। বুঝতে পারার সাথে সাথেই মেরুদণ্ড বেয়ে যেন একটা শীতল আগুনের হলকা বয়ে গেলো।
এতো শীতল হাত কারো হয়, জানা ছিল না আমার। সন্তর্পণে ব্লুস্টোনটা প্যান্টের পকেটে চালান করলাম আমি। সেই সাথে খুব ধীরে ধীরে পেছনে তাকানোর চেষ্টা করলাম। দেখা দরকার বিষয়টা। কিন্তু পেছনের দিকে হালকা নড়ে উঠতেই পেছনে বিকট গলায় গর্জন করে উঠলো কিছু একটা।
ঝট করে পেছনে তাকালাম আমি। আর তাকাতেই যেন আত্নারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবার জোগাড় হলো আমার।
‘গেছি,’ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলার স্বগোক্তির মতো শোনালো কথাটা আমার নিজের কাছেই।
আর সেই মুহূর্তেই হঠাত করেই যেন কিছু একটা নিজের দিকে টেনে নিতে থাকলো আমাকে। কখন পা মাটিছাড়া হয়েছে, কে জানে!

*******
মাটিতে পড়তেই হুস করে যেন ফুসফুস খালি হয়ে গেলো আমার। দ্রুত একটা দম নিয়ে পেছন দিকে গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তারপর হাত চালালাম এইমাত্র সামনে চলে আসা লোকটির দিকে।
‘ধীরে,’ দ্রুত চেঁচিয়ে উঠলো লোকটা। হাসছে দাঁত বের করে।
সাজিদ!
সাজিদ, আমার বন্ধু। আমার মতো সাজিদও সাধারণ মানুষ নয়। ও একজন “অতৃব্য”, মানে সেকেন্ড জেনারেশন ভ্যাম্পায়ার আর কি। অনেকেই মনে করে ও হচ্ছে কিং ইনোচের কার্বন কপি। কার্বন কপি বলতে একই রকম দেখতে নয়, ও-ই নাকি কিং ইনোচ, যাকে কেইন সর্বপ্রথম এমব্রাস করেছিল। যদিও কিং ইনোচ মারা গেছেন অনেক আগেই, কিন্তু সেকেন্ড জেনারেশন ভ্যাম্পায়াররা নাকি বারবার জন্ম নেয়।
আমাদের অমানবদের একটা অলিখিত নিয়ম আছে। কখনোই আমরা আমাদের পরিচয় ফাঁস করিনা। এটা অতৃব্যদের ক্ষেত্রেও খাটে। কিন্তু হয়তো ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো আমরা আমাদের নিয়ম ভেঙেছি। প্রায় দু’বছর বছর আগে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম যে, নিজেদের আসল পরিচয় জানাতে হয়েছিল আমাদের। অবশ্য তারপর একটা মাসও আমরা এক দেশে থাকতে পারিনি। আমার স্কলারশীপের জন্য চলে আসতে হয়েছিল দেশ ছেড়ে। সেটা অন্য কাহিনী।
‘তুই এখানে?’ অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলাম আমি।
‘হ্যাঁ,’ বোকার মতো হেসে বললো ও, ‘কিন্তু তুই এখানে কেন?’
‘লম্বা কাহিনী,’ শ্রাগ করলাম আমি, ‘তুই এখানে কেন?’
‘আরে বলিস না,’ খেদ প্রকাশ পেলো ওর কন্ঠে, ‘মানুষের সাথে প্রেম করার জ্বালা আর কি! বয়ফ্রেন্ড বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, তো পাঠিয়ে দাও ফালতু কাজে! অবশ্য জিনিসটা এখন আর ফালতু বলে মনে হচ্ছে না। একই কাজে দুজন অসম্পূর্ণ মানব, বিষয়টা নেহাত কো-ইন্সিডেন্স হতে পারে না নিশ্চয়ই?’
‘জানি না এখনো,’ মৃদু হাসার চেষ্টা করলাম আমি।
‘অফুরন্ত সময় আছে আমাদের হাতে,’ নিজের কাঁধ ঝাঁকালো ও, ‘সব জানা যাবে, অবশ্যই যদি বেঁচে থাকতে পারি।’
‘বেঁচে থাকতে হবে,’ দৃঢ়গলায় বললাম আমি।
‘দেখা যাক,’ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের প্যান্টের পেছনদিকটা ঝাড়া দিলো ও। তারপর একদিকের দেয়ালের দিকে মনোযোগ দিলো।
‘ঐ মালটা কি ছিল?’ বাইরের কিম্ভুতকিমাকার ক্রিয়েচারটার কথা জিজ্ঞেস করলাম আমি।
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো সাজিদ। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। চারদিক দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
এতক্ষণে জিনিসটা খেয়াল করলাম আমি। আমরা আছি সেই অদ্ভুত গহ্বরটার ভেতরে। পুরোপুরি একটা বৃত্তাকার ঘরের মতো এটা। গহ্বরটার উপরের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। তারপরও ভেতরে এখানে একটা নীলচে আলো বিরাজ করছে। ভালোভাবে খুঁজেও আলোর উৎসের দেখা পেলাম না আমি।
‘লেখাগুলো দেখেছিস?’ দেয়ালের এক দিকে আঙ্গুল তুলেছে ও।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আমি সেখানে। কাছে যেতেই নজরে পড়লো খুবই ছোট ছোট অক্ষরে কিছু একটা লেখা আছে এখানে।
קדימה.ולחשב. אתה תמצא את הייעוד שלך.
‘এগিয়ে যাও। এবং হিসেব করো। তুমি তোমার গন্তব্যে পৌছে যাবে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো সাজিদ, ‘ট্রান্সলেট করলাম আর কি।’
‘কি হিসেব করবো?’ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলাম আমি।
‘কে জানে,’ আবারও নিজের কাঁধ ঝাঁকালো ও, ‘এগিয়ে দেখা যাক, যেহেতু প্রথমে এগিয়ে যেতে বলা আছে।’
‘হুম,’ বাঁকাস্বরে বললাম আমি, ‘কিন্তু এগোবো কোনদিক দিয়ে?’
‘দেখা যাক,’ বলে নিজের ডান হাত লেখাটার উপর রাখলো সাজিদ। প্রায় সাথে সাথেই ‘বাপরে!’ বলে চিৎকার করে উঠলো।
দ্রুত ওর দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। বাঁহাতে নিজের ডান হাত চেপে ধরে মুখ বিকৃত করে বসে পড়েছে সাজিদ।
‘কি হয়েছে?’ ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
‘বুঝতে পারছি না,’ কঁকিয়ে উঠলো যেন ও। ঘামছে সমানে, ‘হাত রাখতেই কারেন্টের শকের মতো লাগলো। হাতটা ঝিন ঝিন করছে।’
‘মানে কি?’ অবাক হয়ে গেলাম আমি।
বেশ কিছুক্ষন সময় লাগলো ওর ধাতস্ত হতে। বেশ কয়েকবার হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো, ‘আমার মনে হয়, তোর চেষ্টা করা উচিৎ। আমি ভুল জায়গায় চলে এসেছি।’
‘কি?’ ভ্রু কোঁচকালাম আমি, ‘ভুল জায়গা মানে?’
‘হুম,’ ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে বলে উঠলো ও, ‘দুটো জায়গার কথা বলা আছে। একটা স্টোনহেঞ্জ, আরেকটা ঠিক জানা নেই আমার। একটা দিয়ে লুসিফারের বংশধর ঢুকবে, অন্যটা লিলিথের সাথে সম্পর্কিত লোকদের জন্য।”
‘বুঝলাম না,’ একইভঙ্গিতে আবারও প্রশ্ন করলাম আমি।
‘জিনিসটা একটা বইয়ে পেয়েছি আমি,’ মৃদু হাসি দেখা দিলো সাজিদের চেহারায়, ‘আসলে আমি নই, প্রথমে জিনিসটা খেয়াল করেছিল স্বর্ণা।’
ওর দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালাম আমি। আমার তাকানো দেখে জোড়ে হেসে ফেললো ও, ‘ওহ, সরি। স্বর্ণার কথা জানানো হয়নি তোকে। আমার গার্লফ্রেন্ড।’
‘বুঝতে পারছি,’ মৃদু হাসলাম আমি, ‘কিন্তু সেই বা কিভাবে পেলো জিনিসটা? আর হঠাত এর পেছনে লাগার উদ্দেশ্য কি?’
‘আসলে জিনিসটা একটু জটিল,’ ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে বলে উঠলো সাজিদ, ‘ব্যাখ্যা করতে সময় লাগবে।’
‘ব্যাখ্যা কর,’ মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসলাম আমি, ‘যতক্ষণ না মাথায় এগিয়ে যাওয়ার মতো কোন বুদ্ধি আসে, তোর জটিল কাহিনী শোনা যেতেই পারে।’
‘ভাল কথা বলেছিস,’ আমার দেখাদেখি আমার পাশে বসে পড়লো সাজিদ, ‘শোন তাহলে। বছরখানেক আগে একটা বিপদে পড়েছিলাম আমি। আমাদের ভার্সিটির ফিজিক্স প্রফেসর শামসুল নওয়াব এবং তার এক শ্বেতাঙ্গ বন্ধু আমাকে নিয়ে কি একটা গবেষণা করার পায়তারা করছিলেন। শ্বেতাঙ্গ লোকটি ছিল ডারপা, মানে ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সীর গবেষক, নাম প্রফেসর রেডক্লিফ ব্রাউন।’
প্রফেসর রেডক্লিফ ব্রাউন! মানে কি?

