somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: সমাপ্তিতেও অসমাপ্তি

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিপুনের ঘন ঘন পেট ব্যথাটা নিত্যদিনের একটা অংশ হয়ে গেছে। কোন ধরনের কারন দর্শানো ছাড়াই পেট ব্যথাটা হয়। এই পেট ব্যথাটা বোধ হয় এপেন্ডিসাইটিস এর উপসর্গ। গত বছর আশার এরকম হয়েছিল, তখন তার অপারেশন করতে হয়েছিল। নিপুনের বেশ ভয় হয়, তারও যদি সত্যি সত্যি এপেন্ডিসাইটিস হয়, তাহলে তাকেও অপারেশন করতে হবে। ভাবতেই নিপুনের শরীরটা শির শির করে উঠে।

নিপুন এবার এস.এস.সি দিবে।পরীক্ষার আর মাত্র দুই মাস বাকি আছে। অথচ পড়াশুনার প্রতি তার তেমন মনোযোগই আসছেনা। সত্যি বলতে তার তেমন অনুভূতিও কাজ করছে না।কয়েকদিন আগে টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টও দিয়েছে, তেমন একটা ভালও হয় নি।

নিপুন আয়নার সামনে বসে অনেকক্ষন ধরে সাজার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনভাবেই মনোযোগ দিতে পারছে না।চোখে যেই মাত্র কাজল দিতে যাচ্ছে,কিভাবে যেন তা লেপ্টে যাচ্ছে। অবশ্য এটা হবার কারনও সে বের করে ফেলেছে। তার আসলে ভীষন পেট ব্যথা করছে,যার কারনে ঠিক মনোযোগ দিতে পারছে না ।কিন্তু এখন পেট ব্যথাকে গুরুত্ব দিলে চলবে না।তাকে সাজতে হবে,চোখে কাজল দিতে হবে, আইলানার দিতে হবে,হালকা লিপ্সটিক দিতে হবে । হাল্কা মেক আপও দেয়া যায়, যদিও প্রয়োজন নাই। নিপুন যথেষ্ট রকমের ফর্সা।ছোট্ট টিপও দিতে হবে। ইদানীং সে টিপ দেয়,আপুও দেয় বলে। আপুকে খুব সুন্দর লাগে। তাই এখন থেকে আপুর অনুকরণ করার চেষ্টা করে।

নিপুনের আপুর নাম নীরা। সে এ বছর এইচ.এস.সি দিবে। সম্পর্কে খালাত বোন হয়। নিপুনের সবচেয়ে কাছের ঘনিষ্ট মানুষ এই নীরা আপুই। আপুর কোথাও কোন কিছুই থাকলে সে যায় আপুর সাথে। যেমন আপুর কোচিং এ নাকি আজকে নাকি পিকনিক।তাই সে আপুর সাথে তার কোচিং এ যাবে।আজকে অবশ্য আপুর কোচিং এ গেলে আবির ভাইয়ার সাথে দেখাও হয়ে যেতে পারে। আবির ভাইয়া আপুর ব্যচমেট, আপুকে ভীষন পছন্দ করে। সেই সূত্রে ভাইয়ার সাথে পরিচয়। তারপর কিভাবে কিভাবে যেন তার ভাইয়া হয়ে গেল। ভাইয়াকে দেখলে ক্যামন যেন বড় ভাইয়া ভাইয়া মনে হয়।আবির ভাইয়ার সাথে আরেকজন থাকে, সুমন ভাইয়া। আবির ভাইয়ার সাথে দেখা হলে উনার সাথেও দেখা হবে,অদ্ভুত রকমের দরকারি মানুষ সে।


আবির প্রায় পনের মিনিট হল মেইন রোডের ফুট পাতে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকার পেছনে একটা গূঢ় কারণ আছে। সে নীরার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগছিল না। এখন অবশ্য খানিকটা বিরক্ত লাগছে।এখন ফেব্রুয়ারি মাস চলছে,ফেব্রুয়ারি মাসের রোদের তেজটা প্রথম প্রথম ভাল লাগলেও আস্তে আস্তে অসহ্য হয়ে উঠে। তাছাড়া কিছুক্ষন আগে সুমন সাথে ছিল। আবিরের অপেক্ষার মত গুরুতর কাজের মধ্যে সেও অংশ নিয়েছিল। কিছুক্ষন আগে তার বিরক্ত ধরে যায়। তাই সে বিরক্তি নিয়ে কোথায় যেন সে উধাও হয়ে গেছে। সুমন হচ্ছে তার সবচেয়ে কাছের ছোট ভাই। এক অর্থে বন্ধুও বলা যেতে পারে কারন আবির আর সুমন ব্যচমেট। অদ্ভুত হলেও সত্যি যে সুমন আবিরের ছোট ভাই হলেও ব্যচমেট!!

প্রায় একুশ মিনিট পর নীরাকে দেখ গেল। সে রিকশা থেকে নামছে,সাথে নিপুনটাও আছে। আবির বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল বলে নিখুঁত ভাবে সময়ের হিসাবটা রাখতে পাচ্ছিল। আবির লক্ষ্য করল নীরার মত করে নিপুনও চোখে কাজল দিয়েছে, যাকে বলে মিথস্ক্রিয়ার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

নীরা আর নিপুন উদয় হওয়ার সাথে কোথা থেকে যেন সুমনও উদয় হল। আবিরের বেশ ভাবান্তর হল।এটা কি বিপদের সূত্রের মত উদয় সূত্র নাকি। বিপদ যখন আসে তখন সব বিপদ একসাথে আসে ঠিক তেমনি বোধ হয় কেউ যখন উদয় হয় সবাই তখন একসাথে উদয় হয়!

