সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে এক মিসরীয় নাগরিককে হত্যার অভিযোগে ১১ বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করা হয়। সৌদি আরবের বিচার বিভাগ ১১ বাংলাদেশীর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাদের অভিযুক্ত করে এবং অভিযুক্তদের ৮ জনকে সম্প্রতি সৌদি আরবের নিজস্ব বিচার প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। অপর ৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। সৌদি আরবের বিচারব্যবস্থা আরবদের মধ্যযুগীয় রীতিনীতি ও ইসলামী শরিয়া আইন দ্বারাই মূলত নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত।
ইসলামী শরিয়া আইন অনুযায়ী খুনের বদলে খুন অর্থাত্ খুন করার শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড (কিসাস)। সৌদি আরব মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়া এখনও তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও প্রথা অনুসরণ করে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে কার্যকর করে। অতীতে সৌদি আরবে (আরবীয়রা) মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে শিরশ্ছেদ করার পর তার বিচ্ছিন্ন মস্তককে একটা বড় থালার মধ্যে বসিয়ে বিচারকমণ্ডলীর সামনে নিয়ে প্রদর্শন করে রায় কার্যকর করার প্রমাণ দেয়া হতো। এখনও প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতা (আরবীয়রা) হাততালি দিয়ে ও আমিন আমিন বলে উল্লাস ও সমর্থন প্রকাশ করে। কিন্তু কোনো কোনো সময় অন্য দেশের মানুষ এ দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়। এ বিচার প্রক্রিয়া তথা রায় কার্যকর করার প্রথা আমাদের কাছে, অপরাপর বিশ্ববাসীর কাছে এবং মানবতাবাদীদের কাছে নিষ্ঠুর, বর্বর, পৈশাচিক ও মানবতাবিরোধী বলে মনে হলেও সৌদি আরব তথা আরব্য সমাজ এটাকে আল্লাহর আইন বা ইসলামী শরিয়ার বিধান (কিসাস) বলে সব সমালোচনা ও বিরোধিতার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে এটাকে প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের ইসলামী বা ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করে। স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে এটা তাদের নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও আধুনিক ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব সমাজের অংশ হিসেবে আরবরাও এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো জাতি নয়। তাই আরবদের অনেক ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত রীতিনীতি ও বিধান—যা গণতান্ত্রিক ও আধুনিক বিশ্বের গণতন্ত্রমনা ও মানবতাবাদী সমাজের কাছে অগণতান্ত্রিক ও মানবতাবিরোধী বলে মনে হয় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে অনেককে সোচ্চার হতে দেখা যায়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে মাত্র কিছুদিন আগে সৌদি আরবের নিজস্ব বিচার প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্যে ৮ বাংলাদেশীর শিরশ্ছেদ করার দৃশ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে প্রদর্শিত হওয়ায় এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। নিহতদের ঘরে ঘরে মাতম আর কান্নার রোল বয়ে যায়। একজনকে হত্যার দায়ে একসঙ্গে ৮ জনকে হত্যা করায় সৌদি আরবের বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও যথার্থতা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশীদের সাজা মওকুফ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের সক্রিয় উদ্যোগ ও ভূমিকা নিয়েও জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের হাইকোর্ট থেকে একটা রুল ইস্যু হয়েছে এবং এ বিষয়ে যা বলার বা যা করার তা এখন বাংলাদেশ সরকারই করবে। বিচারাধীন বিষয় বলে এ নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য বা আলোচনা করার আর তেমন সুযোগ নেই।
