বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী জাঁকজমকভাবে উদযাপিত হলো এক বছর আগে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয়ে ফিচার নিবন্ধ লেখা হলেও গত ৫০ বছরে আমাদের জাতীয় জীবনের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ঘটনাগুলো নিয়ে তেমন কোনো লেখা পত্র-পত্রিকায় চোখে পড়েনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছে এরকম লক্ষ লক্ষ লোক এবং বাংলাদেশের জন্মের পূর্ব থেকেই রাজনীতিতে জড়িত ব্যক্তিরা এখনো বেঁচে আছেন। এই অবস্থায়ও ইতিহাস বিকৃতি হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ বাংলাদেশের ইতিহাস সঠিকভাবে জানে না এবং জানার ইচ্ছাও নেই। আবার যারা কিছুটা জানে তারাও অনেককিছু ভুল জানে। বাংলাদেশের এক শ্রেণীর রাজনীতিক ও দলকানা লেখক ভুল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করেছে বারবার। আবার কেউ সঠিক ইতিহাস জানতে চাইলেও পুরানো পত্র-পত্রিকা ঘাটাঘাটির ঝামেলায় যেতে চাই না। তাই বাংলাদেশের ৫০ বছরের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ঘটনাগুলো নিয়ে এই সিরিজটি লেখার উদ্যোগ নিয়েছি। ঘটনাগুলো এমনভাবে বাছাই করেছি যাতে পাঠক বাংলাদেশের ৫০ বছরের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পায়।
অফিসিয়ালি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে হিসাব করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দেশ পাকিস্তানী হানাদারমুক্ত হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তাই এই সিরিজটি ১৯৭২ থেকে শুরু করে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৫০টি পর্বে প্রকাশিত হবে। এই সিরিজে উল্লেখিত রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ঘটনাগুলো বর্ণনামূলকভাবে উপস্থাপন করা হবে। অর্থাৎ সেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনা থাকবে না, লেখকের নিজের কোনো মতামতও থাকবে না। আশা করি পাঠকগণ নিজেরাই নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে ইতিহাসের ঘটনাগুলো মূল্যায়ন করবে।
০৩ জানুয়ারি - শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তিদানের ঘোষণা
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আজ ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী শেখ মুজিবর রহমানের সাথে অন্তত একদফা আলোচনার পর তিনি বিনাশর্তে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবেন। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো করাচীর নিশতার পার্কে এক বিরাট জনসভায় তাঁর শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তারা শেখ মুজিবের মুক্তি অনুমোদন করেন কিনা। শ্রোতারা একবাক্যে তাদের অনুমোদন জ্ঞাপন করেন। সভায় কয়েক লক্ষ শ্রোতা ছিলেন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেখ মুজিবকে তাঁর ঢাকাস্থ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করেছিলেন।
১০ জানুয়ারি - বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি সকালে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর একটি পাকিস্তানি সামরিক বিমানে করে গোপনে তাকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হোটেল ক্যারিজেসে থাকার ব্যবস্থা করেন। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু আসেন দিল্লিতে। সেখানে পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু নামার পর তাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিবি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধী স্বাগত জানান। দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় আসেন। পাকিস্তানের কারাগারে নয় মাসের অধিককাল বন্দি জীবন যাপনের পর স্বাধীন, সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান সকালে লন্ডন থেকে বৃটিশ বিমান বাহিনীর একটি কমেট বিমানে দিল্লী এসে পৌঁছালে তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সম্বর্ধনা জানানো হয়। এদিকে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জয়লাভ করলেও যার নেতৃত্বে যুদ্ধ হয় সেই নেতার জন্য জাতি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। ওই দিন বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য ঢাকায় জনতার ঢল নামে। এরপর এক অভুতপূর্ব ঐতিহাসিক জন-সংবর্ধনার মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশ সময় বেলা পৌনে দুটোয় ঢাকার তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেন। বিমান থেকে নেমে মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন বঙ্গবন্ধু। তেজগাঁও বিমান ঘাঁটি থেকে রমনার রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত দীর্ঘপথ লক্ষ লক্ষ লোকের "জয় বাংলা", "জয় বঙ্গবন্ধু" স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে। রমনার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ২৫ লক্ষ লোকের জমায়েতে বক্তৃতা দিতে উঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শেখ মুজিবর রহমান আজ এখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে।
