বাইশে ডিসেম্বর। এ দিনের দিবাভাগ বছরের অন্য যে কোনও দিনের দিবাভাগের তুলনায় ক্ষুদ্রতম। সেই হিসেবে রাতটি কিন্তু দীর্ঘতম। অর্থাৎ দিন ছোট, রাত বড় – এই হলো মোদ্দাকথা। কিন্তু এর ঠিক তিনদিন পরে যেই পঁচিশে ডিসেম্বর এলো – সেই অমনি দিনটা কেমন করে বড়দিন হয়ে গেলো? একুশে জুনকে পেছনে ফেলে দিলো না কি পঁচিশে ডিসেম্বর? না, তা নয়। কিন্তু কেমন করে বড়দিন নাম এলো সেটা এখনও উদ্ধার করতে পারিনি। ক্রিসমাসকে বাংলায় অনেক যায়গায় খ্রিস্টমাস লেখা দেখেছি। তাতে অসুবিধা নেই। অসুবিধা হওয়ারও কোনও কারণ নেই। পঁচিশে ডিসেম্বরের নাম যেমন বড়দিন, ভাগ্যেও কিন্তু লক্ষ্মীর নির্ঘন্ট! পঁচিশ লিখতে যে ২ ও ৫ লাগে তাকে যোগ করলে পাওয়া যায় ৭ - অর্থাৎ লাকি সেভেন। ক্রিসমাস খ্রিস্টান সম্প্রদায় বড় আড়ম্বরে উদযাপন করে। লাকি না হওয়ার কোনও কারণ নেই।
সংখ্যার এ হিসেবকে আপাততঃ মেনে নিলে ১৬ ডিসেম্বরও লাকি। তা তো বটেই! ১ আর ৬ যোগ করেই দেখুন না। অর্থাৎ লাকি সেভেন। বিজয়ও পেয়েছি এই দিনে।
রামলোচন আমাকে বলে, তাহলে ৭ মার্চ তো একেবারে ৭ এর মধ্যে সিঁধে আছে! এর ক্ষেত্রে কি হবে?
কি আর হবে? স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপনের দিনটির কথা নিশ্চয় তোমার মনে আছে।
তা আছে।
তারপর এলো ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ২ এর সঙ্গে ১ যোগ করে যোগফল দিয়ে সংখ্যাটিকে ভাগ করলে সাত পাওয়া যায়। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও লাকি সেভেন! বলে কি!
তা তো বটেই, গেলো না কিছু প্রাণ, কিন্তু ভাষা তো পেয়েছি! লাকি হবে না মানে!
এতক্ষণে অরিন্দম চুপ ছিলো। এবার বিষাদে কহিলো, ও ভাই, এতো গেজিও না। তাহলে ১৪ ডিসেম্বরের মানে কি হয় বুঝিয়ে দাও।
বলা বাহুল্য যে ১৪ এর মধ্যে সাত ঘুমিয়ে আছে, ৭ গুণন ২। এই দিন দেশের মেধাবী মানুষেরাও চিরতরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন – ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। অর্থাৎ পূর্ব গগনে সূর্য ওঠার কেবল ২ দিন বাকি, তার আগে ১৪ কে ২ ভাগ করে দিলো। দেশও ভাগ হয়ে গেলো, সাতও পেলাম আবার, কিন্তু দেশ কি হারালো?
তবে এ ক্ষেত্রে কিন্তু খাটলো না সাত এর মুজেজা।
তখন আর একজন তেড়ে উঠলো, বললো, এবার বলুন, কি হয় মানে ২৫ শে মার্চের?
আরে তাই তো! আমার তখন হতভম্ব হওয়া কেবল বাকি, হতবুদ্ধি হয়ে গেছি প্রায়। কিন্তু তখন খোদায় সাহায্য করলেন কি না জানি না, অর্থাৎ সেলফ ডিফেন্সের জন্য মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, ২৫ মার্চ আর ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানীদের জন্য লাকি নয় কি!
সেই থেকে আমি রাজাকার।
*******
আমার ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর, ৭, ১৪, ২৫ অর্থাৎ গাঁটে যা ছিলো, সব বৃথা হয়ে গেলো। সাত নিয়ে রঙ্গ করতে গিয়ে যে তকমার সঙ্গ পেয়েছি তা আর ঘুঁচবার লয়, অর্থাৎ ভঙ্গ হবার নয়! মনে পড়ে গেলো ডঃ হুমায়ুন আজাদ স্যার (উনি প্রথাবিরোধী, কিন্তু উদ্ধত ধরনের পণ্ডিত ছিলেন) -এর এক অমর উক্তি। তিনি বললেন, একজন রাজাকার চিরকালই রাজাকার, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়! বাপস! উক্তি বটে!
