somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাশ্মিরের শাল এবং সামারের দিনগুলি (আরব ডায়েরি-৮৪)

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমরা বেশ কয়েকটি ফ্যামিলি এবার সামারের ছুটিতে বাংলাদেশে যাইনি। অনেক ফ্যামিলিতেই নতুন অতিথি এসেছে। এবারের সামারটা সবার সাথে বেশ জমজমাট কাটল। আমি ও শাকিলা বিয়ের পর একসাথে দেশে কোরবানীর ঈদ করতে পারিনি। তাই এবার সামারের ছুটিতে দেশে না গিয়ে, কোরবানীর ঈদে ঘুরে এলাম।

ছুটিতে আমাদের অন্যতম কাজ ছিল আড্ডাবাজি করা। রাত হলেই আমি, মাহমুদ ভাই, জহির ভাই, কখনোবা শফিক ভাই গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। রাতের খাবার আর চা/কফি চলত ব্যাপকভাবে। জহিরভাই এক আজব মানুষ। যেদিন আয়েশ করে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছি, সেদিনই ডাকাডাকি- ভাই একটু আড্ডা দিয়ে যান, কতদিন দেখিনা !

সামারের ছুটির ২ সপ্তাহের মাঝেই রোজা শুরু হয়ে যায়। ইফতারে বাংলাদেশি খাবার কখনো মিস করিনি। শাকিলা প্রতিদিনই দেশীয় ইফতারের আয়োজন করেছে। প্রায়দিনই আমাদের বাসায় কাউকে না কাউকে নিয়ে ইফতার করেছি। এর মাঝেই জহির ভাই ভোর ৩ টায় সেহরির দাওয়াত দিলেন। ভোর ৩ টার দাওয়াত! এমন দাওয়াত এই প্রথম পেলাম। আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১ টা। এদিকে ২:৩০ থেকে জহির ভাইয়ের অনবরত ফোন। আমি আর মাহমুদ ভাই গেলাম। অনেক আয়োজন। বিভিন্ন রকমের ভর্তা, মুড়িঘন্ট, মাছ, মাংস, খেজুর গুড়ের পায়েস- বড়ই উপাদেয়। সব কিছুর মাঝে শিম, আলু আর মাছ দিয়ে একসাথে তৈরি একটি ভর্তা এতই মজা লাগল যে, আমিই বেশীরভাগ খেয়ে ফেললাম।

মাহমুদ ভাই আমাদের এ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজার, একা থাকেন। উনিও একদিন ভোর ৩ টায় আমাদের সব শিক্ষককেই দাওয়াত করলেন। মাহমুদ ভাইয়ের মুসুর ডাল স্বাদে, গুনে এখানে সব ভাবীদের চেয়ে সেরা। সবাই খেল, সাথে করে বাসায়ও নিয়ে গেল।

রোজার ঈদে ফজরের নামাজ পড়েই সবাই মিলে ঈদ্গাহে গেলাম। মনেই হয়নি দেশের বাহিরে আছি। সবার বাসায় তিনদিন ধরে দাওয়াত চলল। ঈদের পর ভার্সিটি খুললেও ২ সপ্তাহ কোন ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম ছিল না। আমাদের আড্ডা, মুভি শো- থেমে থাকেনি, যারা দেশে গিয়েছিল তারা ফিরে এসে আনন্দটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

ঠান্ডা কনকনে এক রাতে গেলাম ফায়ার ওয়ার্কস দেখতে। আমার ডাক না ফেলতে পেরে (মনে মনে আমাকে বিস্তর বকেছে) সবাই আবহা লেকের পাশে হাজির হয়। প্রতি বছর গ্রীষ্মের রাতগুলোতে ৫/১০ মিনিটের জন্য আতশবাজি পোড়ানো হয়। লেকের একদিকে লেজার শো, সার্কাস দেখার জন্য সৌদিরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একেবারে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতাটা অতুলনীয়। রাত ১১টায় যখন ফায়ার ওয়ার্কস শুরু হল, সবাইকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আকাশপানে চেয়ে থাকতে দেখলাম।

এই সময়টাতে আবহায় মাসব্যাপি বাণিজ্য মেলা হয়। এক বিকালে সবাই হইহুল্লোড় করে মেলায় গেলাম। সেখানে বিভিন্ন রাইড ছিল। সৌদি মেয়েরা যেভাবে আনন্দ করছিল ও রাইডগুলোতে উঠছিল, তাতে বুঝা গেল একটু স্বাধীনতার জন্য তারা কতটা মুখিয়ে থাকে। তারা এমন সব ভয়ংকর রাইডগুলোতে চড়ছিল, যাতে আমি উঠতে গেলেও দুইবার ভাবব। আমরা সেই ভয়েই হয়তো সেদিকে গেলাম না।

আমরা কেনাকাটা করতে গেলাম। বিভিন্ন ঘরোয়া জিনিষপত্র, কাপড়, জুয়েলরিতে ভরপুর। বিভিন্ন দেশের স্টল ছিল। তুর্কিদের গহনার কাজ, কার্পেট অনেক ভালো লাগল। শাকিলা চমৎকার দেখে একটা ব্রেসলেট কিনে ফেলল। একজায়গায় দেখলাম সাঈদ কি জানি দেখছে। কাছে গিয়ে দেখি এক ইন্ডিয়ান স্টলে কাশ্মিরি শাল ও জুতা বিক্রি হচ্ছে। শালের কাজ দেখে মুগ্ধ হতে হয়। ঠিক করে ফেললাম যত দামই হোক কিনতে হবে। অনেক দামাদামির পর ১৫০ রিয়াল করে শাল কিনলাম। জুতাগুলো অনেক আভিজাত্যপূর্ণ। শাকিলা দুই জোড়া জুতা ৫০ রিয়াল করে কিনে ফেলল। বাকীরাও শাল কিনে আনন্দচিত্তে বাড়ী ফিরল।



