পাঠ্য পুস্তকে পড়া কবিতার বাইরে, কবির বাইরে কোন কবিতা বা কবি এভাবে আচ্ছন্ন করতে পারে তা কিন্তু তখনি বুঝতে পারিনি, যখন আবুল হাসানের কবিতায় ডুবে যাচ্ছি; যখন বুঝেছি, তখন আকণ্ঠ ডুবে গেছি আবুল হাসানে। আবুল হাসানের উন্মূল যৌবনে যখন কবিতার জন্য ওঁরা দিশেহারা, সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা তখন কবিতার সুঘ্রাণ পেতে চেষ্টা করছি। মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-যতীন্দ্রমোহন বাগচী-নজরুল-জীবনানন্দ ছাড়াও বাংলা ভাষায় কবি আছেন, জানলাম নির্মলেন্দু গুণ পড়ে; নির্মলেন্দু গুণ আমাদের কবি, এক শহরের কবি; তাঁর প্রতি এক স্বাভাবিক পক্ষপাত কাজ করেছে; কিন্তু নির্মলেন্দু গুণের ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে চিনেছিলাম আবুল হাসানের নাম। ১৯৭২-এর শেষদিকে প্রকাশিত রাজা যায় রাজা আসে ১৯৭৩-এ পড়েই গোপনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাকেও কবি হতে হবে। কৈশোরের আবেগে আরো আগেই দু’একটি কবিতা লিখলেও বলা যায় আবুল হাসান-ই হাত ধরে আমায় নিয়ে এলেন কবিতা সড়কে। রাজা যায় রাজা আসে কাব্যের কবিতাগুলোয় কী ছিলো? সে কথা আজও ভাবি। আজও আবুল হাসানের ঘোর কাটেনি। সেই যে পড়েছি–
‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা !
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা !
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন !’
(পাখি হয়ে যায় প্রাণ॥ রাজা যায় রাজা আসে)
অসাধারণ মুগ্ধতায় পড়েছি আদ্যপান্ত। কী মমতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন–
‘আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে সরকারী লোক, পুলিশ বিভাগে চাকরী কোরেও
পুলিশী মেজাজ কেন ছিলনা ওনার বলুন চলায় ও বলায় ?
চেয়ার থেকে ঘরোয়া ধুলো, হারিকেনের চিমনীগুলো মুছে ফেলার মতোন তিনি
আস্তে কেন চাকর বাকর এই আমাদের প্রভু নফর সম্পর্কটা সরিয়ে দিতেন ?’
(চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ॥ রাজা যায় রাজা আসে)
আধুনিক কবিতা এত সরল, এত গভীর-স্পর্শকাতর– এর আগে সেভাবে পড়িনি, অথবা পড়াই হয়নি; কেন কীভাবে আবুল হাসান চলে এলেন হাতে ঠিক বুঝতে পারিনি। তাঁর কবিতা পড়ে বারবার চমকে উঠেছি। একসময় তাঁর বেশ কিছু কবিতা মুখস্থ বলতে পারতাম। সেই যে কবিতাটি যেটি পড়ে মনে হয়েছিলো, এতো আমার কথা ! এত সুন্দর করে আর কে বলতে পারতো ?
‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না,
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন,
কী লাভ যুদ্ধ কোরে ? শত্রুতায় কী লাভ বলুন ?
আধিপত্যে এত লোভ ? পত্রিকা তো কেবলি আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর…..
মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলো না !’
(জন্মমৃত্যুজীবনযাপন॥ রাজা যায় রাজা আসে)
আবুল হাসানের কবিতা নিয়ে বলতে চাইলে লোভ সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। মনে হয় সব কবিতা বলতে থাকি। এত গভীর, এত কোমল-পেলব-মায়াবী শব্দে বাক্যবিন্যাস অথচ কত ঋজু-দৃঢ়-দার্ঢ্য। জীবনানন্দ দাশের ‘হায় চিল’ কবিতা পড়ে বারবার মনে পড়েছে আবুল হাসানের কথা-
‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তাঁর ম্লান চোখ মনে আসে !