আমার দাদার একটা মুদ্রাদোষ ছিলো। ভালো কিছু হলেই, বা শুনলেই তিনি বলতেন, বাহ রে বেটা বা!
রাজাকার তকমা নিয়ে আমি তড়পাই, আর বলি, বাহ রে পণ্ডিত বাহ! কি শিখাইয়া গেইলে গা পণ্ডিত!
*******
মজলিসে পণ্ডিত রামচরণ উপস্থিত ছিলেন। আমাকে তিনি প্রশ্ন করেন, তাহলে ৪৭ এর সাতের ব্যাপারে তোমার মতামত কি?
আমি বলি, ৪৭ আমার জন্য দুঃসহ যন্ত্রণার। বিষয়টা ভাঙনের। আমি জুড়তে পছন্দ করি, তাই ৪৭ এর আগে বাস করি।
এই কথা বলার পরই মনে মনে চমকে গেলাম, ভাবলাম এবার নিশ্চয় কেউ দালাল খেতাব দিয়ে দেবে!
আমি অপেক্ষা করতে থাকি। নাহ, কাউকে কিছু বলতে দেখা গেলো না।
পণ্ডিত রামচরণ ৪৭ নিয়ে আর তেমন কিছু মন্তব্য করলেন না, শুধু বললেন, দেখো পাকিস্তান যে হলো তা কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের ভোটেই। বর্তমান পাকিস্তানের কতজনই বা এ ভাগের পক্ষে ছিলো - বড়জোর বিশ ভাগ!
৪৭ যে কেন এত কষ্টের এবার মনে হয় বুঝেছেন আপনি। বাঙালি মুসলমানেরা পাকিস্তান চাইলো, কিন্তু হুজুগে না পড়ে যদি সত্যিকারে বিচার করে দেখতো, তবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়? পাকিস্তানে মেহেদী হাসান, গুলাম আলী আর ওয়াসিম আকরাম এর মত দু-একজন ছাড়া আর কি আছে কইতে পারেন?
তা বলেছো বটে! পণ্ডিত রামচরণ দেখি একটু খুশি। বুঝতে পারছি না তাকে খুশি থাকতে দেবো, না একটু খোঁচাবো।
বললুম, দেখুন ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তানকে কিস্যুই দেয়নি। অর্থাৎ ১৪ এর মধ্যে সাত-এর অস্তিত্ব আছে বৈকি, কিন্তু তাতে অগতি। ভারতের কথাও যদি বলি, দেশটা স্বাধীন হলো ১৫/০৮/৪৭ এ। সংখ্যার অংকগুলো যোগ করুন তো?
পণ্ডিত রামচরণ দেরি করেন না। চোখ বন্ধ করে বলেন ২৫। তার মানে সাত!
আচ্ছা বলুন তো এই সাত ভারতকেই বা কি দিয়েছে? দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি দরিদ্র লোকের বাস ভারতে। ষাট কোটি লোকে সকাল হলে বাইরে ‘ইয়ে’ করে। শুধু ফেস পাওডার লাগিয়ে বলিউড, আর উপরের সারির ক’জন ধনী, আর ক্রিকেট দেখিয়ে আসলে কি কোনও লাভ হইছে ওই সাধারণ মানুষদের?
দেখা গেলো সাত বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তান কাউকেই তিষ্টোতে দেয়নি। দেবে, সে সম্ভাবনাও দেখি না।
পণ্ডিত রামচরণ কেমন করে পণ্ডিত হলেন, আর কোথাকার পণ্ডিত অর্থাৎ কোন ঘরানার তার কিস্যুই জানি না। কিন্তু ধারণা করতে পারি যে, রামের চরণের স্পর্শ পেলে তিনি যদি প্রসন্ন হন তবে পাণ্ডিত্য দান করলেও করতে পারেন। রামের আবার সৌভাগ্যের শেষ নেই। রামের কপাল একেবারে খোলা। র (২৭ নং ব্যাঞ্জনবর্ণ) আর ম (২৫ নং) এর বেলায় অংকগুলোর যোগফল (২+৭+২+৫) হলো গিয়ে ১৬, সেখান থেকে ৭ পাওয়া যায়। আবার ২৭ + ২৫ = ৫২ => ২ + ৫ = ৭!
