এক.
কলিং বেলটা কে যেন চেপে ধরে রেখেছে আর সেই কখন থেকে কর্কশ স্বরে গান গেয়ে জানান দিচ্ছে কোন এক মহারথী আসিয়াছেন দোয়ার খোল! দোয়ার খোল! মেজাজ খারাপের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে আবার এই কাকভোরে বিছানা ছেড়ে উঠতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। বউ এর অভাবটা এই মুহূর্তে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ব্যাটা তো দেখছি নাছোড়বান্দা, একেবারে কচ্ছপের কামড়! দরজা খোলতেই হবে মনে হচ্ছে। কে হতে পারে? চোর-ডাকাত না তো? আরে ধুর! চোর নিশ্চয় কলিং বেল টিপে চুরি করতে আসবে না, আর ডাকাত! ছ্যা! অভিজাত শ্রেণীতে উত্তরণ ঘটবে রাতারাতি। পাড়ার লোক আঙ্গুল তুলে বলবে, “দেখ দেখ এর বাসায় না দিন কতক আগে ডাকাত পড়েছিল!” তবে কি ভিক্ষুক? আজকাল কি ভিক্ষুকরা ফজরেরে নামাজের আগেই এক খেপ মেরে নেয় না কি? নানান কুচিন্তা করতে করতে বা হাতে লুঙ্গির গিঁটটা আলতো করে ধরে বিছার উপর সটান দাঁড়ালাম, চোখ বন্ধ করে কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছি; হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়, নিশ্চয়! নিশ্চয় সে! ভাগ্যিস গিঁটটা ধরে রেখেছিলাম না হলে আর্কিমিডিসের ইউরেকা হয়ে যেত। লাফিয়ে উঠে একে একে ঘরের সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে চুপ পেরে বসে আছি, দরজায় ধাক্কাও কমে এসেছে, কলিং বেলও আর বাজছে না; হঠাৎ ভীষণ চমকে দিয়ে নচ্ছার মোবাইলটা বেজে উঠল।
কাঁপা কাঁপা হতে মোবাইলটা তুলে নিলাম; খাস্তগীরের নাম্বার অনেক আগেই মুছে দিয়েছিলাম কিন্তু সাক্ষাৎ জমে মত এই নাম্বার কি আর ভুলে থাকা যায়, এক নজরেই চিনতে পারলাম; ধরবো কি ধরবো না ভাবতে ভাবতে কি মনে করে ধরেই ফেললাম। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খাস্তগীর বলে উঠল, “ঘরের বাতি নিভিয়ে লাভ নেই, আমি জানি তুই বাসায় আছিস, আমার লাইফ স্ক্যানারে দেখাচ্ছে তোর বাসায় একটা মাত্র জীবিত প্রাণী আছে।”
আরে ঐটা তো আমার বউও হতে পারে, বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না; হঠাৎ মাথায় টং করে উঠলো, বদমাইশটা লাইফ স্ক্যানার সাথে করে নিয়ে এসেছে এখানে! ইচ্ছে করছে লাইফ স্ক্যানার তোর, বল্গাহীন চিন্তা বেশি দূর এগোতে পারল না তার আগেই সে বলে উঠল, “লাইফ স্ক্যানারে দেখাচ্ছে পুরুষ লাইফ; তাই এটা তোর বউ হতেই পারে না, তোর বউ নিশ্চয় রাতারাতি পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়নি! বেটা জলদি দরজা খোল খুবই জরুরী পরিকল্পনা আছে তোকে নিয়ে”। হতচ্ছাড়াটা কি সাথে করে থট-রিডারও নিয়ে এসেছে না কি? এই পাগলের পক্ষে অসম্ভব নয় কিছুই।
দরজা খুলে বিস্ময়ে মুখখানা হা হয়ে গেল মুহূর্তেই, এ কী বেশ ধরেছে সে? মাথায় ইংলিশ হ্যাট, কম করে হলেও পাঁচ জোড়া বিশাল বিশাল পকেট সমৃদ্ধ বড় কলারের খাকি রং এর হাফ হাতা সার্ট, কালার ম্যাচিং করে থ্রী-কোয়াটার ঢোলা প্যান্ট, গলায় বাইনোকুলার জাতিয় কিছু একটা ঝুলানো, পায়ে গাম বুট, কাঁধে বিশাল আকৃতির ট্র্যাভেল-ব্যাগ; পুরাই পাঁচ ফুটি সাহেব; এ দেখি “চন্দ্র সূর্য অস্ত গেল, জোনাকি ধরে বাতি; মোগল পাঠান হদ্দ হল ফারসি পড়ে তাঁতি”।
-- “কাল বিলম্ব না করে এখনি রেডি হয়ে নে, তোকে নিয়ে সুন্দরবন যাব”, এমন ভাবে বলল যেন ভোরের আলো ফোটার আগে আচমকা কারও বাসায় এসে তাকে ধরে সুন্দরবন নিয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা, অহরহই ঘটছে। ইচ্ছা হচ্ছে পশ্চাৎ দেশে কষে একটা লাথি মেরে ফাজিলটাকে এখনি সুন্দরবনে পাঠিয়ে দেই, যা শালা পারলে এবার বাঘের লাইফ স্কেন কর গিয়ে।
তুই সুন্দরবনে যা, ইচ্ছে হলে আফ্রিকার জঙ্গলেও ঘুরে আসতে পারিস, বেশি সখ হলে আমাজনের তিহিমিরিমাদের সাথে উলুউলু কর কিন্তু আমাকে টানছিস কেন? কিছুটা নিঃস্পৃহ কণ্ঠে বললাম;
-- ঝামেলা পাকাস না তো! আজ থেকে তিন দিন সব অফিস বন্ধ, ভাবীও বাপের বাড়ি গেছে, অনেক দিনের ইচ্ছে প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে সুন্দরবনে একটা ঢুঁ মারবো। কোন চিন্তা করিস না, যাবতীয় খরচ আমি দেব।
সুন্দরবনে কেউ ঢুঁ মারতে যায় সেট জানা ছিল না, কিন্তু কি করে বোঝাই? তিন দিন ছুটি একাকী অকুণ্ঠ উপভোগ করার জন্যেই তো কৌশলে বউকে শশুড় বাড়ি পাঠিয়েছি! অবশ্য এখন পাপমোচন হচ্ছে নিশ্চিত, আগে যদি জানতাম এই আপদ এসে জুটবে তাহলে কি আর এই তল্লাটের ত্রিসীমানায় থাকি? কবেই ফুড়ুৎ! কিন্তু খরচের কথা বলে খাস্তগীর আমার মধ্যবিত্তের সবচেয়ে দুর্বল স্থানে আঘাত হেনেছে, পিছিয়ে আসার আর কোন পথ খোলা নেই। বিনে খরচে দুতিন দিন বেড়িয়ে আসা যাবে তাও সেই সুদূর সুন্দরবনে! হাল ছেড়ে দেওয়ার মত করে কাষ্ঠ কণ্ঠে বললাম, “ঠিক আছে, তোর এতই যেহেতু দরকার আমাকে, আর কি না করতে পারি? কিন্তু হঠাৎ কর সুন্দরবন কেন?”
