somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অস্পৃশ্য আয়োজনে

১৪ ই মে, ২০০৮ বিকাল ৫:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহর ছাড়িয়ে বহুদূরে কোন এক গন্ডগ্রামের একটি গাছ। তার সর্বাঙ্গ জুড়ে অযত্নের ছাপ। এরই মাঝে দিকবিদিকজ্ঞানহীন হয়ে তার বেড়ে ওঠা। আশেপাশে খোলা মাঠের প্রাচুর্যে একা নিভৃতে দাড়িয়ে থাকা গাছটাকে ঘিরে গ্রামবাসী কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়। গাছটার কদাকার গঠন সেই কুসংস্কার কল্পনার সাকো মজবুত করে। এমনকি কোন পাখিও তার ডালে বসে না। তবে গ্রামের দামাল ছেলেরা বয়জৈষ্ঠ্যদের কল্পনার সেই সাকো উপেক্ষা করে কৈশোরের প্রাণপ্রাচুর্যে অবগাহন করতে বেশি পছন্দ করে। তাদের দুঃসাহসিকতা আর বাধাহীন আবেগে প্রায় প্রতিদিনই গাছটির একটি কি দুইটি ডাল ভাঙে।
গাছটি আকাশের দিকে ডালপালা ছড়িয়ে কি যেন প্রার্থনা করে। সেই প্রার্থনার ভঙ্গি আর তার নিভৃত অস্তিত্বের কারণে তাকে জীবন বিবাগী মহাপুরুষের মত মনে হয়। তবে সে আসলে তেমন কিছু না। বরং খুবই সাধারণ। সঙ্গহীনতা তাকে বিচলিত করে। তার প্রতিক্রিয়াশুণ্য দেহে বলার মত অনেক কথাই জমা আছে। তার বড়ই জমা কথার ঝাপি খুলতে ইচ্ছা হয়।


অন্যসব দিনের মতই একটা দিন। সেদিনও গাছটি গ্রামের ছেলেদের তান্ডবলীলার অপেক্ষা করে। যদিও তারা তাকে কষ্ট দেয় অনেক তবু তার নিঃসঙ্গ নিশব্দ জীবনে এসময়টুকু ব্যতিক্রম কাটে। কষ্ট দেয়া ছাড়া তাদের বাকি সব কাজই তাই তার ভাল লাগে। তবু এই বুঝি তাকে কষ্ট দিলো সেই উৎকন্ঠা তাকে ভাল লাগার পুরো আস্বাদটুকু পেতে দেয় না।
এমনি এক দিনে তাকে আনন্দে ভাসিয়ে একটা চড়ুই তার ডালে বসে। তাড়াহুড়ো করে ডালাপালা এগিয়ে চড়ুইটিকে সে ছায়া দেয়ার চেষ্টা করতে করতে কথা বলে।
-তুমি কে গো?
-আমি কিচকিচ।
-কি জন্য এসেছ?
-বাসা বানাতে।
-তুমি একা কেন? তোমার বাবা মা আসেনি?
-আমি বাসা থেকে রাগ করে পালিয়ে এসেছি।
এতক্ষণে চড়ুইটির তার ডালে এসে বসার কারণ স্পষ্ট হয়। এমন একটা কদাকার গাছে কেউ চড়ুইটিকে খোজার কথা ভাববে না। কষ্টটা কোন মতে চাপতে চাপতে সে আবারো কথা বলে।
-কতদিন থাকবে ?
-অনেকদিন।
-আমি কি কোন ভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি? গরম পড়েছে খুব। ডাল দিয়ে বাতাস দেই?
-তোমার তো বাতাস করার মত ডাল বেশি নাই।
তার কথাকে ভুল প্রমাণ করতে সে তার রুগ্ন ডালগুলো দিয়ে সবেগে বাতাস করে। তাতে অল্পই বাতাস হয়। চড়ুই আপন মনে বাসা বানায়। মাঝে মাঝেই অযাচিতভাবে গাছটা একটা দুইটা পরামর্শ দেয়। সেদিন আর দুষ্ট ছেলেরা এসে তাদের কর্মে ব্যাঘাত ঘটায় না।


