somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হরিণ লালন-পালন নীতিমালা-২০১০: বিলুপ্তির পথে হাঁটবে কি চিত্রা হরিণ?

২৯ শে মে, ২০১১ সকাল ৯:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বন্যরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা এই কথাটি এখন বুঝি গত হতে চলল। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় “হরিণ লালন-পালন নীতিমালা-২০১০” বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে শর্তসাপেক্ষে যে কেউই হরিণ লালন-পালনের সুযোগ পাবেন। খবরটি জানার পর থেকে গুগল করে নীতিমালাটির পূর্ণাঙ্গ কপি না পেয়ে অবশেষে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে লেখাটি সাজাতে হল।

কি আছে এই নীতিমালায়?

নীতিমালাটি কেবল চিত্রা হরিণের জন্যই শুধু প্রযোজ্য৷ কেউ অন্য হরিণ পুষলে তাঁর বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লাইসেন্সধারীরা লোকালয় বা জনবসতিতে হরিণ পালনের সুযোগ পাবেন৷
হরিণ লালন-পালনের জন্য উপযুক্ত শর্ত পূরণ করে আগ্রহী ব্যক্তিকে ফির বিনিময়ে বন বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে৷ লাইসেন্স ফি পাঁচশ' টাকা৷
ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিটি হরিণের জন্য প্রাথমিকভাবে একশ' টাকা করে পজিশন ফি দিতে হবে৷ পরবর্তী প্রতি বছর একশ' টাকায় তা নবায়ন করা যাবে৷ (উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রতি জোড়া হরিণের জন্য পজিশন ফি ১০ হাজার টাকা৷ আর প্রতি বছর নবায়ন ফি জোড়া প্রতি ৫ হাজার টাকা৷)
মহানগর এলাকায় প্রতি খামারের জন্য অনুমোদন ফি দুই হাজার টাকা। জেলা সদর এলাকায় প্রতি খামারের জন্য ফি আড়াই হাজার টাকা। অন্য এলাকায় খামারের জন্য ফি দুই হাজার টাকা।
পালনকারীকে হরিণের বসবাস উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
চিত্রল হরিণ লালন-পালন ও ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে।
চিত্রল হরিণ পাওয়া যায় এমন বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে এই হরিণ পোষা যাবে না।
ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১০টি চিত্রল হরিণ পোষা যাবে। এর বেশি হলে খামার হিসেবে অনুমতি নিতে হবে।
বন বিভাগ ও চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী হরিণ বিক্রি করতে পারবে।
খামারের হরিণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বন সংরক্ষক ও ব্যক্তিগত হরিণের ক্ষেত্রে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন দিতে হবে। হরিণ পরিণত হলে তার মাংস খাওয়া যাবে। তবে বাচ্চা প্রসব করলে বা মারা গেলে ঘটনা ঘটার ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের কাছে তা জানাতে হবে। হরিণের মাংস বা কোনো অঙ্গ স্থানান্তর করতে হলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে স্থানান্তর অনুমোদন নিতে হবে। কাউকে হরিণ দান করতে হলেও বন বিভাগকে অবহিত করতে হবে।


হরিণ লালন পালনে যৌক্তিকতা কি?

হরিণ না মেরে, বাঁচিয়ে রেখে কাজে লাগানোর সুযোগ।
নিঝুম দ্বীপের বনাঞ্চলের মত স্থান থেকে অতিরিক্ত হরিণ সরানো কারণ বাড়তি হরিণের জন্য খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে
দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হরিণ চাষ বাড়বে৷ অনেকেই হরিণ লালন-পালনে আগ্রহী হবেন।
কম ফি দিয়ে লাইসেন্স পেলে প্রতি বছর বাচ্চা হরিণ পালনে অসুবিধায় পড়তে হবে না, যা অনেককে উত্সাহিত করতে পারে।
এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে৷


পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন?

বন বিভাগের অগোচরে কিংবা চোরাকারবারিতে এখনও হরিণ শিকার সেখানে যে বেড়ে গেছে, এ কথা সকলের জানা৷ হরিণ না মেরে, বাঁচিয়ে রেখে কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টির করতে জনসচেতনতা তৈরির আহ্বান জানানো হলেও এ পদক্ষেপে পরিবেশবাদীরা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না৷ তারা দেশের মূল বনভূমির হরিণের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এ নীতিমালার সুযোগ নিয়ে একটি শ্রেণী বনাঞ্চল থেকে হরিণ উজাড়ের উৎসবে নামতে পারে৷ অতীতে রফতানির কথা বলে দেশের ব্যাঙ, কচ্ছপকে (টার্টল) এভাবে বিপন্নতার মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
ঢালাওভাবে হরিণ পালনের অনুমতি দিলে এর অপব্যবহার হতে পারে। বন্য হরিণ আরও বিপন্ন হতে পারে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই বন্য প্রাণী ব্যক্তিগতভাবে পালনের অনুমতি রয়েছে। জোরালো তদারকি ছাড়া হরিণ পালনের অনুমতি দেওয়া হলে সুন্দরবনসহ অন্যান্য স্থানের বন থেকে হরিণ চুরি বেড়ে যেতে পারে।
সরকারের উচিত হবে হরিণের উৎসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা। নিয়ন্ত্রিতভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা রাখা।
বন বিভাগ বনের হরিণই ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছে না। নতুন আইন কার্যকর হলে বনের হরিণ ও ঘরের হরিণ মিশে যেতে পারে। ফলে হরিণ পালন নীতিমালা কার্যকর করতে হলে এর অপব্যবহার তদারকির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে।