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে !’
(হায় চিল॥ বনলতা সেন॥ জীবনানন্দ দাশ)
জীবনানন্দের সেই চিল যেন আবুল হাসান, যিনি হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসেন; বেদনার কথা বলতেই দু’টি কবিতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে–
‘আঙুলে সেলাই করবি আমার আঙুল
বুক থেকে নামাবি না পারদ বা পরিতৃপ্ত ঘৃণা
শরীরে ধনুক বেঁধে সুন্দরের ছিলা রাখবি টান
কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন
আমাকে শাসাবি খুব, কষ্ট দিবি, ক্লান্তি দিবি, আর
রাত হলে স্বপ্ন দিবি শুতে দিবি বুকের খোঁপায়
শরীরে সেলাই করবি সেই সাপ, সেই আদি পাপ’
(কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন॥ রাজা যায় রাজা আসে)
‘আমার এখন চাঁদ দেখতে খারাপ লাগে
রাতের বেলা ট্রেনের বাঁশি শুনতে আমার খারাপ লাগে
জামার বোতাম আটকাতে কী কষ্ট লাগে
তুমি আমার জামার বোতাম অমন কেন যত্ন করে লাগিয়ে দিতে
জুতোর ফিতে প্রজাপতির মতোন তুমি উড়িয়ে দিতে’
(যে তুমি হরণ করো)
আবুল হাসান আকণ্ঠ বেদনায় নিমজ্জিত একজন হতাশাবাদী সে কথা মেনে নেয়া কঠিন, যদিও তাঁর কবিতায় প্রেমে হতাশার কথা আছে, মৃত্যুচিন্তা আছে; পাশাপাশি তাঁর কবিতায় যে সমকাল-সমাজ সচেতনতা আছে তা কিন্তু তিনি তাঁর প্রথম কাব্যেই পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতায় সমকাল বুঝতে নিচের পংক্তি ক’টি পড়ে নেবো–
‘অনেক যুদ্ধ গেলো,
অনেক রক্ত গেলো,
শিমুল তুলোর মতো সোনারূপো ছড়ালো বাতাস।
ছোট ভাইটিকে আমি কোথাও দেখিনা,
নরোম নোলক পরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখিনা।
কেবল পতাকা দেখি,
কেবল উৎসব দেখি,
স্বাধীনতা দেখি।
তবে কি আমার ভাই আজ ঐ স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব ?’
(উচ্চারণগুলি শোকের॥ রাজা যায় রাজা আসে)
আবুল হাসানের কবিতায় দেখেছি উল্লম্ফন। কাব্যযাত্রা-জীবনযাত্রা দ্রুত পার হয়ে যাবেন বলেই হয়তো এই দ্রুততা।
‘ঘুরে ঘুরে নাচিতেছে পণ্ডিতের মতো প্রাণে
রৌদ্রের উঠানে ঐ নাচিতেছে যন্ত্রণার শেষ অভিজ্ঞানে !
পাখা লাল, শরীর সমস্ত ঢাকা লোহুর কার্পেটে !
মাথা কেটে পড়ে আছে, যায় যায়, তবুও নর্তক
উদয়শঙ্কর যেনো নাচিতেছে ভারতী মুদ্রায় !’
(মোরগ॥ পৃথক পালঙ্ক)
জীবদ্দশায় আবুল হাসানের শেষ কাব্য পৃথক পালঙ্ক। এ গ্রন্থে তাঁর কবিতার পরিমিতি এবং পরিণতি দুই-ই লক্ষ করা যায়; পাশাপাশি তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে মৃত্যুচিন্তা। কবিতায় মৃত্যুচিন্তা পড়তে নিচের পংক্তি ক’টি পড়ে নেবো–
‘চলে গেলে–তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।
জল নেমে গেলে ডাঙ্গা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল:
নদীর প্রবাহপলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার অনড় শামুক !’