১২ জানুয়ারি - বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ঘোষণার ১৬ ঘন্টার মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করলেন। আজ সন্ধ্যায় বঙ্গভবনের দরবার হলে ৯০ মিনিট ব্যাপী এক অনুষ্ঠানে কূঠনীতিক, গণপরিষদের সদস্য এবং সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সরকারি কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হলো।
১৩ জানুয়ারি - বাংলাদেশের পতাকার নকশা সংশোধন
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশের জাতীয় পাতাকার নকশা সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্বান্তে বলা হয় যে মুক্তিযুদ্ধকালে যে নকশার জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা হয়েছে উহাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা থাকবে। তবে পতাকার মধ্যবর্তী মানচিত্রটি বাদ দেওয়া হবে। কারণ মানচিত্রসহ পতাকার নকশা সঠিকভাবে করা জনসাধারণের জন্য কঠিন হবে।
২৪ জানুয়ারি - বঙ্গবন্ধুর নিকট কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ
আবদুল কাদের সিদ্দিকীর (বাঘা কাদের) নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর ১৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইলে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এক আবেগময় অনুষ্ঠানে অস্ত্র সমর্পণ করেন। অস্ত্র সমর্পণের সময় কাদের সিদ্দিকী বলেন, 'যে নেতার আদেশে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম, সে অস্ত্র নেতার হাতেই ফিরিয়ে দিলাম।' সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমি তোমাদের তিন বছর কিছু দিতে পারবো না। আরো তিন বছর যুদ্ধ চললে, তোমরা যুদ্ধ করতে না? তাহলে মনে করো যুদ্ধ চলছে, তিনবছর যুদ্ধ চলবে। সেই যুদ্ধ দেশ গড়ার যুদ্ধ। অস্ত্র হবে লাঙ্গল আর কোদাল।'
২৪ জানুয়ারি -পাক বাহিনীর দালালদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন
বাংলাদেশের যারা পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছিল এবং যারা গণহত্যার জন্য দায়ী তাদের সকলের দ্রুত ও যথাযথ বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার এক বিশেষ আদালত গঠনের আদেশ জারি করেন।
২৫ জানুয়ারি - সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃতি
সোভিয়েত ইউনিয়নের আজ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নই বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিল।
২৯ জানুয়ারি - মিরপুর থেকে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক জহির রায়হান নিখোঁজ
বড় ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের মৃতদেহ মিরপুরের বধ্যভূমিতে খুঁজতে গিয়ে নিজেই নিখোঁজ হয়েছিলেন চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রতিভাবান পরিচালক, বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার জহির রায়হান।
৩০ জানুয়ারি - মোহাম্মদপুর হতে বেআইনী অস্ত্রশস্ত্র ও লুটের মালামাল উদ্ধার
মোহাম্মদপুর এলাকায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর যৌথ উদ্যোগে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও লুটের মালামল উদ্ধার করা হয়েছে। অনুরুপভাবে মিরপুর এলাকাও তল্লাশি করে অস্ত্রশস্ত্র ও লুটের মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। গত ২৯শে জানুয়ারি হতে দুস্কৃতিকারীরা উস্কানিমূলকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলে দুই পক্ষের মধ্যে গুলী বিনিময় হয়। এতে উভয়পক্ষের কয়েকজন হতাহত হয়।
উল্লেখযোগ্য যে, রাজধানীর উত্তর-পশ্চিম এই দুটি এলাকায় পাক হানাদার বাহিনী তাদের তাবেদার ও দুস্কৃতিকারীদের মধ্যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে। দুটি এলাকায় প্রধানত অবাঙালি অধ্যুষিত।
৩১ জানুয়ারি - মুজিব বাহিনীর অস্ত্র হস্তান্তর
অপরাহ্নে ঢাকা স্টেডিয়ামে সুসংগঠিত গেরিলা দল মুজিব বাহিনী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অানুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র হস্তান্তর করেন।
০৬ ফেব্রুয়ারি - বঙ্গবন্ধুর পশ্চিমবঙ্গ সফর