*******
‘রেডক্লিফ ব্রাউন?’ অবাক হলাম আমি, ‘তুই বলতে চাইছিস, প্রফেসর রেডক্লিফ ব্রাউন তোকে খুঁজতে বাংলাদেশে গিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ,’ ওর চোখেও বিস্ময়, ‘তুই চিনিস নাকি লোকটাকে?’
‘চিনি মানে?’ দ্রুত বলে উঠলাম আমি, ‘উনি তো আমাদের প্রফেসর। নেভাডা স্টেটস কলেজে বায়োলজি বিভাগের হেড। সাথে ডারপার অনারারি প্রজেক্ট ডিরেক্টর।’
‘বলিস কি?’ ওর দৃষ্টি যেন বিস্ফারিত হবে, এমনভাবে বলে উঠলো সাজিদ, ‘এটা তো জানা ছিল না।’
‘কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না,’ নিজের মাথা চুলকালাম আমি, ‘প্রফেসর ব্রাউন তোকে খুঁজতে বাংলাদেশে গেলো কেন? তোর খোঁজই বা পেলো কিভাবে?’
‘আমি জানি না,’ নিজের মাথা নাড়লো সাজিদ।
‘হুম, চিন্তার বিষয়,’ গম্ভীরস্বরে বললাম আমি। বেশ কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে আবারও প্রশ্ন করলাম, ‘কোন একটা বইয়ের কথা বলছিলি তুই। স্বর্ণা যেটা ঘাটাঘাটি করেছিল। জিনিসটা আসলে কি?’
‘হেটরিংক্স,’ উত্তর দিলো ও, ‘বইটার নাম হেটরিংক্স। বইটা আসলে প্রফেসর ব্রাউনের হোটেলরুমে পাওয়া গেছিল। জিনিসটা নিয়ে প্রথমে তেমনভাবে কেউই মাথা ঘামায়নি। গ্রীকের প্রাচীন ফরমেটে লেখা। কয়েক মাস বিআইসিএবি, মানে বাংলাদেশ ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি এন্ড এন্টি-টেরোরিজম ব্রাঞ্চের অফিসে পড়েছিল। কিন্তু কেউই এর মানে বুঝতে পারছিল না। আমি আগ্রহ দেখালে স্বর্ণা গিয়ে বইটা নিয়ে আসে। জানিসই তো, আমার আবার পুরনো ভাষা পড়তে কোন সমস্যা হয়না। যেকোন ভাষাই পড়তে পারি আমি। জন্মগতভাবেই এই জিনিসটা আছে আমার মাঝে।’
একটা সন্দেহ মাথায় পাক খাচ্ছে আমার। সেইসাথে একটা খটকা। তাই প্রশ্ন করলাম আমি, ‘স্বর্ণা বিআইসিএবি’তে গিয়ে চাইলো আর ওরা দিয়ে দিলো?’
‘আসলে,’ মৃদু হাসি দেখা দিলো ওর চেহারায়, ‘স্বর্ণা বিআইএসবির এজেন্ট।’
‘বুঝলাম,’ আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, তুই যে বইটার কথা বলছিস, মানে হেটরিংক্স, এটা কি সম্পূর্ণ প্রাণীর চামড়া দিয়ে তৈরী?’
‘তুই জানলি কিভাবে?’ অবাক হলো ও।
‘গ্রীকের এক্সেন্ট সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো?’
‘হ্যাঁ,’ বিস্ময় বাড়ছে ওর, ‘কিন্তু... বইটা কোথাও দেখেছিলি তুই আগে? মানে, প্রফেসর ব্রাউনের কাছে?’
‘না,’ সত্য প্রকাশ করলাম আমি, ‘এই বইটার জন্যই রুদ্র মারা গিয়েছিল। অবশ্য, বইটা নষ্ট করে ফেলেছিলাম আমি। রুদ্রের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে।’
‘মানে কি?’ হতভম্ব দেখালো সাজিদকে, ‘আমি গতপড়শুও বইটা হাতিয়ে দেখেছি।’
আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না এখন। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। যে বইটা আমি দুই বছর আগে নষ্ট করে ফেলেছি, সেটা সাজিদ গত পড়শুও দেখেছে। মানে কি এর?
এক সেকেন্ড! রুদ্র খুন হয়েছিল দুই বছর আগে। আর সাজিদ বলছে প্রফেসর ব্রাউন ওকে খুঁজতে বাংলাদেশে গিয়েছিল বছরখানেক আগে। তাহলে কি এটা আগেরটার কোন কপি?
হতে পারে! প্রাচীন বইটার হয়তো কয়েকটা কপিও বানানো হয়েছিল কোন একসময়। হাজার হোক স্পেরিট্রিক্সদের ধর্মগ্রন্থ ছিল এটা। কপি থাকাই স্বাভাবিক। দুই’এক কপি টিকে থাকাটা বিচিত্র কিছু নয় অবশ্য। যদিও এখনো জানি না, বই দুটো একটা অপরটার হুবহু কপি কি না। বিকৃত হবার সম্ভাবনাই বেশী। পুরোটা না পড়ে কিছুই বলা যাবে না।
‘কি হলো?’ সাজিদের প্রশ্নে ঘোর ভাঙ্গলো আমার, ‘কি ভাবছিস?’
আমার সন্দেহের কথা খুলে বললাম ওকে। সব শুনে ও বললো, ‘হতে পারে। কপি থাকাটা বিচিত্র নয়। অবশ্য আমি, অন্য কথা ভাবছি। দুটো কপি যদি টিকে থাকে, আরো কয়েকটা কপি থাকাও কি খুব একটা কষ্ট-কল্পনা?’
‘জানি না আসলে,’ মাথা নাড়লাম আমি, ‘এখন এখান থেকে বেরুতে পারলে বাঁচি।’
‘হুম,’ আমার সাথে একমত হলো ও, ‘তুই একটু চেষ্টা করে দেখ না? কোন উপায় যদি বের করতে পারিস।’
‘আমি কি করবো?’
‘জানি না,’ বাঁকা হাসি হেসে উঠলো ও, ‘তবে আমার মনে হয়, তোর ব্লুস্টোনটা বা তোর কাছে থাকা অন্যকিছু এই কাজে সাহায্য করতে পারবে আমাদেরকে।’
‘মানে?’ ভ্রু কোঁচকালাম আমি। আমার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ও।
ঠিক তখনই জিনিসটা বুঝে গেলাম আমি। সত্যিই তো! জিনিসটা আমার মাথাতেও আসেনি। এখান থেকে বেরুবার রাস্তা তো আমার পকেটেই আছে।
לשמו של שטן ולילי
দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি। গিয়ে দাঁড়ালাম দেয়ালে খোদাই করা קדימה.ולחשב. אתה תמצא את הייעוד שלך. লেখাটার কাছে। ডানহাতটা লেখাটার উপর রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলাম। তারপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলাম, ‘ঈমে সাতান ঈ লিলিথে।’
কথাটা উচ্চারণ করা মাত্রই যেন আবারও ভুমিকম্প শুরু হলো। এবার আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি জানি কি হচ্ছে। নিশ্চয়ই উপরের দিকটা খুলে যাচ্ছে।
কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। উপরের দিকে তাকিয়ে হতাশ হতে হলো আমাদের। তার বদলে আমার ডানপাশের দেয়ালের কিছু অংশ যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে লাগলো।
হচ্ছেটা কি?
‘কাহিনী কি?’ চেঁচিয়ে উঠলো সাজিদ, ‘উপরের দিকে খোলার কথা না?’
‘জানি না,’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম আমি।
ডানপাশের দেয়ালের একটা অংশ পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে গেছে। সেখান দিয়ে একটা টানেল চলে গেছে অনেকটা দুর। অদ্ভুত একটা নীল আলো ছেয়ে রেখেছে পুরো টানেলের ভেতরের অংশকে। টানেলটা কতোটা লম্বা তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না যদিও।
‘চল,’ সাজিদের পিঠে হালকা টোকা দিলাম আমি, ‘এগিয়ে যাই। দেয়ালের প্রথম অংশের অনুবাদ তো এই ছিল, তাই না?’
