শফিক সাহেবের স্ত্রী আজ চার বছর যাবৎ প্যারালাইজড । হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয় । কথা বলতে পারেন না, তবে তার চোখের ভাষা পড়তে পারেন শফিক সাহেব । কখন কি প্রয়োজন সবকিছু এমন কি প্রাকৃতিক ক্রিয়ার ব্যাপারও শফিক সাহেবের চোখ এড়ায় না ।
প্রতিদিন ভোরে উঠে নামাযের পর থেকে শফিক সাহেবের নিত্যকর্ম শুরু হয় । রাতের এটো বাসন-বাটি ধুয়ে সেই যে শুরু তারপর বাচ্চাদের ডেকে তোলা, নাস্তা তৈরী করা, দুপুরের খাবার তৈরী করে বাচ্চাদের স্কুলটিফিন দেয়া, নিজের জন্য নেয়া সবশেষে স্ত্রীর জন্য হটপটে খাবার রেখে বাচ্চাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে গোসল করা পর্যন্ত সব যেন এক নিঃশ্বাসে করে যান ।
অফিস সাড়ে নয়টা থেকে কিন্তু প্রতিদিন উনার ২০-৩০ মিনিট দেরী হয়ে যায় । বস অবশ্য সবকিছু জানেন, তবু ভাবগম্ভীর স্বরে বলেন- কি শফিক সাহেব আজো লেট ! আচ্ছা, যান কাজ করুন ।
এবার অফিসের কাজে এ ক্লায়েন্ট থেকে সে ক্লায়েন্ট । দম ফেলার ফুসরত নাই । সারাক্ষন ছোটাছুটির মাঝে তবু কোনরকমে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেন । আবার ঠিক তিনটায় বাসায় ফোন করে বাচ্চাদের জিজ্ঞাসা করেন নিজেরা খেয়েছে কি না এবং মাকে ঠিকমত খাইয়েছে কি না !
ব্যাপারটা নিয়ে তিনি খুব চিন্তায় থাকেন, নিশ্চিত হওয়ার পর যা একটু স্বস্তি !
সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস হলেও চেষ্টা করেন তার আগেই কাজ শেষ করে চলে আসতে । কখনো পারেন, কখনো পারেন না । কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনদিন দেরীতে আসেননি । প্রয়োজনে অর্ধেক কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে আসেন তবু দেরী করেন না । তিনি তো জানেন, তার স্ত্রী এক মিনিট দেরী হলে কেমন উদ্বিগ্ন বোধ করেন ।
সন্ধ্যার নাস্তার পর ছেলে-মেয়েদের পড়া দেখিয়ে দিয়ে রাতের খাবার তৈরী পর্যন্ত এতটুকু বিশ্রাম নেই । খাবার খেয়ে যখন শুতে আসেন তখন দেখেন তার স্ত্রীর নয়ন গড়িয়ে জল নামছে । তিনি বোঝেন সবকিছু দেখে সবকিছু সয়ে নিজ অক্ষমতায় দগ্ধ হয়ে প্রতিক্ষন তার স্ত্রী কুঁকড়ে মরেন । যন্ত্রনার নীলে তিলতিল করে নিঃশেষ হন । কাঁদতে কাঁদতে দু'চোখের নীচে সরু দাগ স্পষ্ট ।
শফিক সাহেব কি করতে পারেন ! তিনি তো কতবার চোখের জল মুছে দেন । অকৃত্রিম আশ্বাস বানীতে ভরিয়ে দেন । ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করেন স্ত্রীর সব আক্ষেপ । সহস্রবার বলেছেন এসব করতে তার কোন কষ্ট হয় না । বরং তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন এসব করতে পেরে । আজ তো তিনিও তার স্ত্রীর জায়গায় হতে পারতেন !
গাড়ী একসিডেন্টের সেই ক্ষনে তিনি ঠান্ডা বাতাস লাগায় জোর করে স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে বসেছিলেন । তার কিছু মুহুর্ত পরেই ভয়ংকর সেই ঘটনা । শফিক সাহেব জানালার পাশে থাকায় ছিটকে বাইরে চলে আসেন, হালকা চোটের চেয়ে বেশী আর কিছু হয়নি । অথচ গাড়ীর ভেতরে থাকা তার স্ত্রী প্যারালাইজড হয়ে গেলেন !
অবশ্য এখানেও ভাগ্য ভাল । গাড়ীর ভেতর থাকা মাত্র তিনজন যাত্রী বেঁচেছিলেন । তার মধ্য শফিক সাহেবের স্ত্রী একজন ।
চিকিৎসা চলছে । এখনো ডাক্তাররা বলতে পারছেন না, কবে নাগাদ সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে বা আদৌ সুস্থ হবে কি না ! তবে স্রষ্টায় ভীষন আস্থাশীল শফিক সাহেব প্রতিরাতে সকলের অগোচরে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেন তার স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য । এবং নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য ।
আর অঝোর নয়নে কেঁদে কেঁদে কামনা করেন তার স্ত্রীর সুস্থতা ।
সমস্ত কিছু নীরবে পর্যবেক্ষন করেন শফিক সাহেবের স্ত্রী । মানুষটা দিন দিন কেমন কংকাল হয়ে যাচ্ছে । রাতদিন খাটাখাটনিতে কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে তার সমস্ত রসবোধ । আগে কত কিছু বলে চোখে হাসি দেখতে চাইত, আর আজকাল কান্না দেখলে নিস্পলক চেয়ে থাকে । যেন ও জড়পদার্থ । ওর কোন প্রান নেই, নিথর ।
আর সহ্য করতে পারেন না শফিক সাহেবের স্ত্রী । আবারো কেঁদে উঠেন তিনি । মনে মনে বিধাতার কছে মৃত্যু কামনা করেন । নিস্কৃতি দিতে চান, অর্ধাঙ্গকে ।
শফিক সাহেব তবু নিজেকে সুখী মনে করেন । সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে । চাকরিটা আর বেশীদিন করবেন না । আর এই দৌড়াদৌড়ি অবিরাম ছোটাছুটি ভাল লাগে না । স্ত্রীর পাশে পাশে থাকবেন বাকীটা সময় ।
নিকট ভবিষ্যত ছবি এঁকে তিনি কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন । অন্যরকম ভাললাগায় স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ছেঁয়ে যায় মন ।
বিছানার দিকে এগিয়ে যান তিনি ধীর পায়ে, নিঃশব্দে ।
__________#####__________
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:১৪