(হয়ত খুব ক্ষুদ্র, নিত্যদিনের ছোটখাটো বিষয়, তারপরেও আপনাদের সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে হলো, তাই লিখা)
‘আপনার মত শিক্ষিত লোকের কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি’ – এটি বহুল ব্যবহৃত একটি বাক্য। শিক্ষিত লোকমাত্রই আমরা আশা করি তিনি তাঁর শিক্ষা-জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনা কাজে লাগিয়ে সমাজের অন্যদের চেয়ে আচরণে-বিনয়ে-ভদ্রতায়-মূল্যবোধে এগিয়ে থাকবেন।
দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে, পাশের হার বাড়ছে, বাড়ছে জিপিএ ফাইভের সংখ্যা। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উচ্চশিক্ষিতের হার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন ছাত্র-ছাত্রীদের জায়গা দিতে হিমসিম খাচ্ছে, যার ফলে বাড়ছে সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে দেশের বাইরে যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য। কেউ ফিরে আসছেন, অনেকেই আসছেন না। যারা দেশের বাইরে থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আসেন, তাঁদের কাছে প্রত্যাশা থাকে আরো বেশি।
কিন্তু বাস্তবতা আসলেই কি তাই? বরং তার উলটো। আমাদের শিক্ষিতদের মধ্যেই বেশি দেখা যায় দম্ভ, বড়াই আর অপরকে ছোট করার হীন প্রয়াস। আমি বাকি সবার চাইতে বেশি শিক্ষিত, বেশি জানি – সেটা জাহির করার একমাত্র উপায় অন্য সবাইকে ছোট করা। আমি ছাড়া বাকি সব শিক্ষক ভূল পড়ান, কিংবা ঠিকমত পড়াতে পারেন না/ অন্য ডাক্তার যে চিকিতসা দিয়েছেন সেটা পুরোটাই ভূল, আমি নতুন করে ঔষধ দিব, সেগুলোই ঠিক!
আশেপাশে অনেক উচ্চশিক্ষিতদের দেখে প্রথম প্রথম অবাক হতাম, যাঁদের জীবনবৃত্তান্তে যোগ হয়েছে গোটাকয়েক সনদ, শুধু দেশেরই নয়, বিশ্বের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয় চষে এসেছেন। কিন্তু আচরণে বিনয়ের ছিটেফোটা নেই, আছে হামবড়া ভাব। অন্যের পেছনে লেগে থাকা, দলীয় লেজুড়বৃত্তি, অবৈধ অর্থের বাহাদুরী – যা কিনা তাঁদের বিশাল জ্ঞানের সাথে ঠিক যায়না।
পরে ভেবে বের করলাম, অবাক হওয়ার কিছু নেই। একটা সময় ছিল, যখন মানুষ বিদ্যালয়ে যেত জ্ঞান অর্জন করতে, মূল্যবোধ শিখতে, আচরণ-সৌজন্যবোধ শিখতে। এখন আর সেদিন নেই। বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে। বাজারে অমুক সাব্জেক্টের কদর বেশি, এটা পড়লে চাকরী নিশ্চিত, তাই এই বিষয়ে চান্স পেতেই হবে। সামাজিকভাবে সম্মানজনক, আর্থিকভাবে লাভজনক চাকরী নিশিচত করতে যা যা সনদের দরকার হয় সেগুলো যেভাবেই হোক যোগাড় করতেই হবে।
এতসব সনদ, চাকরী, সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক নিশ্চয়তা- এসবের মধ্য মূল্যবোধ, বিনয়, সৌজন্যবোধ চর্চার যায়গা কোথায়?! যার ফলে, অগুনিত সনদ আমাদের চারিত্রিক উতকর্ষতা ঘটাতে ব্যর্থ হয়, কিন্তু ক্ষনিকের জন্য হয়ত ঢেকে রাখে আমাদের আসল রূপ। আমরা সমাজে চলি শিক্ষিত ভদ্রলোকের বেশে, সনদের মুখোশ পড়ে। কিন্তু যখনই দরকার হয় কিংবা সুযোগ আসে, সব উলটে, ফুঁড়ে বের হয় সনদের নিচে লুকিয়ে থাকা আমাদের আসল রূপ, যেটা আমরা পেয়েছি আমাদের পরিবারের কাছ থেকে। এতগুলো বছর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে, বস্তাভর্তি সনদ যোগাড় করেও যার বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি।
আমি শিক্ষিত বলে আমার কাছে ভদ্রতা, আচরণ, বিবেচনাবোধ আশা করছেন? – সেটা আপনারই ভূল।