somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঁধমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশায়

১১ ই আগস্ট, ২০১১ দুপুর ১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রকৃতিকে ততটাই পরিবর্তন করা যায় যতটা সে নিজে থেকে মেনে নেয়। এই সহজ সরল সত্যটি জানার পারও মানুষ তার স্বার্থ, লোভ আর ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে অবিবেচকের মত প্রকৃতিকে মাত্রারিক্ত পরিবর্তন করে চলেছে। ফলশ্রুতিতে একটা সময় পর প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে নতুন নতুন সমস্যার আবির্ভাব ঘটে যার সমাধান করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। শুধু বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীজুড়ে বিবেচনাহীনভাবে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ সাময়িকভাবে মানুষের আবাস ও ফসলের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করলেও শেষ পরিণতিতে যে বিপর্যয় নেমে আসে তা বড় ধরণের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়। এই সহজ সমীকরণটি একুশ শতকে এসে অনুধাবন করতে পেরে অনেক উন্নত দেশ তাদের শত শত বাঁধ এর মধ্যেই ভেঙ্গে দিয়েছে এবং দিচ্ছে কেবলমাত্র প্রকৃতিকে তার মতো করে চলার সুযোগ করে দেবার জন্য (একটা পর্যায়ে অবশ্য তা না করে কোন উপায়ও থাকে না)। কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশ এখনও সেই আশির দশকের আদি ধ্যান ধারণা নিয়েই একের পর এক বাঁধ দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এর আশপাশের বিশেষত উজানের দেশ ভারত ও চীন বিচার বিবেচনাহীনভাবে একান্তই নিজেদের স্বার্থে একের পর এক বাঁধ দিয়ে যাচ্ছে। যার ক্ষতিকর প্রভাব তাদের নিজের দেশে যেমন পড়তে শুরু করেছে তেমনই ভাটির দেশ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির হুমকিতে পড়েছে বাংলাদেশ। দেশের ভূপ্রকৃতির বড় ধরণের পরিবর্তন ইতোমধ্যে দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে। দেশের মৎস্য সম্পদসহ সকল জলজ সম্পদ আজ ধ্বংসের প্রান্তে। অনেক হারিয়ে যাওয়া দেশী বর্ষালী ধানের প্রজাতির সংরক্ষক হচ্ছে ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র। এই ক্ষতি উত্তরণের একমাত্র স্থায়ী পথ ক্ষতিকর বাঁধ ভেঙ্গে ফেলে ভূ-প্রকৃতিকে তার আগের অবস্থায় যতটা সম্ভব ফিরিয়ে দেয়া। নতুবা প্রকৃতি তার মত করে প্রতিশোধ নেয়া ইতোমধ্যে শুরু করেছে এবং শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা আমাদের চিন্তারও বাইরে।

সবচেয়ে বিস্ময় কর বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের পক্ষে (পদ্মা নদীর উপর নির্মিত ব্যারেজের নাম কেন গঙ্গা ব্যারেজ তার কোন উত্তর আমি খুঁজে পাই না। সম্ভবত কোন স্বপ্নদ্রষ্টার নাম কেউ প্রস্তাব করে নি) । এমন কি ভারতের টিপাইমুখ বাঁধের বিপক্ষে যারা কথা বলে থাকেন তাদের অনেকেই যখন গঙ্গা ব্যারেজের পক্ষে কথা বলেন তখন বিস্ময়ের সীমা থাকে না। অনেকেই এমন স্বপ্নে বিভোর যে তারা মনে করেন গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ হলেই ফারাক্কার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে অথবা ভারতকে একটা উচিত শিক্ষা দেয়া হবে। এই প্রতিশোধ স্পৃহা আর আত্মতৃপ্তিতে তারা এতটাই মগ্ন যে কী উপকার হবে তার হিসেব করলেও দীর্ঘ মেয়াদে কী ক্ষতি হবে তার হিসেব কেউ বিবেচনায় নিচ্ছে বলে মনে হয় না।

