somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘুম

১০ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাইদের আজকাল ঘুম হয়না। রাত আসলেই তার ভয় লাগতে থাকে। প্রায় আট নয় ঘণ্টা একা একা বিছানায় গড়াগড়ি করা তার কাছে বিরাট দুসঃস্বপ্নের মত লাগে। মাস তিনেক ধরে সে একেবারেই ঘুমাচ্ছে না। প্রথম দিকে রাতে ঘুম আসতে দেরি হত, রাত আড়াইটা তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর ঘুম আসতো। কিন্তু সকালে উঠতে দেরি হয়ে যেত। সাইদ ভেবেছিল, রাতে দেরি করে ঘুমায় বলে সকালে উঠতে পারেনা। সে ইন্টারনেট ঘেঁটে "sleep disturbance" "insomnia-facts and solution" ইত্যাদি লেখার ওপরে পিএইচডি করতে লাগল এবং সেগুলো মানারও চেষ্টা করতে লাগল। রাতে টিভি দেখা বাদ দিল, ঘুমের আগে কিছুক্ষন ব্যায়াম করতে যেয়ে খাট থেকে পরে ব্যথা পেল। রাত ১২ টার সময় গোসল করে বিরাট ঠাণ্ডা লাগিয়ে ফেলল। রাতে খাবার পরে গরম দুধও বাদ গেলনা। কিন্তু ঘুম তার হাতে ধরা দিল না। একসময় দেখা গেল ভোর রাতের আগে ঘুম আসেনা। সকালে আবার ঘুম তাড়াতাড়ি ভেঙ্গেও যেতে লাগল। আর কিছু না, শুধু সারারাত জেগে থাকার তীব্র যন্ত্রনা থেকে বাঁচার জন্য সে অস্থির হয়ে গেল।

সাইদের বয়স বেশি না। ২৮ বছরের টগবগে যুবকের ঘুমের সমস্যা হয় কেউ শুনেছে কখনও? তার চেয়েও বড় কথা ছাত্র জীবনে সে তার ঘুমের জন্য বিখ্যাত ছিল। অকাতরে ২০-২২ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারত সে। রিতা’র অসংখ্য কলেও ঘুম ভাঙত না ।এমন কত হয়েছে, মোবাইল হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে, রিতা সারারাত কল দিয়েছে, কিন্তু তার ঘুম ভাঙ্গেনি। এই নিয়ে রিতার কি অভিমান, কত ঝগড়া হত তখন। তবে কি রিতা’র অভিশাপ লেগেছে? ধুর, রিতা তাকে কোনদিন অভিশাপ দেবেনা। তাহলে কি? বড় কোন অসুখ হল? সে ভাবল, এবার একজন ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। কিন্তু কিসের ডাক্তার দেখাবে? নিউরোলজি? মেডিসিন? নাকি মানসিক রোগের ডাক্তার? সাতপাঁচ ভেবে একদিন অফিস থেকে বের হয়ে চলে গেল গ্রিনরোডে। তারপর তিন লাইন ডিগ্রি লাগানো একজন নিউরোলজিস্ট এর চেম্বারে ঢুকে পড়লো। প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে বিদায় করলেন। ওষুধ খেয়ে তার ঠিক তিনদিন ঠিকমত ঘুম হল। তারপর আবার সেই পুরোনো প্যাটার্ন । রাতে দেরি করে ঘুম আসা, সকালে দেরি করে ওঠা, তারপর একেবারেই ঘুম না আসা।

সেদিন সকাল থেকেই তার অল্প অল্প মাথা ধরেছে। অফিসে কাজের চাপও বেশি ছিল, তার ওপর ভ্যাপসা গরমে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাথা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল। রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে পরে রইল, চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে, সে অপেক্ষা করছে কোন এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়বে। হঠাৎ কান চুলকাতে লাগল, সেখান থেকে হাত সরাতেই মনে হল পায়ে মশা বসেছে। হাত বাড়িয়ে কাল্পনিক মশা মারা শেষ করে যখন শুল,তখন মনে হল পিঠের এপাশটা ব্যথা করছে, উল্টোদিকে কাত হয়ে শুতে গিয়ে মাথা চুলকাতে লাগল।একবার চোখ মেলে দেখল ঘরের কোনায় কিসের যেন ছায়া, আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। এপাশ-ওপাশ করে আরও কিছুক্ষণ কাটল। একবার ভাবল ঘড়ি দেখে, আবার ভাবল থাক, কি দরকার। হঠাৎ কোত্থেকে এক পাল কুকুর ডাকতে শুরু করল। সাইদ আশ্চর্য হয়ে ভাবল, এই যে এত জোরে কুকুর ডাকছে, কারও ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছেনা কেন? তারপর তার মনে পড়ল একদিন সেও শান্তিতে ঘুমাত, কোন কিছুর ডাকেই সেদিন তার ঘুম ভাঙ্গেনি। রিতা'র কথা মনে পরল, রিতা থাকলে কি আজ খুব খুশি হত?