-- “আরে তেমন কিছু না, শুধু একটু বোটানির বোটা ধরে একটু টানাটানি করব আর কি”, চোখের ভুল কি না জানি না, এক চিলতে মুচকি হাসি ঠোটের কোণায় খেলে গেল খাস্তগীরের। বিধাতাও মনে হয় মুচকি হেসেছিলেন আমার ভবিতব্য দেখে; একটা টিকটিকিও ঠিক এসময় ডেকে উঠল। কুলক্ষণ।
বোটানি! মানে?
-- আরে সুন্দরবনের শতশত বছরের উদ্ভিদগুলোর উপর একটু এক্সপেরিমেন্ট করব। তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না, শুধু খাবি দাবি ফুর্তি করবি, এই তো!
কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে আমি রেডি, খাস্তগীর দেখি চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তুই তো দেখছি সম্পূর্ণ ঘরটাকেই সাথে নিয়ে যাচ্ছিস, তাহলে আর গৃহত্যাগের মানে কী? আরে বন্ধু, প্ল্যাটোর মত মিতব্যয়ী হও, পিথাগোরাসের মত সংযমী হও; এত বাক্স পেটরা সাথে নেয়া যাবে না, একান্ত অপরিহার্য ছাড়া বাকী সব কিছুই হল বোঝা। শুধু ছোট একটা ব্যাগ নিতে পারবি।
কি আর করা, তাহাই সই। প্ল্যাটো কিংবা পিথাগোরাসের কেমন ছিলেন জানিনা কিন্তু আমাকে আজ অনেক কিছুই বর্জন করতে হবে নিশ্চিত। অবশ্য অন্তঃনিহিত কারণটা টের পেলাম ঘর থেকে বের হয়েই। খাস্তগীর আমার পিঠে মুটামোটি সের তিরিশেক ওজনের একটা বোঝা চাপিয়ে হাতে আরেকখানা সের বিশেক ওজনের ব্যাগ গছিয়ে দিয়ে নিজেও আরও তিনটা ব্যাগ তুলে খাস্তগীরীয় রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, “চল”।
দুই.
মংলাবন্দর থেকে ছোট খাট ইউট টাইপের একটা লঞ্চ ভাড়া করলাম চার দিনের জন্য, উদ্দেশ্য বনের ভেতর খাল বিল নালা দিয়ে গভীর বনে বনে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু আমার মন বলছে হতচ্ছাড়াটার অন্য উদ্দেশ্য আছে; চার দিনের কথা শুনে কিছুটা চমকে উঠলাম! বন্ধু, আমার তো তিন দিনের ছুটি, অফিস কামাই করতে হবে তো?
-- দুধের শিশুর মত কথা বলিস না তো! দিন কতক অফিস কামাই করলে কিছু যায় আসে না। আর কি কাজ করিস সেটা তো ভালোই জানি। দিন কয়েক অনুপস্থিত থাকলে তোর চেয়ারটার নিচে যে নরম সরকারী তোয়ালেটা আছে সেটা ছাড়া আর কেউ বুঝতেই পারবে না যে তুই নেই।
খাস্তগীরের কথায় কিছুটা আস্বস্ত হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন এসে হাজির, মাথায় সাদা রঙ এর জাহাজি ক্যাপ, পুরু গোঁফ, চোখে কাল সানগ্লাস পড়নে ঢিলাঢালা স্টাইপের পাজাম, চেহারায় মিষ্টি আলু মিষ্টি আলু একটা ভাব আছে। হঠাৎ এমন কেন মনে হলো? মিষ্টি আলু না হয়ে গোল আলু হলেই বরং বেশি মানানসই হত। চেহারার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার চোখ, গরুর মত বড় বড় চোখ কিন্তু ঝলমল করছে, হাসছে যেন, হাসন্ত চোখ। “স্যার, আমি হলাম এই পঙ্খিরাজের ক্যাপ্টেন, খালি টাইট হয়া বইসা থাকবে; দেখবেন কেমনে উড়ায়া লইয়া যাই”। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, বাবা তোমার উড়িয়ে উড়িয়ে লঞ্চ চালানোর দরকার নাই; ঠিকঠাক মত জলের উপর চললেই হলো; দয়া করে শুধু ডুবু জাহাজ বানিয়ে দিও না।
-- এই যে তুমি বললে পঙ্খিরাজের মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে শুনতে যতোই উদ্ভট মনে হোক না কে বাস্তবে কিন্তু খুবই সম্ভব। তুমি যদি ভেবে থাক ‘রাইট ব্রাদার্স’ উড়ার মূলনীতি আবিষ্কার করেছে তাহলে ‘ইউ আর নট রাইট’। মূলনীতি দিয়ে গিয়েছেন আর্কিমিডিস সাহেব। উনি বলেছেন, “প্লবতার মান যদি বস্তুর ওজনের চেয়ে বেশি হয় তাহলে বস্তুটি তরলের মধ্যে ভেসে থাকবে”। আসলে এটাই হলো উড়োজাহাজের মূলনীতি। এখানে যদি বাতাসকে তরল ধরি, আর কোনভাবে যদি বস্তুর ওজন প্লবতার চেয়ে কমিয়ে ফেলতে পারি তবে যেকোনো বস্তুকেই আকাশে ভাসিয়ে দেওয়া সম্ভব। দম নেওয়ার জন্য একটু থামে খাস্তগীর।
চোখ ছানাভরা হয়ে গেছে ক্যাপ্টেনের। নিশ্চয় ভাবছে সে, এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা। দীর্ঘ এই লেকচারের ফলে উপকার হয়েছে যে আগামী কয়েকটা দিন সে ভুলেও আর খাস্তগীরকে ঘাঁটাবে না। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই হাড়ে হাড়ে টের পেলাম কি ভুলই না ভেবেছিলাম। ক্যাপ্টেন সাহেব এখন খাস্তগীরকে না ঘাটিয়ে আমাকে ঘাঁটাচ্ছে, ঘাঁটাচ্ছে বলতে একেবারে ঘুঁটাচ্ছে।
- বুঝছেন ছ্যার, এক বার হইল কি, পঙ্খিরাজ নিয়া ডাকাতিয়া বিল দিয়া যাইতেছি। এই সময় পড়ল ডাকাইত। বিলের মাঝখানে আমি আর দুইদিকের দুই খাড়ি দিয়ে গুল্লি করতে করতে আমার দিকে আগায়া আইতাছে ডাকাইতে ইঞ্জিনের নাউ। এক সেকেন্ড ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলাম, ডাকাইতের মাইরে-বাপ, আমারে চিনে নাই; বিপদের সময় আমার মাতা ডীপফ্রীজ হয়া যায়, এই সময় মাতার উফরে পানি রাখলে আইসক্রিম হয়া যাইবও, বলেই হা হা হো হো করে ডাকাতের মতোই হাসতে লাগল শরফুল্লাহ। দাঁতগুলো হলুদ আর মাড়ি কুচকুচে কালো, ভয়ংকর সে হাসি।
কি উদ্ভট নাম, আকবরে শরফুল্লাহ! নামের মধ্যেই ডাকাত ডাকাত গন্ধ! আল্লাই জানে কি বিপদে পড়তে যাচ্ছি, দেখা যাবে গভীর বনে আমাদের পুতে রেখে সবকিছু নিয়ে ভেগেছে। মুহূর্তে ভয়ের ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি গুড়গুড় করে উঠে পেটের ভেতর।
- একবার চিন্তা করেন ছ্যার, আমি চলতাছি সোজা, আর দুই দিক থেকা দুইড়া ইঞ্জিনের নাউ কইরা আইতাছে ডাকাইত। কি বিপদ! এই বিপদে সবাই যা করে আমি সেগুলার ধারে কাছেও গেলাম না। সবাই করে গিয়া যেমনে যাইতেছিল তেমনেই সোজা যাইতে থাহে খালি স্পীড আরও বাড়ায়া দেয়। আরে আহাম্মক, তুই স্পীড বাড়াইলে কি ডাকাইত বইসা বইসা আলু-পুরী খাইব? আমি করলাম কি...
