নিরাপত্তা ফটক পেরিয়ে লন। লনের একপাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ। কতদিনের চেনা! তৃতীয়বার মোড় নিয়ে একটা দরোজা। যার পেছনটা অন্ধকার। শেষবার যখন এসেছি তারেক মাসুদের সদা হাস্যোজ্জল মুখ স্বাগত জানিয়েছিল। আজ এসেছি তাকেই উদযাপন করতে। সে নেই।
____
সেলফোন বেজেই চলছে। সন্ধ্যার হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত কন্ঠ আমার পরিচয় যাচাই করে বললোঃ ২৬ শে আগস্ট বিকেল ৩ টায় ব্রিটিশ কাউন্সিলে তারেক মাসুদকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান। আমি যেন যাই।
ফোন রাখতেই মনে হল যে অনেকদিন হয় আমাদের কোন ক্যামেরা নেই। মোবাইল দিয়েই ঠ্যাকা কাজ চালাচ্ছি একটা ক্যামেরা কিনলাম। অনুষ্ঠানে ছবি তুলবো বলে।
_________________________
ক্যামেরা আনতে পারিনি। নিমন্ত্রণ পত্রে না আনতে বলে দেয়াতে।
বৃটিশ কাউন্সিলে প্রথম যাই বাবার হাত ধরে ১৯৬২-৬৩ তে। তখনো সরকারী লাবরেটরি স্কুলে ভর্তি হইনি। গ্যাদাই বলা চলে। একটা মুভি দেখেছিলাম। রাজ্যের পোকার ওপর। লেডি বার্ডই বেশীর ভাগ সময় ধরে দেখিয়েছিল। একটুও ভাল লাগেনি। পরে অবশ্য অনেক মজার মজার ছবি দেখেছি অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার এখানে। সবচেয়ে বেশী তারেক মাসুদের সাথে। তখনো অডিটরিয়ামে ঢুকিনি। বাঁয়ে লনে চোখ যেতেই একগাদা বাতাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। ঐখানে লনের মধ্যে বসে আড্ডা দিয়েছিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা, শীতের এক বিকেল থেকে অনেক রাত অব্দি। ওখানে কাজলদার (রুহুল আমিন কাজল, ট্রাফিক আর্ট, ডেনমার্ক প্রবাসী, বন্ধু) একটা বাঁশের শিল্পকর্ম ছিল-আলোকিত-তার নীচে বসে। তখন কাজলদার বাঁশকর্মের প্রদর্শনী চলছিল।
____________________________________
প্রথমেই তারেক মাসুদের সারা জীবন দেখানো হল অনেকগুলো স্থির চিত্রের মাধ্যমে। প্রথম দিকের কিছু ছবি আমকে স্মৃতি ভারাক্রান্ত করলো। সত্তর দশকের কিছু ছবি। ওর চাচাতো ভাই এর বাসার ছবি-ওর চাচাতো বোন ঊর্মি, ভাতিজি-স্যুজির সাথে। ঐ বাসার ফয়ারটা দেখলাম এক ঝলক, যেখানে আমাকে ঊর্মি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওর সাথে, ৩৮ বছর আগে ।
ছবি শেষে জীবন চারণ।
ছোটবেলার কথা লিখে পাঠিয়েছিল ওর আরেক চাচাতো বোন- পড়ে শোনালো শাকিল, প্রখ্যাত নজরুল সংগীত শিল্পী। ওর জীবনের পরের সময়টুকু বললো ওর মুক্তিযোদ্ধা মামা। তারপর ওর ভাবী-ক্ষণজন্মা চিত্র পরিচালক আলমগীর কবীরের বোন। তিনি তার একমাত্র ভাই এবং সবচেয়ে আদরের দেবরটিকে সড়ক দূর্ঘটনায়ই হারিয়েছেন। পুরো অডিটরিয়াম নিস্তব্ধ- শুধু চাপা ফোঁপানো আর নাক ঝাড়ার শব্দ। আমার পাশে আমার স্ত্রী, তার পাশে আমার অনুজা-আমার পেছনে অল্প বয়সী একটি ছেলে, তার পাশে বসা বন্ধু শম্পা রেজা-দূরে বুনো, রেহমান সোবহান, মোস্তফা মনোয়ার স্যার, ডঃ কামাল হোসেন, সারা জাকের, আলী জাকের, মমতাজ, ডালিয়া নওশীন, হ্যারন্ড , মিশুকের স্ত্রী ম. কাজী, প্রাচী, জয়ন্ত, মাকসুদ, দোস্ত শিশির ভট্টাচার্য, আনিসুল হক (মা), ব্যারিস্টার সারা, নায়লা জামান(খান), লুবনা মরিয়ম, মৌসুমী ভৌমিক, কে আসেনি আর কেই বা সামলাতে পারছে তার আবেগ। সারাক্ষণ চোখ মুছছে-এত্তো ভালো কি মানুষকে বাসা যায়?