নীরা আর নিপুন কাছে আসতেই আবির বিরক্ত মুখে বলল,প্রায় একুশ মিনিট লেট!
একুশ মিনিট দেরি করাতে নীরার তেমন কোন ভাবান্তর হল না।নীরা রিকশা থেকেই নেমে কোচিং এর দিকে রওনা হতে থাকল,পিছে পিছে নিপুন,সুমন আর পাশাপাশি আবির। নীরার সংক্ষিপ্ত জবাব,তো!
আবির বেশ ঠান্ডা গলায় বলল,তো কিছু না। জাস্ট বাঙ্গালিরা কখনও বাঙ্গালি লেবাস বাদ দিতে পারবে না। যতই সে নিজেকে জাপানী জাপানী বলে দাবি করুক।
-অউ।
-মাথায় কাকের খাঁচার মত ওইটা কি??
-এটা খাঁচা না, ব্যন্ড। পঞ্চাশ টাকা দিয়া কিনছি।
-না ভাবলাম মাথার মধ্যে কাকও পুষিস।
-তাই তো ভাববিইই।
-ভাবাভাবির কিছু নাই তো, দেখে যা মনে হচ্ছে তাই বললাম।
-ভাগ তুই।
-কোচিং পর্যন্ত বডিগার্ড হিসেবে যাব। তারপর তো আলাদা হয়ে যাবই।
-মরেক তুই!
-তোকে সাথে নিয়া মরব।
-মরব না!
আবিরের আর কিছু বলতে ভাল্লাগতেছে না। চুপচাপ হাঁটতে থাকল।পেছন থেকে শুধু সুমন আর নিপুর বেশ সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে।

কোচিং থেকে ফেরার পথে সুমন আর আবির হাঁটছে মেইন রোডের ফুটপাত ধরে। উদ্দেশ্য সুমনে মেস। সুমন কে অবশ্য মেসেই থাকতে হয়, কারন সুমন এখানকার স্থানীয় নয়। আবির সেখান থেকে বাসায় ফিরবে।

সুমন অনেকক্ষন ধরেই কথা বলছে না। আবির অবশ্য সুমনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে, সুমনের তাতে কোন আগ্রহ নেই বলে কথোপকথন জমে উঠছে না। আবির অবশ্য সুমনের কথা না বলার কারনও গূঢ় কারণও বের করে ফেলেছে। নিপুন তার আপুর সাথে কখন যে চলে গেছে বলতেও পারে না। কোচিং থেকে ফেরার পথে সুমন মনে মনে নিপুন কে অনেক খুঁজেছিল কিন্তু খুঁজে না পেয়ে তাদের বাসা যাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হয় সুমন। তাতে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়। আবির সুমন কে জিজ্ঞাসা করে, আজকে খাওয়া দাওয়া টা ভাল হইছে কি বলিস?
-হুম
-আজকের ডিসপ্লে টাও খারাপ হয় নাই, মেয়েটা ভালই নাচল। তুই কি বলিস ভাল হইছে না?
-হুম
- মেয়ে টার নাম কি যে ন?
-জানি না।
-ইসস, নামটাও জানা উচিৎ ছিল রে। মিস্টেক হয়ে গেল রে।
-হুম
-কি সুন্দর ডাগর ডাগর চোখ, তবে ময়দা টা বেশি হয়ে গেছে।
-হুম
-নাম্বার টা নিলে কাজের কাজ হইত, আমি না করলেও তুই এটলিস্ট চুটিয়ে প্রেম করতে পারতি।
সুমন প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে আবিরের দিকে তাকাল।
-তবে আজকাল শুনছি সব মেয়েরাই কম বেশি ফোন ইউজ করে.....বলে আবির লক্ষ্য করল সুমন প্রচন্ড আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে তার দিকে।আবির একটু ক্ষণের জন্য থেমে গিয়ে বলল,আফসোসের বিষয় নিপুন ফোন ইউজ করে না।

একটা ফোলা বেলুন যেভাবে চুপসে যায় সুমনের মুখখানা ঠিক সেভাবেই চুপসে গেল। আবির হো হো হাসতে লাগলো। সুমন আবিরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
-আচ্ছা এই বাচ্চাটার পিছনে তুই কতদিন ধরে ঘুরতেছিস বল তো? আবির ফের সুমন কে জিজ্ঞেস করে।
-এই মেয়েটাকে তোর বাচ্চা মনে হয়, তুই জানিস মেয়েটা কত পাকনা!
- কি জানি, আমার তো বাচ্চাই মনে হয়।
সুমন খেঁকিয়ে উঠল, তোর তো সবাইকেই বাচ্চা মনে হয়। আমাকেও তো তোর বাচ্চা মনে হয়।
আবির হেসে উঠে বলল,তুই তো বাচ্চাই।
সুমন তেড়েফুঁড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আবির বলল,ম্যালাদিন তো ঘুরলি। প্রপোজ দিয়া দে।
সুমন অনুনয়ের সুরে বলল,ক্যামনে দিব তুই ক না ভাই। আইডিয়া দে।
-আমার আইডিয়া শুনলে ছ্যাক খাবি, নিশ্চিত।
-না তোর আইডিয়া এত্ত খারাপ হবে না আমি শিউর।
আবির বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে ঠান্ডা গলায় বলল,আগে মেসে চল।