‘হুম,’ মাথা নাড়লো সাজিদ, ‘এগিয়ে যাও। এবং হিসেব করো। তুমি তোমার গন্তব্যে পৌছে যাবে।’
আর কথা না বাড়িয়ে আমরা হাটা শুরু করলাম টানেল ধরে। এর শেষ দেখতে হবে।

*******
যতোই এগুচ্ছি, টানেল যেন ধীরে ধীরে প্রশস্ত হচ্ছে আরো। যদিও এখনো এর শেষমুখটা দেখতে পারছি না আমরা। জানি না কি আছে এর শেষ মাথায়। তবুও এগিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া আর কিছু করার নেই যদিও।
টানেলের দেয়ালগুলো অদ্ভুত। অসংখ্য অপরিচিত প্রাণীর মাথা দেখা যাচ্ছে দেয়ালের বুকে। বীভৎস, ভয়ংকর সেগুলো। এমনভাবে মুখ ব্যাদান করে আছে, যেন এখনই ঝাপিয়ে পড়বে তার শিকারের উপর।
‘এগুলো কি?’ চলতে চলতেই প্রশ্ন করলাম আমি।
‘কোন আইডিয়া নেই,’ অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো সাজিদ।
আর কোন কথা হলো না আমাদের মাঝে। চুপচাপ হেটেই চলেছি। যতোই হাটছি, টানেল ততোই প্রশস্ত হচ্ছে, এবং সেই সাথে দেয়ালের গায়ে বাড়ছে ভয়ংকর প্রাণীদের মাথা। ভয়ংকর দৃশ্য। যদিও সাধারণ কেউ নই আমরা, তবুও বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠছে। ভয়ে গায়ে কাঁটা না দিলেও একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে কেন যেন। মনে হচ্ছে, জায়গাটা শুভ নয় মোটেও।
অবশেষে যেন সব অপেক্ষার অবসান ঘটলো। টানেলের শেষ প্রান্ত দেখা দিচ্ছে। খুশীতে নেচে উঠতে চাইলেও সেটা করতে পারছি না আমরা। কেননা, এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে টানেলের শেষমুখটা সিল করা।
টানেলের শেষ প্রান্তে একটা দেয়াল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। যদিও দেয়ালের গায়ের বামপাশে দেখা যাচ্ছে চারটা গর্ত। তার ঠিক নিচেই চারটা পাত্রে ভিন্ন ভিন্ন রঙের ছোট ছোট বল। অনেকটা সাইকেলের বেয়ারিংয়ের বলের মতো, তবে চার রঙের।
‘এখন?’ প্রশ্ন করলো সাজিদ।
‘জানি না,’ মাথা নাড়লাম আমি। এখন কি করতে হবে, সে বিষয়ে কোন ধারণাই নেই আমার, ‘আচ্ছা, হেটরিংক্সে কিছু লেখা ছিল না এই বিষয়ে? অনেক আগে পড়েছিলাম। তাছাড়া মনোযোগ দিয়ে পুরোটা পড়তে পারিনি আমি।’
‘ঠিক মনে পড়ছে না,’ নিচের ঠোঁট কামড়ালো সাজিদ, ‘ভাবতে হবে।’
‘চিন্তা কর।’
নিজের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করা শুরু করলো সাজিদ। ভাবছে! আমিও ফাঁক পেয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকলাম। আর তখনই জিনিসটা চোখে পড়লো আমার। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম দেয়ালের আরেক কোণার দিকে। হা হয়ে তাকিয়ে আছি একেবারে কোণার দিকে। সেখানে একটা লাইন লেখা।
"אני לעלות לגן עדן; מעל הכוכבים של אלוהים אני יהיה להגדיר את כס המלכות שלי על גבוה; אני אשב בהר ההרכבה בקצה הרחוק של צפון; אני לעלות מעל הגבהים של העננים; אני אעשה את עצמי אוהב את רוב גבוה.
‘আইজায়াহ ১৪:১২-১৫,’ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো সাজিদ।
‘মানে?’ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম আমি।
‘এটা একটা আয়াত,’ ব্যাখ্যা করলো ও, ‘বাইবেলের আইজায়াহ ১৪:১২-১৫ এর একটা অংশ। ইংরেজীতে বললে, “I will ascend to heaven; above the stars of God I will set my throne on high; I will sit on the mount of assembly in the far reaches of the north; I will ascend above the heights of the clouds; I will make myself like the Most High.” এখানে শয়তান নিজেকে ইশ্বরের চেয়েও মহিমান্বিত করার শপথ গ্রহণ করেছে।”
‘ব্যাপারটা বুঝলাম,’ মাথা নাড়লাম আমি, ‘কিন্তু সমস্যা হলো, এটা তো বাইবেলের একটা আয়াতের অংশ, তাই না? শয়তানের আবার বাইবেলের আয়াত টানার কি প্রয়োজন পড়লো?’
‘এখনো জানি না,’ লেখাটার আরো কাছ ঘেষে দাঁড়ালো সাজিদ। ভাবছে, ‘হয়তো... উমম... হয়তো এই কথাগুলো সে সত্যিই উচ্চারণ করেছিল... হয়তো... উমম... এক সেকেন্ড!’ নিজের কপালে দুটো আঙ্গুল রাখলো ও, তারপর বললো, ‘মনে পড়েছে। এই লাইনটা হেটরিংক্সেও ছিল। আহনা ২৬:১৩-৪।’
‘মনে পড়েছে,’ চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আমার, ‘অনেকটা এরকমই ছিল। কিন্তু আমি এর অন্য অর্থ করেছিলাম।’
‘মানে?’ অবাক হলো ও।
‘আমি ভেবেছিলাম,’ হেসে উঠলাম আমি, ‘আমি ভেবেছিলাম এটা লিলিথকে উদ্দেশ্য করে শয়তান বলেছিল। God শব্দটা খেয়াল করিনি আমি।’
‘হাহ হা হা,’ হেসে উঠলো সাজিদ, ‘খারাপ না! যাই হোক! এখন কি করা যায়? এখানে বসে থাকলে চলবে না আমাদের।’
‘আমি বোধহয় বুঝে গেছি জিনিসটা,’ একটু আগে দেখা চারটির পাত্রের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম আমি।
‘কিভাবে?’ সংক্ষেপে প্রশ্ন করলো ও।
‘আহনা ২৬:১৩-৪,’ এবার ওর দিকে তাকালাম আমি, ‘হিব্রু প্রত্যেকটা অক্ষরের সাথে সংখ্যার একটা হিসেব আছে। আহনা (אהנה) প্রথম অক্ষর א, হিব্রুতে এর মান ১। ২৬:১৩-৪, প্রথম থেকে ধর। ২+৬=৮, ১+৩=৪, এবং ৪। মোট চারটা সংখ্যা বেরুলো। ওখানে খাঁজও আছে চারটা।’
‘এর মানে,’ খুশী হয়ে উঠলো সাজিদ, ‘খাঁজগুলোর ডানের ঘরে একটা, পরের ঘরে আটটা, তার পরের ঘরে চারটা এবং একেবারে বামের ঘরে একটা বল রাখলেও চলবে? যেহেতু হিব্রু লেখাগুলো ডান থেকে শুরু হয়!’
‘না,’ আবারও মাথা নাড়লাম আমি, ‘তুই হয়তো খেয়াল করছিস না, এটা আমাদের পৃথিবী নয়। আমার ধারণা, পৃথিবীর বাইরের একটা জগত এটা। আর তুই যে দুই রাস্তার কথা বললি, সেগুলো পৃথিবী থেকে এই জগতে পা দেবার রাস্তামাত্র।’
‘তাহলে?’ ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর, ‘কিভাবে?’
‘হিব্রুতে আরো কিছু মজার জিনিস আছে,’ মৃদু হাসলাম আমি, ‘এখনকার হিব্রু নয়, বরং প্রচীণ হিব্রুর কথা বলছি আমি। প্রত্যেকটা অক্ষরের মানকে ওরা ত্রিভুজের আকৃতি দিতে পছন্দ করতো কেন যেন। হয়তো ইশ্বর, শয়তান আর লিলিথের স্মরণে।’
‘কিভাবে?’
‘বলছি,’ আবারও খাঁজগুলোর কাছে চলে এলাম আমি। নিচের পাত্র থেকে একটা বল বেয়ারিং তুলে নিলাম, ‘ওরা প্রথম অক্ষর, মানে אকে একটা বিন্দু দিয়ে প্রকাশ করতো। ২য় অক্ষরকে তিনটি বিন্দুর সমন্বয়ে একটা ত্রিভুজ ধরতো। তৃতীয় অক্ষরকে প্রকাশ করা হতো ছয়টি বিন্দুর মাধ্যমে তৈরী করা ত্রিভুজের মাধ্যমে। সংখ্যার ক্ষেত্রেও অদ্ভুদ কারণে এই একই হিসেবটা করতো ওরা। এর অবশ্য একটা সূত্র ব্যবহার করতে পারিস। সূত্রটা হচ্ছে 1/2n(n+1).’
‘এরমানে,’ হাসি ফুটে উঠেছে ওর কন্ঠেও, ‘একেবারে ডানের খাঁজে বসাতে হবে আমাদের একটা বল বেয়ারিং। তার পরের খাঁজে ছত্রিশটা বল বেয়ারিং। পরের দুটো খাঁজে দশটা দশটা করে বসালে এই দরজা খুলে যাবার কথা!’
‘হয়তো,’ হাতের বল বেয়ারিংটা একেবারে ডানের খাঁজে গুজে দিলাম আমি, ‘যদি আমার ধারণা সত্যি হয় আর কি। আর যদি আমার ধারণা মিথ্যে হয়, তাহলে খারাপ কিছুও ঘটতে পারে আমাদের কপালে।’
‘জানার আর কোন উপায় দেখছি না,’ নিচে ঝুঁকে বল বেয়ারিং গুনতে শুরু করলো সাজিদ, ‘আপাতত জানার এই একটাই উপায় আছে।’
‘বাঁচতে হলে জানতে হবে,’ মৃদু হাসিটা আবারও ফিরে এলো আমার, ‘কিংবা, জানতে হলে বাঁচতে হবে।’
‘দেখা যাক!’ নিজের মাথা ঝাঁকালো ও।
‘দেখা যাক,’ স্বগোক্তির মতো বললাম আমি।
দ্রুত বল বেয়ারিংগুলো দিয়ে সঠিকভাবে ত্রিভুজ নির্মাণ করলাম আমরা। তারপর সেগুলোকে খাঁজের ভেতর ঠিকঠাকভাবে গুজে দিলাম। তারপর দু’পা পেছনে এসে দাঁড়ালাম। দেখা যাক কি হয়!