একে রামে কি আর তাহলে রক্ষা হয়? আর তখন সুগ্রীব যদি দোসর হয় তবে কি ঘটে আন্দাজ করা শক্ত নয়। অর্থাৎ কচুকাটা চলে। এমনই এক কচুকাটা চলেছিলো এ দেশেও – ৭১ এ।
কিন্তু কচুকাটা হলেও বিপরীতে হীত হলো আমাদেরই। অর্থাৎ স্বাধীনতা। যাক না ত্রিশ লক্ষের জান চুলোয়! দেশ তো পেয়েছি! অর্থাৎ ২১, ১৪, ১৬, আর ৭ – এই সংখ্যাগুলোর মধ্যে যে ‘লাকি’ ৭ লুকোনো আছে তা শুধু বছর বছর কপালে পটি বেঁধে আমাদের শহীদ মিনারেই নিয়ে গেলো। সেখানে পদদলিত হওয়া ফুল, আর অডিটোরিয়ামের সভা-সেমিনার ছাড়া লাকি সেভেন থেকে কি পেয়েছি আমরা?
কোটি কোটি ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দেয়া যেতো ফালতু সভা আর মিনারে চড়ানো ফুলের দামে। একাত্তরের অনেক গুলো সাত তখন সত্যিই মূল্য পেতো।
*******
আর সাত সতেরো নয়, এখন শুধু সাতকে নিয়েই গল্পটা বাড়বে। লাকি নম্বর বলে কথা! আমাদের লাকির কথা-ই ধরুন। সে কি কম লাকি? লাকি শব্দটার মধ্যে দূর্বলভাবে হলেও সাতের অস্তিত্ব আছে। ল (২৩ নং) এবং ক (১ নং) কে বিচার করি আসুন। ২ * ৩ + ১ = ৭! একটু দূর্বল আর কি। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের লাকি দেখতে যতই দূব্বল হোক না কেন, আর রাজনীতির চণ্ড বাবাজিরা যতই তাকে পেদিয়ে ঘুঘু দেখাতে চাক না কেনো, লাকির রূদ্র কণ্ঠ কিন্তু তত জোরেই শোনা গেলো। অর্থাৎ নতুন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা ৭ এর বর প্রাপ্ত। নতুন একাত্তরের মধ্যে ৭ থাকলেও ১ এর জন্য কিছু লাক তো মিস করেছেই।
অমনি মঞ্চের কর্মী তেতে উঠলো। কেন, আপনি ইচ্ছেমত গুণ করে যোগ করে সাত বানাতে পারেন, আমরা পারিনা? দেখুন না ৭১ এর ৭ এর সঙ্গে ১ গুণ করে, সাতই তো পাচ্ছি!
আরে তাই তো! মাথা আছে ছেলেটার।
তারপরও সে ছাড়বার পাত্র নয়। মওকা পেলে কেউ কি আর ছেড়ে কথা কয়? সে যোগ করে, তাছাড়া সংখ্যাটা তো সাত-এর দশকেই পড়েছে!
আরে গাধা, সাত এর দশক হয় না, বল সত্তরের দশক।
ওই হলো আর কি। সত্তরের মধ্যেও তো সাত আছে!
‘ওই হলো আর কি’ করেই তো আন্দোলনটা চালাচ্ছ বাবা! বটে বটে! চালিয়ে যাও।
*******
এবার আর লাকি নয়, এবং LUCKY কে বিচার করবো।
L = ১২ নং ইংরেজী বর্ণ
U = ২১ নং
C = ৩ নং
K = ১১ নং
Y = ২৫ নং
অংকগুলো যোগ করলে ১৮ পাই। ৮ – ১ = ৭।
অর্থাৎ গড (GOD) LUCKY কে-ই লাকি বানিয়ে দিয়েছেন। আর তিনি নিজেও বিচরণ করছেন সাত- এ ( GOD এর G ৭ নং ইংরেজি বর্ণ)
তখন শুরু হলো উৎপাত। এক শ্রেনির ধার্মিকেরা প্রশ্ন তুলে বললো, এ বড় অবিচার। আমাদেরকে খুব খাটো করা হচ্ছে কিন্তু! খ্রিস্টানরা ৭ কে লাকি নাম্বার বানিয়ে ১৩ কে বানিয়ে দিয়েছে আনলাকি!
কেন, কেন? ১৩ তে আবার কি ঘটলো?