ডাকাতের গল্প শুনতে ভালো লাগছিল না, প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য বললাম, শরফুল্লাহ, “বনে বাঘ ভাল্লকু নাই?”
-- কি যে কননা ছ্যার! ভাল্লুক থাকবো কৈ থিকা? সুন্দর বনে আছে খালি বনের রাজা বাগ! আরে বাইসরে বাইস! কি বাগ, বাঙ্গাল বাগ যারে কয় আর কী! মানুষ কি এমনি এমনিই কয় “বাগা বাঙালি”। একাবার হইল কী শুনেন। তহন আমার ভরা যৌবন, সুন্দর বনে একলা একলা ঘুইরা বেড়াই, ভয় ডর বইলা দুনিয়ায় কিচ্ছু নাই। হঠাৎ আজরাইলের মত সামনে আইসা খাঁড়াইলও এত্ত বড় একটা চিতা বাগ, বলেই যে দুই হাত প্রসারিত করে বাঘের সাইজ দেখানোর চেষ্টা করল।
সুন্দর বনে চিতা বাঘ আছে কি না আমার জানা নাই, তবে এটা বুঝলাম দুনিয়ার সবকিছু নিয়েই শরফুল্লাহর একটা করে বীরত্বের গল্প আছে। তার কথা শুনার আগ্রহ উবে গেল।
-- শ্রোতার দিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ নেই ক্যাপ্টেন সাহেবের, সে তার যৌবনের বীরত্বের গল্প বলে যেতে পারলেই খুশি। বাগের সামনে পড়লে বেশি ভাগ মানুষই হাইগা মুইতা প্যান্ট ভাসায় ফালায়, তারপর মারে খিঁচ্ছা দৌড়। এখানেই হইলো সবচেয়ে বড় ভুল। আরে বেক্কল! তুই কি মোহাম্মদ আলী না কী যে বাগের লগে দৌড় লাগাবি? আগেই তো কইছি বিপদের সময় আমার মাতা ডীপফ্রীজ হয়া যায়; আমি করলাম কি, চোখ পাক দিয়া বাগের চোখের দিকে তাকায়া থাকলাম। দেখি বাগও আমার দিকে বড়বড় কইরা চায়া আছে, এক নজরে তাকায়া আছি তো আছিই; কতক্ষণ তাকায়া আছি মনে নাই হঠাৎ দেখি বাগ অজ্ঞান হয়া পইড়া গেল। শালার বাগ আমারে চিনে নাই, তুই যদি চিতা হস আমি হলাম মিতা, তুই যদি বাগ হস আমি হলাম মাগ।
এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে শরফুল্লাহর চোখে তাকাতে হবে না এমনিই অজ্ঞান হয়ে যাব আর এটা নিয়ে সে নতুন কোন গল্প ফাঁদবে। ব্রিজ থেকে বের হয়ে চলে গেলাম বড় হল রুমের মত ফাকা জায়গাটাতে, সেখানে খাস্তগীর সব বাক্স-পেটরা খুলে ঝাঁকিয়ে বসেছে। পাশে বসতে বসতে বললাম, “দোস্ত বনে তো শুনেছি ডাকাতের বেশ উপদ্রব, বাঘটাঘও নাকি আছে।”
-- “আরে ধুর, এগুলো নিয়ে মোটেও চিন্তার করবি না। চিন্তার দায়িত্ব আমার, তুই শুধু দেখে যাবি। নে কানে এটা লাগিয়ে দেখ সব ঠিক আছে কিনা”, বলেই আমার দিকে হেডফোনের দুটি মাথা বাড়িয়ে দিল সে।
কি দেখে যাব বুঝতে পারলাম না, বদমাইশটা আমার উপর কোন এক্সপেরিমেন্ট করার পরিকল্পনা করছে না তো? কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলাম। দ্বিধান্বিত হাতে হেডফোনের মাথা দুটি কানে গুজে দিলাম। মিষ্টি মৃদু মেয়েলি স্বরে একটা গান, রবীন্দ্রসংগীত। মনোযোগ দিয়ে শুনছি, ভালোই লাগছে,
“আমার সকল দুঃখের প্রদীপ
জ্বেলে দিবস, গেলে করবো নিবেদন
আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন” – মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল যেন! গানটার মধ্যে অন্যরকম কিছু একটা আছে, খুব ধীরে ধীরে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে মনে হলো। খাস্তগীরের দিকে তাকিয়ে দেখি হাতে স্টপ ওয়াচ, আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কোথা থেকে বিষণ্ণতার একটা আবেশ ঝেঁকে বসল মনজুড়ে। তীব্র তিতকুটে একটা স্বাদ অনুভব করলাম গলার কাছে, আচমকা।
“যখন বেলা শেষের ছায়ায়
পাখিরা যায় আপন কুলায় মাঝে
সন্ধ্যা-পূজার ঘণ্টা যখন বাজে
তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন
আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন” – হঠাৎ করে নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগল, দুঃখের একেকটা পর্বতসম ঢেউ যেন হৃদয়ে আছড়ে পাছড়ে পড়ছে মুহূর্মুহ। অনেক দূরে কে যেন পূজার ঘণ্টা বাজাচ্ছে টুংটাং টুংটাং, ধূপের মাতাল গন্ধও নাকে এসে বাড়ি দিচ্ছে যেন! কি হচ্ছে কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না, লঞ্চের মধ্যে ধূপ জ্বালাবে কে? পূজাই বা করবে কে? খস্তগীরকে কিছু একটা বলতে যেয়ে দেখি গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না! কথা বের হচ্ছে না, না কী কি বলছি তা মস্তিষ্ক অনুধাবন করতে পারছে না?
