১
বাহিরে ঝড় হচ্ছে! ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে! মোমের আলোয় একের পর এক পোকা ধরে পোড়াচ্ছে তন্দ্রা! তার কিছু উদ্ভট শখের মধ্যে এটা একটা। কারেন্ট চলে গেলে মোমের উপর যে পোকাগুলো উড়ে এসে বসবে সে সেগুলোকে একে একে মোমের লাভাতে দগ্ধ করবে! তন্দ্রার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শাহেদ। মোমের আলোয় অসম্ভব রুপবতী লাগছে তাকে! দিনকে দিন তার রুপ যেন বেড়েই চলেছে! গায়ের রঙও এখন প্রায় দুধে আলতা। মসৃণ চিকন চুলগুলো আরো ঝলমলে হয়ে উঠেছে। মোমের লালচে আলোয় তাকে দেখে মনে হচ্ছে রুপকথার গল্প থেকে উঠে আসা কোন রাজকন্যা!
তন্দ্রাকে কাছে ডাকে শাহেদ। ''তন্দ্রা ঘুমুতে এসো। অনেক রাত হল!''
-''আমি এত অন্ধকারে ঘুমুতে পারব না। আগে কারেন্ট আসুক। তুমি ঘুমাও।'' তন্দ্রার নির্লিপ্ত উত্তর।
রাত যত বাড়তে থাকে ঝড়ও ততই বাড়তে থাকে! শাঁ শাঁ আওয়াজে বাতাস গাছের ডালপালাকে সজোড়ে ধাক্কা দিয়ে একের পর এক জানাতে থাকে প্রতিবাদ! যেন আজ সব কিছু ভেঙ্গে নিয়ে যাবার পণ করেছে! শাহেদ আবার তন্দ্রাকে ডাকে ,''তন্দ্রা ঘুমুতে এসো! ঝড় আরো বাড়লে ভয় পাবে!''
-''তুমি আমাকে ভয়ের কথা বলে আমাকে ইনফ্লুয়েন্সড করছো শাহেদ! যেন তোমার কথা শুনে আমার মস্তিষ্ক একটা কাল্পনিক ভূত তৈরী করে! আর আমি তার ভয়ের তোমার কাছে ছুটে আসি! তার চেয়ে এ কথা সরাসরি কেন বলছো না তুমি আমাকে কাছে পেতে চাইছো?''
-''তুমি সব সময় একটু বেশি বোঝো তন্দ্রা!''
-''দেখো শাহেদ, এভাবে আমার সাথে কথা বলবে না! আমি এভাবে কথা শুনে একদমই অভ্যস্ত নই!''
শাহেদ এসে তন্দ্রার হাত পিছনে বাকিয়ে ধরে ,''এত অহংকার কিসের তোমার? একটা বাচ্চা হলে আর এত অহংকার থাকবে না!''
তন্দ্রা নরম হয়ে আসে। হালকা গলায় বলে ,''ছেড়ে দাও! ব্যাথা পাচ্ছি তো!''
শাহেদ ছেড়ে দেয়! তন্দ্রা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার আগের মত পোকা ধরে সেগুলোকে মোমের লাভায় কবর দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়!
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে শাহেদ পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে তন্দ্রার দিকে বাড়িয়ে দেয়। তন্দ্রা ফিরিয়ে দিয়ে বলে ,''এগুলোকে খেলে মোটা হয়ে যাবো! তখন দেখতে আন্টিদের মত লাগবে!''
-''তন্দ্রা তুমি কি জানো তুমি Anorexia Nervosa তে ভুগছো? তুমি ভাবছো তুমি মোটা হয়ে যাবে কিন্তু দিন দিন শুকিয়ে রোগা হয়ে যাচ্ছো! আরো বেশি শুকালে মা হওয়ার মত স্বাস্থ্যটুকু পর্যন্ত তোমার থাকবে না!''