সুমন মেসে এসে রাগে গজ গজ করতে লাগল।আবির ভাই কে সে হাজার বারের মত প্রশ্ন করেছে, ভাই আইডিয়া কি? বেটা ওই যে তখন মুখ বন্ধ করেছে তো আর মুখ খোলেই নি। ভাবটা এমন যে কেউ যেন তাকে হুমকি দিয়েছে মুখ খুললেই গর্দান যাবে।

সুমন আর আবির মেস রুমে ঢুকামাত্রই আবির বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,যা হাত মুখ ধুয়ে আয় তাড়াতাড়ি। আমি বাসায় যাব।
সুমন কিছু না বলে চুপচাপ হাত মুখ ধুতে গেল। আবির ঠিক বুঝতে পারছিল না সে কি করবে। তাই ঘরের চারদিকে ইতিউতি করে তাকাতে লাগল।খানিক বাদে কি মনে করে সুমনের ডেস্ক এ রাখা ডায়েরি টায় নিপুনের নাম্বার টা টুকে রাখল।আবির ডায়েরি টা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিল।কিন্তু ডায়েরির ঠিক কত নাম্বার পেজে নাম্বারটা টুকে রেখেছিল তা লক্ষ্য করে নি।তাই আবিরের নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে।
সুমন হাত-মুখ ধুয়ে রুমে এসে আবির কে শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করল,আইডিয়া পাইলি ভাই?
আবির বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,হে বৎস শোন, প্রেমের ব্যপারে ধৈর্য হইল প্রথম ধাপ। যার এটা যত বেশি তার প্রেম তত মজবুত।
সুমন মুখ পানসে করে বলল,অ।

আবির মেস রুম থেকে বের হতে হতে বেশ আয়েশি গলায় বলল, তোর ডায়েরী তে নিপুনের নাম্বারটা আছে। খুঁজে নিস।
সুমনের চোখে যেন বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল। সে পাগলের মত অনবরত ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগল আর তৎক্ষণাৎ আবির বের হয়ে এল।


নীরার ইদানীং প্রচুর ঘুম পায়।ঘুমাতে নিরার মন্দ লাগে না, ভালই লাগে। ঘুমাতে ইচ্ছে হলে একটা পদ্ধতি প্রয়োগ করে, ঘুমানোর আগে মুঠোফোন টা সাইলেন্ট করে রাখে। মুঠোফোনটা সাইলেন্ট করলে তার ঘুম সত্যিই ধরে, মোবাইলের নীরবতার সাথে তার নীরবতার অদ্ভুত এক সম্পর্ক! তবে আজকে ঘুমুতে যাবার সময় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয় নি,এমনিতেই ঘুম এসেছিল। তার ফলস্বরুপ মুঠোফোনের রিংটোনে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়,ছোট্ট কারনে তাকে এক বান্ধবী, প্রাইভেট সম্বন্ধীয় সামান্য কিছু ব্যপারে তাকে ফোন দেয়। এ জন্য ফোন দেয়ার সময় কি আর নাই, মেজাজটা তিক্ত হয়ে গেল। এই মেজাজ খারাপ হওয়া ভাবটা দূর করার জন্য মুঠোফোনে একটা প্রিয় গান খুঁজছিল। কিন্তু কেনো যেন সেটা খুঁজে পাচ্ছে না। এখন মেজাজ টা আরো খারাপ হয়ে গেল। এক ধরনের জেদ চেপে গেল। সে যেভাবেই হোক গানটা খুঁজে বের করবেই। ঠিক তখনই তার মুঠোফোন টা বেজে উঠল। স্ক্রিনে তাকাতেই বিরক্তি যেন আরো বেড়ে গেল, আবির কল দিয়েছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কল টা রিসিভ করে নীরা বলল,বল?
-কালকে তুই আর নিপুন আমার সাথে দেখা করবি।
-না।
-জাস্ট পনেরো মিনিটের জন্য।
-তাও না।
-ক্যানো?
-ইচ্ছা নাই তাই
-মাঝে মাঝে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে হয়।
-যাব না।
ওপাশ থেকে আবির কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে বলল,মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস?
-কি?
-দুনিয়াটাকে ফালা ফালা করে দেই।
নীরা হেসে ফেলল।
-হাসলি ক্যান?
-ইচ্ছা হইল তাই।
-অ আচ্ছা।
-আচ্ছা তুই সিরিয়াস হচ্ছিস ক্যা?
-সিরিয়াস হবার মতই ব্যপার তাই।
-অউ।
-ও হ্যা একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম।
-বল
- কোচিং এর পিক্নিকের দিন তোকে সেম পেত্নীদের মত লাগতেছিল।
-অ ।
-রাখলাম। বলে ওপাশ থেকে আবির ফোনটা কেটে দিল।