“অনেক দিনের অনেক কথা
ব্যাকুলতা , বাঁধা বেদন ডোরে
মনের মাঝে উঠেছে আজ ভরে” – হঠাৎ করেই যেন ভেঙে গেল সংযমের বাঁধ, হুহু করে কেঁদে উঠলাম; অব্যক্ত জমানো কথা যেন কান্না হয়ে কামানের গোলার মত ফুড়ে ফুড়ে বের হয়ে আসছে, একেবারে হাউমাউ বিলাপ করে কান্না! কতক্ষণ ধরে কাঁদছি বুঝতে পারছি না, সময়ও যে তার আপেক্ষিক রূপ দেখাতে শুরু করেছে।
"যখন পূজার হোমানলে
উঠবে জ্বলে একে একে তারা
আকাশ পানে ছুটবে বাঁধন হারা
অস্তরবির ছবির সাথে মিলবে আয়োজন
আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন" - যেমন হঠাৎ করে এসেছিল তেমন হঠাৎ করেই যেন উধাও হয়ে গেল মনে সব দুঃখ। হালকা লাগছে। নিজেকে পাখি পাখি মনে হচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পেলাম বরফ ঢাকা এক পর্বতের চারপাশ দিয়ে ডানা মেলে বাজ পাখির মত উড়ে যাচ্ছি, সে এক ভয়ংকর উত্তেজনাময় অনুভূতি। হঠাৎ করেই সাদা বরফের মধ্যে নানান জাতের রং উদ্ভাসিত হয়ে উঠল! রঙগুলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে, আলোক ছটা ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছে যেন। সে যেন রং এর এক অপার্থিব খেলা! এর সৃষ্টি পৃথিবীতে হতেই পারে না! পৃথিবীর কোন মানুষের চোখ এই রং দেখার জন্য তৈরি হয়নি। তারপর! হঠাৎ বমি। একেবারে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে আসছে যেন! জ্ঞান হারালাম।
ভোরের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল, ভীষণ দুলছিল সে সময় লঞ্চটি। মাথাটা কেমন যেন ভারভার লাগছে, হঠাৎ রাতের কথা মনে পড়ে গেল, কি হয়েছিল? দুঃস্বপ্ন? না তো! স্বপ্ন কি এত জীবন্ত হতে পারে? খাস্তগীরের কোন এক্সপেরিমেন্ট? হারামজাদা! ও তো বলেছিল বোটানি নিয়ে কি যেন পরীক্ষানিরীক্ষা করবে এখন দেখছি আমাকে গিনিপিগ বানিয়ে ছেড়েছে! বদমাইশটা কি আমাকে বৃক্ষ ভেবেছে? না কী বোটানি আর জুলোজির পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেছে? বিছানা থেকে নামতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠল কোন রকমে টেবিলের কোণা ধরে চিৎপটাং থেকে রক্ষা করলাম নিজেকে।
-- হাসি হাসি মুখে খাস্তগীর রুমে ঢুকল হাতে নাস্তার প্লেট নিয়ে। কি ঘুম ভাঙ্গল তাহলে?
কী করেছিস তুই আমাকে? ধপ করে বিছানায় বসেই চিৎকার করে উঠলাম।
-- আরে উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। তোকে দিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটা একটু ঝালাই করে নিলাম। পরীক্ষা শতভাগ সফল হয়েছে, একত্রিশদন্ত (কলেজে থাকা কালিন তার একটি দাঁত পরপারে পাড়ি জমিয়েছিল, সেই এক ইতিহাস বটে। পরের কোন এক লেখায় সেটা উল্লেখ থাকতে পারে) বিকশিত হাসি তার মুখ জুড়ে। এখন আমরা বনে বাদাড়ে বিনা বাঁধায় মন মত ঘুরে বেড়াতে পারব। নে নাস্তাটা খেয়ে নে, সামনে অনেক কাজ বাকী পড়ে আছে। আর শোন, আমাদের আসল পরিচয় কিন্তু ভুলেও কারও কাছে খুলাসা করবি না। আমরা যে এক্সপেরিমেন্টে এসেছি ক্ষুণাক্ষরেও যেন কেউ টের না পায়। অপাত্রে এই টেকনোলজি পড়লে পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে যাবে, আমরা দুই বন্ধু শুধু মাত্র অবসর কাটাতে এসেছি বুঝতে পেরেছিস?
নিজের অজান্তেই মাথা নাড়ালাম, ভালোই ভালোই বাড়ি পৌঁছে নেই, তোর এক্সপেরিমেন্টের খায়েশ যদি চিরতরে না ঘুচিয়েছি! হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে বসে আছি, ভয় হচ্ছে এটাতেও কোন এক্সপেরিমেন্ট আছে কি না কে জানে?
-- যেন আমার মনে কথাটা ধরতে পেরেছে খাস্তগীর, আরে ভয়ের কিছু নেই এটা একেবারে ফ্রেস নাস্তা, আমি নিজ হাত বানিয়ে এনেছি।
আরে ব্যাটা, তুই নিজ হাতে বানিয়েছিস এখানেই তো আমার ভয়! মনে মনে ভাবলাম। চোখ এখনো সন্দেহে কিছুটা কুচকে আছে, আলতো করে এক টুকরো ব্রেড মুখে পুরতে পুরতে জিজ্ঞেস করলাম, “কাল কি হয়েছিল?”
-- আর বলিস না, তোর উপর ডোসটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, যাক এবার মাত্রাটা বুঝতে পেরেছি পরের বার আর ভুল হবে না।
ভিমড়ি খেয়ে মুখ থেকে খাবার প্রায় পড়ে যাচ্ছিল! মানে? আবারও? এক্কেবারে খুন করে ফেলব হারামজাদা। নিজের কণ্ঠে নিজেই চমকে উঠলাম।
- -আরে উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? তোদের মত নবিসদের নিয়ে যত ঝঞ্ঝাট! তোর উপর তো এক্সপেরিমেন্ট হয়েই গেছে আবার করার কি দরকার? আর বুঝার চেষ্টা কর এটা করেছি তোর ভালোর জন্যেই। তোর ডোজের পরিমাপ করার জন্য এটা জরুরী ছিল। এখানে আসার আগে আমি নিজের উপরেও এই এক্সপেরিমেন্ট করেছি। এটা আসলে আমাদের ডিফেন্স ম্যাকানিজম। পরে তোকে সব খুলে বলব। দেরি না করে তৈরি হয়ে নে, অনেক কাজ বাকি।
তিন.