-'' মা হতে কে চাইছে? এত তাড়াতাড়ি বাবু হলে আমার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে! তখন তোমার আর আমাকে ভালো লাগবে না। তাই বাবু যত দেরিতে হয় ততই ভালো।''
তন্দ্রা একটা ফ্রুটস্ এর থালা হাতে করে নিয়ে উঠে চলে যায়। কাল রাতে কারেন্ট না থাকায় কয়েকটা সিরিয়াল মিস হয়ে গেছে। এখন সেগুলো দেখবে। শাহেদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে! তন্দ্রাকে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না! মাঝে মাঝে মনে হয় অসম্ভব বুদ্ধিমতি মেয়ে তন্দ্রা। তার বোঝার সীমারেখার অনেক ঊর্ধ্বে! আর মাঝে মাঝে মনে হয় মাথা মোটা টাইপের মেয়ে যে কিনা টিভি সিরিয়াল, ছেলেমানুষী কাজ কর্ম আর রুপ চর্চার চিন্তার বাহিরে আর কোন চিন্তাই করতে জানে না।
তন্দ্রা সোফায় বসে রিমোট দিয়ে টিভি অন করে। টিভিতে এখন সিরিয়ালে নায়ক নায়িকাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে! নায়িকার পরকিয়ার সম্পর্ক আবিস্কার করেছে নায়ক। তাই নিয়ে চলছে দু জনের মাঝে চলছে সম্পর্কের টানা পোড়ন! কোল্ড ওয়ার চলছে দু জনের মাঝে। কেউ কাউকে কিছু বলছে না,কিন্তু আচার আচরণে ভয়াবহ যুদ্ধের পূর্বাভাস স্পষ্ট! তন্দ্রা আড়চোখে ডাইনিং টেবিলে বসা স্বামীর দিকে তাকায়! সে চিন্তিত মুখে গম্ভির হয়ে নাস্তা সারছে।
নাস্তা সেরে অফিসে চলে যায় শাহেদ। কিন্তু কিসের যেন দুশ্চিন্তা জাপটে ধরে রাখে! সে তন্দ্রাকে ফোন দেয়। ফোন ব্যস্ত! এমন সে প্রায়ই দেখেছে! সে অফিসে চলে যাবার সাথে সাথে ফোন এংগেজড! তন্দ্রা কার সাথে যেন কথা বলে! সে জিজ্ঞাসা করলে বলে এই বান্ধবী,ঐ বান্ধবীর সাথে কথা বলেছি। কিন্তু তাদের বিয়ের এক বছরের মধ্যে সে তার কোন বান্ধবীকে তাদের বাসায় আসতে দেখেনি।
তন্দ্রার কারো সাথে এফেয়ার নেই তো? থাকলেও থাকতে পারে! তাকে তো কখনোই পরিপূর্ণভাবে ভালোবাসে নি সে। তার আচরণেই বোঝা যায় দূরে দূরে থাকতে পারলেই বাঁচে সে। এ নিয়ে সে তন্দ্রার ভাবির সাথেও আলোচনা করেছে। ভাবি বলেছে ছেলেমানুষ তো তাই এমন হচ্ছে! আরেকটু বয়স বাড়ুক, বাচ্চাকাচ্চা হোক তখন ঠিক হয়ে যাবে।
২
কিন্তু তন্দ্রার মাঝে ঠিক হওয়ার কোন লক্ষণ নেই! বরং দিন দিন তার ছেলেমানুষীগুলো আরো বাড়ছে! ইদানিং সে না বলে মাঝে মাঝে যেন কোথায় চলে যায়! ফোন সুইচড অফ করে একেবারে লাপাত্তা! তার আত্মীয় স্বজন ভাই ভাবি কেউ জানে না! শাহেদ যখন বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে খুঁজে অস্থির তখন হঠাৎ ফিরে আসে। যেন কিছুই হয় নি! এসে সুন্দর টিভির রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত!