আবির নীরাকে যে পেত্নী বলেছে তাতে নীরা মোটেও বিচলিত নয়,বিচলিত হবার কথাও না। কারন আবিরের কোন কথাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। আবির নীরার কাছে কি ধরনের ব্যক্তিত্ব সেটা নীরার কাছে আজও দুর্বোধ্য লাগে। ছেলেটা তার সামনে এলে ক্যামন যেন অস্বস্তি লাগে। খুব ভাল বন্ধুত্ব থেকে আবির যে একদিন তাকে প্রপোজ দিবে এটা নীরার জন্য খুব একটা অবাক করার মত বিষয় ছিল না,মোটামুটি তার কাছে খুব সাধারন সত্যের মত এটাও সত্যি মনে হত। আবির যেদিন প্রপোজ দেয় সেদিন টা ছিল নীরার কলেজে যাবার প্রথম দিন।সেদিনটায় আবির ক্যামন যেন অস্থির ছিল। তার চোখের সামনে পর পর তিনটা ঔষধ খেয়ে ক্যামন যেন উদভ্রান্তের মত হয়ে যায়। আবিরের চোখে ছিল দিশেহারা দৃষ্টি, সেই অবস্থায় আবির নীরার পিছু পিছু তার কলেজ ক্যান্টিনে যায়। আর নীরা অস্বস্তি তে ডুবে মরে তার পিছু নিয়েছে বলে। শেষমেশ আবির বিড় বিড় করে কোন ধরনের নাটকীয়তা ছাড়াই নীরা কে বলে ফেলে মনের মধ্যে চেপে রাখা কথাগুলো।সেদিন নীরার আর কলেজ যাওয়া হয়ে উঠে নি,মূলত আবিরই তাকে আটকে রেখেছিল।পরমুহুর্তে নীরা আর আবির কেউ আর নীরবতা ভাঙ্গে নি। চুপচাপ রিকশা ডেকে নীরা বাসায় চলে আসে।তার কাছে মাতালের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে হয়।


আবিরের মাথায় তখন থেকেই পেত্নী শব্দটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে যে এই শব্দ টা ব্যবহার করেছে সে জন্য মস্তিষ্ক তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, মাথায় যন্ত্রনাটা সেই বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ। এর থেকে সমাধানের একটা উপায় আছে। নিস্তেজ হয়ে যাওয়া অর্থাৎ ঘুমিয়ে পড়া। জোর করে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে হবে, ঘুমের ঔষধ খেতে হবে। এই ঘুমের ঔষধ নিয়ে নিজের কত উপাখ্যান আছে। এলাকার ফার্মেসীর দোকানে চাকরী করা শামীম ভাইয়ের কথাগুলো এখনও মনে পড়ে,বুঝলা ভাই এইডা খাবা ঘুম কারে কয় বুঝবা। তয় বেশি না,বেশি হইলে ঘুমের বদলে মাতালের মত পেটের যত কথা আছে সব মুখ দিয়া গড়গড় করে বের হয়া যাবে,এইডা খুব পাওয়ারফুল বড়ি, বাংলাদেশের বাজারে বর্তমানে নিষিদ্ধ মেডিসিন । সত্যিই সেবার নীরাকে প্রপোজ দেবার দিন শামীম ভাইয়ের কথামত ঔষধ দারুন কাজ করেছিল আর তখন থেকেই শামীম ভাইয়ের নিয়মিত ক্রেতা আবির। নীরাকে সেবার সত্যি সত্যি দুর্বোধ্য বাক্যগুলো বলতে পারলেও বলার পরমূহুর্তের কাজ সম্বন্ধে সে সচেতন ছিল না। নীরা যখন রিকশায় করে চলে যাচ্ছিল তখন সিদ্ধান্ত চাওয়ার অনীহা থেকে আবির ঠায় দাঁড়িয়েছিল। কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিল। আজ অব্দি সে বাক্যগুলো স্তিমিত থেকেছে, কখনও জেগে উঠে সিন্ধান্তের পর্যায়ে আসে নি।

আবির ইতিমধ্যে পাঁচটা বড়ি গিলে ফেলেছে, আরো গেলানোর ইচ্ছা ছিল।ইচ্ছাটা দমিয়ে রেখেছে । কারন গা'টা ক্যামন গুলিয়ে আসছে, যেকোন মুহূর্তে ঘুমে ঢলে পড়তে পারে। কিন্তু এখন ঘুমালে চলবে না, তাকে ছোট ছোট কয়েকটা কাজ করতে হবে।
আবিরের অনুমান মিথ্যে না হলে কিছুক্ষনের মধ্যেই নিপুন কল দিবে। সত্যি সত্যি পরক্ষনেই নিপুন কল দিল।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা জিজ্ঞাসাসূচক একটা প্রশ্ন এল, ভাইয়া তুমি আপুকে পেত্নী বলছ?
-হু
-এহ সাহস কত, আমার আপুকে পেত্নী বলে। আসলে তুমিইই বুড়া
-হু
-ক্যান এরকম কর ভাইয়া, আমি যতই ঠিক করতে চাই ততই তুমি.....সবদোষ তোমার।
আবির সযত্নে প্রসঙ্গ পালটিয়ে বলল,আজকের কোচিং এর ডিসপ্লে চরম হইল।তোরা তো মিস করলি।
ওপাশ থেকে নিপুন বিষন্ন গলায় বলল,আপুই আর থাকতে চাইল না।
আবির রসিকতার ভঙ্গিতে বলল,আহা কি দুক্ক তোর সুমন ভাইয়ার সাথে দেখা হইল না।
-এহ ভাইয়া এগুলান কি বল?
আবির হেসে ফেলল। অতিশয় গোপন কথা ধরে ফেলার ভঙ্গীতে বলল,তোর এখন সুমন ভাইয়ার নাম্বার খুব দরকার আমি জানি।
-এহ আমার লাগবে না।
-আচ্ছা আমি বলতেছি, তুই শোন
-না আমি কান বন্ধ করছি।
আবির তাতে বিচলিত না হয়ে নাম্বার টা দিয়ে ফেলল।
-শুনি নাই আমি, শুনি নাই। ওপাশ থেকে নিপুনের গলায় স্পষ্ট আনন্দের আভাস। বুঝতে পেরে আবির হেসে ফেলল।
-আচ্ছা তুই শুনিস নাই। এখন রাখি রে?
-ক্যান রাখবা?
-খুব ঘুম পাচ্ছে।
-না তুমি আজকের রাতটা অন্তত পক্ষে ঘুমাবা না ভাইয়া প্লিজ। আবির শুনতে পেল নিপুন কাঁদো কাঁদো গলার স্বর। আবির কান্নার শব্দ সহ্য করতে পারে না,প্রচন্ড বিরক্তিতে ফোন টা রেখে দিল।
আবিরের এখন জরুরী ভিত্তিতে সুমন কে ফোন দেয়া দরকার। ওপাশ থেকে সুমন ফোন ধরতেই বল,তুই একটা হালার পুত, তুই বলদ।
আবির হেসে ফেলল,নাম্বার পেয়েছিস?
-তিনশ পঁয়ষট্টি টা পেজ খোঁজার পর আবিষ্কার করলাম তুই কভার পৃষ্টাতেই নাম্বার টা লিখে রেখেছিস।
-ফোন দিছিলি?
-না ভাই, ভয় লাগে।
আবির রাগান্বিত হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,তুই এখনও ফোন দিস নাই।বুঝছি তোর দ্বারা প্রেম সম্ভব না।
-ভাই এমন করিস ক্যান?দিবই তো
-দে এক্ষুনি দে।
-কি কমু?
-তোর যা মনে হবে তাই বলবি।কালকে সকাল সকাল বাসায় আসিস।
-ভাই তোর গলা এমন শোনাচ্ছে ক্যান? তাল হইছিস নাকি?
-আর রাত বারোটার পর নিপুন রে বার্থ ডে উইশ করিস । কাল বেচারির বার্থ ডে।
অনেক কষ্টে এটুকু বলে ফোন কেটে দিয়ে আবির ঘুমে ঢলে পড়ল।