বনের ভিতর দিয়ে হেটে যাচ্ছি, দুজনের পিঠেই বিশাল আকৃতির ট্রাভেলিং ব্যাগ, নানান অকাজের জিনিসে ঠাসা, কি জানি! আমার কাছে অকাজের মনে হলেও নিশ্চয় জরুরীই হবে। একেক জনের প্রয়োজন একেক রকম, প্রয়োজন ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। বাহ! এভাবে ভাবতে পেরে নিজেকে বেশ দার্শনিক দার্শনিক মনে হচ্ছে। নিশ্চয় বনের প্রভাব। গভীর বনে এক জায়গায় এসে চারদিকটা পর্যবেক্ষণ করে খাস্তগীর জানালো এটাই তার কাঙ্ক্ষিত জায়গা। তাকিয়ে দেখি চারদিকে অসংখ্য গাছ, বিশাল বিশাল গাছ, কিছু গাছ বেশ বয়স্ক মনে হল, তিন চারশো বছরের পুরানো হতে পারে বা আরও বেশি, কিছু গাছ নতুনই মনে হচ্ছে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের মত। ঘন বন, গা ছমছম করেছে। কিছুটা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললাম, “এখানে? আর ইউ সিউর?”
-- “শতভাগ, খাস্তগীর সিউর না হয়ে কোন কাজে হাত দেয় না।”, কণ্ঠে তার কর্তৃত্ব স্পষ্ট। অবশ্য সব এক্সপেরিমেন্টের আগেই তার আত্মবিশ্বাস থাকে তুঙ্গে, সমস্যা বাঁধে এক্সপেরিমেন্ট শেষ হওয়ার পর।
বনে ঢুকার পর থেকেই দোয়া দুরুজ পাঠ শুরু করেছি, আল্লাহ আল্লাহ করে আস্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরতে পারলে একটা ছাগল ছদকা দিব মানত করেছি। যে আপদ নিয়ে আছি এক ছাগলে কি হবে? মনে হয় এক হালির নিচে উদ্ধার পাওয়ার যাবে না। চারদিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে শুকনো একটা ঢোক পেটে চালান করে দিয়ে পিঠ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে নিলাম। পরবর্তী ঘণ্টা তিনেক খাস্তগীর চরকির মত ঘুরেছে বেশ কিছু জায়গা জুড়ে, কাজের মধ্যে প্রায় একশ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বসিয়েছে কয়েকটা বড়বড় স্পিকার, আর বেশ কয়েকটা গাছের বাকল ছিলে তারমধ্যে লাগিয়েছে অদ্ভুত দর্শন কিছু ডিভাইস।
-- এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে মৃদু হাঁপাচ্ছে খাস্তগীর, একটু দম নিয়ে বলল, “এবার আমরা পুরাই নিরাপদ, আমাদের আশেপাশে বাঘ তো দুরের কথা, একটা ইঁদুরও ঘেষতে পারবে না”
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, এই স্পিকার দিয়ে কি তুই হিন্দি সিরিয়াল চালাবি নাকি যে বাঘ দৌড়ে পালাবে?
-- কি যে বলিস না? তোকে দেখলে বুঝা যায় আমাদের দেশ কেন এখনও বিজ্ঞানে শত বছর পিছিয়ে আছে। তুই হলি গিয়ে আমাদের সাইন্সের পশ্তাৎপদতার প্রতিনিধি।
খোঁচাটা আলতো করে গিলে ফেললাম, খাস্তগীরের এই ধরনের কথার সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। মনে মনে বললাম, আরে তুই না হয় বিশাল বিজ্ঞানী টিজ্ঞানী হয়ে গেছিস তাই বলে কি সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে হবে? জিজ্ঞাসু নয়নে গোবেচারা ভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম তারদিকে।
-- খাস্তগীর নিজের মনে ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে, তার লেকচার শুরু হয়ে গেছে আর কোন চিন্তা নেই এবার সে হড়বড় করে সব উগড়ে ফেলবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। “হিন্দি সিরিয়াল চালালে বাঘ আরও ঝেঁকে বসবে, জানিস তো বাঘ আর বৌ এ দুয়ের তফাৎ যৎসামান্যই। আর তুই এই সাধারণ ব্যাপারটার কিছুই বুঝিসনি কেন সেটাই আমার পরবর্তী গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত। তোর নিউরনে মনে হয় কিছু সমস্যা আছে, কেটেকুটে দেখতে হবে। মদ খেয়েছিস কখনো?”
মেজাজ চটে যাচ্ছিল, মনের উপর জোর খাটিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখলাম। অপ্রত্যাশিত এই প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম, সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে জানালাম এই জিনিস চেখে দেখিনি কখনো।
-- ব্রেনের চারটা অংশ; স্যারেব্রাল কোর্টেক্স, কোর্পাস ক্যাল্লোসাম, স্যারিবিলাম ও হাইপোথ্যালামাস। এগুলো থেকে সিগনাল ব্রেন-স্টিমের মাধ্যমে সমগ্র দেহে প্রবাহিত হয়। আমাদের রক্তে যখন এলকোহলের মাত্রা বাড়তে থাকে তখন একে একে ব্রেনের এই অংশগুলো আবেশিত হতে থাকে। এর ফলে আমাদের হিতাহিত জ্ঞান, লজিক, অনুভূতি সব লুপ্ত হয়ে পড়ে। এখন রক্তে এলকোহল না দিয়ে যদি ব্রেনের এই নির্দিষ্ট অংশে এলকোহলিক স্টিমুলেশন দেওয়ার যায় তাহলে একই ফল পাওয়া যাবে। আমি কতগুলো ডিজিটাল মিউজিক এর ব্যাকগ্রাউন্ডে এমন কিছু এলকোহলিক স্টিমুলেশন সিগনাল সুপার-ইমপোজ করেছি, কাল তোকে যে রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়েছিলাম সেটা এমনই এক ডিজিটাল এলকোহল। একদিক দিয়ে বলা যায় হালাল মদ, হা হা হা।
ভিমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম প্রায়! আমার কথা আটকে আসছিল, কোন রকমে বললাম, “কী! ডিজিটাল মদ?”
-- এত অবাক হওয়ার কি আছে? তোকে তো হাতেনাতেই দেখিয়ে দিলাম সবকিছু!
কিন্তু এটা আমাদের প্রতিরক্ষা হিসাবে কিভাবে কাজ করবে?