২৫ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণোচ্ছল জয়ধ্বনির মধ্যে আজ কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারত এবং বাংলাদেশ, এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দুই প্রধানমন্ত্রীই ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রী অটুট থাকবে, অমর হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যখন ফিরে আসি তখন জানতাম না আমার দেশের এতো সর্বনাশ করা হয়েছে, এত মানুষকে খুন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শ্রীমতি গান্ধীর নেতৃত্বে সারা ভারত এগিয়ে না এলে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে সফল হতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধু শ্রীমতি গান্ধী ও ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের দান আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। আজ আমি শুধু বলতে পারি:
“নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি
দেবার কিছু নাই,
আছে শুধু ভালোবাসা,
দিয়ে গেলাম তাই।”
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় দিল্লী থকে কলকাতা যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে তা সম্ভব না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু কথা দিয়েছিলেন পরে সময় করে পশ্চিমবঙ্গে আসবে। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এখানকার মানুষের অবদান চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে।
১২ মার্চ - স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতের সামরিক বাহিনীর বিদায়
ঢাকায় ভারতীয় সেনাদের বিদায়ী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়া শুরু। স্বাধীনতার তিন মাসের মধ্যে আজ থেকে ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য দেশের সেনাবাহিনীকে বরণ করার যে কয়টি নজির স্থাপিত হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ মিত্রবাহিনীর অভ্যুদয় অতুলনীয়, ইতিহাসে অনন্য।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় ভারতে কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি নিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময় তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কবে বাংলাদেশ ত্যাগ করবে? ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কথা দিয়েছিলেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে সব সৈন্য ফিরিয়ে আনা হবে।
ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি নির্দেশে বলা ছিল, বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনী তাদের কর্তব্য সমাধানের পর অতিরিক্ত একটি দিনও থাকবে না। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের মাধ্যমে, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে এদেশের স্বাধীনতাকে সুসংহত করার কাজে সাহায্য করে, এদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মিত্রবাহিনী তাদের কর্তব্য সম্পাদন করেছেন এবং তারা স্বদেশে ফিরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রস্থান সূচিত করে প্রস্থানবাদ্যের মুর্চনায় যখন ভারত আর বাংলাদেশের পতাকা নামানো হয় তখন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রায় এক লক্ষ লোক ধ্বনি তোলেন: 'জয় বাংলা', 'জয় মিত্রবাহিনী', 'ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক'।
১৭ মার্চ - সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্ধিরা গান্ধীর ভাষণদান
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্ধিরা গান্ধী রমনার বিশাল জনসভায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পাশে ভারত ও বাংলাদেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে। ভারতের মতই বাংলাদেশও একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে চিরদিন টিকে থাকবে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্য ভারত সাহায্য করতে প্রস্তুত। সেইসাথে তিনি একথাও বলেন, কোনো অঞ্চলেই নিজ-প্রভাব বিস্তারের অভিসন্ধি ভারতের নেই।
১৯ মার্চ - বাংলাদেশ-ভারত ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পঁচিশ বছর মেয়াদি এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গভবনে উভয় দেশের মধ্যে এই মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধি স্ব স্ব দেশের পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্সর করেন। চুক্তির মূল কথা হচ্ছে একে অন্যের প্রয়োজনে, একে অন্যের বিপদে সর্বশক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়াবে।
২৬ মার্চ - বৃহৎ শিল্প, ব্যংক, বীমা জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা
বাংলাদেশের প্রথম বার্ষিক স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশে শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার সংকল্পের পুনরাবৃত্তি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে তাঁর সরকার ব্যাংক, বীমা, পাট, চা, চিনি ও প্রধান প্রধান শিল্প জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেেন। দেশের সংবিধান প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের সংবিধানের মৌল ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরেপক্ষতা।