নিপুনের মনটা ভীষণ খারাপ, ভাইয়া যে তার বার্থ ডে ভুলে যাবে এটা ভাবতেও পারে নি। ভাইয়া আসলে তাকে পছন্দই করে না এটা তার প্রমাণ। ভাইয়া একটা মাতাল, বদ্ধ উন্মাদ,ঘুমের ঔষধ যার প্রধান খাদ্য। নিপুনের অভিমান ক্রমান্বয়ে রাগে উপনীত হচ্ছে। ঠিক এই সময়ে নিপুনের মুঠোফোন টা বেজে উঠল। প্রচন্ড আক্রোশে মুঠফোনের দিকে তাকাতে বেশ অবাক হয়ে গেল।ভাইয়ার দেয়া সেই নাম্বার টা অর্থাৎ সুমন ভাইয়ার নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করে প্রচন্ড বিরক্তিতে নিপুন বলল,আপনি ফোন দিছেন ক্যানো?
-সেটাই তো। ক্যানো যে দিলাম?
নিপুন ঠোঁট কামড়ে বসল, সে মস্ত বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। সেই সঙ্গে হাজারটা প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করতে থাকল, আর উত্তরগুলোও মাথা থেকে আসতে থাকল।নিপুন বেশ নরম গলায় বলল,তো রেখে দেন।
-রেখে দেয়ার জন্য তো ফোন দেই নি?
- তাইলে?
- কন্ঠ শোনার জন্য।
নিপুনের ক্যানো যেন সমস্ত রাগ অভিমান সুমন ভাইয়ার উপর ঝাড়তে ইচ্ছে হল।নিপুন বেশ অভিমানি গলায় বলল,জানেন আবির ভাইয়া খুব বদ, বদের যম।
-সেটা আর বলতে। অইটা তো ফাজিলেরও শীর্ষস্থানীয় নেতা।
নিপুন বিরক্তমুখে বলল,আপনি কি করে জানেন?
- আরে আমি তো সাথেই থাকি।
নিপুন হেসে ফেলল।
-প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে, বুঝলা? আচ্ছা তুমি খাইছ?
নিপুন হেসে ফেলে, ক্ষুধার প্রসঙ্গটা যে তাকে প্রশ্ন করার জন্য করা সেটা সে বুঝতে পারে।নিপুন বলে, হুম খাইছি। তো আপনার ক্ষুধা লাগছে ক্যান?
-আর বলিও না, করলা ভাজি। সেই জন্যে উপবাস।
- ইসসসসস রে।
-রাত করে জেগে থাকা ঠিক না, বুঝলা।
-আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাকে।
-না ভাবাটা তো আমার....না থাক।
নিপুন একটা হাসি দিল,যার অর্থ অনেকরকম হতে পারে। হাসি দিয়ে চুপ মেরে গেল। কিছুক্ষন এভাবেই চুপ থেকে নিপুন বলল,আচ্ছা আপনাকে তুমি করে বলতে পারি?
- অপেক্ষায় আছি কখন তুমি করে বলবা?
- বাব্বাহ এত বলতে পারেন সরি পার।
- হ্যা আমি পারি তো অনেক কিছু, শুধু মেয়ে পটাইতে পারি না।
-অইটা পারতে হবে না। ঘুমাবা না? একটা পূর্নাঙ্গ তুমি সম্বোধক বাক্য বলতে পেরে নিপুনের শিরদাঁড়া বেয়ে ক্যামন যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল।
ওপাশ থেকে নম্র কন্ঠে একটা উত্তর এল,হ্যা ঘুমাব, তুমি? যেখানে সমস্ত নম্র কন্ঠ একীভূত।এভাবেই চলতে থাকুক গাঢ় থেকে গাঢ়তর মমতার বাক্যপ্রবাহ।


ঠিক রাত বারোটায় নিপুনের মুঠোফোনে সদ্য চেনা নাম্বারটা থেকে জন্মদিনের অভ্যর্থনার একটা খুদেবার্তা এল। সে সময়ে নিপুনের ক্যানো যেন আবির ভাইয়ার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিতে বড্ড ইচ্ছে হল।