আমরা এখন শুধু অপরাধ দমনে সৌদি আরব তথা আরব দেশগুলোর বিচারব্যবস্থা বা শাস্তির প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে পারি। খুন বা হত্যা করার অপরাধে আপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান সব দেশেই আছে, শুধু মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে ভিন্ন। আবার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড বা অন্যান্য শাস্তি থেকে অপরাধীকে মওকুফ বা মাফ করে দেয়ার সুযোগও সৌদি আরবসহ বিশ্বের সব দেশেই আছে। ইসলামী শরিয়া আইন অনুযায়ী খুন করার অপরাধের শাস্তিও খুন (মৃত্যুদণ্ড), সৌদি আরব তাদের রীতিনীতিকে ধারণ করে খুনের আসামিকে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়া এখনও বহাল রেখেছে। তাদের কাছে ইসলামী শরিয়ার আলোকে এর অন্তর্নিহিত যৌক্তিকতা হলো শাস্তির ভয়াবহতা দেখে যাতে এমন আপরাধ থেকে মানুষ বিরত থাকে।
এ নিয়ে আধুনিক ও তথাকথিত গণতান্ত্রিক বা মানবতাবাদী সমাজে বিতর্ক থাকলেও আইন বা শাস্তির এমন কঠোরতা ও ভয়াবহতা বহাল থাকায় সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশে পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, রাহাজানির মতো জঘন্য অপরাধের পরিমাণ অনেক কম। এ ব্যাপারে যারা নাস্তিক্যবাদের বা ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী, তথাকথিত প্রগতিশীল ও মুসলমানের নামধারী হয়েও নিজেকে মুসলমান বলতে বা ভাবতে লজ্জা বোধ করে একমাত্র তারাই দ্বিমত পোষণ করে।
তথাকথিত আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী সমাজে তথা বিশ্বে প্রতিদিন খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ অমানবিক ও মানবতাবিরোধী যে অপরাধ সংগঠিত হয় আইনের কঠোরতা ও শাস্তির ভয়াবহতার কারণে সৌদি আরবসহ আরব সমাজে এ জাতীয় অপরাধের পরিমাণ নিতান্তই কম। রাজনৈতিক দলাদলির কারণে কলহ বা হত্যাকাণ্ড, অপহরণ করে নিয়ে মানুষকে বা শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশকে বীভত্সভাবে খণ্ড খণ্ড করে বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া, বিনাবিচারে ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা, পকেটমার বা চোর বা মাদক ব্যবসায়ী সন্দেহে সাধারণ মানুষ কর্তৃক মানুষকে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে পিটিয়ে (গণপিটুনিতে) হত্যা করা, নারী বা মহিলাদের এসিড মেরে ঝলসে দেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলাদলির কারণে সহপাঠী দ্বারা সহপাঠীদের খুন করা, রাম দা, চায়নিজ কুড়াল ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মিছিল করে একপক্ষ আরেক পক্ষকে আক্রমণ করে রাজপথে লাশ উপহার দেয়া, খুন করে টাকা-পয়সা ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া, প্রতিদিন তথাকথিত গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী সমাজে এমন শত শত অমানবিক, নির্মম, নিষ্ঠুর, পাশবিক ও নৃসংশ ঘটনা যেভাবে অব্যাহতভাবে ঘটছে তার ছিটেফোঁটাও সৌদি আরব তথা আরব দেশে ঘটে না এবং তা একমাত্র তাদের দেশের আইন প্রয়োগে কঠোরতা ও শাস্তির ভয়াবহতার কারণে।
একটা দেশ ও সেদেশের সরকারের মূল ও নৈতিক দায়িত্বই হলো সমাজকে আপরাধমুক্ত রাখা বা সমাজে অপরাধের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে ও কমিয়ে রাখা এবং অমানবিক, নির্মম ও নৃসংশ অপরাধের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করে জনগণের জান-মালের হেফাজত করা বা জনগণকে নিরাপদে রাখা। এ পবিত্র ও গুরু দায়িত্ব পালন করার জন্য যদি কোনো দেশ বা সেদেশের সরকার কঠোর আইন ও ভয়াবহ শাস্তির বিধান অনুসরণ করে, তবে সে আইন ও শাস্তির বিধানকে যে আইনেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, জনগণের জান-মাল তথা মানবতাকে অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তার বিবেচনায় যথার্থ ও উপযুক্তই বলতে হবে।
উল্লেখ্য, মানবজাতিকে অপরাধ করা থেকে বিরত রাখতে পারে বলে মনে করা হতো : ১. শিক্ষা (বিবেক), ২. শাস্তির ভয় ও লোকলজ্জা (যদি কেউ দেখে ফেলে বা জেনে যায়) এবং ৩. ধর্ম। এর অর্থ হলো, যার মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার আলো আছে তার বিবেক বেশি শাণিত—যা তাকে কোনো পাপ কাজ বা আপরাধ করা থেকে বিরত রাখে। কিন্তু এখন দেখা যায় এ অস্ত্রের ধার ভোঁতা হয়ে গেছে। শিক্ষিতরাই এখন বেশি পাপ কাজ ও অপরাধ করছে। আর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষকতার জোয়ারে মানুষের জীবন থেকে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রভাব অনেকটাই হালকা হয়ে গেছে; তাই নামাজ পড়ে কপালে কালো দাগ ফেলেও ঘুষ খাওয়া ও দুর্নীতি সমানে চলতে থাকে। আর লজ্জা-শরমের তো কোনো বালাই-ই নেই (ভয় তো দূরের কথা)। (বাকি অংশ আগামী রোববার)
