দীপন হত্যা সমকালের একটি জ্বলন্ত খবর। এর আগেও বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন ব্লগার বা বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক বা প্রশ্নবিদ্ধ লেখক নিহত হয়েছেন। পক্ষীয়গণ এবং সোচ্চার কিছু মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছেন বরাবর, বিচার দাবী করেছেন, অধিকাংশেরই কোন সুরাহা হয়নি শেষাবধি। ব্যাপারটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ারে, আমাদের সে বিষয়ে কথা না বলতে যাওয়াই ভালো। আসলে এসব মারাত্মক বিষয় নিয়ে কিছু লিখতে যাওয়াও নিজেকে বিপদে ফেলার শামিল।
আমি দীর্ঘদিন কিছু লিখছি না, লিখতে ইচ্ছে করে না, কল্পলোকের কোন অনুভূতি এখন কেন জানি কাজ করে না। আপনারা লেখার জন্য রোজ দাবি জানান, অসন্তোষ প্রকাশ করেন, তাই আজ ভাবলাম, কল্পলোক বাদ দিয়ে দেশের বর্তমান নির্মম বাস্তবতা নিয়েই লিখি।
প্রথমেই বলে রেখেছি, অপরাধী চিহ্নিত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর, আপনার আমার নয়। আমি সাদা যুক্তিতে একটা জিনিস বুঝি, সেটা আগে বলি। রহিমের সঙ্গে করিমের ঝগড়া হয়েছে, করিম ক্ষেপে গিয়ে রহিমকে শাসাল, আমি তোর রক্ত দিয়ে গোসল করব!!
অতঃপর যে যার বাড়ি গেল, আর সেদিন রাতেই জলিল পূর্বশত্রুতার ফায়দা নিতে রহিমকে খুন করল। দোষটা হল কার? পুলিশ কাকে ধরবে? অবশ্যই করিমকে।
বিজ্ঞানমনষ্ক লেখকেরা এখন হুমকিগ্রস্ত দুইদিক দিয়েই। ব্যক্তিগত শত্রুতার শোধ তুলতেও এখন যে কেউ হত্যা করে দায়টা চাপিয়ে দিতে পারে ব্লগারবিদ্বেষী আততায়ীদের ঘাড়ে। ইন্টেলিজেন্স বিভাগ অবশ্যই এসব বিষয় আমার চেয়ে ভালো বোঝেন, আমি এই স্পর্শকাতর বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।
আমি এখন বলতে চাই আততায়ীদের উদ্দেশ্যে। ধর্ম নিয়ে আমি বেশ কয়েকবার লিখেছি, ধর্মের প্রয়োজনীয়তা, ধর্মবিদ্বেষ এবং তার কুফল, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, মৌলবাদিতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, আলেম সমাজের দায়িত্ব ইত্যাদি সব বিষয়েই আমি লিখেছি, আপনারা দেখেছেন, জানেন। আমার প্রত্যেকটি লেখাই মঙ্গলের উদ্দেশ্যে এবং কোন লেখাতেই কাউকে আঘাত করা হয়নি, হেয় করা হয়নি, কোন পক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়া হয়নি। আমি সবসময়ই সমাধান খুঁজেছি, শুভ বোধের উদয় কামনা করেছি।
বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক নিহত হওয়া মানেই আমরা ধরে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে এটা ধর্মবাদীদের কাজ। হতেই পারে, আবার না-ও হতে পারে। আততায়ীই ভালো জানে, আর জানেন ঈশ্বর।
যদি এই হন্তারক কোন ধর্মান্ধ হয়, তবে আমি তার উদ্দেশ্যে আমার পূর্বের একটি লেখা থেকে বলতে চাই, আপনার ধর্ম এত ঠুনকো নয় যে কেউ একজন আপনার ধর্মকে মিথ্যে বললেই আপনার ধর্ম মিথ্যে হয়ে যাবে। আপনার ঈশ্বর এত দুর্বল নন যে কেউ তাঁকে গালিগালাজ করলেই ঈশ্বর ক্ষীণ হয়ে যাবেন। একজন ঈমানদারের সামনে কেউ কুফরি করলে ধর্মের অবমাননা করলে তাতে ঈমানদারের ধর্ম নষ্ট হয় না, বরং সে ঈমানদার অন্যের পাপ দেখে গোমরাহীর ভয়ানক মাত্রা দেখে মনে মনে শিউরে ওঠে এবং আল্লাহ বা ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে, পানাহ চায়।
এখন যুক্তি হিসেবে বলতে পারেন যে, ধর্মকে বাজে গালিগালাজ করলে ধর্ম নষ্ট হয় না বলেই কি ইচ্ছেমত ধর্মকে গালি দেওয়ার বৈধতা দিতে হবে??