আসলেন আদমজী কলেজে পড়া ওর এক সতীর্থ, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, মোরশেদুল ইসলাম, মোরশেদুল ইসলামের স্ত্রী আলমগীর কবীরের সড়ক দূর্ঘটার বর্ণনা দিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ের তার বাম রাজনীতির কথা বললেন তার এক বন্ধু ও স্বল্প দৈর্ঘ চলচিত্র নির্মাতা শামীম। কিভাবে ট্রটস্কীকে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করতে গিয়ে তারেক ও তাদের বাম রাজনীতি ছাড়তে হ’ল সেটাও বললেন।
প্রথম আন্তর্জা্তিক স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র উৎসবে তারেকের অবদানকে অনেকেই শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করলেন।
গান গাইলো আনুশে, সংগত করলো বুনো। মুক্তির গানের প্রথম সংগীতটি সমবেত কন্ঠে গাওয়া হ'ল, লীডে ছিল শাহীন সামাদ। তারেক আলী ও আরো কয়েক জন ছিল সাথে।
ক্যাথরিনের মা আর ভাই কথা বললেন। তারেক মাসুদ তাদের হৃদয়েও যে কি বিশাল স্থান করে নিয়েছিল তা কখনোই বুঝতাম না যদিনা আজ তাদের কথা শুনতাম।
ক্যাথরিন মাসুদ তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সবচেয়ে আশার কথাটি বললো-তারেক মাসুদ যে কাজ ফেলে গেছে সেটা সে করবে, যে পথে তারেক চলেছে সে পথেই সে চলবে।
==================================
তারেক মাসুদ উদযাপনে যে ব্যাপারগুলো খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেগুলো হলঃ
বিনয়ী, বন্ধু বৎসল, কঠোর পরিশ্রমী এবং সদা হাস্যজ্জ্বল এই চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রচন্ড আর্থিক সংকটের মাঝে জীবনপাত করেছে কিন্তু এই প্রচন্ড প্রতিকূলতা এক মূহুর্তের জন্যেও তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।
এককভাবে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচিত্র তার অবদান ছিল অকল্পনীয়।
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষনায় (যাদের ইচ্ছে “পাঠ” পড়ুন) তারেক মাসুদ “On behalf of our great national leader, the Supreme Commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman ” এই অংশটুকু জোড়া দেন। এই অডিও ক্লিপটি তিনি ডয়েসে ভ্যালে থেকে সংগ্রহ করেন।
রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে এদেশের মানুষ যখন আমাদের মহান মুক্তি যুদ্ধকে ভুলতে বসেছিল তখন সে মুক্তিযুদ্ধকে সবার মাঝে প্রোথিত করেছে।
তার চলচ্চিত্র নির্মানের মান এক কথায় এদেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ যা তার ক্যাথরিনএবং মিশুক মনিরের অক্লান্ত যৌথ প্রচেষ্টার ফসল।
____________________________________________
আজকের অনুষ্ঠানটি তারেক মাসুদের শোক সভা নয়, ছিল “তারেক মাসুদ ঊদযাপন”, তারেক, আমাদের সিনেমার ফেরিওয়ালা পছন্দ করতো এমন একটি কর্মকান্ড।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১:৪৯