স্ববিরোধী ও দ্বৈত চরিত্রের মানুষই এখন চারিদিকে। একমাত্র অস্ত্র এখনও অবশিষ্ট আছে, তা হচ্ছে বিচার বা শাস্তি। এ-ও যদি তথাকথিত গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী মতাদর্শের আঘাতে ভোঁতা হয়ে যায়; তবে মানুষ আর পশু-জানোয়ারে দুনিয়ায় কোনো পার্থক্য থাকবে না (যদিও বনে-জঙ্গলে পশুরা মানুষের তুলনায় এখন অনেক ভদ্র ও সুশৃঙ্খল—যা শিক্ষা, ধর্ম, চক্ষুলজ্জা বা শাস্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না )।
আমাদের মতো গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী বিচারব্যবস্থায় একজন খুনের মামলার অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত আসামিও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বা আইনের সঙ্গে জড়িতদের প্রভাবিত করে বের হয়ে বা অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে যায়, আইনের সঙ্গে জড়িতরা আইনের মারপ্যাঁচের বদৌলতে বাদীকে আসামি ও আসামিকে বাদী বানাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশে প্রাচীনকালে যে কাজির বিচার ছিল এবং সেখানে যেমন সাক্ষী, প্রমাণপত্র ও পারিপার্শিকতার ওপর নির্ভর করে বিচার করা হতো এখনও একই ভিত্তির ওপর নির্ভর করেই বিচার হয়। তবে তাদের বিচারব্যবস্থাও এখন অনেক আধুনিক ও যুক্তিনির্ভর হয়েছে। নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালত, মহকুমা আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট হয়েছে, আইন পেশা অনেক উন্নত হয়েছে, হাজার হাজার আইনজীবী কর্মরত আছে, অভিজ্ঞ ও প্রবীণ আইনজীবীরা বিচারক নিযুক্ত হচ্ছেন, আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন করা ও আইনজীবী নিয়োগ করার বিধান ও সুযোগ রয়েছে, বিদেশিদের জন্য (রাষ্ট্রীয়ভাবে) দোভাষী নিয়োগের ব্যবস্থাও রয়েছে। এখানে অপরাধ করলে কেউ আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হওয়ার সুযোগ নেই বা এ ধরনের ঘটনা নেই বললেই চলে। টাকা খেয়ে চার্জশিট দাখিল করার মাধ্যমে বাদীকে আসামি বা আসামিকে বাদী বানানোর কোনো সুযোগ ও সাহস (শাস্তির ভয়ে) এখানে কারও নেই। তবে এ কথাও সত্য, রাজপরিবারের কেউ বা পশ্চিমা বিশ্বের কোনো দেশের লোক যদি সৌদি আরবে বা অন্য কোনো আরব দেশে কোনো জঘন্য অপরাধ করে তবে তাদের বেলায় কখনও কখনও আইনের কঠোরতা শিথিল করার ঘটনা ঘটে থাকে (যদিও আইনের চোখে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে সবাইকে সমানভাবেই বিচার করতে হবে। একই অপরাধে কাউকে কঠোর শাস্তি, কাউকে কম শাস্তি বা ক্ষমা নয়)। কিন্তু তাই বলে অন্যের অপরাধ ক্ষমা করলে অমারও বিচার করা যাবে না, এটাও যুক্তি হতে পারে না। তাহলে তো আর অপরাধের বিচারই হবে না—সমাজে অপরাধ বাড়তেই থাকবে।
সৌদি আরব তথা আরব দেশেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা বা দণ্ড মওকুফ করার নিয়ম বা বিধান আছে; তবে আমাদের দেশের মতো খুনের মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিকেও রাজনৈতিক বিবেচনায় যেভাবে ছেড়ে দেয়া হয় বা ক্ষমা করা হয়, সেভাবে হয় না। ক্ষতিগ্রস্তের পরিবার যদি অপরাধীকে ক্ষমা করে তবে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশিদের বেলায় সেদেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান সৌদি বাদশাহকে অনুরোধ করলেও বাদশা তা নিজ ইচ্ছায় করতে পারেন না। বাদশার পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের রক্তপণ দিয়ে বা অনুনয়-বিনয় করে যদি রাজি করানো যায়, তবে ক্ষমা করা হয়ে থাকে। অর্থাত্ ক্ষতিগ্রস্তের পরিবারের সম্মতিটাই প্রধান বিবেচ্য। এমন উদাহরণ আমাদের দেশেও আছে। কিছুদিন আগে স্বয়ং আমাদের প্রধানমন্ত্রী এক জায়গায় বক্তব্য দেয়ার সময় জানালেন, লিবিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি একবার তাকে পবিত্র কোরআনের একটা আয়াত উদ্ধৃত করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মাফ করে দেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। জবাবে শেখ হাসিনাও কোরআনের আর একটা আয়াত উদ্ধৃত করে বাবার হত্যার বিচার করার হক সন্তানের আদায় করতে হয় বলে গাদ্দাফিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে দুটো বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে গেছে : ১. ইসলামে খুনের বিচারও খুন এবং ২. ক্ষতিগ্রস্তের পরিবার ছাড়া খুনিকে কেউ মাফ করতে পারে না (কিন্তু আমাদের দেশে পারে)।