-- আরে এটা এতক্ষণেও বুঝিস নি? যখনই দেখব বাঘ ভাল্লুক কিছু এসে হাজির তখনই স্পিকারগুলোতে ডিজিটাল এলকোহল চালিয়ে দেব। আর দেখতে না দেখতেই সবগুলো মাতাল হয়ে যাবে। আমাদের আক্রমণ করা তো দূরে থাক, দেখা যাবে আমাদের পিঠে চড়িয়ে ধাই ধাই করে নাচছে।
ডিজিটাল মদ খেয়ে মাতাল হলে বাঘ কি করবে সেটা ভেবে মোটেও স্বস্থি পাচ্ছিলাম না, যদি হাসতে হাসতে ঘাড়ে একটা কামড় বসিয়ে দেয়? অথবা আমাদের পিঠে না চড়িয়ে উলটা আমাদের পিঠেই চড়ে বসে? আমার ঘাড় শরীরের ভেতর প্রায় সেঁধিয়ে যাচ্ছিল, চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, “কিন্তু গাছের গায়ে এ সব ডিভাইস কেন লাগিয়েছিস? গাছকেও কি মাতাল বানাবি না কী?”
-- আমার দিকে মুহূর্তকাল তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল রসিকতা করছি কী না। হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “তোকে নিয়ে আর পারা গেল না, গাছের কি আর আমাদের মত ব্রেন আছে না কী? ডিভাইস গুলো হলো টি-টকার। এক ধরনের টকিং ইন্টারফেস”
নির্বাক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, “মানে?”, অবাক হওয়ার সীমাও মনে হয় অতিক্রম করে গেছি।
-- শুন, তুই কি জানিস গাছেরাও চিন্তার করে, গান পছন্দ করে, দুঃখিত হয়, হাসে এমন কি কথাও বলে?
জানি
-- আমার জবাব যেন শুনতেই পায়নি সে বা শুনলেও বিশ্বাস করেনি; সে বলেই যাচ্ছে, “গাছ যেহেতু কথা বলে, অনুভূতি আছে তাই এর মেমরিও আছে। এ চিন্তাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই কোমর বেঁধে নেমে গেলাম।”
তোর আবার কোমর বাঁধতে হয়ে না কী? তোর কোমর তো সবসময় বাঁধায় থাকে, খালি কিঞ্চিত ছুতো পেলেই হল।
-- আমার কথায় কান না দিয়ে সে চালিয়ে যাচ্ছে তার বক্তব্য, “অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে বের করলাম গাছের মেমরি লোকেশন। আমাদের যেমন স্পাইনাল কর্ড আছে গাছেরও তেমন আছে অর্গানিক এক্সট্রিম সিগনালিং নেটওয়ার্ক সংক্ষেপে একে বলে ওএক্সেএসএন। বৃক্ষে আমাদের ব্রেনের মত কেন্দ্রীভূত কোন কিছু নেই বরং এই ওএক্সেএসএন জুড়ে কিছু কোষ নিউরনের কাজ করে। এখানেই একটি গাছের সব স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে।”
অদূরে কিছু নড়াচড়া নজরে আসতেন পিলে চমকে উঠলাম। ভীত চোখে খাস্তগীরের দিকে তাকাতেই সে হাতের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “আরে, এত ভয় পেলে কিভাবে চলবে? এগুলো শাখামৃগ, মানে বানর। যাক একদিক দিয়ে ভালোই হল, বাঘ টাগ আসলে এই বানরের দলই গাছে লাফালাফি করে আমাদের জানান দিয়ে দিবে”।
-- ও যা বলছিলাম; তুই কি আমার কথা বুঝতে পারছিস? আমার জবাবের তোয়াক্কা না করে আবার বলা শুরু করল, চোখ মুখ তার চকচক করছে অপার্থিব এক উত্তেজনায়। এখন মেমরি তো পাওয়া গেল, আর আগেই বলেছি গাছও আমাদের মত কথা বলে, দুঃখ পায়, কাঁদে, এখন আমাকে খুঁজে বের করতে হবে গাছের সাথে মানুষের ভাব বিনিময়ের একটা মাধ্যম; অবশেষে এই ডিভাইসটা আবিষ্কার করলাম, টিটকার। এটা গাছের মেমরিকে ব্যবহার করে এর চিন্তাকে শব্দে ট্রান্সফর্ম করে আমাদের কাছে ট্রান্সমিট করবে।
বিস্ময়ে হা হয়ে গেল আমার চিমসে মুখখানা! চোখ পিটপিট করে বললাম, “ক্কি? কি বলছিস তুই? গাছের সাথে কথা বলবি? বলিস কি? বুঝতে পারছিস তুই কোন লেভেলের উদ্ভাবনের কথা বলছিস? বিজ্ঞান নিয়ে খুব একটা আগ্রহী না হওয়া স্বত্বেও এই আবিষ্কারের গুরুত্ব অনুধাবন করার মত সাধারণ জ্ঞান আমার আছে।
-- আরে এটা আর এমন কি আবিষ্কার, এগুলো তো বা হাতের খেলা এমন একটা ভাব নিয়ে সে বলল, “বিরক্ত করিস না তো, এখন আমরা গাছের টকশো শুনব। রেডি ওয়ান টু থ্রী, একশন”; বলেই বাটন চেপে সিস্টেমটা অন করে দেয় খাস্তগীর।
বয়স্ক একটা কণ্ঠ গমগম করে উঠলো, “Sir, would you please remove the stick from my private part?” – মানব ইতিহাসের প্রথম বৃক্ষ ডায়ালগ! বাপরে এতো দেখি ব্যাপক ভদ্র ইংরেজ বৃক্ষ! খাস্তগীর ডিভাইসটার স্টিকটা একটু চেপে ভিতরে ঢুকিয়ে দিতেই বৃক্ষ মশায় চেঁচিয়ে উঠলো, “You, bloody Indian slave! I will slash you till death”, খাস্তগীর মুচকি হেসে বলল, “এই তো জায়গা-মতো এক গুঁতাতেই সাহেব মশাই এর ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়েছে, যথারীতি।”
পাশ থেকে আরেকটা কণ্ঠ মিনমিন করে বলে উঠল, “মাই লর্ড, আপনি কেন খামাখা কষ্ট করবেন, এই অধমকে হুকুম করুন পিটিয়ে তক্তা করে দেই একেকটাকে; অচ্ছুৎ জাত কোথাকার”
দোস্ত, কি বলছে এরা? এভাবে কথা বলছে কেন?