সুমন এমনিতেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে না, কিন্তু আজকে উঠতে হল। কারন দেরি হলেই আবির ভাই খোঁটা মারবে, তোর দ্বারা প্রেম সম্ভব না। মানুষ অসম্ভব খোঁটাপ্রিয় প্রাণী,সুযোগ পেলেই খোঁটা মারতে ছাড়ে না।


সুমন আবিরের ঘরে ঢুকেই বেশ অবাক হয়ে গেল।ঘরটা বেশ অন্ধকার আর এলোমেলো। বাসায় কেউ নাই বলে আবির ভাইয়েরর ঘরটা যে ব্যচেলরের তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে। আন্টি সহ এ বাসার সবাই গতকালকেই কুড়িগ্রামে নানার বাড়ি গেছে,সেখানে কোন বা খালার বিয়ে।আবির যায় নি সামনের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার অজুহাতে,সেই সাথে সুমনও যেতে পারে নি।
অনেক ক্ষন ধাক্কাধাক্কি করার পর আবির চোখ খুলল।ধীরে ধীরে সুমনকে বলল,তুই আসছিস?
-ক্যা, আমাক দেখি কি ভূত মনে হয়। আর তোর হইছে টা কি,এখনও ঘুম থেকে উঠিস নাই ক্যান?
-এমনিতেই। আচ্ছা শোন প্রপোজ দিলি?
-হুর ভাই কি কইস? ক্যামনে দেব আন্দাজি....
আবির চোখ মুখ কুঁচকে বলল,বুঝছি তোর দ্বারা প্রেম সম্ভব না, তুই কাপুরুষ। যা মুড়ি খা যা
-হুর ভাই এত চেতিস ক্যান, দিবই তো। প্রপোজ দেয়া তো হাতের কলা আর মলা না ভাই।
-আজকেই দিবি
সুমন আর্ত চিৎকার দিয়ে উঠে, ক্যামনে কি ভাই?
-যেমনে হয় তেমনে।আমি যা বলি তা শোন।
সুমন সিরিয়াস হবার ভঙ্গিতে বল, আচ্ছা বল।
সুমন জানে আবির ভাই বক্তৃতা দেবার ভঙ্গিতে লেকচার দেয়া শুরু করবে। এই লেকচার আধা ঘন্টার আগে শেষ হবে না।


২.
সুমনের বিরক্তি চরম সীমা অতিক্রম করেছে। বিরক্তির সমস্ত কারন আবির ভাই। আজকে ধারনার আধাঘন্টা বদলে এক ঘন্টার লেকচার শুনিয়েছে, কোন মানে হয় এর! বিরক্তির আরেকটা কারনও আছে। লেকচারের শেষে ঘুমের ঘোরে বলতেছে, সুমন শোন তোকে পারতে হবে, আমি পারি নাই।তুই পারবি। সুমন খোদ নিজেই জানে না তাকে কি পারতে হবে।সুমন যখন লেকচার শুনছিল তখন আবির ভাইয়ের কথাগুলো মাথায় তেমন ঢুকে নাই, এখন সে গুলাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।আবির ভাইয়ের মাথায় নির্ঘাত কোন সমস্যা আছে। নইলে কি করে বলে যে,সুমন শোন ব্যাচেলর নারীজাতিরা হইল মুরগির মতন। মেয়ে মানুষ কি করে মুরগি হয় এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।

সুমন অপেক্ষা করছে,সেই তিনঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, যদিও নিপুন তাকে ডেকেছে বিকাল তিনটায়,তবুও কেন সে আগে এসে দাঁড়িয়ে আছে জানে না । সম্ভবত আবির ভাইয়ের কারনে, অপেক্ষা সম্পর্কে আবির ভাইয়ের লেকচারের একটা অংশ আছে,সুমন প্রেমিক দের একটা বড় বিষয় জয় করতে হয়, সেটা হল অপেক্ষা। পৃথিবীর বড় বড় প্রেমিকরা অপেক্ষা করেছিলেন। এই আবির ভাইয়ের কথামত নিপুনের জন্য গিফট কিনতে গিয়ে দেখে, উপহার সামগ্রীর দোকানগুলাতে ন্যাকামুতে ভর্তি। কিসব বার্বি ডল আর শো-পিচ দিয়ে দোকানগুলোতে ঠেসে দিয়েছে। তাই সুমন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সদ্য কলিফোটা লাল গোলাপ কিনেছে। কি করে দিবে এগুলা নিপুনকে সে সম্পর্কে কোন ধারনা নেই সুমনের। এই সব ব্যপারে আবির ভাইয়ার কাছে বুদ্ধি চাওয়া বৃথা,উলটা দুনিয়ার নীতিকথা ছাড়ে।আরে নীতিকথা তো বাজারের পাঁচটাকার বইতেও পাওয়া যায়।

