আমার অফিসের পিওন ছেলেটি, নাম জুনেদ। অফিসের এ্যাডমিন প্যানেলের আইটি সেকশনের ইন-চার্জ হওয়ায় মাঝে মধ্যেই অনেকেরই ইন্টারভিউ নিতে হয় আমাকে। স্পষ্ট মনে আছে, জুনেদের ইন্টারভিউের সময়টা। সামান্য ৪,৫০০/= টাকার চাকুরীর জন্য সদ্য এস.এস.সি পাশ করা একটা মাঝ বয়সী ছেলেকে এমন আকুতি-মিনতি করতে আমি আর কখনো দেখিনি কখনো, কাজের বিভিন্ন রকমের কষ্টের কথা জানানো হলেও তাকে দামিয়ে রাখা যায় নি। হাঁসি-মুখে নিজের চাকুরীর কনফারমেশন জেনে পরের দিনই চলে আসে কাজ করতে। ছেলেটা "শ্রীমঙ্গল আলিয়া মাদ্রাসা"য় এবার ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে। পড়াশুনা ছেড়ে দেয়নি, বরং আশায় আছে অফ-ডে এর জন্য। কারন, যদি কলেজে দু-একটা ক্লাস করতে পারে। আমি বরাবরই প্রথম থেকেই, চাকুরী ক্ষেত্র আমার জুনিয়ররা আমাকে "স্যার" বলবে সে বেপারখানা হজম করতে পারি না। আমি সবাইকেই বলি "ভাই" বলে ডাকতে, যাই হোক গত ৩/৪ মাস জুনেদ এখানে চাকুরী করলেও কখনো আমাকে ভাই বলে ডাকে নি। ওর ভিতরে খেয়াল করতাম চাকুরী হারাবার ভয় কাজ করে। সবাইকে অনেক বেশী ভয় পায়। মোটামোটি সবারই অনেক জুলুম হাসি মুখে সহ্য করে গেছে। আজ সকালে আমার কেবিন খানা পরিষ্কার করতে আসার পর কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি যে, তারা ২ ভাই আর ১টি বোন। তার বাবা সৌদি ছিলেন কয়েক বছর। দেশে ফেরার পর ব্যবস্যায় ধরা খেয়ে পুরো পথে বসে গেছে। তার বড় ভাইটিও শিক্ষিত, কিন্তু চাকুরী নামক সোনার হরিণখানা ধরা দিচ্ছে না তার কাছে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। জিঞ্জাসা করলাম বাসায় সবাই জানে না কি সে কি কাজ করে? উত্তরে সে বলে, "স্যার, বাসাত কইসি হারা দিন স্যার তারার লগে বই তাকি, আর আফনেরার কুনু কাগজ-ফাইল লাগলে ওতা আনিয়া দেই। কেউ ঘুরানিত আইলে চা নাস্তা আনিয়া দেই বার তাকি।" (স্যার বাসায় বলেছি, সারা দিন আপনাদের আশে পাশেই বসে থাকি, আপনাদের কোন কাগজ-ফাইল লাগলে সেগুলো এনে দেই। আর বাহিরের কোন গেস্ট আসলে চা নাস্তা এনে দেই) বাবা-মাকে দেয়া উত্তরখানা আংশিক সত্য ছিল, তবে তার দৈনন্দিন কাজের সিংহভাগই লুকিয়ে রেখেছিল সে, কষ্টের সেই কাজ গুলোর কথা বলে নি সে তার বাবা-মাকে। জিঞ্জাসা করলাম, "আর বাকি যে কাজ গুলো করো সেগুলো?" ওর উত্তর, "স্যার, হকলতা কইয়্যা দিলে আমারে ওনো আর কাম করাত আইতে দিবো নায়" (স্যার সব কিছু বললে বাসা থেকে এখানে কাজ করতে দিবে না) বাস্তবতাটা খুব ভালো ভাবেই বয়স বাড়িয়ে দিলো ছেলেটার... তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম শুধু, আর সে আপন মনে তার কাজ করে যাচ্ছে।
দেখতে দেখতে চোখের কোণে নিজের অজান্তেই কিছু একটা আটকে গেল, ঝাপসা হয়ে এলো সব কিছু। জুনেদ ছেলেটাকে কেন যেন বুকে জড়িয়ে ধরতে মন চাইলো, পরক্ষণেই আবার বাস্তবতার করুণ সেই হাসি আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমার নিজেকে... আমি অমানুষ, আমি নিকৃষ্ট, আমি সেই "অবাক"...