১ এপ্রিল - জনতার ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ১৮জন হতাহত
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন লোক বাকবিতন্ডাকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের একটি সিনেমাহলে গুলিবর্ষণ করলে ৮ ব্যক্তি নিহত এবং ১০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়। জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে পরে কোর্ট মার্শালে এদের বিচারের সিদ্ধান্ত হয়।
৪ এপ্রিল - বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দান
অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বাংলাদেশকে এ পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো ৫৭তম এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে চতুর্থ রাষ্ট্র।
৬ এপ্রিল - দুর্নীতির অভিযোগে আওয়ামী লীগ থেকে ১৬ জন এমসিএ বহিষ্কৃত
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় শৃঙ্খলা, স্বার্থ এবং দলীয় নির্দেশাবলীর পরিপন্থি কার্যকলাপের দায়ে ১৬ জন গণপরিষদ সদস্যকে বহিষ্কার করেছেন এবং ১৩ জনকে বিশেষ কমিঠির সন্মুখে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
২০ মে - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের জয়লাভ
আজ অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে। ডাকসুর ১৯৭১-৭২ সালের এই নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। নব নির্বাচিত সহ-সভাপতি জনাব মুজাহিদুল ইসলাম খান (সেলিম) এবং সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব জামান। ফলাফলে জানা যায়, সর্বমোট ১৮টি পদের মধ্যে সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১৭টি পদে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জয়লাভ করে।
২৪ মে - বিদ্রোহী কবিকে ঢাকায় আনয়ন
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আজ কলকাতা থেকে এখান এসে পৌঁছলে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রনে কবি নজরুলকে ঢাকায় আনয়ন করা হয়। কবিকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমানটি অবতরণ কেন্দ্রে আসামাত্র বিপুল সংখ্যক লোক উহা ঘিরে ফেলে। কবির সঙ্গে তাঁর দুই পুত্র, পশ্চিমবঙ্গের দুই চিকিৎসক এবং কবি পরিবারের প্রায় ১৫ জন লোক সাথে এসেছেন।
০৭ জুন - কালোবাজারী, চোরাচালানী, মজুতদার ও বাআইনী দখলদারদের প্রতি সরকারের ১৫ দিনের আল্টিমেটাম
ঐতিহাসিক ৭ই জুন উপলক্ষে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে যেন কালোবাজারী, চোরাচালানী, মজুতদার, লুটতরাজকারী তথা সমাজবিরোধি দুষ্কৃতিকারীদের সমুদয় দুষ্কর্ম বন্ধ হয়। তা না হলে সরকার কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রয়োজনে এলাকাওয়ারীভাবে সান্ধ্যআইন জারি করে অপরাধীদের পাকড়াও করা হবে। বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, যে কোনো রাষ্ট্রকেই বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া হবে না। উপকারী বন্ধুর উপকার স্বীকার করতে লজ্জা পাওয়া উচিত নয়।
২১ জুন - জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রথম দল
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ সচিবালয়ের সামনে আবদুল গণি রোডে জাতীয় রক্ষী বাহিনীর প্রথম দলের অভিবাদন গ্রহণ করেন। প্যারেড পরিচালনা করেন জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ডাইরেক্টের লেফট্যানেন্ট কর্নেল নুরুজ্জামান।
২৩ জুন - ৬০ ভাগ দোকান বন্ধ, মাল-পত্র উধাও
কালোবাজারী, চোরাচালানী, মজুতদার, লুটতরাজকারী তথা সমাজবিরোধি দুষ্কৃতিকারীদের আত্মশুদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধু যে ১৫ দিন সময় দিয়েছিলেন গতকাল উহার মেয়াদ উত্তীর্ন হয়। কিন্তু এত হুশিয়ারী দেওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণীর দুষ্কৃতিকারী ও অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে গতকাল থেকে ঢাকার বাজারে বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় উধাও হয়ে যায়। গতকাল বিকাল থেকে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী শহরের বিভিন্ন এলাকায় টহল দিতে শুরু করে।
২৫ জুন - শহরে সান্ধ্যআইন জারি করে ঘরে-ঘরে তল্লাশি শুরু
আজ থেকে রাজধানীতে এলাকা ভিত্তিক কারফিউ দিয়ে ঘরে ঘরে ব্যাপক তল্লাশি শুরু হয়। প্রথম দিনে ১৭টি গাড়িসহ প্রচুর অস্ত্র ও মালামাল উদ্ধার, ৩৩ জন গ্রেফতার।
২৫ আগস্ট - নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রশ্নে সুদান, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা
বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য পদ প্রদানের জন্য নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা মুলতবি রাখার জন্য সুদানের প্রস্তাব চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন, ভারত ও যুগোশ্লোভিয়ার প্রতিনিধিগণ মুলতবি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য পদ দেওয়ার দাবি জানায়।
২৬ আগস্ট - চীনের ভেটো
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের জন্য ভারত-সোভিয়েতের যৌথ উদ্যোগে উপস্থাপিত প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটো প্রয়োগের ফলে বাতিল হয়ে যায়। জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে চীন ভেটো দেওয়ায় সমগ্র বাংলাদেশে বিক্ষোভ হয়েছে। জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি বলেন, পাকিস্তান ও ভারত এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অমিমাংসিত বিষয়গুলো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পাবে না।
১৯ সেপ্টেম্বর - অভ্যন্তরীন নৌ-চলাচল সংস্থার চেয়ারম্যানসহ ৪ জন সিনিয়র অফিসার সাসপেন্ড
কর্তব্যে অবহেলা ও অসদাচরণের জন্য চেয়ারম্যান কমোডর এ রশিদ, সিনিয়র অফিসার এস জামান, নুরন্নবী ও ক্যাশিয়ার মাসুদ আলীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
১২ অক্টোবর - গণ পরিষদে খসড়া সংবিধান পেশ
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য আজ এক ঐতিহাসিক দিন। স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদে খসড়া সংবিধান অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়। আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এই ঐতিহাসিক সংবিধান বিল পেশ করেন।
১৫ - অক্টোবর - আটক বাঙালিদের স্বদেশ ফিরতে সাহায্য কামনা
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে সেক্রেটারি জেনারেলের নিকট তার যোগে প্রেরিত এক ব্যক্তগত পত্রে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের অবস্থার দ্রুত অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তাহাদের আশু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর সাহায্য কামনা করেন।
৩১ অক্টোবর - জাসদের জন্ম
আজ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নামে একটি নতুন দল গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। মেজর জলিল এবং ডাকসুর প্রাক্তন সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব এই নতুন দলের যুগ্ন আহবায়ক নিযুক্ত হয়েছেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজ ও কৃষক-শ্রমিক রাষ্ট্র কায়েম করাই এই দলের লক্ষ্য।
১৫ নভেম্বর - খুলনায় দশ কোটি টাকার পাট ভস্মীভূত
খুলনায় স্মরণকালের বৃহত্তম অগ্নিকান্ডে ২৯টি গুদামের বিপুল পরিমাণ পাট সম্পূর্ণরুপে ভস্মীভূত হয়েছে। খুলনা, দৌলতপুর, খালিশপুর, নওয়াপাড়া ও যশোরের সমস্ত দমকল একযোগে ঘটনাস্থলে গমন করেও অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রনে আনতে পারে নাই।
২৭ নভেম্বর - নারায়নগঞ্জে পাটের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড
খুলনা ও গৌরিপুরের পাটের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের দগদগে ক্ষত না শুকাতেই আজ সকালে নারায়নগঞ্জে পাটের গুদামসমূহে সংঘটিত হয়েছে আর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। পাটের গুদামে উপর্যুপরি আগুন লাগার ঘটনাকে নাশকতামূলক কর্মকান্ড হিসাবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর - সংবিধান চালু
বাঙ্গালি জাতির আত্মশাসনের মহান দলিল সংবিধান আজ থেকে কার্যকরী হওয়ায় দেশবাসীর দীর্ঘদিনের সংগ্রাম সফল হলো। সংবিধান চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণপরিষদেরও বিলুপ্তি ঘটেছে।
২৯ ডিসেম্বর - মাওলানা ভাসানীর ২ দিনের হরতাল পালনের আহবান
পল্টন ময়দানে বাঙলা ছাত্র ইউনিয়নের সন্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে মাওলানা ভাসানী সারাদেশে দুইদিন ব্যাপী হরতাল পালনের আহবান জানিয়ে বলেন, ভারতের সহিত গোপন চুক্তি বাতিলের দাবীতে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবীতে এবং আগামী নির্বাচনে দলীয় স্বার্থে আওয়ামী লীগ কর্তৃক সরকারি প্রচারযন্ত্র ও যানবাহনসমূহ ব্যবহার করার প্রতিবাদে এই হরতাল পালিত হবে।
২৯ ডিসেম্বর - খুলনায় ৫ জন নিহত
খুলনায় আততায়ীর গুলিতে আওয়ামী লীগের নেতাসহ ৫ জন নিহত। ৫ ব্যক্তি গ্রেফতার, অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার।
তথ্য ও ছবির সূত্র:
ইত্তেফাক, যুগান্তর, আজাদ, বাংলার বাণী (বাংলা সংবাদপত্র)
বাংলাদেশের তারিখ - মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (গ্রন্থ)
https://songramernotebook.com (ইন্টারনেট)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০২২ ভোর ৬:২৫