সুমনের অপেক্ষার বিষয়টা এখন বিরক্তির পর্যায়ে পৌঁছেছে। নিপুনের স্কুলের সামনে থাকতে আর ভাল্লাগতেছে না। আধাঘন্টা পেরিয়ে গেল এখনও নিপুনের বের হওয়ার কোন নাম নাই। মেয়েদের কি সময়জ্ঞান কম নাকি! সুমন নিপুনকে ফোন দিয়ে তিনটার মধ্যে দেখা করতে বলছে, অথচ এখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে তিনটা ছুঁইছুঁই করছে তবুও মেয়েটার কোন পাত্ততা খবর নাই। বাসায় আবার চলে যায় নি তো আবার, ভাবতেই সুমনের শরীরটা ক্যামন যেন অবশ হয়ে আসে। শেষমেশ একচল্লিশ মিনিট পর নিপুনকে স্কুল গেট থেকে বের হতে দেখা গেল, সুমন সমস্ত উদ্বেগের অবসান থেকে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল,বিরক্তিটাও যেন কোথায় উবে গেল।নিপুনকে দূর থেকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। হাল্কা জরীর কাজ করা সবুজ জামা পড়েছে আর মাথায় ওড়না দিয়েছে। মাথা নিচু করে মন্থর গতিতে নিপুন সুমনের দিকে এগিয়ে আসছে। আবির ভাইয়ের লেকচারের একটা অংশ হল, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের কাছে তার প্রিয় মানুষটা সবচেয়ে সুন্দর।কথাটা এখন আর মিথ্যা মনে হচ্ছে না।


নিপুন আর সুমন পাশাপাশি হাঁটছে । চারদিকে কাশবন। কাশবনের ভেতর দিয়ে দুজনেই জায়গা করে নিয়ে হাঁটছে। এই ব্যস্ত শহরে যে এত নিরিবিলি জায়গা থাকতে পারে তা সুমন ভাইয়ার সাথে না আসলে জানা যেত না। নিপুন আপন মনে কাশফুল তুলছে আর হাতের মধ্যে গুটি পাকিয়ে ফেলে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে। উড়িয়ে দিয়ে ছেলেমানুষি হাসি দিচ্ছে।

সুমন এই অদ্ভুত খেলাটা দর্শক হয়ে লক্ষ্য করলেও তার মাথায় একটা বাক্য ঘুরপাক খাচ্ছে।ব্যচেলর নারীজাতি হচ্ছে মুরগি। মুরগি জাতির সাথে নারীজাতির কি সম্পর্ক এখনও সে ভালভাবে ঠাওর করতে পারছে না। তবুও এই মুহূর্তে তাকে একটা নাটকীয় পরিবেশ তৈরী করতে হবে। আবির ভাইয়ের লেকচারের একটা অংশ হল,জীবনে প্রেম আসলে তার জন্য নাটকীয়তা অত্যন্ত জরূরী বিষয়।
-নিপুন।বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে ডাক দেয় সুমন।
-বলো। নিপুনের এখন তুমি বলাতে তেমন কোন অস্বস্থি বোধ হয় না। 'তুমি 'করে সম্বোধন করাটা তার গা সওয়া হয়ে গেছে।
সুমন নিপুনের সিরিয়াস ভঙ্গিতে দাঁড়ানো দেখে ক্যামন যেন ঘাবড়ে যায়। তবুও অনেক কষ্টে হেসে বলল,তুমি একটা মুরগি।
-হ্যা, তুমিও একটা মোরগ। বলে বেশ জোরে হেসে ফেলে নিপুন। পরমূহুর্তে তার হাসি আবার মিলিয়ে যায়।
সুমন নিপুনের এ ধরনের বিচিত্র আচরনে সম্পর্কে তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারে না। আচ্ছা এই বিচিত্র আচরনের সাথে মুরগি জাতির কোন সম্পর্ক নেই তো!

নিপুন বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। সুমন কি করবে না করবে এরকম দোদুল্যমান অবস্থায় এপাশ ওপাশ তাকায়। পরমূহুর্তে কাঁধের ব্যগ থেকে সযত্নে লাল গোলাপটা বের করে। একহাঁটু মুড়ে বসে গোলাপটা উঁচু করে তাক করে নিপুনের দিকে। এতটুকু করেই সুমন হার্টবিট অনেকাংশ বেড়ে যায়। প্রচন্ড ঘামতে থাকে, মনে হয় দুই কানের পাশে বোলতা ভোঁ ভোঁ করছে, ঠিক সে অনুভব করে কানগুলো টকটকে লাল হয়ে গেছে। নিপুনের অনড় ভূমিকা তার কাছে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি মনে হয়,যার এক হাতে শিকল আর এক হাতে বই।

মনের মধ্যে চেপে রাখা সেই প্রতীক্ষিত চার অক্ষরের শব্দটা চয়নে গ্রহণযোগ্যতা পাবার আশায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুমন নিপুনের দিকে তাকায়। বলতে থাকে, তুমি আমার সেই মুরগি যে সারাক্ষন আমার মনের ভিতরে কক কক করবে। আমার স্বপ্ন, শয়নে,জাগরণে যাকে আমি সবসময় দেখি তুমি হচ্ছ সেই! অই মুরগি থাকবা তো আমার সাথে?

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সুমন তখনও তাকিয়ে থাকে নিপুনের মুখের দিকে চেয়ে। নিপুনের মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেলেও তার প্রচুর হাসি পাচ্ছে ।তবে এই মূহুর্তে হাসাটা ঠিক নয় বলে হাসতে পাচ্ছে না।নিপুন প্রবলবেগে হ্যা সম্মতিতে মাথা নেড়ে মুখ টা দুহাত দিয়ে ঢেকে ফেলে, তার লাল মুখটা কাউকে দেখাতে চায় না। সুমনের হাতে গোলাপটা তখন বড্ড বেমানান লাগে। সুমন কিছু বুঝতে উঠতে না পেরে মাথা চুল্কায়।