সাইদ ভেবেছিল, কারও সাথে এই বিষয়ে আলাপ করবে। কিন্তু তার সেরকম কোন মানুষ নেই। মায়ের ধারণা তার অতিসত্বর বিয়ে করা উচিত। মাকে তার এই সমস্যার কথা বললে আর দেখতে হবেনা। মা আবার তার বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লাগবে। ভার্সিটি'র বন্ধুবান্ধবেরা সব চাকরি বাকরি করছে, কেউ বিয়ে-থা করে ফেলেছে। তাদের কারও কাছে হঠাৎ হাজির হয়ে বলা যায়না, দোস্ত, আমার ঘুম হয়না। যখন রিতা ছিল তখন এসব সমস্যার কথা তার সাথে শেয়ার করা যেত, কিন্তু রিতার বিয়ের পর থেকে সে রীতিমত একা।

হঠাৎ সেদিন অফিসে মামুনের ফোন এল। মামুন তার সদ্যবিবাহিত বন্ধুদের একজন। বছরখানেক আগে বিয়ে করেছে। যদিও তার বিয়েতে সাইদ যেতে পারেনি। অফিসের ট্যুরে রাজশাহী যেতে হয়েছিল। মামুন জানাল, সে আর তার স্ত্রী তাদের বাসায় একটু ডাল-ভাতের আয়োজন করেছে, পুরনো বন্ধুরা সবাই আসছে, সাইদ যেন অবশ্যই আসে। সাইদের বেশ খুশি খুশি লাগছিল। এতদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, হয়ত সে তার ঘুম না হওয়ার ব্যাপারটা বন্ধুদের সাথে আলোচনা করতে পারবে।

মামুনের বাসা সে চেনে, মালিবাগের এই বাড়িতে কতদিন ওরা একসাথে থেকেছে, মামুনের মা অসাধারন রান্না করতেন। আজ অবশ্য তার রান্না খাওয়ার কোন সুযোগ নেই। মামুনের বিয়ে দিয়ে তিনি দেশের বাড়িতে থিতু হয়েছেন। বাসার বেল বাজাতে মামুনই দরজা খুলল। সে বেশ মোটা হয়ে গেছে। চোখ মুখে খুশি উপচে পড়ছে। সে হাঁকডাক করে তার স্ত্রী পিয়াকে ডেকে আনল। মেয়েটাকে দেখে সাইদ প্রায় ভিরমি খেল। মামুনের কাছে শুনেছিল তার বউ ইন্টার পাস করে অনার্স পড়ছে, তাই বলে এত কম বয়সি সেটা ভাবেনি। তার ওপর মেয়েটার চেহারায় একটা ফাযিল ফাযিল ভাব আছে। কাজেকর্মে বড় সাজার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । লাল একটা শাড়ি পড়েছে , সেই শাড়ি কোমরে গুঁজে আবার এখান থেকে ওখানে ছোটাছুটি করছে। ফাহিমের শার্টে কোক পড়াতে সে আঁচল দিয়ে সেটা মুছে দিতে গেল, সাইদ চোখ সরিয়ে নিল। খাবারদাবার সব পিয়া'র মা রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছেন, কাজের মেয়ে সবাইকে প্লেটে বেড়ে খাওয়াল। আর পিয়া বসে বসে অনর্গল কথার তুবড়ি ছুটিয়ে গেল। খাওয়ার পর বেশ আড্ডা জমল, বেশিরভাগই অবিবাহিত, তাদের বাড়ি ফেরার কোন তাড়া নেই, রাজনীতি থেকে কথা শুরু হয়ে ক্রমশ আদিরসের দিকে যেতে লাগলো। সাইদ বার বার ঘড়ি দেখছিল, রাত হয়ে গেছে, ওঠা উচিত, কিন্তু এখান থেকে বাড়ি ফেরা মানেই বিছানায় শুয়ে ছটফট করা, আবার এখানে বসে থাকতেও তার আর ভাল লাগছিলনা। এর মধ্যে পান দিতে এসে পিয়া তার শার্টের বোতামে হাত দিয়ে বলল, "ওমা, আপনার বোতাম দেখি ঢিলে হয়ে গেছে।" বলেই তার কি হাসি! সাইদ আর দেরি করলনা, সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরল। সে ভুল ভেবেছিল, এই পরিবেশে ঘুম না হওয়া সমস্যার কথা আলোচনা করা যায়না।

