দ্রোহের কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন, “শরীর বেচি শরীর বেচি, শোনো ভদ্রলোক, রাতের নায়ক যারা, তারাই দিনের বিচারক”। কবি কথাগুলো তার নিজ ভাবনা থেকে লিখেছিলেন। আজকের এই সময়ে আমাদের প্রশ্ন – রাতের রানী শতাধিক। তাদের যোগানদাতা বলেও দু চারজনের কথা শোনা যাচ্ছে। রাতের রাজারা কোথায়?
আমরা বাস করছি একটি চরম দ্বান্দিক সময়ে। যেখানে হ্যাঁ এবং না একসাথে হাত ধরাধরি করে চলে। আমরা একদিকে পতিতালয়ের লাইসেন্স দেই, অন্যদিকে পতিতাবৃত্তিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করি। আমরা একদিকে মদ ক্রয় বিক্রয়ের লাইসেন্স দেই, অন্যদিকে মদ রাখাকে অবৈধ বলি।
সরকার চাইলে দেশে মদকে নিষিদ্ধ করতে পারে আবার প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য উন্মুক্তও করতে পারে। ঠিক একই ভাবে পতিতাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ করে পতিতাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা যেমন করতে পারে অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে পতিতাবৃত্তি এবং পতিতালয়ে গমনাগমনকে আইনসিদ্ধও করতে পারে। যে কোন একটা পথ বেছে নিলে তো এত দ্বান্দিকতা এবং রাখঢাকের দরকার পরে না।
প্রশ্ন হল, দেশে মদ ও অবৈধ যৌনাচারের এত প্রয়োজনীয়তা কেন? এ দুটি যদি সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করা হয়। তাহলে কি দেশ রসাতলে যাবে? যাবে না তো। তাহলে? ক্ষেত্র বিশেষে এর বৈধতা কেন দিতে হবে?
দেশে যতদিন পর্যন্ত মদের আমদানি নিষিদ্ধ না হবে ততদিন পর্যন্ত মদের অবৈধ বেচাকেনা চলতেই থাকবে। কেউ লাইসেন্স নবায়ন করবে না। কেউ অতিরিক্ত কিনবে এটাই তো স্বাভাবিক। যেমন বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘পরী মণির মদ সেবনের একটি লাইসেন্স আমরা পেয়েছি কিন্তু তার মেয়াদ ও আইনসম্মত ছিল না। তা ছাড়া তার বাসা থেকে যে পরিমাণ মদ জব্দ করা হয়েছে তা তার লাইসেন্সে কভার করার কথা নয়।’ bd-pratidin.com
বাবার মদ খাওয়ার লাইসেন্স আছে সে মদ খেয়ে বাড়িতে আসছে ছেলের তো মদ খাওয়ার সাধ জাগবেই। বাবার শিক্ষায় শিক্ষিত বলে কথা! সমস্যা হল তার তো লাইসেন্স নেই সে কি করবে? তার অর্থ আছে, সে অবৈধ ভাবে মদ যোগাড় করবে। বাবার লাম্পট্যের লাইসেন্স আছে, ছেলের তো নেই। কিন্তু ছেলের তো সাধ আছে, অর্থ আছে। কাজেই লাম্পট্যে তার বাধা থাকার কথা নয়।
এখন এই রাজপুত্রদের মদ ও নারীর যোগান দাতার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। আর প্রয়োজনই তো সৃষ্টির রূপকার। কাজেই যোগানদাতাও সৃষ্টি হবে সহজেই। এবার আসি আপনারা যাদের রাতের রানী বলে ডাকেন তাদের কথায়। আমাদের এই ভোগ বাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিনিয়ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্রেণীর জন্ম দিচ্ছে। আর অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষা সর্বদাই মানুষকে নিতি নৈতিকতা বিসর্জনে প্র-ভোক করে। কাজেই অর্থের লোভ আর আলো ঝলমলে দুনিয়ার দিকে খুব সহজেই ঝুঁকে পড়ে মিডিয়া পাড়া থেকে শুরু করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠতি তরুণীদের একটা অংশ।
এই তরুণীরা এবং তাদের যোগানদাতা এরা সবাই কিন্তু এক একটি প্রডাক্ট। এই প্রোডাক্টগুলো কারা প্রডিউস করছে? আমরা সেই উৎপাদকের খোজ করছি কি? করছি না। কেন করছি না? কাড়ন হল, এটা এক ধরনের খেলা। আমাদের প্রশাসনের কাজ হল প্রডাক্ট খুঁজে বের করা ও তা নির্মূলের চেষ্টা করা। আর আমাদের সিস্টেমের কাজ হল প্রডাক্ট তৈরির মেশিনারিজের দেখভাল করা। এই সব প্রডাক্টের নির্মাতা বিশেষ কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়। এর নির্মাতা আমাদের নৈতিকতা, রাষ্ট্রের পলিসি, ধর্ম, সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থ। আর তার সাথে রয়েছে গুটিকয়েক সুবিধাভোগী। এদের সব্বাইকে একত্রে বলা যায় ‘সিস্টেম’। যা এতটাই শক্তিশালী যে, এদের বিরুদ্ধে কারোরই করার কিছুই নেই। একমাত্র রাষ্ট্র যদি কখনো এর নির্মূলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তবেই সম্ভব এর প্রতিকার। যদিও সেটাও খুব সহজ নয় তা বলাই বাহুল্য।
লক্ষ করে দেখুন, পরি মনিদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ ধনী ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী এবং বড়লোকের সন্তানদের অনৈতিক ভিডিও ধারণ করে তাঁরা নাকি পরে ব্লাকমেল করে অর্থ আদায় করত। হতেই পারে অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ একাধিক অনৈতিক কাজ করে থাকতেই পারে। প্রশ্ন হল যাদের ব্লাকমেল করা হত তাঁদের কি অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হত না তাঁরা মধুকুঞ্জে স্বেচ্ছায় যেতেন? সেই সব রাতের রাজা এবং রাজপুত্রদের হেনস্থা করার দায়েই কি এই নারীদের গ্রেফতার? তাহলে তো সেই ভুক্তভোগী রাতের রাজা এবং রাজপুত্রদের বদনখানি দেখা যেত। দেখা গিয়েছে কি? রাতের রানী যদি শতাধিক রাজা তো সহস্রাধিক হওয়ার কথা। তাঁরা কোথায়? মামলা তো তাদের পক্ষ থেকে হওয়ার কথা। হয়েছে কি? হয়নি। কেন হ্য়নি? এইখানে তাহাদের সম্মানে আঘাত লাগে। মধুকুঞ্জে মুখ ঢেকে যাওয়া যায়, আদালতে তো মুখ ঢেকে রাখা চলবে না।
কাজেই চোর-পুলিশের এই খেলাটা আগেও ছিল, এখনো চলছে, অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে, আমরা শুধু দেখে যাব আর অবাক হব। একসময় ভুলে যাব। হতাশ হব না, কাড়ন পরিত্রাণের আশা থাকলেই না কেবল হতাশ হওয়ার প্রশ্ন ওঠে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৯