হঠাত আমাদের চমকে দিয়ে যেন গর্জে উঠলো কেউ। দ্রুত নিজেদের পেছনে তাকালাম আমরা। তারপর তাকাতে লাগলাম নিজেদের চারপাশে। কিন্তু শব্দটা কোত্থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। একটু পর শব্দের সাথে সাথে যেন ভূমিকম্পও শুরু হলো!
হচ্ছেটা কি আসলে! আমার ধারণা কি তবে ভুল ছিল?

*******
‘খাইছে!’ কানের কাছে খেঁকিয়ে উঠলো সাজিদ, ‘এগুলা কি?’
এমনিতেই কানে ভেসে আসছে গগনবিদারী আওয়াজ, তার মাঝে সাজিদের কানের কাছে খেঁকিয়ে উঠা। পিলে চমকাবার মতো অবস্থা হয়েছে আমার। যদিও সাধারণ অবস্থায় ‘ভয়’ জিনিসটা আমার মাঝে নেই। অবশ্য এটাও ঠিক যে, এটা সাধারণ অবস্থা নয়।
কারণ, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, একটু আগের ফেলে আসা টানেলের দেয়ালে দেখা অদ্ভুত মূর্তিগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে! ধীরে ধীরে নিজেদেরকে মুক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে গেছে দেয়াল থেকে।
গগনবিদারী আওয়াজগুলো বাড়ছে তো বাড়ছেই। ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে যাচ্ছে সেগুলো। মনে হচ্ছে যেকোন সময়ই ফেটে যাবে কানের পর্দা।
‘ভুল হয়ে গেছে একটা,’ দ্রুত বলে উঠলো সাজিদ।
‘আমিও তাই ভাবছি,’ ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগলো না আমার, ‘আমরা ভুল করেছি। সাধারণ ধর্মগ্রন্থের আয়াত যেভাবে লেখা হয়, হেট্রিংক্সে লেখা হয় উল্টোভাবে। জিনিসটা আসলে হবে এভাবে, ৪-১৩:২৬ আহনা।’
দ্রুত কাজে নেমে গেলাম আমরা। বল বেয়ারিংগুলো আবার সঠিক অবস্থানে নিয়ে এলাম। তারপর আবারও তাকালাম পেছনের দিকে। এখনো প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে ওদিকে। দেয়ালের বুক থেকে নিজেদেরকে পৃথক করার খেলায় মত্ত হয়ে গেছে সাক্ষাৎ আতংক!
এতো তীব্র শব্দের মাঝখানেও একটা মৃদু আওয়াজ আমার কানকে ফাঁকি দিতে পারেনি। আমাদের পেছনে হঠাত করেই মৃদু একটা শব্দ হলো স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমি। সাজিদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেও বুঝতে পেরেছে জিনিসটা।
ধীরে ধীরে পেছনে তাকালাম আমরা। তাকাতেই দেখতে পেলাম, এতোক্ষণ বন্ধ থাকা দেয়ালের একটা অংশ ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হচ্ছে।
এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা বের হয়েছে!
শেষবারের মতো পেছনে তাকালাম আমি। ইতোমধ্যেই দেয়ালের বুক থেকে নিজেদেরকে খুলে নিতে সক্ষম হয়েছে কয়েকটা ক্রিয়েচার। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সেগুলো। ওদের কমলা চোখগুলো যেন জ্বলছে কোন এক আক্রোশে!
আর দেরী করা যায় না!
‘দৌড়া শালা,’ ঠিক একই চিন্তা চলছে সাজিদের মাথায়, সেটা ওর চিৎকারেই বুঝতে পারলাম।
আর এক মুহূর্তও দেরী করলাম না আমি। ঝেড়ে দৌড় লাগালাম উন্মুক্ত দেয়াল লক্ষ্য করে। কপালে কি আছে, কে জানে!
দেয়ালটা কোনমতে পার হবার পর সামনের দিকে তাকালাম আমি। সামনে লম্বা টানেল দেখা যাচ্ছে। কোনকিছু চিন্তা না করে ঝেড়ে দৌড় লাগালাম সামনের দিক লক্ষ্য রেখে।
বেশ কিছুক্ষণ দৌড়াবার পর হঠাতই খেয়াল করলাম আমি, শব্দগুলো হঠাত করে যেন থেমে গেছে। চারদিকে বিরাজ করছে নিঝুম নিরবতা।
‘কি রে,’ একটু সামনে থেকে বলে উঠলো সাজিদ, ‘থামলি ক্যান?’
‘বিপদ কেটে গেছে মনে হচ্ছে,’ ফেলে আসা টানেলের দিকে তাকালাম আমি। দেয়ালটা আবার বন্ধ হয়ে গেছে।
‘বিপদের কেবল শুরু,’ খেঁকিয়ে উঠলো সাজিদ।
‘মানে কি?’ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম আমি।
‘চারদিকে খেয়াল কর।’
ওর কথা শুনে চারদিকে ভালোভাবে খেয়াল করলাম আমি। আর সাথে সাথেই চমকে উঠলাম। বুকের ধুকপুকানি কমে এসেছিল কিছুটা, সেটা যেন আবারো বেড়ে গেলো।
খাইছে!
আর এক মুহূর্ত দেরী না করে আবারও ঝেড়ে দৌড় লাগালাম আমি। পৌছতে হবে পরের দেয়ালটার কাছে।
এতোক্ষণ পেছনের বিপদটার চিন্তায় চারদিকে নজর দেয়ার কথা খেয়াল ছিল না। দৌড়াবার ফাঁকে যা দেখতে পেলাম, তা দেখে আমার একটা কথাই মনে হলো। উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনের মধ্যে পড়ে গেছি আমরা!
আমাদের পায়ের নিচে চার ফুট চওড়া রাস্তা। তার দুপাশে উঁকি দিচ্ছে খাদ। কতোটা গভীর, সেটা বুঝতে পারছিনা এখনো। তবে ভয়ংকর জিনিসটা হলো, খাদটা রক্ত আর পুঁজে ভরা। যতদূর চোখ যায়, শুধু সাগরের মতো মনে হচ্ছে, রক্ত আর পুঁজের সাগর। যেন রক্ত আর পুঁজের সাগরের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে সামনের দিকে। তার উপর দিয়ে দৌড়াচ্ছি আমরা। আর এরই মাঝখান দিয়ে উঁকি দিচ্ছে বীভৎস চেহারার অদ্ভুতদর্শন কিছু ক্রিয়েচার।
সামনে প্রায় নব্বই ডিগ্রীর মতো একটা বাঁক দেখা যাচ্ছে। বাঁকটার কাছে গিয়েই থেমে গেলো সাজিদ। অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমি পৌছে যেতেই আবারও দৌড় শুরু করলো।
‘এগুলো কি?’ দৌড়ের ফাঁকে চিৎকার করলাম আমি, ‘কোন আইডিয়া?’
‘জানি না,’ একইভাবে খেঁকিয়ে উঠলো সাজিদ, ‘কোন আইডিয়া নেই। জাষ্ট দৌড়ানো ছাড়া আর কোন আইডিয়া মাথায় আসছে না আপাতত।’
‘তাহলে আপাতত এই আইডিয়া ধরেই দৌড়া,’ দৌড়ের গতি বাড়াতে বাড়াতে বললাম আমি।
রাস্তার যেন আর শেষ নেই। দৌড়ে চলেছি তো চলেছিই। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই টের পাচ্ছি, ফুসফুসটা জ্বলছে আমার। আরো বাতাস প্রয়োজন তার।
দৌড়ের ফাঁকেই একবার পেছন দিকে তাকালাম আমি। সাথে সাথেই পেছনে তাকানোর খায়েশ মিটে গেলো আমার। যে দেখেছি, সেটা না দেখাটাই বোধহয় ভাল ছিল।
‘উঠে আসছে,’ চিৎকার করে উঠলাম আমি, ‘কয়েকটা ইতোমধ্যেই উঠে পড়েছে রাস্তার উপর।’
‘সামনে তাকা,’ দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো সাজিদ, ‘পেছনে তাকানোর কোন প্রয়োজন নেই। জাষ্ট সামনের দিকে তাকিয়ে দৌড়া।’
ওর কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারলাম আমি, ওর অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়। হাপাচ্ছে সেও। আমারও একই অবস্থা। হাপরের মতো উঠানামা করছে বুক।
অবশেষে যেন রাস্তা ফুরালো। বেশ কিছুটা দূরে দেখা যাচ্ছে টানেলের শেষ প্রান্ত। আগের মতোই দেয়াল দিয়ে সিল করা।
দেয়ালটার কাছে পৌছেই আবারও পেছনে তাকালাম আমি। আসছে ক্রিয়েচারগুলো। যদিও এখনো অনেকটাই দূরে আছে।
‘সময় নেই,’ স্বগোক্তির মতো শোনালো আমার কন্ঠ।
দ্রুত বাম দিকের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। এখানেও আগের মতোই দেখা যাচ্ছে চারটি খাঁজ, নিচে চারটা পাত্রে চার রঙের বল বেয়ারিং। ওদিকে সাজিদও পৌছে গেছে দেয়ালের ডান প্রান্তে। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো ও, ‘এজিকিল ২৮:১৭। “ইউর হার্ট ওয়াজ প্রাউড বিকজ অফ ইউর বিউটি, ইউ করাপ্টেড ইউর উইশডম ফর দ্য শেক অফ ইউর স্প্লেন্টার। আই কাষ্ট ইউ টু দ্য গ্রাউন্ড; আই এক্সপোজড ইউ বিফোর কিংস, টু ফিষ্ট দেয়ার আইজ অন ইউ”।’
‘এটা লিলিথের উদ্দেশ্যে,’ বুঝতে পারলাম আমি, ‘অনেকটা এরকমই একটা লাইন ছিল হেটরিংক্সে, লিলিথকে অভিশাপ দেয়ার কথা বলা ছিল। ইশ্বর লিলিথকে উদ্দেশ্য করে বলছিল...’