আজকাল সে অফিস থেকে দেরি করে বের হয়, অফিসে তাকে কেউ বিশেষ একটা ঘাটায় না, প্রতিদিন রাতে ঘুমের সাথে তার যে যুদ্ধ হয়, তা চেহারায় ছাপ ফেলতে শুরু করেছে। একদিন বস তাকে ডেকে সমস্যা কি জিজ্ঞেস করল, লাগলে কয়েকদিন ছুটি নিতে বলল। সাইদ হু-হা করে কথা কাটিয়ে দিল, পাগল...সে নেবে ছুটি? তার তো এমনিতেই সময় কাটানো দায়, ছুটি নিয়ে করবেটা কি?

গতকাল রাতে আটটা ট্যাবলেট একসাথে খাওয়ার পর তার একঘণ্টা ঘুম হয়েছে। ঘরে আর ছিল না, থাকলে আরও কয়েকটা খেত, তখনি ঠিক করেছিল কাল বাসায় যাওয়ার পথে আরও কয়েক পাতা কিনে নিয়ে যাবে। পরদিন অফিস থেকে বেরিয়ে মোড়ের বড় ওষুধের দোকানটাতে ঢুকল। ওষুধের নাম বলতে অল্পবয়স্ক কর্মচারী ক্যাশ কাউন্টারে বসা বয়স্ক ভদ্রলোককে কি যেন বলল। সাইদ লাল চোখ, উস্কখুস্ক বড় বড় চুল, রোগা চেহারা নিয়ে সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে ঢুলছে... বয়স্ক দোকানদার বাজখাই গলায় তাকে বলল ,"না, ওষুধ নাই এইখানে, যাও যাও, বাইর হও।" ঢুলুনি কেটে গিয়ে চমকে উঠল সাইদ। তারপর বুঝতে পারল কি ঘটেছে, দোকানদার তাকে নেশাখোর ভেবেছে। এক ছুটে দোকান থেকে বেরিয়ে এল সে, তারপর হাঁটতে লাগল। কখনও ফুটপাথ দিয়ে, কখনও মেইন রোডে গাড়ির ভিড়ের মধ্যে দিয়ে, পথচলতি মানুষকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল সে। তবে কি সে ঘুমাতে পারবে না? সারা দুনিয়ার মানুষ আরাম করে ঘুমায়... বড়লোক গদি আঁটা বিছানায় ঘুমায়, গরিব রাস্তায় ঘুমায়, নাইটগার্ডরা চেয়ারে বসে ঘুমায়, জন্তু জানোয়ার-তাদেরও ঘুম আসে। আর সে একটু ঘুমাতে পারবে না? নিজের ওপর অভিমানে তার চোখে পানি চলে আসে। তারপর তার জেদ চেপে যায় । ঘুমাতে তাকে হবেই...কেউ তার ঘুম কেড়ে নিতে পারবেনা......ঘুমের সন্ধানে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকে সে...কখন ফ্লাইওভার এর ওপর উঠে গেছে, টেরও পায়না...পাশ থেকে তীব্র গতিতে হুসহাস গাড়ি চলে যাচ্ছে......বাতাসে চুল উড়ছে সাইদের। হঠাৎ পেছন থেকে তীব্র হর্ন ভেসে আসে। রাতের বাতাস কেটে ছুটে আসছে একটা পাঁচটনি ট্রাক, সাইদ এর মুখে এবার হাসি ফুটে ওঠে, চোখ মুছে সে ট্রাকের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। এবার সে নিশ্চিন্তে ঘুমাবে, কেউ তাকে বাঁধা দিতে পারবেনা।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=স্মৃতির মায়ায় জড়িয়ে আছে মন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:০৯


ঘাস লতা পাতা আমার গাঁয়ের মেঠো পথ, ধানের ক্ষেত
জংলী গাছ জড়ানো লতাবতী - আহা নিউরণে পাই স্মৃতির সংকেত,
রান্নাবাটির খেলাঘরে ফুলের পাপড়িতে তরকারী রান্না
এখন স্মৃতিগুলো পড়লে মনে, বুক ফুঁড়ে বেরোয় কান্না।

ফিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×