-- আরে এগুলো ব্রিটিশ আমলে গাছ, এটা মনে হয় কোন ইংরেজ সাহেবের লাগানো, আর ঐটা দালাল, উপমহাদেশীয় দালাল বৃক্ষ আর কি। তারা তাদের জন্মের দায় শোধ করছে। চুপচাপ আলোচনা শুনতে থাক।
হঠাৎ করে তিন চারটা কণ্ঠ একযোগে চেঁচিয়ে উঠে, “ভারত সে ভাগও, ভারত সে ভাগও; আভি ইসি ওয়াক্ত ভারত সে ভাগও। নেহি তো মিট্টিমে মিটা দোঙ্গা।” বাপরে! এ দেখছি বিপ্লবী বৃক্ষ! সাক্ষাত ক্ষুদিরাম!
“ভাই ও বেহেনো, ব্রিটিশরাজ বহুত আগেই এই দেশ সে ভাগ গিয়া। আভি দেশকো ল্যাকে আগে বারনা হ্যা। হামারা পেয়ারা পাকিস্তানকো সামনে বহুত দুশমন হে। ইন্ডিয়াকো উচিত শিক্ষা দিয়েঙ্গে, ইস লিয়ে আগে আমাদের সাচ্চা পাকিস্থানি হোনা হ্যা, সব বাঙালকো সাচ্চা ঈমানদার বানায়েঙ্গে। শালে বাঙালী ঈমান বহুত কম জোর হ্যা, উর্দূমে বাতচিত কারেঙ্গে, রুটি খায়েঙ্গে চাল নেহি খায়েঙ্গে, কোর্তা পড়তে হইবে।” পাকিস্তানী বৃক্ষও দেখছি হাজির! কিন্তু এরা এভাবে ঝগড়া করছে কেন? আর এত অতীত নির্ভর কেন? এত উগ্রপন্থী আচরণই বা করছে কেন? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না!
-- কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে মাথাটা খানিক চুলকে খাস্তগীর বলল, “এখনও তো এক্সপেরিমেন্ট স্টেজে আছে তাই আমার ধারনা ভুলও হতে পারে, একজন বৃক্ষ-মনোবিজ্ঞানী সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। তবে আমার মনে হয় মানুষেরে মধ্যে যেমন ভণ্ডামি আছে, লুকোচুরি আছে বৃক্ষের মধ্যে এগুলো নেই। বৃক্ষ মানেই অনাবিল অকৃত্রিম। তাই এদের মনে যা আসছে সেগুলোই বলে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা এরা সবাই কিন্তু যার যার জন্মভূমির প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ শুধু কতক দালাল বৃক্ষ ছাড়া। আর দালালদের সাইকোলজি তো মনে হয় এরা নিজেরাও বুঝে না, আমি আর কি এনালাইসিস করব? আর টকশোতে এমন আলোচনায় হয়, এত দিনেও এই সাধারণ জিনিসটা বুঝতে পারিস নি?”
“তোমার আমার ঠিকানা; পদ্মা মেঘনা যমুনা......
ভয় কি মরনে, রাখিতে সন্তানে মাতঙ্গি মেতেছে আজ সমর রঙ্গে ......
হ্যা হ্যা হ্যা, এই যে ইয়াহিয়ার চ্যালা; এমুন মাইর দিমু, এমুন ক্যাচকি দিয়া ধরুম ড্যাডি ড্যাডি করে ড্যাডির দেশ ছাইড়া পালাইবার পথ পাইবা না, হ্যা হ্যা হ্যা।”, যাক অবশেষে বাংলাদেশের প্রতিনিধিও পাওয়া গেল। তাকিয়ে দেখি তরুণ এক বৃক্ষ। মনে মনে বললাম সাবাস বাঘের বাচ্চা। নিজের কাছেই কেমন যে উদ্ভট মনে হল বৃক্ষকে বাঘের বাচ্চা বলছি! গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম নাহ, স্বপ্ন টপ্ন দেখছি না, জেগেই আছি।
সেদিন ও তারপরের দিন মিলিয়ে আরও হাজার খানেক গাছে সাথে আমরা কথা বলেছি, রেকর্ড করেছি তাদের আনন্দ বেদনার ইতিহাস, তাদের দর্শন, জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে তাদের ভাবনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি নানান বিষয়ে; সে এক অন্য জগত; এই প্রথম খাস্তগীরের কোন আবিষ্কার এতটা উপভোগ করেছি। নোবেল টবেল পেয়ে যেতে পারে যে কোন সময়, আচ্ছা উদ্ভিদবিদ্যায় কি নোবেল দেয়? কী জানি! পরে জেনে নিতে হবে।
চার.
মাস ছয়েকের উপর হয়ে গেছে খাস্তগীরের কোন খবর নেই, প্রতিদিন পেপার আর খবরের দিকে তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকি কখন দেখাবে - “বাংলাদেশের আইনস্টাইন - যুগান্তকারী আবিষ্কার”, ক্রমেই হতাশ হয়ে যাচ্ছি, ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে; বন্ধ।
একদিন কি মনে করে অফিস শেষে সোজা তার বাসায় হাজির হলাম। দরজায় বিশাল তালা ঝুলছে, তালার উপর বেশ ধুলা জমে আছে বুঝাই যাচ্ছে কয়েক মাস এটায় কারও হাত পড়েনি । কি ব্যাপার? কোথায় গায়েব হয়ে গেল? কোন বিপদে টিপদে পড়েনি তো? বিজ্ঞান-বিপদ খাস্তগীরের নিয়তি মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসব এমন সময় তালা খুলে গেল অটোমেটিক, দরজার ফাঁক দিয়ে চুলদাড়িগোফের আড়ালে যে মুখটা দেখা যাচ্ছে অনেক কষ্টে সেটাকে খাস্তগীরের বলে অনুধাবন করতে পারলাম। আমাকে টেনে ঘরে ঢুকিয়েই দরজা লাগিয়ে দিল।
-- এখানে যে এসেছিস তোকে কেউ দেখেনি তো? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে খাস্তগীর।
বড় ধরনের কোন গ্যাঞ্জাম পাকিয়ে বসে আছে সে নিশ্চয়, আমি আস্বস্থ করলাম তাকে যে আমাকে কেউ দেখেনি, কেউ ফলোও করেনি।
-- যাক বাঁচিয়েছিস, আমি আজই তোর এখানে যেতাম, ভালোই হল তুই নিজেই এসেছিস।
হয়েছে কী? কি করেছিস আবার তুই?