‘বাইবেলে লিলিথের উদ্দেশ্যে কোন আয়াত নেই,’ নিজের মাথা নাড়লো সাজিদ।
‘কিন্তু হেটরিংক্সে আছে,’ মৃদু হেসে উঠলাম আমি, ‘এবং কাকতালীয় কিনা জানি না, লাইনটা অনেকটা এরকমই। “তার রুপ তাকে অহংকারী করে তুলেছিল। রুপের মহিমায় এবং এডামের উন্মাসিকতায় সে ক্ষেপে উঠেছিল। অতঃপর সে স্বর্গ ত্যাগ করে এবং যোগ দেয় লুসিফারের সাথে। কিন্তু সেখানেও সে সুখী হয়নি, তাই যুগ যুগান্তরের অতৃপ্ত বাসনা পূর্ণ করে আদম সন্তানদের দিয়ে।’
‘মনে পরেছে,’ হাসি ফুটলো ওর কন্ঠে, এগিয়ে এলো আমার দিকে, ’১১-৩৮:১৭ ক্কারিনা। ক্কারিনার প্রথম অক্ষর ק’
‘ק মান ১০০,’ দ্রুত হিসেব করলাম আমি, ‘মানে ১। ১+১=২, ৩+৮=১১, ১+৭=৮, মানে, ২,২,৮,১।’
‘হুম,’ নিজের মাথা নেড়ে বললো সাজিদ। লেগে গেছে বল বেয়ারিং গোণার কাজে।
‘একটা জিনিস মনে পড়ে হাসি পাচ্ছে আমার,’ পেছনে দিকে তাকালাম আমি, এখনো অনেকটা দূরে আছে ক্রিয়েচারগুলো। আসতে সময় লাগবে কিছুটা।
‘কি,’ মাথা না তুলেই প্রশ্ন করলো সাজিদ।
‘লিলিথের কথা অনেক ধর্মগ্রন্থেই হয় চেপে যাওয়া হয়েছে,’ আবারও বল বেয়ারিং তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমি, ‘নাহলে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সেগুলোও এমনভাবে যেন দেখে মনে হয় যে লিলিথের সাথে এর কোন সংস্পর্শ নেই। কিন্তু লোককথায় বিভিন্নভাবে এসেছে সে। ব্যবিলনীয় উপকথায় এসেছে সাকুবাস হিসেবে, আরবীয় উপকথাগুলোতে এসেছে ক্কারিনা হিসেবে, গিলগামেসে কি-শিকিল-লিল-লা-কে হিসেবে। একটু আগে বললি বাইবেলে লিলিথের উদ্দেশ্যে কিছু বলা নেই। কিন্তু আইজায়াহ ৩৪:১৪তেই বলা আছে এভাবে, “The desert creatures will meet with the wolves, The hairy goat also will cry to its kind; Yes, the night monster will settle there And will find herself a resting place.” এখানে সরাসরি লিলিথের নাম নেই, কিন্তু তাকে লেখা হয়েছে রাত্রীর অপদেবী হিসেবে। এবং হারসেলফ বলতে কিন্তু মেয়েই বোঝায়।’
‘বুঝলাম,’ বলেই উঠে দাঁড়ালো সাজিদ। হাতে বল বেয়ারিং, ‘এবার কাজে নেমে পড় ভাই। এসব নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে, ঠিক আছে।’
‘ওকে,’ নিজের মাথা নাড়লাম আমি। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কাজে।
একেবারে বামের খাঁজে একটা, পরের খাঁজে ছত্রিশটা, পরের দুটোতে ছয়টা করে মোট বারোটা বল বেয়ারিং গুঁজে দিলাম আমরা। তারপর পিছিয়ে এলাম এক পা। আশা করছি খুব দ্রুত খুলে যাবে দেয়ালের একটা অংশ।
আমাদের ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে ধীরে ধীরে সরতে শুরু করলো দেয়াল। সেই সাথে আমার কানে এসে পৌছলো কারো দ্রুত দৌড়ে আসার আওয়াজ।
এতো দ্রুত পৌছে গেছে বীভৎস ক্রিয়েচারগুলো!
দ্রুত পেছনে ফিরলাম আমরা। আর সাথে সাথেই অবাক হলাম। ঝড়ের বেগে আমাদেরকে পাশ কাটালো কিছু একটা। শুধু চোখের কিনারা দিয়ে একগোছা চুল নজরে এলো আমার। নজর ফেরানোর আগেই অবশ্য দেখতে পেলাম কয়েকটা ক্রিয়েচারকে। এখনো অনেকটাই দূরে আছে তারা আমাদের থেকে।
তাহলে আমাদেরকে এইমাত্র যে পাশ কাটালো, সেটা কি?
আপাতত ভাবার সময় নেই। দ্রুত পেছন ঘুরেই দৌড় শুরু করলাম আমরা। দেয়ালটা যথেষ্ট সরে গেছে। দুজন মানুষ একত্রে ঢুকতে পারার মতো ফাঁক হয়ে আছে।
দেয়ালের ফাঁকটা পার হতে সময় লাগলো না। দেয়ালটা পার হয়েই আবারও পেছনে তাকালাম আমরা। আবারও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেটা। দেয়ালের ওপাশে থাকা ক্রিয়েচারগুলো আর আসতে পারবে না এপাশে।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও হঠাত করেই থেমে গেলাম আমি। আচ্ছা, একটু আগে আমাদেরকে যেটা পাশ কাটালো, সেটা আসলে কি ছিল? যদি ঐ ক্রিয়েচারগুলোর একটা হয়ে থাকে, তাহলে?
‘ধন্যবাদ,’ ঠিক তখনই একটা মেয়েলী কন্ঠ কানে এলো আমার।
চমকে দ্রুত পেছনে ফিরলাম আমি। চোখের কোণের নড়াচড়ার ফলে বুঝতে পারলাম, একই কাজ করেছে সাজিদও।
‘ধন্যবাদ,’ আবারও বলে উঠলো কন্ঠটা। এবার কন্ঠ শোনার সাথে সাথে কন্ঠের মালিককেও দেখতে পেলাম স্পষ্টভাবেই।
এটা কি করে সম্ভব?
স্পষ্টভাবেই অবাক হলাম আমি। ভালোভাবে দু’হাত দিয়ে দু’চোখ ডললাম আমি। তারপর আবারও তাকালাম কন্ঠের মালিকের দিকে।
ঋতু!**

*******
‘ভাগ্য ভাল,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে চললো মেয়েটা, ‘তোমরা ছিলে। ভাগ্য আরো ভাল যে এপাশে ওপাশের মতো পরিবেশ নেই। নাহলে আবারও দৌড়ের উপরে থাকতে হতো আমাকে। আর তোমাদেরও হয়তো ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগটা পেতাম না।’
‘তুমি!’ অবাক কন্ঠে বলে উঠলো সাজিদ।
‘ঋতু,’ এগিয়ে এলো মেয়েটি। এক হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে অলরেডি।
আবারও অবাক হলাম আমি। ঋতু বেঁচে আছে!
কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? আমি তো নিজ হাতে খুন করেছিলাম মেয়েটাকে! তাহলে ও আবার কিভাবে এখানে এলো?
‘তা বুঝলাম,’ সাজিদের কথায় যেন বাস্তবে ফিরে এলাম আমি, ‘কিন্তু তুমি এখানে কিভাবে পৌছলে?’
‘ও একজন অপমানবী,’ ধীরে ধীরে বলে উঠলাম আমি। ঘোর কেটে গেছে আমার ইতোমধ্যেই।
‘রাইট,’ হেসে উঠলো ঋতু। এখন আর হাঁপাচ্ছে না আগের মতো। দম ফিরে পেয়েছে, ‘কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে?’
‘আমি জানি,’ সংক্ষেপে উত্তর দিলাম আমি। সাজিদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘চল, এগুতে হবে।’
‘এক সেকেন্ড,’ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ঋতু, ‘তুমি জানলে কিভাবে আমি অপমানবী?’
‘কারণ,’ অনিচ্ছাসত্যেও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম আমি, ‘শুধুমাত্র লুসিফার বা লিলিথের বংশধররাই এখানে আসতে পারবে। সাধারণ মানুষ নয়।’
‘ঠিক,’ আবারও হেসে উঠলো সে, ‘কিন্তু আমার জানামতে প্রতি ছয়শো ছেষট্টি বছর পর পর একজন অমানবের জন্ম হয়। কিন্তু আমি তো এখানে দুজন অমানব দেখছি!’
