জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই আলো, জ্ঞানই আনে মুক্তি। মানুষের দুই ধরনের ক্ষুধার সৃষ্টি হয়। একটি হলো দৈহিক ক্ষুধা, অন্যটি হলো মানসিক ক্ষুধা।দৈহিক ক্ষুধার চাহিদা যেমন সাময়িক, তেমনি এটা সহজলভ্য। আর মানসিক ক্ষুধার চাহিদা যেমন, তেমনি এটা পূরণ করাও কঠিন। ইসলাম এমনি একটি মানবহিতৈষী ধর্ম, যা এই জ্ঞানরাজ্যের ক্ষুধা নিবারণে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে এবং নানাভাবে এর প্রতি উত্সাহিত করেছে। মুসলমানদের সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থ আল কোরআন শুরুই হয়েছে ‘পড়ো’ নির্দেশ দিয়ে। পবিত্র কোরআনে বারবার এরশাদ হয়েছে, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান ? তারা কখনও সমান নয়।শুধু ইসলামই নয়, অন্যান্য ধর্মেও মানুষকে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের উপর জোর দেয়া হয়েছে।
শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি সভ্য ও উন্নত হতে পারে না। ভোগ করতে পারে না তাদের স্বাধীনতার সুফল। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৪ বছর পর এসে বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার বেড়েছে উত্সাহব্যঞ্জকভাবে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও হতাশাব্যঞ্জক নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উত্কর্ষের এ যুগে আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি নানা ঘাত-অভিঘাত সত্ত্বেও। দেশের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে শিক্ষার আলো। প্রত্যন্ত অঞ্চলও খালি নেই প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা প্রাইমারি স্কুল থেকে।প্রতিটি শহরে গড়ে উঠেছে কলেজ-মহাবিদ্যালয়। দ্রুত বেড়ে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ ও শিক্ষিত শ্রেণীর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে ধনী-গরিব ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই যাচ্ছে পাঠশালায়। এমনকি শিক্ষার সৌভাগ্যবঞ্চিত গত প্রজন্মের প্রবীণরাও বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে। তবে এসব সত্ত্বেও যে সত্যটি অস্বীকার করার মতো নয় তা হলো, আদর্শ, চরিত্রবান দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করতে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ ও ফলপ্রসূ হবে না। সম্ভব হবে না সুখী-সমৃদ্ধশালী একটি দেশ গঠন ও দেশের প্রতিটি নাগরিকের মুখে হাসি ফোটানো। আগে মনে করা হতো, সামাজিক অপরাধের সঙ্গে শুধু অশিক্ষিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীই জড়িত; কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে র্যাব কর্তৃক পরিচালিত মাদক ও নৈতিকতাবিরোধী অভিযান সে ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছে। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা যেসব অসামাজিক ও নৈতিকতাহীন কর্মকা ে জড়িয়ে পড়েছে, তা দেখে দেশবাসী যুগপত্ বিস্মিত ও হতাশ হয়েছে। তখন একযোগে মিডিয়াগুলোতে লেখালেখি হয়েছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি এবং ধর্মীয় চেতনা হ্রাস পাওয়ার কারণেই এ চারিত্রিক ধস।
আজ দেশের এ ক্লান্তিকালে সবাই অনুধাবন করছেন যে, শিক্ষিত ও চরিত্রবান নাগরিক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। মানুষকে সুশিক্ষিত ও চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দরকার তাদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষার আলো এবং পরকালে জবাবদিহিতার ভয় জাগিয়ে দেয়া। এজন্য ইসলাম শুরুতেই মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও আলোকিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আসমানি প্রত্যাদেশের প্রথম শব্দই ছিল ‘পড়ো’। আর নবী মুহাম্মদ (সা.)-ও দ্ব্যর্থহীনভাবে শিক্ষার গুরুত্ব ঘোষণা করেছেন। বদর যুদ্ধে শত্রুপক্ষের যারা আটক হয়েছিল, তাদের মধ্যে পণমূল্য না থাকায় যারা মুক্তি পাচ্ছিল না তাদের জন্য তিনি নিরক্ষরকে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিলাভের সুযোগ দেন। এ থেকে তার শিক্ষার প্রতি অনুরাগ অনুমিত হয়। দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং নাগরিকের দুনিয়া ও আখেরাতের এ লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তেও চাই সবার কাছে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেয়া।