পরের সপ্তাহে মক্কা গেলাম ওমরাহ করতে। সেখানে এক ব্র্যান্ডের দোকানে দেখি একই শাল ৪২৫ রিয়ালে বিক্রি করছে। মক্কা থেকে ফিরে এসেই আবার মেলায় গেলাম। সাথে শাকিলা ও মাহমুদ ভাই আছেন।



মেলায় ঢুকতেই সৌদি মেয়েদের চিৎকারে কান ঝালাপালা। তারা নৌকার মতো একটা রাইডে উঠে ‘V’ চিহ্ন দেখাচ্ছে। কেউ কেউ সেলফিও তুলছে। ওখানে উঠার চিন্তা করতেই ভয় পেয়ে গেলাম। মেয়েদের সাহস দেখে অবাক হতেই হল। নৌকার দু’পাশই একটা সময় সোজা ৯০ ডিগ্রি খাড়া হয়ে যায়। মাথার শেষ মেয়েটি সেখান থেকে চিৎকার করতে করতে ‘V’ চিহ্ন দেখাচ্ছে। খুব মন চাইল একবার উঠে দেখি।


ছবিঃ ইন্টারনেট

ভয়কে জয় করে মাহমুদ ভাইকে জোর করে সাথে নিয়ে রাইডটিতে উঠে বসলাম। আমরা দু’জন মোটামুটি নৌকার শেষ মাথায়। আমার সামনে এক সৌদি ছেলে হেলাফেলায় ৩টা সিট নিয়ে অর্ধশোয়া , যেন এইসব রাইড কোন ব্যাপার না ! আস্তে আস্তে নৌকা নড়তে শুরু করল। স্পিড কম, ভালোই লাগলো। আমারা দু’জনেই সৌদিদের সাথে গলা মেলালাম, চিৎকার করলাম। নীচে অপেক্ষারত শাকিলাকে হাত নেড়ে দেখালাম- ভালোই লাগছে। কিন্তু হঠাৎ করেই স্পিড বেড়ে গেল, নৌকার মাথা উঠতে উঠতে মনে হলো আসমানে গিয়ে ঠেকল। তারপর মনে হল- কেউ যেন উপর থেকে আমাদেরকে নীচে ফেলে দিয়েছে। ভয়ংকর গতিতে নীচে নেমে আসছি, পেটের ভেতর শূণ্য মনে হল। আমার দু’ পা ঠকঠক করে কাপছে। তারপরও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছি- নীচ থেকে শাকিলা দেখছে, সামনের সেই সৌদি এখনো অর্ধশোয়া যেন কিছুই হচ্ছে না। পাশেই আরেক সৌদি সেলফি তুলছে- বয়েস আমার অর্ধেক হবে, এতো সাহস? আমার তখন মাহমুদ ভাইয়ের দিকে তাকানোর সময় ছিল না, নিজেকে সামলানো নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। দেখতে পেলাম নৌকার আমাদের পাশের মাথাটি আবার নীচ থেকে উপরের দিকে উঠছে। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। মাহমুদ ভাইয়ের দিকে ফিরে কেবল বলতে পারলাম- কখন থামাবে? উনি তখন দাত মুখ খিচিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। এভাবে পাঁচ মিনিট ধরে আমার সাহসী হার্ট নিয়ে নৌকাটি তামাশা করল। রাইডটি বন্ধ হতেই দৌড়ে নীচে নামলাম। শাকিলা আমার সাহসীকতার জন্য বাহবা দিল, আমিও আমার পা ঠকঠকানির কথা গোপন রাখলাম। এতক্ষন পর মাহমুদ ভাইয়ের দিকে ভালোভাবে তাকানোর সুযোগ পেলাম। ওনার মুখখানি পাংশু হয়ে গিয়েছিল। উনি সব অকপটে স্বীকার করলেন- ‘ভাই, এত ভয় জীবনে পাই নাই। আমার দুই পা কাপতে কাপতে শেষ।’ আমি কাষ্ঠ হাসি দিয়ে ইন্ডিয়ান দোকানে শাল কিনতে চললাম।

ইন্ডিয়ান দোকান থেকে আরো কয়েকটি কাশ্মিরি শাল কিনলাম। মাহমুদ ভাইও কিনলেন। ফেরার পথে একটু আনন্দ পেতে সার্কাস রুমে ঢুকি। এই প্রথম এধরনের সার্কাস দেখা, আগে শুধু টিভিতেই দেখেছি। মোটামুটি ভালো সময় কাটল। আনন্দ ভয়ের মিশ্র অনুভুতি নিয়ে রাত বারটায় বাসায় ফিরলাম।



এরপর আরো কয়েকবার মেলায় যাওয়া হয়েছে। আমাদের সাথে অনেকেই গেছেন শুধুমাত্র শাল কেনার জন্য। ভুলেও রাইডগুলোর পথ মাড়াইনি।

পরেরদিন মাহমুদ ভাই বলেছিলেন- রাতে ওনার নাকি ভালো ঘুম হয়নি। সারারাত নৌকাটি তাকে তাড়া করে ফিরছিল- একবার উঠছেন, একবার নামছেন......।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩৮
৪টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×