তাদের যুক্তি ১৩ সংখ্যায় তাদের প্রোফেট মুহম্মদ (স) এর নামের প্রথম অক্ষর M এর অবস্থান। অর্থাৎ বিষয়টা UNLUCKY হয়ে গেলো যে! রক্তপাত হয় কি না হয় এই নিয়ে সেটা এখন দেখার বিষয়।
সে যা হোক, আসুন UNLUCKY এর সাংখ্যমান বিচার করি এবার।
U = ২১
N = ১৪
L = ১২
U = ২১
C = ৩
K = ১১
Y = ২৫
সংখ্যার অংকগুলো যোগ করুন, দেখুন কি পান। তেমন নয় ২৬ পাওয়া যায়। হলো তো! ২৬ এর মধ্যে ১৩ আছে! কি সর্বনাশ! এত বড় চক্রান্ত!
কিন্তু হায়, হে ধার্মিকেরা, তোমরা বলতে পারলে না যে, ALLAH শব্দের A হলো নাম্বার ওয়ান! তারপর কেউ এও বলতে পারলো না, আয় ভাই ১ আর ৭ নিয়ে আমরা সবাই মিলে মিশে থাকি। আত্মবিশ্বাস ও বিশ্বাস দুই-ই খুইয়ে এখন অন্যের দোষ দিয়ে কি লাভ? কার এতো সময় আছে?
মুসলমানের আত্মবিশ্বাস নিয়ে একটা গল্প মনে পড়লো। আমি আমার খুব এক প্রিয়ভাজন চাচাতো ভাই এর কাছ থেকে শুনেছি এ গল্প।
এক ইমানদারকে ছোট্ট একটি সূচের পেছনের ছিদ্র দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহ এই ছিদ্র দিয়ে গলে যেতে পারবেন?
ইমানদার চোখ তীক্ষ্ম করে সূচের ছিদ্রের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভাবতে থাকেন। ভাবনা শেষ হলে, মাথা এ দিক ওদিক দুলিয়ে বলেন, না আ আ, তা ক্যামনে হইবে? তিনি বিশ্বজগতের মালিক, কাদির, তারপক্ষে ওইহান দিয়া যাওন... ! না না না, কি যে কয়েন না!
একই প্রশ্ন করা হলো এক গবেট পাগলকে। তার উত্তর, উনি তাও পারেন।
এখন আমার প্রশ্ন হলো, বেহেশতবাসী কে?
(ইমানদারে সত্যিই জানে আল্লাহ মহান, কিন্তু তার বিশ্বাস এতো নড়বড়ে, টলমল যে, যাঁকে সে কাদির বলতে পারে, তাঁর পক্ষে যে সব কিছুই সম্ভব, এই বিশ্বাস সে অন্তরে পোষন করতে পারেনি। )
*******
কথা শুরু হয়েছিলো বড়দিন নিয়ে। দুনিয়ায় দরিদ্র খ্রিস্টানের সংখ্যা নেহাত কম। অন্ততঃ দরিদ্র মুসলিমদের সংখ্যার তুলনায়। কিন্তু বড়দিন এলে খ্রিস্টান দুনিয়ায় ত্যাগের দরজা খুলে যায় – Sale Sale Sale!!! যাও দোকানে, আর ইচ্ছেমত কেনো। আর ইচ্ছেমত উৎসবে মেতে ওঠো। এই হলো সাম্য। সবার একসঙ্গে সুন্দর করে বাঁচা, বা বাঁচতে চাওয়া। একটি দিনের জন্যে হলেও। তাহলে ২৫ ডিসেম্বর কেন লাকি হবে না? হতেই হবে।
আসুন তো ঈদ শব্দের বিচার করি! করেই দেখি না!
ঈ = ৪
দ = ১৮
অংকগুলো আপনিই যোগ করুন। কি পেলেন?
*******
ঈদের আগে বাজারের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। সে কাজ করতে বুকের পাটা লাগে। আমার তা নেই।
দীনের রজ্জুকে শক্ত করে ধরতে বলা হলো পবিত্র গ্রন্থে। আরে ভাই দীনের কি কোনও রজ্জু থাকে নাকি? এই রজ্জুর নাম হলো ইউনিটি - একতা। আমরা একটি দিনের জন্যও সাম্যের সঙ্গে বাঁচতে শিখিনি। চোখ বন্ধ করে দরিদ্র মুসলিমের ঈদের কথা স্মরণ করুন।
আপনি নিশ্চয় দেখতে পাবেন কেমন করে হতভাগ্য ১৩ মুসলিমদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে।