somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাকিস্তান আমল প্রেক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম

১০ ই মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৫:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিংশ শতকের চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান আন্দোলন যখন জোরদার হতে থাকে তখন ত্রিপুরা রাজ্যের শেষ মহারাজা বীরবিক্রম উত্তরপূর্ব ভারতের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলো নিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হন।কিন্তু তিনি সফল হতে পারেন নি।পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন রাজা এবং নেতাসহ অন্যান্য উপজাতি অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ তাকে সমর্থন করেনি।১৯৪৭ সালের মে মাসে মহারাজার মৃত্যু হয় এবং তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে সেই উদ্যোগেরও মৃত্যু ঘটে।অতপর মুসলীম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দাবি অনুযায়ী ব্রিটিশরা ভারতকে দুভাগে ভাগ করতে রাজি হয়।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট তারিখে ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্তান ঘটে।উল্লেখ্য যে,ভারতের স্বাধীনতা আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়।ঐ সময়ে স্যার “সিরিল র‍্যাডক্লিফের” নেতৃত্বে গঠিত বাউন্ডারী কমিশনের রোয়েদাদ ঘোষনা করা হয়নি।পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন ৯৭.৫% আদিবাসী, বাকিরা সবাই অ-আদিবাস মুসলীম,বড়ুয়া এবং হিন্দু।ফলে স্বভাবতই আদিবাসীরা আশা করেছিল যে, যেহেতু ভারতের মুসলীম সংখ্যগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে মুসলীমদের জন্য আলাদা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামও অমুসলীম এলাকা হিসেবে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে।তাই ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার দিন স্নেহকুমার চাকমার নেতৃত্বে রাঙামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।১৭ আগস্ট তারিখে র‍্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ঘোষণা করা হলে জানা যায় যে,পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে।২১ আগস্ট তারিখে বেলুচ রেজিমেন্ট রাঙ্গামাটি আসে এবং পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে।কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিকেও ধরাপাকর করা হয় সেদিন।কিন্তু কয়েকমান পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।স্নেহ কুমার চাকমাকে ধরা যায়নি।তিনি তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে যান।

পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ সালে ১৮৮১ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশন বাতিল ঘোষণা করে জেলার পুলিশ বাহিনীকে পূর্ববঙ্গের পুলিশ বাহিনীর সাথে একীভূত করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশ বাহিনীকে (যাদের প্রায় সবাই ছিল আদিবাসী) দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বদলি করে প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চল হতে বাঙালী পুলিশ নিয়ে আসে।তাছারা পার্বত্য চট্টগ্রাম মেনুয়েল সংশোধন না করেই ভারত হতে আগত কয়েক হাজার বাঙালী পরিবারকে লুংগুদু, লামা,নানিয়াচড় এবং রাঙ্গামাটি শহরের উপকন্ঠে পূনর্বাসন করে।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়।নতুন শাসনতন্ত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “Excluded Area” হিসেবে রাখা হয়।১৯৬২ সালে আবার পাকিস্তানের নতুন শাসনতন্ত্র চালু করা হয়।এই শাসনতন্ত্রেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে “উপজাতি এলাকা” হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৫৯ সালের মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩৯টি ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করে প্রথম স্থানীয় সরকার ব্যাবস্থা প্রনয়ন করা হয়।সেই সাথে ১১টি থানা কাউন্সিল গঠিত হয়।ইউনিয়ন কাউন্সিলে মোট ২৭০ জন নির্বাচিত সদস্য এবং ১৩৫ জন মনোনীত সদস্য ছিলেন।২৭০ জন নির্বাচিত সদস্যর মধ্য মাত্র একজন ছিলেন বাঙালী সদস্য।তিনি বর্তমান নাক্ষ্যংছড়ি থানার একটি ইউনিয়নে নির্বাচিত হয়েছিলেন।মনোনীত সদস্যদের প্রায় সবাই ছিলেন বাঙালী।