না। বৈধতা কখনই দেওয়া হয়নি। আমাদের সংবিধানে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, এবং অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত না করার বিধান রয়েছে। আপনাদের হয়ত খেয়াল আছে যে, এই আক্রমণাত্মক লেখার কারণে বিশেষ কিছু ব্লগারকে সেসময়ে (রাজীব হত্যার সময়কাল) আটক করা হয়েছিল। এবং এটাও স্বস্তির বিষয় যে ধর্মবিদ্বেষী লেখা অনলাইনে এখন নেই বললেই চলে। তাহলে ধার্মিক আর অধার্মিকের দ্বন্দ্ব এখন আর টানার কোন অবকাশ দেখি না।
আমি ইদানিং অনলাইন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। কখনই কোন লেখক প্রকাশকের সঙ্গে আমার কোন দহরম মহরম ছিল না এবং আমি সঙ্গত কারণে লেখকসমাজকে বরাবর এড়িয়ে চলেছি। তাই দীপন কেমন লেখক ছিলেন সে বিষয়ে আমার তেমন ধারণা নেই, তবে এটা মনে হয় না যে, তিনি কোন আক্রমণাত্মক লেখা লিখেছেন বা প্রকাশ করেছেন।
তবু এরকম নৃশংস হত্যার পেছনে প্রশ্ন থেকেই যায়। এদেশে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল বলা চলে পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডেড হয়ে গেছে। তাদের এখানে কোন ভূমিকা আছে কি না বলার উপায় নেই। আমি শুধু বলব, ইসলাম কেবল ভারতবর্ষ কেন, গোটা বিশ্বে তলোয়ারের দাপটে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, আক্রোশ বা প্রতিহিংসার শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বীয় উদারতা আর স্বার্বজনীন মঙ্গলময়তার ভিত্তিতে। রক্ত দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত বা অক্ষুণ্ন রাখার মনোভাব যদি কেউ পোষণ করে থাকেন এখনও, তবে আপনি ভুল পথে আছেন!
জিহাদের কথা তুলবেন? জিহাদ মানে যে যুদ্ধ নয় সে তো আপনিও জানেন। আর যুদ্ধ করার বাদশাহী আমল পার হয়ে গেছে তো আড়াইশো বছর আগে। নবীজী (স.) তাঁর জীবদ্দশায় যতগুলো যুদ্ধ করেছিলেন তার একটিও কি ধর্ম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছিল???
মোটেই না। ইতিহাস সমালোচনায় দেখবেন, প্রত্যেকটির প্রেক্ষাপটই রাজনৈতিক।
যদি নবীর (স.) অনুসারী দাবি করেন নিজেকে, তবে ত্যাগ, সহনশীলতা আর মহানুভবতার পথে আসুন। বিদ্বেষ নয়, আচরণের সৌন্দর্য দিয়ে মানুষকে আপনার পথে আনুন, খুন বা হত্যা করে নয়।
আমি নিশ্চিত করছি যে, আমার বক্তব্যে কাউকে বিশেষভাবে ইঙ্গিত করা হয়নি, কেউ একজন হত্যা হলেই যে অমুক রাজনৈতিক পক্ষের গুপ্তঘাতকের কাজ- এই জাতীয় দায়সারা উক্তি দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার প্রবৃত্তি বন্ধ হোক, দেশে বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনাও পরপর দু'বার ঘটেছে সম্প্রতি, আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। জঙ্গিবাদ নামক একটা মনগড়া জুজুর দায় আমি এদেশের নাগরিক হিসেবে আর দেখতে চাই না।
বাংলাদেশ গত দশ বছরে ব্যাপক উন্নতি করেছে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, কোনপ্রকার আন্তঃবিশৃঙ্খলা আমাদের এই অগ্রগতিকে থমকে দিক এ আমরা চাই না।
আমার দেশ, আমার সোনার বাংলাদেশ সাফল্যমণ্ডিত হোক বিশ্বের প্রতিটি আসরে।
জয় বাংলা!!!