‘ও অমানব নয়,’ সাজিদের দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি।
‘তাহলে?’ ঋতুর দু’চোখ যেন বিস্ফারিত হবার জোগাড় হয়েছে, ‘সাধারণ মানুষ তো এখানে আসতে পারবে না!’
‘সাজিদ হচ্ছে অতৃব্য,’ দ্রুত জবাব দিলাম, ‘লিলিথের বংশধর।’
‘তাই নাকি?’ অবাক চোখে ওর দিকে তাকালো ঋতু, ‘তাহলে তো আমরা ভাইবোন হলাম!’
বুঝতে পারছি, সাজিদ একটু বিব্রতবোধ করছে। কারণ, ও এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করেনা যে ও একজন অতৃব্য।
‘চলো এখন সবাই,’ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম আমি, ‘এখানে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। কখন আবার কি হয়, বলা যায়না।’
আবারও পথ চলতে শুরু করলাম আমরা। অবশ্য এখন আবার হেটে চলেছি।
চারদিকে কেমন যেন একটা গুমোট আবওহাওয়া বিরাজ করছে। রাস্তাটা এখন একটু চওড়া লাগছে। মনে হচ্ছে অন্তত ছয় ফুট চওড়া হবে। কিনারটা নেমে গেছে নিচে। অদ্ভুত একটা আলো ঘিরে রেখেছে যেন আমাদেরকে। শুধু রাস্তাটা ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
‘তুমি এখানে এলে কিভাবে?’ নিজের অজান্তেই ঋতুকে উদ্দেশ্য করে হঠাত বাঁকাস্বরে প্রশ্ন করলাম আমি।
‘একটা বই পড়ে,’ জবাব দিলো সে, ‘হেটরিংক্স নাম। বইটা পড়ার পর নিজেকে আর...’
‘এক সেকেন্ড,’ মেয়েটাকে থামিয়ে দিলো সাজিদ, ‘হেটরিংক্স?’
‘হ্যাঁ,’ মৃদু হেসে উঠলো মেয়েটা, ‘অদ্ভুত একটা বই। অনেক অনেক...’
দ্রুত সাজিদের দিকে তাকালাম আমি। ও-ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জানি, দুজনের মাথাতেই একই চিন্তা চলছে।
আরেকটা হেটরিংক্স!
কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? একটা নষ্ট করেছি আমি। একটা আছে সাজিদের গার্লফ্রেন্ড স্বর্ণার কাছে। অথচ এই মেয়েটা বলছে, এর কাছেও আছে আরেকটা? আসলে পৃথিবীতে মোট কয়টা হেটরিংক্স এখনো বহাল তবিয়তে আছে?
‘কি হলো?’ নাকের সামনে ঋতুর তুড়িতে ঘোর ভাংলো আমার। দ্রুত সাজিদের দিকে তাকালাম আমি। ওরও একই অবস্থা। আবারও জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা, ‘কি হয়েছে? এভাবে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলে কেন তোমরা?’
‘কিছু না,’ সংক্ষেপে উত্তর দিলো সাজিদ।
আবারও এগুনো শুরু করলাম আমরা। কিন্তু আমার মাথায় একটা চক্করই ঘোরপাক খাচ্ছে বারবার।
হেটরিংক্স।

*******
টানেলের শেষ প্রান্তে পৌছতে বেশী সময় লাগলো না। সেখানে পৌছতেই দ্রুত বামদিকে এগিয়ে গেলাম আমি। সাজিদ চলে গেলো ডানদিকের কোণার দিকে।
মাথাটা কেবলই ঝুঁকিয়ে নিচে রাখা চারটা পাত্রের দিকে নজর দিলাম আমি, এমন সময় বলে উঠলো সাজিদ, ‘লুসিফারের বর্ণনা!’
‘মানে?’ আমি কিছু বলে উঠার আগেই ওর দিকে এগিয়ে গেলো ঋতু, ‘কি লেখা আছে এখানে?’
‘এখানে লেখা আছে,’ দেয়ালের কোণার দিকে আংগুল তুললো সাজিদ, ‘লুসিফারের বর্ণনা। ব্যাস, এইটুকুই।’
‘মানে কি?’ দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি। হেটে এসে দাঁড়ালাম দেয়ালটার দিকে। সেখানে হিব্রুতে লেখা আছে, תיאור של לוציפר
‘কাহিনী কি?’
‘জানি না,’ অসহায়ভাবে নিজের মাথা নাড়লো সাজিদ, ‘এটা কোন পূর্ণ বাক্য নয়। অন্তত শুধু দুটো শব্দ। আর এই দুটো শব্দ দিয়ে আর যাই হোক, একটা লাইন হবে না।’
‘ভাবতে হবে,’ নিজের মাথা চুলকাতে লাগলো ঋতু।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো এভাবেই। কেউ কোন কথা বলছি না। চুপচাপ ভেবে চলেছি। হেটরিংক্স আমি পড়েছিলাম বেশ আগে। রুদ্র মারা যাবার পর দ্রুত পড়তে হয়েছিল। তাই অনেককিছুই মনে করতে পারছি না। এছাড়া একেক ধর্মগ্রন্থে লুসিফারের বর্ণনা একেকভাবে এসেছে। কয়েকটার মাঝে কিছু মিল থাকলেও অমিলেরও অভাব নেই।
’১২: হেটরিংক্স,’ হঠাত করেই বলে উঠলো ঋতু, ‘এটাতে লিলিথের বর্ণনা ছিল। ১৩: হেটরিংক্সে ছিল এক অদ্ভুত মেয়ের কথা। যে কি না এসকায়দিয়ার রক্ষক। কিন্তু লুসিফারের বর্ণনাটা ঠিক মনে পড়ছে না।’
‘এসকায়দিয়া,’ ভ্রু কোঁচকালাম আমি, ‘মানে?’
‘মানে,’ ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে বলে উঠলো মেয়েটা, ‘আমরা এখন যেখানে আছি, তার নাম। এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগত। যখন লিলিথ এডামকে ছেড়ে লুসিফারের কাছে চলে এলো, তখন তারা দুজন মিলে গড়ে তুলেছিল এই জগত। লিলিথের স্বপ্ন ছিল লুসিফারকে নিয়ে এখানে চমৎকার একটা জগত তৈরী করবে, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি লুসিফারের বেঈমানীর কারনে।’
‘হুম,’ মাথা নাড়লাম আমি, ‘বুঝলাম। কিন্তু এই জগতটা আসলে কি?’
‘ঐ যে বললাম, লিলিথ আর লুসিফারের নিজেদের তৈরী জগত। সুখে থাকার জন্য তারা দুজন মিলে তৈরী করেছিল এই জগতটা। এই জগতে প্রবেশের আগে মোট চারটা ধাপ আছে যা পার করতে হয়। প্রথম ধাপে আছে পাথর, দ্বিতীয় ধাপে রক্ত আর পুঁজ, তৃতীয় ধাপে সময়, আর চতুর্থ ধাপে আছে আগুন। এই ধাপগুলোর সবগুলোতে আছে কিছু প্রতিনিধি, যারা এগুলোকে রক্ষা করে। আর তাদের সবাইকে সঠিকভাবে চালানোর জন্য আছে আহ্নাস্তিয়া নামের একটা ক্রিয়েচার। আহ্নাস্তিয়া স্বাভাবিকভাবে দেখতে একজন সাধারণ মেয়ের মতোই। কিন্তু মানুষের চেয়ে অনেক অনেকগুণ বিপদজনক সে। প্রথম ধাপে প্রবেশের আগে দেখা হয়েছিল তার সাথে। কোনমতে প্রবেশ করেছি এখানে। আবার দেখা হবে চতুর্থ ধাপে। ১৩:হেটরিংক্সে বলা আছে, যখন সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে, তখন দেখার মতো একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়। একেবারেই শীতল হয়ে যায় সে, আক্ষরিকভাবেই। আর তার শরীর থেকে বেরুতে শুরু করে বোটকা একটা গন্ধ। অবশ্য স্বাভাবিকভাবে সে অত্যন্ত সুন্দরী।’
’১৮-১:হেটরিংক্স,’ এসময় চেঁচিয়ে উঠলো সাজিদ, ‘মনে পড়েছে! ১৮-১:হেটরিংক্সে ছিল লুসিফারের পুর্ণাঙ্গ বর্ণনা! মোট দশটা শিং এবং সাতটা মাথা ছিল তার। সেইসাথে দশ শিঙে দশটা মুকুট শোভা পেতো। এছাড়া...’
এমনসময় হঠাত করেই আবারও যেন শুরু হলো ভুমিকম্প। সেই সাথে শুরু হলো কেমন যেন একটা শব্দ। মনে হচ্ছে প্রচন্ড শব্দে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে কেউ। প্রচন্ডভাবে নড়ে উঠলো পায়ের নিচের মেঝে। তাল সামলানোর জন্য মেঝেতে বসে পড়ে পড়লাম আমি। আমার সাথে সাথে বাকি দুজনও একই কাজ করলো।
‘তৃতীয় ধাপ সময়ের,’ চেঁচিয়ে উঠলো ঋতু, ‘সময় প্রায় শেষ আমাদের। জলদি এই ধাপ পার হতে হবে, নাহলে এখানেই হবে আমাদের পরিসমাপ্তি।’
‘পরিসমাপ্তির গুষ্ঠি কিলাই,’ বলেই উঠে দাঁড়ালাম আমি। কিন্তু কয়েক পা এগুতেই ধপাস করে পড়ে গেলাম আবার মেঝের উপর।
উঠে বসার চেষ্টা করলাম আমি। সেই সময়ই লক্ষ্য করলাম, আমার পাশ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলো দুটো শরীর।
সাজিদ আর ঋতু!