কিছুক্ষন পর নিপুন খুব স্বাভাবিক ভাবে সুমনের হাত থেকে গোলাপটা ছো মেরে নিজের চুলের খোঁপায় বাঁধে। তারপর সুমনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিপুন একটা অর্থহীন হাসি দেয়। সুমন বেশ অবাক হয়ে প্রত্যুত্তরে একটা হাসি দেয়। নিপুন হাসি চেপে বলে, মোরগ সাহেব।
-হু
নিপুন একটা অট্টহাসি দেয়। তারপর আহ্লাদিত গলায় আব্দারের ভঙ্গিতে বলে, আমি মরিচ খাব।
সুমন চোখ বড় বড় করে বলল,মরিচ!
নিপুন লোভাতুর চোখে বলে, উইথ ফুচকা।

পড়ন্ত বিকেলে ব্যস্ত নগরীর রাজপথ দিয়ে ত্রিযানে চড়ে সুমন আর নিপুন কোন এক গন্তব্যে। সুমনের কাঁধে নিপুনের মাথা,সে চোখ বুজে আছে বড্ড ক্লান্তিতে, অনেক হেঁটেছে আজ সে। সুমন অল্পক্ষনের জন্য আবেগে চোখ বুজে থাকলেও পরক্ষনেই গম্ভীর মুখে হয়ে যায় এই ভেবে, শুধু কাঁধে রাখা মাথাটা নয় পুরো মানুষটার সুখ-দুঃখের ভারটা আজ থেকে যে তাকেই নিতে হবে।সমাপ্তি হয়তো এ অংশটুকুর,সামনে আছে আরও কত পথ।


নিপুনের বড্ড অদ্ভুত লাগে আবির ভাইয়া ঠিক রাত বারোটা বাজার আগ মুহূর্তে জন্মদিনের উইশ করে, যাকে বলে লাস্ট উইশার। আচ্ছা ভাইয়াটা এমন ক্যানো, আর আপুটকেও কি ভাইয়ার অনুভূতি গুলো ভাবায় না। আজকে আপুর সাথে কথা হইল,তবে বেশিক্ষন কথা হয়নি, আপুর নাকি খুব ঘুম পাচ্ছিল।কথা বলার সময় আপু একবারের জন্য ভাইয়ার কথা বলল না। অথচ ভালবাসার মানুষকে চেনা যায় তো, ক্যান সে তো চিনতে পেরেছিল। সুমন কে অপেক্ষা করিয়েছিল অল্পক্ষনের জন্য, কিন্তু মানুষটা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিল,অপেক্ষা করেছিল। আজকে ক্লাস হবে না জেনেও স্কুলে এসেছিল আড্ডা দিতে, কি মনে করে বাইরে তাকিয়েছিল,তাকে অবাক করে সুমন তার জন্য সময়ের অনেক আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল,ইচ্ছে হচ্ছিল একবার ছুটে গিয়ে বলতে, তুমি এত তাড়াতাড়ি আসছ ক্যানো? সে ছুটে যায় নি,শুধু দেখছিল বেচারি দরদর ঘামছিল,তবুও সে সেখান থেকে একবারের জন্য নড়ে নি।

সেদিন আবির ঠিক রাত বারোটার পর ল্যাম্পপোস্টের আলোয়ে যখন অর্থহীন ভাবে হাঁটছিলো, তখন ফের নীরাকে শেষবারের মত মনের কথাগুলো বলার বড্ড ইচ্ছে হয় আর জানতে ইচ্ছে হয় নীরার সত্যিকারের বুলিগুলো। নিয়তির হয়তো কোন এক নিয়মে সেটা আর হয়ে উঠে নি। সেদিন শত রকমের সাহস সঞ্চয় করে মনের কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে নীরার মুঠোফোনে তিনবার ফোন দিয়েছিল,কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ধরে নি। হয়তো মুঠোফোন টা মুঠোফোনের ভাষায় 'সাইলেন্ট মোড' এ ছিল। এরপর থেকে আবির ক্যানো যেন বিশ্বাস করে;নীরাকে কখনও আর বলা হবে না, আমি তোর হাতটা ধরে হাঁটতে চাই কোন এক নির্জন রাস্তায়, তোর চোখের চাহনী টা ক্যামন যেন ঘোরের মত লাগে, তোর লজ্জায় রাঙ্গা মুখটা বড্ড ভাল লাগে,তোর রহস্যময় স্মিত হাসি অন্যরকম ভাল লাগে, তোর সচেতনমূলক এড়িয়ে যাওয়া বড্ড বিরক্তের হলেও ক্যানো যেন ভাল লাগে, তোর মাথা নিচু করে হেঁটে যাওয়ার মত সাধারন ব্যপারটাতেও কি যেন খুঁজি।আবির সে রাতেই নিশ্চিত হয়, চার অক্ষরের অই শব্দটার ষোল আনা অধিকার নিয়ে নীরার সামনে তার পক্ষে আর দাঁড়ানো সম্ভব নয়,কারন সে পারে না,পারে না বলতে সুস্থ মস্তিষ্কে,হাল ছেড়ে দেয়া ব্যর্থ একটা মানুষ সে।এইটা ভেবে ভারমুক্ত হয়ে আবির অদ্ভুত এক আনন্দে সে হেঁটেছিলো ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয়ে রাজপথ জুড়ে। আবিরের সেই বিচিত্র মানসিকতার কোন বিশ্লেষণ বোঝা যায় নি সে রাতে নতুবা আর কোন রাতেও নয়।


ইংরেজি তে একটা বুলি আছে, End of incompleteness. যাকে আমরা বাংলায় বলি সমাপ্তিতেও অসমাপ্তি। এই গল্পটা এমনই,যে গল্পে সমাপ্তিতেও অসমাপ্তির রেশ রয়ে যায়।


-তাহমিদ আহবাব।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×