বর্তমান বাস্তবতা:
গোস্ত ও চামড়ার জন্য যথেচ্ছ শিকারের কারণে ৫০-এর দশক থেকে বাংলাদেশে হরিণের সংখ্যা হ্রাস পায়। কিন্তু ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অধ্যাদেশের মাধ্যমে যথেচ্ছ শিকার নিষিদ্ধ করার পর এ অবস্থার উন্নতি হয়। বর্তমানে সুন্দরবনে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার হরিণ রয়েছে। আর নিঝুম দ্বীপে আছে ২০ হাজারের বেশি হরিণ। অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যায়- বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই লাখ চিত্রল হরিণ রয়েছে। চিত্রল হরিণের মূল বসতি এলাকা সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় দেড় লাখ। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে ১২ থেকে ১৫ হাজার। এ ছাড়া চর কুকরিমুকরি, বাঁশখালীসহ উপকূলীয় বনে বিচ্ছিন্নভাবে হরিণের বসতি রয়েছে। অবশ্য গত সিডরের সময় নিঝুম দ্বীপে কত হরিণ প্রাণ হারিয়েছে তার কোন তথ্য জানা যায় না।

বাংলাদেশে মোট ৫ প্রজাতির হরিণ রয়েছে৷ এর মধ্যে দুই প্রজাতির হরিণ, যথাক্রমে হগ ডিয়ার ও সোয়াম্প ডিয়ার চলে গেছে বিলুপ্তির তালিকায়৷ বাকী তিন প্রজাতির মধ্যে প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে বারকিং হরিণ ও সাম্বার হরিণ যা এখনও সিলেটের গভীর বন ও কাপ্তাই এবং বান্দারবানে কদাচিৎ দেখা যায়৷ চিত্রা হরিণ এদেশে অন্যান্য হরিণের চেয়ে এখনও বেশ ভালো৷ কবে সুন্দরবন এ নিঝুমদ্বীপ ছাড়া এদেশের চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা, মধুপুর বন ও সিলেটের গভীর বনে হাতে গোনা কিছু চিত্রা হরিণ থাকতে পারে৷

এরকম একটি পর্যায়ে নামমাত্র মূল্যে হরিণ লালন-পালনের সিদ্ধান্তটি বড় ধরণের শঙ্কার। কারণ বন থেকে কত সংখ্যক হরিণ ধরা হবে তা অজানা। যেখানে প্রতিটি হরিণের বর্তমান বাজার মূল্য ৮০ হাজারের উপর। সেখানে একজন লালন-পালনকারীকে দিতে হবে হরিণ প্রতি বছরে মাত্র ১০০ টাকা। অন্যদিকে ফার্মিং এর নামে দেশে ব্যাঙ ও কচ্ছপের কি দশা হয়েছিল তা আমাদের স্মরণে থাকার কথা। আর বর্তমানে সুন্দরবন অঞ্চলে কাঁকড়া নিয়ে চলছে একই কাহিনী। এবারের পালা কি চিত্রা হরিণ?

সুন্দরবন আর নিঝুমদ্বীপের হরিণের বর্তমান সংখ্যা আমাদের আপ্লুত করলেও সংখ্যাটি মোটেও মাত্রাতিরিক্ত নয়। বলা হয়ে থাকে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের লোকালয়ে চলে আসার অন্যতম কারণ খাদ্য সংকট আর এই বাঘের প্রধান খাবার হরিণ। আরও বলা হয়ে থাকে বন বাঘকে আশ্রয় দেয় আর বনকে রক্ষা করে বাঘ। তাই সুন্দরবন, বাঘ আর হরিণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই সহজসরল কথায় বলা যায় হরিণ না থাকলে বাঘ থাকবে না, বাঘ না থাকলে সুন্দরবনও থাকবে না। আর সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশের আর কি হারানোর অবশিষ্ট থাকবে?

দেশের পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা এ শঙ্কা থেকেই বারবার জোরালো তদারকির কথা বলছেন। কিন্তু দেশে তদারকি ব্যবস্থার উপর পূর্ণ আস্থা রাখা কারও পক্ষে সম্ভব কি? সে আস্থা না থাকায় এই শঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উড়িয়ে দেয়া যায় না এর অপব্যবহারের।

বন্যপ্রাণী বন থেকে সরাসরি ধরে এনে লালন-পালনের বিষয়টি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সমার্থক নয়। যদি বন্য প্রাণী লালন-পালন বা পোষার সুযোগ করে দেবার কোন যৌক্তিক কারণ থাকে তবে অত্যন্ত সীমিত ভাবে সরকারী পর্যায়ের ফার্মে (যেমন যেমন মৎস্য-বীজ উৎপাদন খামার) লালন-পালন ও প্রজননের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম তৈরি করে তা সাধারণ মানুষের মাঝে কেবলমাত্র পোষার জন্য (মাংস খাওয়া বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়) প্রচলিত বাজার দরে (কোনভাবেই নাম মাত্র মূল্যে নয়) শর্ত সাপেক্ষে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে, নতুবা নয়। বর্তমান নীতিমালার মত বন থেকে সরাসরি ধরে এনে এমন গণ খামার বা গণ লালন-পালন ব্যবস্থার নিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হতে বাধ্য।

তথ্যসূত্র:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১১ সকাল ৯:৪০
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×