আজ ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ সমাজে শুধু গুরুত্বহীনই নয়, সমাজ থেকে তা বিদায় নেয়ারও পথে।অথচ ধর্মীয় অনুশাসনই মানুষকে চরিত্রবান করে তুলে। মানুষের মধ্যে বিবেক সৃষ্টি করে। তার মধ্যে খারাপ পথে যাওয়া ও চলার ব্যাপারে ভয়ভীতির সৃষ্টি করে। বিবেকের শাসনে শাসিত হওয়ায় অভ্যস্ত করে এই শিক্ষা। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের মধ্যে মায়া মমতা, ভালোবাসা, সহনশীলতা তৈরি করে। আর সেই ধর্মীয় শিক্ষার শুরু শিক্ষার হাতেখড়ি থেকে শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে থাকাটা জরুরি। প্রত্যেক ধর্মেই এই ধরনের শিক্ষা রয়েছে। বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অসংখ্য মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের আধুনিক ও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার নামে শিশুকাল থেকেই ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে রাখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে যে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতোও তা-ও দেয়া হচ্ছে না অনেক পরিবারে। পরিবারের মধ্যেও ধর্মীয় অনুশাসনের অনুপস্থিতি ও শিথিলতা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। অসংখ্য পরিবার আধুনিকতার নামে পোশাক-আশাক ও চালচলনে পশ্চিমা ও বিজাতীয় সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করছে। দেশী-বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত প্রায় উলঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ চালচলন, জীবন আচার সংবলিত অনুষ্ঠান, নাটক, সিনেমার খুন খারাবির কাহিনী, দৃশ্য প্রভৃতি বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবার ও সমাজে। কিছু টিভি চ্যানেল সিরিয়ালের নামে পরিবারের সদস্যদের অনৈতিক সম্পর্ক, পরকীয়া, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, বিত্তবৈভবে গা ভাসিয়ে দেয়া, অতি বিলাসী পোশাক, উগ্র সাজসজ্জা, বন্ধুবান্ধবীদের সাথে অবাধ মেলামেশার দৃশ্য ও কাহিনী প্রচার করছে, যা মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে সেই ধরনের জীবনে অভ্যস্ত হতে উসকানি দিচ্ছে। এর প্রভাব বেশি পড়ছে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীদের ওপর। ফলে স্বকীয় এবং অধিকাংশ মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি চাপা পড়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেশীয় টিভি নাটকে, উপন্যাস সিনেমায় ব্যঙ্গাত্মকভাবে ইসলামি সংস্কৃতিকে উপস্থাপনের ফলে ইসলাম সম্পর্কে তরুণসমাজে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্নভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রবণতাও দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। এভাবে সমাজ ও পরিবার থেকে ধর্মীয় শিক্ষা ও শিক্ষার প্রভাব ক্রমেই কমে আসার কারণেই মূলত মানুষের বিশেষ করে তরুণসমাজের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের জন্ম দিচ্ছে। তরুণসমাজ ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, পেথিডিন ইত্যাদি নেশায় আসক্ত হচ্ছে। বিপথগামী তরুণ-তরুণীরা নিজস্ব অন্ধকার জগৎ তৈরি করছে। তারা বন্ধুত্বের নামে অবাধ যৌনাচারেও লিপ্ত হচ্ছে। পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে নানা অঘটন ঘটাচ্ছে।ঐশীর মতো মেয়েরা তৈরি হচ্ছে । পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান আপন মেয়ের হাতে খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের দিকটি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই পুলিশ কর্মকর্তার ইংলিশ মিডিয়ামে ও লেবেল পড়ু–য়া মেয়ে মাদকের অন্ধকার জগতে পা বাড়িয়ে বিপথগামী হয়। অনৈতিক উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বাবা-মা মেয়েকে তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলে আপন কন্যাই বন্ধুদের নিয়ে নিজ বাসায় নিজ মা-বাবাকে খুন করার মতো লোমহর্ষক ঘটনার জন্ম দেয়। কিন্তু কেন এমন ঘটছে, অথচ শিক্ষার হার দিন দিন বাড়ছে, শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে? এর একটিই কারণ, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব।যদি মানুষ ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয় তবে সে মাদক সেবন,দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি,খুন-খারাবী, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি যাবতীয় পাপাচার ও জুলুম-নির্যাতন করবেনা।এর ফলে দেশ হতে অন্যায়ের পরিমাণ কমবে, পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে আর এভাবেই একটি পরিবার,একটি সমাজ ও একটি রাষ্ট্র উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে।
পরিশেষে বলব,আমাদের সুশিক্ষা অর্জন করে সে আলোকে নিজেকে, সমাজকে পথ দেখাতে হবে,পরিচালিত করতে হবে, স্রোতের প্রতিকূলে চলতে হবে,অনুকূলে গা ভাসিয়ে দেয়া চলবে না।নিজেদেরকে আদর্শ দেশপ্রেমিক ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তূলতে হবে।মনে রাখতে হবে “When wealth is lost nothing is lost. When health is lost something has been lost. When character is lost everything is lost.
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:২৭