খুব সম্ভবত ১৯৯১-৯২, লিবিয়াতে বাংলাদেশ কমিউনিটি স্কুল এন্ড কলেজে ক্লাস সিক্সে পড়ি। একদিন চরম দুষ্টু কিন্তু সবচেয়ে মেধাবী বন্ধুটি দেখি ব্যাগ থেকে চোরের মতো একটা বই বের করছে; আর তাকে ঘিরে দুই তিনজন জটলা পাকিয়ে ফিসফাস করছে। এগিয়ে গেলাম। দেখি হাতে ছোট একটা বই। ছোটকাল থেকেই বই এর পোকা, কিন্তু দেশের বাইরে থাকায় পাঠ্য বই এর বাইরে তেমন কোনও বই হাতের কাছে পেতাম না। তাই দেখা যেতো, নিজের সংগ্রহে যা ছিলো সেগুলোই ঘুরে ফিরে বারবার পড়া হতো। এমনও হয়েছে আম্মু শাড়ি র্যাপ করার জন্যে দেশ থেকে যে পেপার এনেছিলো সেগুলোও খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তাম।
যাই হোক, আমিও বই খানা বুকিং দিয়ে দিলাম। চক্রঘুরে যখন আমার পালা আসল, সেদিন বইটি আমার হাতে দিয়ে ঐ বন্ধু বললো, “খবরদার আব্বু আম্মু যাতে না দেখে।” মনের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে অলরেডি। বই এর প্রচ্ছদে একটি জঙ্গি বিমান আর গগলসে ঢাকা পাইলটের ছবি। সেই সময়ের কথা বলছি, যখন মাসুদ রানা সিরিজকে বলা হতো এডাল্ট গল্প, স্কুলের ছেলেদের পড়া নিষেধ। লুকিয়ে পড়তে হতো এসব বই।
“চারিদিকে শত্রু”, মাসুদ রানার এই বইটা দিয়ে আমার থ্রিলার জগতে প্রবেশ। সেই প্রথম সিআইএ, কেজিবি, মোসাদ এবং অবধারিতভাবে বিসিআই এর সাথে পরিচয়। একে তো নিষিদ্ধ বই, তার উপর স্পাই থ্রিলার, রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে পড়তে বসতাম। সে কী উত্তেজনা! টানা কয়েক মাস পাগল ছিলাম।
একে একে পড়ে ফেললাম মাসুদ রানা বিখ্যাত সব বই। আই লাভ ইউ ম্যান, হ্যালো সোহানা, অগ্নিপুরুষ, মূল্য এক কোটি টাকা মাত্র, বন্দি গগল, সেই উ সেন, অন্ধকারে চিতা, কুউউ ইত্যাদি সব বই। তবে এখনও চারিদিকে শত্রু বই এর কথা মনে হলে গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠে।
এতো কথা বলার উদ্দেশ হলো, সেই একই অনুভূতি হয়েছে এসপিওনাজ জগতের সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা “বিলিয়ন ডলার স্পাই” গল্পটি পড়ে। মাসুদ রানার মতো ঘটনা কি আসলেই বাস্তবে সম্ভব? কেন নয়? বাস্তবতা যে কখনও কখনও কল্পনাকেও হার মানায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে এই গল্পটি। কোল্ডওয়ারের যুগে কেজেবি, সিআইএ কিভাবে অপারেট করতো, কিভাবে রিক্রুট করতো সেগুলো একেবারে চলচিত্রের মতো ফুটে উঠেছে এই গল্পে।
ক্রিপ্টোলজি, কম্পিউটার সায়েন্সের একটি কোর্স। খুবই জটিল কিন্তু মজার একটা সাবজেক্ট। হায়ার ম্যাথমেটিক্সের ডেপথ নলেজ থাকতে হয় এই বিষয়টা ভালো মতো আত্মস্ত করতে। “যে স্পাই বানান করতে জানত না” এ গল্পটা পড়ে মনেই হয়নি লেখক একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বরং মনে হয়েছে তিঁনি ঝানু একজন ক্রিপ্টোলজিস্ট। এনকোডিং, ডিকোডিং এর মেথড গুলো যেভাবে সহজ সাবলীলভাবে বর্ননা করেছেন, এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। সেই সাথে টানটান একটা উত্তেজনা। প্রতি প্যারায় প্যারায় কী হয় কী হয় একটা ভাব।
“বিলিয়ন ডলার স্পাই”, “যে স্পাই বানান করতে জানত না”, “যে স্পাই আওলাকিকে ধরিয়ে দিয়েছিল”, “বৈরুতে ইসরায়েলি মাতাহারি”, “মোসাদের মিশরীয় এঞ্জেল”, “যে স্পাই কিউবাকে ভালোবেসেছিল” এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য এই ছয়টি সত্য কাহিনী নিয়ে এবারের বই মেলায় বের হয়েছে মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার “স্পাই স্টোরিজ” বইটি।
ছয়টি বড় গল্পের ভেতর, এই দুইটি গল্প পড়েছি। আর বাকিগুলো লেখকের কাছে চাই নি। ইচ্ছা আছে, বইটি কিনে দরজা বন্ধ করে কৈশরের সেই আবহ তৈরী করে পড়বো। আমার বিশ্বাস আশাহত হবো না।
শেষ করবো একটি মুভির রেফারেন্স দিয়ে। রাটাটল্লি – আমার বেশ প্রিয় একটা এনিমেশন মুভি। সেখানে স্পেশাল এবিলিটির একটি ইঁদুর সেফ হিসাবে কাজ করে। শহরের সেরা ক্রিটিক, যাকে সন্তুষ্ট করা অতি দুরুহ কাজ। সেই ক্রিটিকই ইঁদুর সেফের একটি স্পেশাল ডিস খেয়ে এই মন্তব্য করেছিলো,
“In many ways, the work of a critic is easy. We risk very little yet enjoy a position over those who offer up their work and their selves to our judgment. We thrive on negative criticism, which is fun to write and to read. … But there are times when a critic truly risks something, and that is in the discovery and defence of the new. Last night, I experienced something new, an extraordinary meal from a singularly unexpected source. To say that both the meal and its maker have challenged my preconceptions is a gross understatement. They have rocked me to my core. … Not everyone can become a great artist, but a great artist can come from anywhere.
বলতে দ্বিধা নেই, স্পাই স্টোরিজের দুটি গল্প আমার শৈশবের সুপ্ত কোনও এক স্মৃতিকে প্রচন্ড নাড়া দিয়েছে। রাটাটল্লি মুভির সেই ক্রিটিকের মতো কিছু শব্দই ঘুরে ফিরে মাথায় আসছে, “discovery and defense of the new”, “They have rocked me to my core.”, “great artist.”
আমি দাবী করবো না, ফাইনেস্ট থ্রিলার রাইটারের আগমন ঘটেছে, কিন্তু জোর গলায় বলতে চাই এই লেখক অনেক দূর যাবেন। শুভকামনা রইল লেখকের প্রতি।
বই এর নাম: স্পাই স্টোরিজ
লেখক: মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা
প্রকাশিনী: স্বরে অ। পাওয়া যাবে ঐতিহ্য ১৪ নং প্যাভিলিউন
রকমারি অর্ডার লিঙ্ক: https://bitly.com/2tQhQP9
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১:৩৩