শাহেদের সব কিছু অসহ্য লাগতে থাকে! আর কতদিন সহ্য করা যায় এমন অবহেলা! যেখানে বউ এর সতীত্বই এখন প্রশ্নবিদ্ধ! কার কাছে এভাবে ছুটে যায় তন্দ্রা? কেন সে এটা তার সাথে শেয়ার করে না? শাহেদের জায়গায় অন্য কোন পুরুষ হলে হয়ত এতদিনে বউকে মারধোর করত! কিন্তু শাহেদ করে না। তার চোখের নিচে কালি পড়ে যায়, চুল উস্কখুস্ক! বন্ধুরা সবাই পরামর্শ দেয় তন্দ্রাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে! হাজার হোক পরকিয়া করা মেয়ের সাথে তো আর সংসার করা যায় না। কিন্তু শাহেদের মন সায় দেয় না। শাহেদ তার নিজের পরিবারেই দেখেছে স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েদের কি অবর্ণনীয় দুঃখ! তার মাকে তার বাবা ডিভোর্স দিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ে করেছিলেন। পরে তার মা স্বামীর শোকে পাগল হয়ে এক সময় সুইসাইড করে। শাহেদ তার নানা নানীর কাছে মানুষ। তাই সে ঠিক করেছিল সে স্ত্রীকে নিয়ে অনেক সুখের সংসার গড়ে তুলবে। এই সংসার ক্ষুধা, ভালোবাসার ক্ষুধা তার অনেক দিনের! তন্দ্রার নিষ্পাপ মুখে সে দেখেছিল সেই স্বর্গীয় সুখের হাতছানী! কিন্তু বিয়ের পর থেকেই তন্দ্রা তাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে নি। কেন পারে নি তা শাহেদের অজানা! তন্দ্রাও কোন দিন মুখ খুলে বলেনি!
৩
শহরের পাশের পার্কের বেঞ্চিতে তন্দ্রা একা একা বসে আছে! আজ বড্ড বিমর্ষ সে! শাহেদকে নিয়ে সে যেই অংক কষে রেখেছিল তা ভুল ভাগফল দেখাচ্ছে! সে ধরে রেখেছিল শাহেদ এসব সহ্য করতে পারবে না। কোন পুরুষই পারে না। স্ত্রীরা স্বামীদের বহুপরকিয়া নিরবে সহ্য করে গেলেও স্বামীরা একটা সিঙ্গেলও সহ্য করতে পারে না। অনেক স্বামীই স্ত্রীদের নির্মমভাবে মারধোর করে, কেউবা বউ খুন করে ফেলে! এমন নজীর সমাজে বহু আছে! কিন্তু শাহেদ ভিন্ন রকম। সে তন্দ্রাকে এত কিছুর পরও ভালোবেসে যাচ্ছে! নিজে কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু তন্দ্রাকে মুখ ফুটে কিছু বলছে না!
তন্দ্রা বিয়ের আগে নাবিল নামক একটি ছেলেকে ভালবাসতো। পাগলের মত ভালোবাসতো। ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের পরিচয় ছিল। সে নাবিলকে পৃথিবীর সব থেকে অনেস্ট ছেলে মনে করতো। কারণ নাবিলের আচরণই ছিল সে রকম! নিয়মিত নামাজ পড়া, অন্যকে শ্রদ্ধা করা, বিপদাগ্রস্থদের সাহায্য করা সব মিলিয়ে সে ছিল হাতেমতায়ীর ডুব্লিকেট ভার্সন! তার যে জিনিসটি তন্দ্রাকে বেশি মুগ্ধ করতো সে খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারতো। এমন কি তার বানিয়ে বানিয়ে বলা গল্পগুলোও তন্দ্রার কাছে সত্যি মনে হত! ইমপারফেক্ট জীবনে কখনো কখনো কত সুখ থাকতে পারে প্রথম বুঝেছিল তন্দ্রা! তারপর একদিন নাবিল তার জবের কাজে সিঙ্গাপুর যাবে বলে চলে যায়। তারপর আর ফিরে আসে নি! তন্দ্রা বহু খোঁজাখুঁজি করে জানতে পারে নাবিল আরেক জায়গায় বিয়ে করেছে! অথচ তার সাথে প্রেমের অভিনয় করে গেছে নিখুঁতভাবে!