দ্রুত এগিয়ে গেলো ওরা। আমিও উঠে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলাম। তিনজনে মিলে যত দ্রুত সম্ভব ব্ল বেয়ারিংগুলো তুলে নিতে লাগলাম।
‘লুসিফারের প্রথম অক্ষর ל,’ দ্রুত বলে উঠলো সাজিদ, ‘এর মান হচ্ছে ২০০।’
‘জানি,’ দ্রুত বললাম আমি, ‘দশটা শিং, সাতটা মাথা এবং দশটা ক্রাউন, মানে ১,৭,১।’
দ্রুত বল বেয়ারিংগুলো নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করলাম আমরা। তারপর আবার হামাগুড়ি দিয়ে হাজির হলাম দেয়ালের সামনে।
কি হবে এখনো বলা যাচ্ছে না। আমাদের ধারণা ভুলও হতে পারে, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপটাই ঘটবে আমাদের কপালে।
পেছন থেকে এখনো প্রচন্ড শব্দ আসছে। ধীরে ধীরে শব্দের মাত্রা যেন বেড়েই চলেছে। আমরা অপেক্ষা করছি দেয়ালটা খোলার জন্য। যদিও জানি না খুলবে কি না!
অবশেষে! অবশেষে আমাদের আশাকে সত্যিই করার জন্যই যেন ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করলো দেয়ালের একটা অংশ। আর দেরী করা চলে না। কোনমতে একজন গলে যাবার মতো ফাঁক সৃষ্টি হতেই নিজেদের সেই ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিতে শুরু করলাম আমরা। তারপর ফিরে তাকালাম দেয়ালের দিকে।
দেয়ালের অন্য পাশে পৌছতেই হঠাত করেই যেন থেমে গেলো সবকিছু। ধীরে ধীরে আবার আগের মতো হয়ে গেলো দেয়াল। সেই সাথে থেমে গেছে যাবতীয় শব্দ।
‘স্বাগতম,’ এমন সময় হঠাত করেই পেছন থেকে বলে উঠলো একটা কন্ঠ। কন্ঠটা শুনেই চমকে গেলাম আমি।
দ্রুত পেছন ফিরলাম আমি। এবং পেছন ফেরার পর আগের চেয়েও অনেক বেশীই অবাক হলাম। ও এখানে কেন? কিংবা বলা চলে, কিভাবে?
আমি কিছু বলে উঠার আগেই এক পা এগিয়ে গেলো সাজিদ। বলে উঠলো, ‘আরে, স্বর্ণা, তুমি?’
‘মানে কি?’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘এ স্বর্ণা হবে কেন? এ তো রেইনা!’
‘রেইনা?’ দ্রুত আমার দিকে তাকালো সাজিদ। চোখে বিস্ময়।
অবশ্য একই চাহনী বিরাজ করছে আমার নিজের চোখেও, এটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আবারও তাকালাম আমি মেয়েটার দিকে। এখনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাকে। যদিও আমি কখনো স্বর্ণাকে দেখিনি, তবে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি এ স্বর্ণা নয়।
এ হচ্ছে রেইনা। আমার রেইনা।
এমন সময় হঠাত করেই আমার কানের কাছে বলে উঠলো ঋতু, ‘এ রেইনা বা স্বর্ণা, দুজনের একজনও নয়। এ হচ্ছে আহ্নাস্তিয়া।’
আবারও চমকে উঠলাম আমি। কি বলছে ঋতু?

*******
‘সত্যিই বলছে মেয়েটা,’ মৃদু হাসি ফুটলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আহ্নাস্তিয়ার ঠোঁটে, ‘আমিই আহ্নাস্তিয়া। এসকায়দিয়ার রক্ষক আহ্নাস্তিয়া!’
হঠাত করেই যেন নিজের রুপ পরিবর্তন করে ফেললো সে। এতক্ষণ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম রেইনাকে, হঠাত করেই সেখানে দেখতে পেলাম অন্য এক চেহারা। অনিন্দ্য সুন্দর এক চেহারা!
‘খাইছে!’ বলেই আমার দিকে আবারও তাকালো সাজিদ, ‘আর একটু হলে তো...’
‘যাইহোক,’ সাজিদকে থামিয়ে দিয়ে বললো আহ্নাস্তিয়া, ‘এতোদুর পর্যন্ত আসতে পেরেছো, কারণ তোমরা লিলিথ আর লুসিফারের বংশধর। কিন্তু আমি এখানকার রক্ষক। আর একারণেই তোমাদেরকে নিরস্ত করতে হচ্ছে আমাকে। চলে যেতে হবে তোমাদেরকে। কারণ, আমাকে স্পষ্টভাবেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে লুসিফার আর লিলিথকে একত্রিত করতে যারাই আসবে, তাদেরকে নিরস্ত করতে হবে।’
‘এক সেকেন্ড,’ বলে উঠি আমি, ‘আমি এখানে লুসিফার আর লিলিথকে একত্র করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। আমি এখানে এসেছিলাম শুধুমাত্র ব্লুস্টোন উদ্ধার করতে।’
‘আমিও,’ বলে উঠলো সাজিদ।
‘আমি সবই জানি,’ দৃঢ়কন্ঠে বলে উঠলো আহ্নাস্তিয়া, ‘তোমরা দুজন নিজে থেকে আসোনি, তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে। লিলিফাররা সবসময় চাচ্ছে লিলিথ আর লুসিফার যাতে একত্র হয়, আর সেই উদ্দেশ্যেই এখানে পাঠানো হয়েছে তোমাদের দুজনকে। আর সেই কাজটা যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই লিলিফারের বর্তমান গুরু নিজে এসেছেন এখানে।’
‘মানে?’ সাজিদ আর আমি নিজেদের মাঝে চাওয়াচাওয়ি করলাম। কি বলতে চাচ্ছে আহ্নাস্তিয়া?
‘হ্যাঁ,’ মুখ খুললো ঋতু, ‘আমি চাই যে লিলিথ আর লুসিফার একত্রিত হোক আবার। তাতে করে আমাদেরই মঙ্গল। আর কতোদিন আমরা নিজেদের মাঝে বিভেদের দেয়াল তুলে রাখবো? এতে করে নিজেদেরই ক্ষতি করছি আমরা। পৃথিবীর মানুষদের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে পারছি না। নিজেদেরকে মানব সমাজের মাঝে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে শুধুমাত্র এই একটা কারণেই।’
‘তুমিই লিলিফারের...’ মুখ থেকে কথা সরছে না আমার। কি বলছে এই মেয়ে?
‘হ্যাঁ,’ মাথা নাড়লো ঋতু, ‘আমিই লিলিফারের বর্তমান গুরু।’
‘তারমানে তুমিই কিডন্যাপ করেছিলে রেইনাকে?’ ক্রোধে বিকৃত হতে শুরু করেছে আমার চেহারা।
‘এটা দোষের কিছু নয়,’ আমার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো ঋতু, ‘তুমিই ভেবে দেখো। এখনো পর্যন্ত রেইনাকে তোমার আসল পরিচয় জানাতে পারোনি তুমি। যেই তোমার সম্পর্কে জেনে এসেছে, তাদের সবাইকেই খুন হতে হয়েছে তোমার হাতে কোন না কোনভাবে। অবশ্য সাজিদ একমাত্র ব্যতিক্রম। এমনকি রেইনাও এতোদিন জানতো না ব্যাপারটা।’
‘রেইনাও জানতো না ব্যাপারটা,’ হঠাত করেই ভয় পেয়ে গেলাম আমি, ‘মানে... মানে কি? রেইনা এতোদিন জানতো না ব্যাপারটা, এর মানে সে এখন...’
‘ঠিক ধরেছো,’ মৃদু হাসি ফুটে উঠলো ঋতুর চেহারায়, ‘এখন রেইনা জানে সে কি! সে এটাও জানে তুমি নিজে কি!’
‘শিট,’ আক্রোশে খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘তুমি ওকে জানিয়ে দিয়েছো?’
‘না,’ মাথা নাড়লো মেয়েটা, ‘ও নিজেই জেনে গেছে। কিডন্যাপারদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হঠাতই ভায়োলেন্ট হতে শুরু করে সে। তখনই বুঝতে পারে রেইনা, সে সাধারণ কোন মানুষ নয়। তার ভেতর আছে অন্যরকম একটা শক্তি, যা তাকে বাকি সবার কাছ থেকে আলাদা করেছে। দেখতে সাধারণ মানুষের মতো হলেও আসলে সে অসাধারণ।’
‘মানে?’
‘মানে তেমন কিছুই না,’ হাসিটা হঠাত করে নিভে যায় ঋতুর চেহারা থেকে, ‘ও নিজেই জেনে গেছে যে ও সাধারণ কেউ নয়। পরে আমাকেই সবকিছু ব্যাখ্যা করে দিতে হয়েছে ওকে। তারপর ঐ হারামজাদী...’