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় আইন সভা জাতীয় পরিষদে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মোট সদস্য সংখ্যা নির্ধারন করা হয় ১৫৬ জন।এদের মধ্য প্রত্যক প্রদেশ হতে ৩টি করে মোট ৬টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়।
১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি আসন বরাদ্দ জরা হয়।কেন্দ্রীয় আইন সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে চট্টগ্রামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়।১৯৬২ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে রাজা ত্রিদিব রায় নির্বাচিত হন।সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম জেলার রাউজান এবং রাংগুনিয়া থানাকে নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকার জন্য কেন্দ্রীয় আইন সভায় একটি আসন বরাদ্দ করা হয়।এই কেন্দ্রীয় আসনের জন্য ১৯৬২ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম হতে ফজলুল কাদের চৌধুরী মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দাঁড়ান বোমাং চীফ মংশুয়ে প্রু চৌধুরী এবং সুশীল জীবন চাকমা।ঐ সময়ে চট্টগ্রামের দুই থানায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিডি(বুনিয়াদী গণতন্ত্র) ভোটার ছিলেন।উল্লেখ্য নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা, যাদের যাদের সংক্ষেপে বিডি মেম্বার বলা হতো,তারাই কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করতেন।তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে একজন প্রার্থী দাঁড়ালে তারই নির্বাচনে জেতার সুযোগ ছিলো।কিন্তু এই জেলা হতে দুজন দাঁড়ানোর ফলে ফজলুল কাদের চৌধুরী জিতে যান।পার্বত্য চট্টগ্রামের তখনকার অনেকেই মনে করেন যে,তদানীন্তন ডেপুটি কমিশনার হেলালউদ্দিন চৌধুরী বুদ্ধি করে সুশীলরজীবন চাকমাকে দাঁড় করান,যাতে ফজলুল কাদের চৌধুরী নির্বাচনে জিততে পারেন।এই সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয় তখন,যখন নির্বাচনে হারার পর পরই সুশীল জীবন চাকমা কর্ণফুলী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্বাস্তদের জন্য গঠিত পুনর্বাসন প্রকল্পে চাকরি পান। তাছারা পরবর্তীকালে শরনার্থী পুনর্বাসনের জন্য বনবিভাগ কতৃক dereserve কৃত ২৫০ একর সেগুন বাগান তার নামে বন্দোবস্ত দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়।রাজা ত্রিদিব রায় আপত্তি করায় সেই বন্দেবস্ত চূড়ান্ত করা যায়নি বটে,তবে কিছুদিন পর তার নামে ২৫ একর সেগুন বাগান বন্দোবস্ত দেয়া হয়।

১৯৬২ সালে কেন্দ্রীয় আসন পরিষদের নির্বাচনের পর ফজলুল কাদের চৌধুরী কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষিমন্ত্রী নিযুক্ত হন।আর স্পীকার পদে নির্বাচিত হন তমিজুদ্দিন খান।১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী সাংসদরা মন্ত্রী হতে পারতেন না।তাই মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পরে ফজলুল কাদের চৌধুরীর আসনটি খালি হয়ে যায়।ইতোমধ্য হঠাৎ তমিজুদ্দিন খান মৃত্যুবরণ করেন এবং স্পীকারের চেয়ারটিও খালি হয়ে যায়।আইউব খান ফজলুল কাদের চৌধুরীকে জাতীয় পরিষদের স্পীকার বানানোর স্বীদ্ধান্ত দেন।ফলে ফজলুল কাদের চৌধুরীর আবার নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয়।ফজলুল কাদের চৌধুরী মন্ত্রী হওয়ার পরে নাকি রাজা ত্রিদিব রায়কে কথা দিয়েছিলেন যে তাঁর খালি আসনে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে একজনকে সমর্থন দেবেন।কাজেই রাজা ত্রিদিব রায় তাঁর কাকা কে,কে রায়কে উপনির্বাচনে দাঁড় করান।ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং গবর্নর মোনায়েম খান রাজবাড়িতে গিয়ে রাজাকে অনুরোধ করা সত্বেও কে,কে রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সড়ে দাঁড়ান নি।এমন অবস্থায় মোনায়েম খান এবং ফজলুল কাদের চৌধুরী স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বুনিয়াদী গণতন্ত্র(বিডি) মেম্বারদের উপর চাপ সৃষ্টি করে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে জয়যুক্ত করান এবং ফজলুল কাদের চৌধুরী জাতীয় সংসদে স্পীকার নির্বাচিত হন।স্পীকার হলেও ত্রিদিব রায়ের প্রতি তাঁর ক্রোড যায়নি।১৯৬৬ সালে যখন প্রেসিডেন্ট আইউব চীন সফরে যান তখন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ মর্যাদার ধারাটি নির্বাহী আদেশে শাসনতন্ত্র থেকে খারিজ করে দেন।তাছারাও পার্বত্য চট্টগ্রামকে কক্সবাজারের সাথে যুক্ত করে দিয়ে জাতীয় সংসদের চট্টগ্রাম ১০ আসনটি পূনর্গঠিত করে দেন।ফলে ১৯৬৫ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে কক্সবাজারের গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী ঐ আসনে নির্বাচিত হন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৫:৩১
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×