তারপর থেকে তন্দ্রার বিশ্বাস পৃথিবীর কোন ছেলে কোন দিন ভালোবাসতে পারে না! সব তাদের মোহ! মেয়েদের রুপের মোহ, সুন্দর ফিগারের মোহ, ভোগবাদিতার মোহ! তাই তন্দ্রাও প্রতিশোধ স্বরুপ তার স্বামীর সাথে মোহের খেলা খেলে গেছে! প্রথমে তাকে ভালোবাসার মোহ, সুন্দর ফিগারের মোহ, রুপের মোহ দেখিয়ে পরে তার মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছে সন্দেহের সূক্ষ্মবীজ! সেও নাবিলের মত হতে চেয়েছিল হৃদয় নিয়ে খেলার দক্ষ প্লেয়ার! কিন্তু আর পেরে উঠল কই? তার স্বামীর দূর্নিবার ভালোবাসার কাছে পরাজিত সে! সে তাকে বাধ্য করছে গলে পড়তে! তার কাছে এখন মায়া, কামনা আর ভালোবাসা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে! নাবিলের প্রতি ছিল তার সত্যিকারের ভালোবাসা আর শাহেদের প্রতি ছিল মায়া! আজ মায়া আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য করার সূক্ষ্ম মাইন্ড যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। আজ সব কিছু ছেড়ে তার শাহেদকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে! আজ কামুক সে ,প্রচন্ড কামুক! ভালোবাসার কাঙাল! যেই ভালোবাসার মন নাবিল চলে যাবার পরে একেবারে মরে গিয়েছিল সে আজ আবার সতেজ হয়ে উঠেছে! শাহেদকে কাছে পাবার তীব্র বাসনায় তন্দ্রা পাগল হয়ে ওঠে!
তন্দ্রা বাড়ি এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বার বার দেখে! কোথায় যেন কমতি! সে সালোওয়ারকামিজ পাল্টে লাল শাড়ি পড়ে আসে। হুম এখন কিছুটা পারফেক্ট! লাল চুড়ি, মেচিং করে কানের দুল, লাল ব্লাসন সব কিছু দিয়ে দিয়ে আজ তার পরীর মত সাজতে ইচ্ছে হয়! কিন্তু শাহেদের মুখের রুপের প্রশংসা না শোনা পর্যন্ত সবই যেন অসম্পূর্ণ! তন্দ্রা অধির হয়ে শাহেদের ফেরা অপেক্ষা করতে থাকে!
অন্যদিন শাহেদ তাকে ফোন দেয়, কিন্তু আজ সে ফোন দেয় শাহেদকে! কিন্তু শাহেদের মোবাইল সুইচড অফ! অফিসে ফোন দিলে অফিসের বয় জানায় সাহেব ঘন্টা দুয়েক আগে বেরিয়ে গেছে!
সন্ধ্যা হয়ে যায় তবু শাহেদ ফেরে না! নানা রকম ভয়, শংকা তন্দ্রাকে গ্রাস করতে থাকে! কি হল শাহেদের? এখনো ফিরছে না কেন? খারাপ কিছু হল না তো! তার শংকাকে বাস্তবে পরিণত করতেই যেন এক অচেনা নাম্বার থেকে ফোন! ''শাহেদ এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি! অবস্থা গুরুতর!'' তন্দ্রা হাসপাতালে ছুটে যায়! কষ্টে নীল হয়ে আছে শাহেদের মুখ! তন্দ্রা নিজের মাঝে ধ্বসে যেতে থাকে। বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। তার সাথে এমন বহুবার হয়েছে! সুখগুলো তার খুব কাছে এসে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! কিন্তু এবার সে হারিয়ে যেতে দেবে না। সে শক্ত করে চেপে ধরে শাহেদের হাত।