(অপরূপ বাগান॥ পৃথক পালঙ্ক)
আবুল হাসান যখন ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন তিনি লিখছেন–
‘অসুখ আমার অমৃতের একগুচ্ছ অহঙ্কার !
আত্মার অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ক্ষুধিত জানোয়ারের
রোমশ বলশালী শরীরের দুটি সূর্যসমান রক্তচক্ষু !
যা দেখে ঈশ্বর পর্যন্ত ভয়ে, ভয়াল হিমে শয্যাদায়গ্রস্ত হন !’
(অসুখ॥ পৃথক পালঙ্ক)
অথবা
‘বনে’র সবুজ লন্ড্রীতে আমার অরণ্য জামা উঠছে ঐ
সর্বঋতু সম্মত পোষাক আমার !
তূষারতুলোর বোনা বস্ত্রালয় থেকে ফিরে এসে
আবার তোমাকে যেন পাই।
কি কি আনবো, শোনো:
পাখিরা রয়েছে তাই পরিবহণের কোনো সমস্যা হবে না।
আনবো অঢেল উষ্ণ মহাকাল, বসন্ত বৈকাল:
উড়– উড়– সমুদ্রের হাওয়া।
বৈদেশিক বাণিজ্য টাওয়ার বাক্সে টোকা দিয়ে
আনবো আলোর নতি, নীল মুদ্রা, মৈত্রী ও বসতি !’
(রোগ শয্যায় বিদেশ থেকে॥ পৃথক পালঙ্ক)
আবুল হাসানের কবিতা এমন এক ঘোর, মনে হবে সারাদিন পাঠ করি, সারাদিন পড়ে পড়ে প্রিয়জনদের শোনাই।
কবি আবুল হাসানের জন্ম ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ৪ আগস্ট; ১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বর মাত্র ২৮ বছরের জীবন কাটিয়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেন। জীবদ্দশায় তাঁর ৪ টি কাব্য প্রকাশিত হয়: ১. রাজা যায় রাজা আসে; ২. আমার প্রেম আমার প্রতিনিধি; ৩. যে তুমি হরণ করো; এবং ৪. পৃথক পালঙ্ক। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় অগ্রন্থিত আবুল হাসান, কবিতা সমগ্র আবুল হাসান রচনাবলী ইত্যাদি। নোওরোজ সাহিত্য সংসদ থেকে এপ্রিল ১৯৮৫ তে প্রকাশিত আবুল হাসানের পৃথক পালঙ্ক-এর দ্বিতীয় সংস্করণের সূচনায় মুদ্রিত গুটি কয় পংক্তির কথা স্মরণ করে প্রিয় কবির প্রতি প্রণতি নিবেদন করবো।
‘বাংলা কবিতার অতিশয় উর্বর এক ভূমিখ- কর্ষণ ক’রে গিয়েছেন আবুল হাসান। যখন তিনি এই স্বগতোক্তি করেন, “আমার আত্মার রুগ্নতাই একমাত্র সৌন্দর্য” তখন মনে হয় সমস্ত পৃথিবী ভ’রে নেমেছে এক ক্ষীণ, ম্লান মরা জ্যোৎস্নার ঢল যেখানে সম্পূর্ণ নগ্নদেহে নতজানু হয়ে অবগাহন করছেন পৃথিবীর এক শীর্ণকায় কবি, যার অমল হৃদপি- থেকে ক্ষরিত হয়েছে ফোঁটা ফোঁটা সৌন্দর্যানুভূতি, টৈ-টুম্বুর হয়ে উপচে পড়েছে প্রসারিত করতল বেয়ে জানুসন্ধিতে কবি মুখ থুবড়ে প’ড়ে গেলেন ঋতুমতী বসুন্ধরার বুকে, ‘আ: কি সুন্দর, কী মধুর অই পীযূষধারা”… পৃথক পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে আবুল হাসান চড়ুইয়ের মতো মুখ ঠোকরান শীতল ও স্বচ্ছ আয়নাতে।’
লেখক: ফরিদ আহমদ দুলাল