পরিশেষে সৌদি আরবে বাংলাদেশীদের অপরাধ বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করা প্রয়োজন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হওয়ায় ১৯৭৬ সাল থেকে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি শুরু করে এবং সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরবে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনশক্তি বা শ্রমিকের সংখ্যাই সর্বোচ্চ। সৌদি আরবের মাটিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূলত স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যগত কারণে বাংলাদেশীদের অপরাধের ঘটনা ও কাহিনী বাড়তে শুরু করল। খুন, হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরিসহ বেআইনি ও অবৈধ কার্যকলাপ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে; যখন সৌদি আরবে অন্য কোনো দেশের লোক অপরাধ করলেও সৌদি কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ মনে করে বাংলাদেশীরাই করেছে। নোয়াখালী সমিতি, সিলেট সমিতি, বরিশাল সমিতি, চট্টগ্রাম সমিতি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমিতি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নামে বিদেশের মাটিতে সহিংস রাজনীতি ও আঞ্চলিকতার বিষবাষ্প এমনভাবে ছড়িয়েছে, চাঁদাবাজি ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে এদের মধ্যে রিয়াদ ও অন্যান্য শহরে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে। বাংলাদেশী স্টাইলে সৌদি আরবের রাস্তায় (এমনকি পুলিশের সামনে) একদল আরেক দলকে রাম দা, চায়নিজ কুড়াল, ছুরি, তরবারি নিয়ে এমনভাবে আক্রমণ করে, যা অবিশ্বাস্য। শুধু যে নিজেরাই মারামারি করে তা নয়, অন্য দেশের লোকজন এমনকি সৌদিদের সঙ্গেও বাঙালিরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
নামাজের সময় সৌদি আরবে আজান দিলেই দোকানপাট সব বন্ধ করে মুসলমান হলে মসজিদে যেতে হয়। এজন্য সৌদি সরকারের বিশেষ বাহিনী (মোতওয়া) এলাকায় এলাকায় গাড়িতে চড়ে নামাজে যাওয়ার জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানাতে থাকে। বাংলাদেশীরা একবার নয় বহুবার এই বিশেষ বাহিনীর সঙ্গেও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এমনকি রিয়াদের বাংলাদেশী ব্যবসায়ী অধ্যুষিত এলাকা বাথা থেকে একবার বাঙালিরা এক সৌদি পুলিশকেও পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। এ ঘটনার পর সবাই মনে করেছিল সৌদি আরব থেকে সব বাংলাদেশীকে বের করে দেয়া হবে।
এটা গেল বাঙালিদের অপরাধের এক দিক, আরেক দিক হলো অবৈধ বাংলাদেশীর সংখ্যাও সৌদি আরবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তথাকথিত ফ্রি ভিসায় গিয়ে মূল স্পনসরের কাছে কাজ না করে বেআইনিভাবে অন্যত্র কাজ করা, হজ-ওমরা ভিসায় এসে পালিয়ে যাওয়া, এক ভিসায় গিয়ে কিছুদিন পর বেশি বেতনের লোভে অন্য জায়গায় পালিয়ে যাওয়া, আবাসিক পারমিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রিনিউ না করে অবৈধভাবে কাজ করা। এ ধরনের অবৈধ হাজার হাজার বাংলাদেশী এখন সৌদি আরবের বিভিন্ন জেলে পড়ে আছে।
বাংলাদেশীদের অপরাধ ও অবৈধ কার্যকলাপের মাত্রা সৌদি আরবে অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন সৌদিরা এবং অন্য দেশের লোকও বাংলাদেশীদের খারাপ নজরে দেখছে। বাঙালি হলেই মনে করে ক্রিমিনাল। মূলত এসব কারণেই ২০০৭ সাল থেকে সৌদি আরব বলতে গেলে বাংলাদেশের ভিসা বন্ধই করে দিয়েছে এবং এক স্পনসর থেকে অন্য স্পনসরের কাছে বদলিও বন্ধ করে রেখেছে। বাঙালিদের ছোট অপরাধকেও বড় করে দেখছে। অপরাধের জন্য শাস্তির কঠোরতাও বৃদ্ধি করেছে। অথচ আমাদের সরকার, বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জনশক্তি রফতানিকারকরা সৌদি আরবে বাংলাদেশীদের অপরাধ দমনে বা অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। যার ফলে এক বিদেশিকে হত্যার অপরাধে আজ ৮ বাংলাদেশীর মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হলো এবং আরও এ ধরনের বিচার সামনে অপেক্ষায় আছে। সর্বোপরি সৌদি আরবে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিও বন্ধ হয়ে গেছে।
তথ্যসুত্র: আমারদেশ ১১/১২/২০১১