আর সহ্য হলো না আমার। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলাম ঋতুর গালে। চড়টা খেয়ে তাল হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো সে।
এক সেকেন্ড পরেই ঝট করে আমার চোখে চোখ রাখলো ঋতু। স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি, ওর চোখজোড়া জ্বলছে।

*******
দুদিন পর

‘তুমি আমাকে কেন বলোনি এসব কথা?’ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করলো রেইনা।
ধীরে ধীরে ওর দিকে তাকালাম আমি। আগেরমতোই অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে।
হঠাত করেই আমি ফিরে গেলাম দুদিন আগের ঘটনায়। ব্যাপারটা যে এরকম হবে আমি ভাবতেও পারিনি কখনো। ঋতু ছিল লিলিফারের গুরু। আসলে এই সংগঠনটা শুরু করেছিল ঋতুর মা। উনি ছিলেন আগাগোড়া লিলিথ আর লুসিফারে বিশ্বাসী। নিজের বিশ্বাসটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং লিলিথ আর লুসিফারের শক্তিতে একত্রিত করতে ব্রতি ছিলেন তিনি।
ঋতুকে হত্যা করতে হয়েছে আমার। যদিও ব্যাপারটা আগেরবারের মতো এতোটা সোজা ছিল না। ঋতুকে হত্যা করার পর বাইরে বেড়িয়ে আসি আমরা। এ কাজে আমাদের সাহায্য করেছে আহ্নাস্তিয়া। যতোটা হিংস্র ভেবেছিলাম তাকে আমরা, সে সেরকম ছিল না মোটেও।
সাজিদ ফিরে গেছে দেশে। অবশ্য ও কথা দিয়েছে দেশে ফিরেই ওর কাছে থাকা হেটরিংক্সটাকে নষ্ট করে ফেলবে ও। অবশ্যই স্বর্ণার অগোচরে।
‘আসলে,’ মৃদুস্বরে বলে উঠলাম আমি, ‘আমি চাইনি এসব ব্যাপার সম্পর্কে জানতে পারো তুমি। এসব ব্যাপার জানা ঠিক নয়। মানুষের মাঝে থেকেও মানুষ না হওয়াটা কতোটা অস্বস্তিকর, তা বোঝানো কঠিন। আমি এই জিনিসটাই করে যাচ্ছি গত নয় বছর ধরে। আমি জানি যে আমি মানুষ নই, তবুও আমাকে স্বাভাবিক আচার ব্যবহার করতে হচ্ছে সবার সামনে। তুমি এসব সম্পর্কে জানতে না, তাই সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলে। কিন্তু এখন আর এটা সম্ভব নয়। এখন তুমি যেহেতু জেনে গেছো যে তুমি মানুষ নও, অমানবী, সেহেতু একটা পরিবর্তন আসবে তোমার মাঝে। যেটার ফলাফল খুব একটা ভাল হবার কথা নয়।’
‘বুঝতে পারলাম,’ নিজের মাথা নেড়ে বলে উঠলো রেইনা। হাতের বইটা দেখিয়ে বললো, ‘এখন এটার কি করবো?’
ওর হাতের দিকে তাকালাম আমি। ওর হাতে শোভা পাচ্ছে একটা বই। ঋতু এসকায়দিয়ায় প্রবেশের আগে তার কাছে থাকা হেটরিংক্সটা দিয়ে গেছিল ওকে।
‘এটা নষ্ট করে ফেলতে হবে,’ ওর হাত থেকে বইটা তুলে নিলাম আমি, ‘এই পৃথিবীতে হেটরিংক্সের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। আমি চাইনা এটা আর কোন সাধারণ মানুষের সামনে আসুক।’
‘হুম,’ সমঝদারের ভঙ্গিতে নিজের মাথা নাড়লো ও, ‘সেটাই ভাল।’
সেই রাতেই বইটা পুড়িয়ে ফেলি আমি। তারপর ফিরে যাই রেইনার কাছে।
একটা জিনিস বুঝতে পারছি আমি, এই পরিবেশে আর রেইনাকে রাখা যাবে না। এই দেশে থাকলে ও আর স্বাভাবিক থাকবে না। এছাড়া ঋতুকে মারার ফলেই থেমে যাবে লিলিফাররা, সেটাও নয়। আজ না হয় কাল আবারও হামলা করবে। তখন রেইনাকে রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে আমার পক্ষে।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই আমার। এই দেশ ছাড়তে হবে আমাকে। রেইনাকে নিয়ে ফিরে যেতে হবে আমার নিজের দেশে। সেখানে আর যাই হোক, লিলিফারেরা আমাদেরকে খুঁজে পাবে না আশা করি। আর বাংলার পরিবেশে রেইনাও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
আজ রাতেই ব্যাপারটা জানাতে হবে রেইনাকে।

*******
মেঘের উপরে ভাসছি যেন আমি। এই তো, মাত্র কয়েক ফুট দুরেই ভাসছে মেঘগুলো। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে সেগুলো। অবশ্য আমি জানি, এটা সম্ভব নয়। জানালার কাছের কারনে জিনিসটা আসলেই অসম্ভব।
মৃদু হেসে উঠি আমি। তারপর নজর দিই পাশের সিটের দিকে। রেইনা এখনো ফিরেনি বাথরুম থেকে। আবারও মনোযোগ দিই আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে।
‘এক্সকিউজ মি,’ হঠাতই কানের কাছে বলে উঠে একটা নারী কন্ঠ।
পাশে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমি, একজন এয়ারহোস্টেজ দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্রে হাতে। ট্রের উপর একটা কাগজ।
‘ইয়েস?’ ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাই আমি।
‘এটা আপনার জন্য,’ বলেই কাগজটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সিটগুলোর মাঝখানেই ফাঁকা জায়গা ধরে হাটতে শুরু করে সে।
ব্যাপার কি? হঠাত করে এই কাগজ পাঠালো কে?
ভ্রু কোঁচকানো অবস্থাতেই কাগজটা খুলি আমি। তারপর পড়তে শুরু করি।

‘শুভ,
তুমি যা ভেবেছিলে, তা ঠিক ছিল। এই পৃথিবীতে হেটরিংক্সের কোন প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর মানুষের জন্য এটা এখন একটা নিষিদ্ধ বস্তু। এই জিনিস হাতে পেলে যে কেউই চাইবে এর ব্যাবহার করতে। এর সাহায্যে সে চাইবে অসীম ক্ষমতা, যার ফলে মানব সমাজে নেমে আসবে বিপর্যয়। তা তো আর আমি হতে দিতে পারিনা, তাই না? আর তাই এই বিপর্যয়ের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে হবে আমাকে। যদিও জিনিসটা কেমন যেন শোনা যাচ্ছে। হাজার হলেও তো আমরা লুসিফারের বংশধর, তাই না? তবে আশা করি উত্তরটা তুমি জানো।
ঋতুর কাছে শুনেছিলাম আমি, এই পৃথিবীতে বর্তমানে মোট তেরোটা হেটরিংক্স থাকার কথা। একটা তুমি ধ্বংস করেছো, যেটা আমি পেয়েছিলাম ঋতুর কাছ থেকে। বাকি আছে আরো বারোটা। এগুলো নষ্ট না করে থামতে পারবো না আমি। আসলে সত্যিই বলতে, এগুলো ঠিকঠাক থাকলে আমি নিজেই ঠিক থাকতে পারবো না। বার বার আমার মনে হবে যে, আমি সাধারণ মানুষ নই। আর আমাকে খোঁজার জন্য কেউ না কেউ হেটরিংক্সের সাহায্য গ্রহণ করছে, এই চিন্তাটা আমাকে স্বাভাবিক থাকতে দেবে না। তাই আমার নিজের শান্তির জন্যে হলেও হেটরিংক্সগুলো ধ্বংস করতে হবে আমাকে। জানি, কাজটা এতোটা সহজ নয় মোটেও, তবুও কাজটা করতে হবে আমাকে।
কাজটা শেষ করা পর্যন্ত যদি বেঁচে থাকি, তবে আবারও দেখা হবে তোমার সাথে। ভাল থেকো। আর মনে রেখো, তোমাকে ভালোবাসি আমি।
----রেইনা।’

দ্রুত উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু বাধ সাধলো সিটবেল্ট, যদিও ছিঁড়ে গেলো সেটা। দ্রুত এগিয়ে গেলাম আমি বাথরুমের দিকে। রেইনাকে থামাতে হবে আপাতত।
বাথরুমের সামনে এসে অবাক হয়ে গেলাম আমি। রেইনা যেটাতে ঢুকেছিল, সেটা হা করে খোলা। ভেতরে নেই রেইনা!
‘রেইনা,’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো আমার বুক চিড়ে।
একটা কথাই আপাতত মাথায় ঘুরছে আমার।
থামাতে হবে ওকে। একা একা কাজটা করা ওর কোনমতেই ঠিক হবে না। পরে দেখা যাবে মানুষের ভাল করতে গিয়ে আরো খারাপটা ঢেকে আনবে ও। যেভাবেই হোক থামাতেই হবে ওকে।

*অমানব দ্রষ্টব্য
**অপমানবী দ্রষ্টব্য
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×