অল্পকদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে আশ্চর্য সখ্য গড়ে োঠে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চড়ুইটি ডাকে।
-তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ ?
-কি হয়েছে?
-তুমি কি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকো নাকি?
-হ্যা।
-কেন?
-ভালো লাগে।
-কখন ঘুমাও?
-একটা মানুষ প্রতিদিন আমার গাছের নিচে এসে দাড়ায়। কিছুক্ষণ থাকে । এরপর চলে যায়। তারপরেই আমি ঘুমাই।
-সবসময় একই মানুষ আসে?
-হ্যা।
-কেন আসে?
-আমার গোড়ায় বসে অনেকক্ষণ কাঁদে। একটা মেয়ের কথা বলে।
-অদ্ভুত তো!
-মনে হয় মেয়েটাই আমাকে জন্ম দিয়েছে।
-মেয়েটা কি তবে মারা গেছে?
-জানি না।
চড়ুইটি গাছের মন খারাপ ভাবটা বোঝে। সে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়। গাছটাকে একা থাকতে দেয়। এক রাতে চড়ুইটির হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যায়।
- তুমি কি জেগে আছো?
-হ্যা।
-মানুষটা এখনো আসেনি?
-না।
-তোমার কি মন খারাপ?
গাছ কোন উত্তর দেয় না। চড়ুইটির ভীষণ মন খারাপ হয়।

আর একদিনের কথা। গাছটির ডাকে তার ঘুম ভাঙ্গে। তার কথায় উৎকন্ঠা ঝরে।
-তুমি তাড়াতাড়ি আমার পেছনের ডালদুইটার আড়ালে লুকাও। অনেকগুলো মানুষের ছেলে আসবে। তোমাকে দেখলে তারা তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।
-ওরাই কি তোমার ডাল ভাঙে?
-বেশি কথা বলো না। তাড়াতাড়ি!
-কিন্তু তারা তোমার ওই ডাল দুইটা ভাঙ্গলেই তো আমাকে দেখে ফেলবে।
-ডাল দুইটা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতেই তুমি উড়ে চলে যেতে পারবে।
চঞ্চল চড়ুই কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়। গাছটি তার সবকিছু দিয়ে তাকে আগলে রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু কেন?
-কি হল?
-আমি লুকাবো না।
-কেন?
-এত কথা বলতে পারবো না।
চড়ুইটির ছোট্ট চোখের পানি বিশাল গাছটি দেখতে পায়না। পেলে কি হত কে জানে।

বড়ই আনন্দে কাটছিল তাদের দিন। সৃষ্টিকর্তা তাদের স্বর্গসুখ দেখে হয়তো ভ্রূকুটি করলেন। হর্ষে বিষাদ ঢাললেন। প্রচন্ড এক ঝড় গাছটিকে একেবারেই লন্ডভন্ড করলো। জ্ঞান ফিরে গাছটি আর চড়ুই কিচকিচ কে দেখতে পেল না। তারা বাসাটাকেও না।


তার অনেকদিন পরের কথা। গাছটি এখনো কিচকিচের অপেক্ষা করে। হয়তো সে বেচে আছে। গ্রামের ছেলেরা গাছটির উপর তান্ডব চালানোর আর উৎসাহ পায়না। গাছটির এখন একেবারেই রিক্তশ্রী অবস্থা।
হঠাৎ আবার একটা চড়ুই এসে বসে তার ডালে। একেবারে কিচকিচের মত চেহারা। সেই চঞ্চু, সেই চোখ।
-তোমার নাম কি কিচকিচ?
-হ্যা কেন?
-তুমি আমাকে চিনতে পারছোনা?
-না তো কেন?
-ওই যে, তুমি অনেক দিন আমার সাথে ছিলে!
-কি বল আবোল তাবোল?
গাছটা থতমত খায়।
-থাকবে এখানে?
-এই গাছে কেউ থাকতে পারে? নাই তো কিছুই। বিশ্রী একটা গাছ।
-তুমি কি চলে যাবে?
-হ্যা। রাতটুকু বিশ্রাম নিবো শুধু।
-আচ্ছা। আমি কি তোমাকে বাতাস করবো?
-কথা না বলে চুপ থাকো।


সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর অনেকক্ষণ চড়ুই মনে করতে পারে না সে কোথায় আছে। গাছটাকে ভাল করে দেখতেই তার মনে পরে। কি বিশ্রী কদাকার একটা গাছ! আজকে এই গাছটা কাটা হবে। ভালই হবে। এত সুন্দরের মধ্যে এই গাছ মানায় না। গাছটা এই কাটার ব্যাপারটা জানে? মনে হয় না। বিরাট বোকা একটা গাছ। সে কি তাকে জানিয়ে দেবে? থাক কি দরকার! বেকুবটা ফিচফিচ করে কাঁদবে মনে হয়।
-তুমি কি জেগে আছো?
-হ্যা। মাত্র উঠলাম।
-তুমি কি খুব ভোরে উঠো?
-না। আজকে কেন জানি উঠে পড়লাম।
-ও। শোনো! আমি চলে যাচ্ছি।
-আর আসবে না?
-না।
-ও।
-যাই তাহলে?
-আচ্ছা। শোনো...
গাছটি এবার সেই মানুষটার কথা বলে। যে গভীর রাতে তার কাছে প্রায়ই আসে। বলে মেয়েটির কথাও। তার বিশ্বাস মেয়েটাই তাকে পৃথিবীতে এনেছে। তারপর বলে,
-তুমি কি তোমার পরিবারের সবাইকে বলবে তারা এই নামের কোন মেয়েকে চেনে কি না? খোজ পেলে যাতে আমাকে একটু বলে যায়?
- সেই মেয়ের খোঁজ পেয়ে কি হবে? সে কি তোমার কাছে আসবে? তুমি তো তাকে ডাকতেও পারবেনা।
-তা ঠিক।
-ওই মেয়েটিকে তুমি কিছু বলতে চাও?
-হ্যা।
-কি?
-বলতাম আমার মত কদাকার গাছকে সে কি ভেবে এত যত্ন করে লাগিয়েছিল।
-আচ্ছা।
-তুমি তাও সবাইকে বলে রেখো। আর তারা যেন বাকিদেরকেও বলে।
-আমার কিছু মনে থাকে না। তবু আমি চেষ্টা করবো।
সূর্যটা একটু একটু করে পূর্ব আকাশে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ৪/৫ জন মানুষের একটি দল এদিকে এগিয়ে আসছে। গাছ চড়ুইটির চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে। তাই সে এগিয়ে আসা মানুষের দলটিকে দেখতে পায় না।


চড়ুইটি চলে যাচ্ছে। আজ তার মনে অনেক আনন্দ। এই আনন্দ ব্যস্ততার, এই আনন্দ সঙ্গের কাছে ফিরে যাওয়ার। জীবজগতের প্রত্যেকেই চায় সঙ্গ। যে সঙ্গ মৃত্যুর সময়ে তার উপর ভালবাসার ছায়া মেলে থাকবে। নিভৃত নিঃসঙ্গ মৃত্যু কেউ চায় না।
গাছটা কি যেন বলেছিল মেয়েটির নাম? চড়ুইটি ভুলে গেছে। কিছুক্ষণের জন্য সে বিব্রত হয়। সে কি ফিরে গিয়ে গাছটিকে আবার জিজ্ঞেস করে আসবে? পিছনে তাকায় সে। মানুষগুলো গাছটি কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। না দেখলেও পাখিটি বুঝতে পারছে গাছটির চোখে ভয়ের বদলে বিস্ময়। আমি তো তোমাদের কোন ক্ষতি করিনি। তোমরা ডালপালা ভেঙ্গেছ। নীরবে সয়েছি। তারপরও আমাকে কাটবে?
ফিরে জিজ্ঞেস করার পরিকল্পনা বাদ দেয় চড়ুই। ফিরে গেলে গাছটার সাথে সেও মারা পরতে পারে। এমনিতে গাছটাতো মরবেই। আর তারপর মেয়েটার নাম মনে আসা না আসা দিয়ে কারো কোনকিছু আসবে যাবে না।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৪৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×