-- “খুন করেছি দোস্ত, খুন; খুন মানে একেবারে গণহত্যা” চোখে মুখে তার স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন।
হাত ধরে টেনে সোফাতে বসিয়ে পিঠে হাত রেখে বললাম, “এত আপসেট হওয়ার কিছু নেই, কি হয়েছে খুলে বল”, আমি নিশ্চিত যত বড় পাগলই হোক না কেন খাস্তগীরের পক্ষে খুন? অসম্ভব। আর গণহত্যা! নিশ্চয় কোন পোকামাকড় মেরে এখন অনুশোচনায় ভুগেছে, অবশ্যই পোকামাকড়! পিঁপড়ার পালও হতে পারে। পিঁপড়াই, অনেকগুলো পিঁপড়ার পালে হয়তো পা দিয়ে ফেলেছে আর এখন ভাবছে গণহত্যা করে বসে আছে।
-- কিছুটা আস্বস্থ হয়েছে, এক গ্লাস পানিও খেল; “দোস্ত, তোর মনে আছে সুন্দরবনের এক্সপেরিমেন্টের কথা?”, উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বলেই চলছে, “সেখান থেকে ফেরার একমাস পর আমি আবার গিয়েছিলাম ফলোআপ রিপোর্টের জন্য। গিয়ে দেখি, উফ! গিয়ে দেখি!”, বলেই কথা বন্ধ হয়ে গেল তার। উদাস নয়নে দূরে কোথায় যেন তাকিয়ে আছে।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ বসে আছি, জানি সময় নিয়ে একটু ধাতস্থ হলে সে নিজ থেকেই আবার বলা শুরু করবে।
-- “গিয়ে দেখি” যেভাবে হঠাৎ থেমে গিয়েছিল তেমন হটাতই আবার শুরু করল কথা, “গিয়ে দেখি যতগুলো গাছে আমি টিটকার লাগিয়েছিলাম সবগুলো গাছ মরে কাঠি হয়ে আছে। বুঝতে পারছিস তুই ব্যাপারটা! হাজার হাজার গাছ! কত বয়স্ক গাছ, কত জীবন, কতগুলো ইতিহাস, কত স্বপ্ন মুহূর্তেই শেষ”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “কেন এমন হলো বের করতে পেরেছিস?”
-- আসলে গাছের যে কোষগুলোতে মেমরি থাকে সেগুলো ওয়ান টাইম রিডার এর মত, বাহিরের কিছুর সাথে সংযোগ ঘটলে সম্পূর্ণ মেমরি ড্রেন হয়ে যায়। অনেকটা স্থির-বিদ্যুতের মত, যেখানে চার্জ জমা থাকে কোন পরিবাহীর সংস্পর্শে এলে সাথে সাথে পরিবাহিত হয়ে যায়।
স্থির বিদ্যুৎ, ব্রেন ড্রেন এগুলোর কিছুই না বুঝলেও বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললাম, “ঠিক আছে, একটা ভুল হয়ে গেছে, পরবর্তীতে সেটা শুধরে নিলেই তো হবে, এতো ভেঙ্গে পড়লে চলবে?”
-- আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “তুই কিছুই বুঝিসনি, তাই না? আসলে তোর বুঝার কথাও না। মূল কথা হল গাছের ব্রেন রিডিং একবারই সম্ভব, আর এর ফলে গাছটির মৃত্যু অনিবার্য।”
-- আর আসল বিপদের কথা তো এখনো তোকে বলায় হয়নি, তুই ঘাবড়ে যাবি বলে। বন বিভাগের লোকজন এখন আমাদের হন্যে হয়ে খুঁজছে, বৃক্ষ পাচারকারি হিসাবে। তার উপর বড় বড় চোরাকারবারিরাও খুঁজছে।
ঘাবড়ে গেলাম ভীষণ। মানে? চোরাকারবারিরা কেন খুঁজবে?
- তুই বুঝতে পারছিস, কত সহজেই এখন একটা গাছকে মেরে ফেলা যাবে? যদি এই ডিভাইসটা আপডেট করে একটা নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা যায় তাহলে মুহূর্তেই একটা বনের সব গাছ মেরে ফেলা সম্ভব। এটা তো চোরাকারবারিদের জন্যে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র। বন বিভাগকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই এদেরকে না হয় ম্যানেজ করলাম, কিন্তু চোরাকারবারিদের? এদের যে সেন্ডিকেট আর এর সাথে যে কত বড়বড় কর্পোরেট হাউজ জড়িত! তবে আশার কথা হল আমরা যে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলাম সে কারণে আপাতত বেঁচে গেছি। তবে সামনে কয়েক মাস গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে।
-- এই নে দুটা সিডি। একটা তে ডিজিটাল এলকোহল আর একটাতে টিটকারের সব ডাটা। তোর কাছে রাখ, আমাকে ধরে ফেললেও যাতে এগুলো তাদের হাতে না পড়ে।
আরও কিছুক্ষণ থেকে রাতের অন্ধকারে চুপিচাপি বের হয়ে গেলাম খাস্তগীরের বাসা থেকে। সেটা আজ থেকে অনেক আগের কথা। এখন খাস্তগীরও সিডি নিয়ে কিছু বলে না, আমিও এই প্রসঙ্গ তুলি না। তবে মাঝেমাঝে ডিজিটাল এলকোহলের কয়েক প্যাগ মেরে দেই, সব সময় যে শুধু দুঃখই চাড়া দিয়ে উঠে তা কিন্তু নয়, প্রবল সুখের অনুভূতিও হয় কিছু কিছু গানে। একদিন বউকেও শুনিয়েছিলাম, ক্ষণকাল শুনে সে বলেছিল, “এই কি অবস্থা তোমার? ঘুরে ফিরে কয়েকটা ঘুমপাড়ানি রবীন্দ্রসংগীত শুনা?” বুঝলাম ডিজিটাল এলকোহলে তার কোন প্রভাব নেই। কারণটা বোধগম্য হলো না, মেয়েদের ব্রেনের গঠন কি অন্যরকম? না কী খাস্তগীর এই গানগুলো শুধু আমার ব্রেনের জন্যেই টিউন করে দিয়েছে?
যা ইচ্ছা তাই হোক, আস্তে করে হেডফোনের মাথাটা কানে গুজে দিয়ে রবিতে মজে গেলাম,
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো ।
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ।।
পাগল হাওয়া বুঝতে নারে
ডাক পড়েছে কোথায় তারে-
ফুলের বনে যার পাশে যায়
তারেই লাগে ভালো ।।
নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা,
বাণীবনের হংসমিথুন মেলেছে আজ পাখা ।
পারিজাতের কেশর নিয়ে
ধরায় শশী, ছড়াও কী এ ।
ইন্দ্রপুরীর কোন্ রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো ।।
------------------------ সমাপ্ত --------------------
এই সিরিজের পূর্বের গল্পগুলো
(কল্প-গল্প) --- ( কল্প-গল্প ) --- খাস্তগীরের পাঠশালা - “ভিশন ২০৪০”
(কল্প-গল্প) --- খাস্তগীরের রাসায়নিক ভালবাসা
( কল্পগল্প ) --- খস্তগীরের বিস্ময়কর চিত্রগ্রহন যন্ত্র
( কল্পগল্প ) --- খস্তগীরের স্বাদ সূচক
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৫:১১