একটা মিথ্যা যেমন হাজার মিথ্যার জন্ম দেয় তেমনই একটি বাঁধ হাজারটা বাঁধের জন্ম দেয় এবং উভয়ক্ষেত্রেই পরিণতিতে ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। দেশের সবচেয়ে বড় বাঁধ কাপ্তাই থেকে কতটা বিদ্যুৎ আর হ্রদ থেকে কতটা মাছ পাওয়া গেছে তার হিসেব পাওয়া গেলেও কত বাস্তুভিটা ডুবে গেছে, কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, কত ফসলের জমি তলিয়ে গেছে (এত বছর ধরে সেখানে কতটা ফসল ফলত), কত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তার হিসেব কাউকে করতে দেখা যায় না। বিদ্যুৎ, মাছ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সহজ জলপথের দোহায় দিয়ে পৃথিবীর আর কোথাও এত সংখ্যক বাস্তুভিটা আর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে দেয়ার নজির আছে কি? গঙ্গা ব্যারেজ হলে দেশের পদ্মা অববাহিকার দক্ষিণের ছোট-বড় নদী ও তৎসংলগ্ন এলাকা স্বল্পকালীন সময়ের জন্য উপকৃত হলেও এ নদীর পানি এতদিন ধরে যেভাবে মেঘনায় পড়েছে তার কী হবে সে সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে শুনি না।

তেমনই ভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ আর উচ্চ ফলনশীল ধানের উৎপাদন বাড়ানোর নামে সারা দেশে সূতা ছেড়া জালের মত যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তার ক্ষতির তীব্রতা কাপ্তাই ও গঙ্গা ব্যারেজের চেয়ে হাজার গুন বেশী তা হলপ করে বলা যায়। এতে করে বন্যা তো নিয়ন্ত্রণ করা যায়ই নি বরং তার স্থান কাল তীব্রতার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। প্রতি বছরই বাঁধ ভেঙ্গে যেয়ে বন্যার তীব্র ঝুঁকির মধ্যে চাষ করা উচ্চ ফলনশীল ধান হারিয়ে কৃষকরা আজ শস্যবীমার দাবী উত্থাপন করছে। এ দাবী তারা করতেই পারে কারণ আমরাই তাদেরকে আশ্বাস দিয়েছি এবং লোভ দেখিয়েছি এমন ঝুঁকির মধ্যে উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষ করার। সারা দেশের সকল জমিতে বছরজুড়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান আবাদ করতেই হবে (বন্যার ঝুঁকিতে হলেও) এমন দৃষ্টিভঙ্গি একুশ শতকের কৃষির সাথে যায় না। বরং প্রাকৃতিকভাবে যে জমি যেমন ধানের উপযোগী, যে ঋতু যে ধানের উপযোগী তেমনই ধান নির্বাচন করা প্রয়োজন। তাতে ব্যক্তিগত উৎপাদনে কম-বেশি হলেও সামস্টিক উৎপাদন খুব একটা কম হবে না বিশেষত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করলে কারণ তাতে লাভের পরিমাণ সামান্য কমলেও ঝুঁকি কমে যায় শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশের কতটা জমিতে ধান চাষ হয়? কতটা জমিতে ক্ষতিকর তামাকের চাষ হয়? সৌখিন ফুলের চাষ? রপ্তানি-মুখী সবজির চাষ? কতটা জমি নষ্ট করা হয়েছে এই ক্ষতিকর বাঁধ নির্মাণের জন্য? বাঁধের জন্য ব্যবহৃত জমিতে গত ত্রিশ বছরে কতটা ধান আবাদ করা সম্ভব হত তার হিসেব কি কারও কাছে আছে?

নিচু এলাকায় প্রতি বর্ষায় এই ধানের জমি প্লাবিত হলে তা পরিণত হয় দেশীয় ছোট মাছের প্রজননক্ষেত্রে। নদী থেকে মা-বাবা মাছেরা সহজেই (বাঁধ না থাকায়) প্লাবনভূমিতে প্রবেশ করে প্রজননে অংশ নিত। সে সময় মাছ যে কিনে খেতে হয় তাই গ্রামের মানুষ জানতো না আর আজ সবস্থানে মাছের জন্য হাহাকার। সেই প্লাবনভূমিও আর নেই সেই মাছও আর নেই। গত ত্রিশ বছরে মাছের কত প্রজাতি প্রায় হারিয়ে গেছে বা হারানোর পথ ধরেছে তা জানা গেলেও এসময়ে কত মাছ উৎপাদন হত তার হিসেব ক্ষতির মধ্যে বিবেচনায় নিতে হবে যা কখনও বিবেচনা করা হয়নি।

বাংলাদেশের মত গঠন প্রক্রিয়া চলমান একটি ব-দ্বীপের ভূ-প্রকৃতিকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছে এই বিবেচনাহীন বাঁধের বিস্তার। তাই আমরা চাই বাঁধ মুক্ত বাংলাদেশ। বাঁধ মুক্ত বাংলাদেশ বলতে বাঁধ বিহীন বাংলাদেশকে বোঝানো হয় নি। বাঁধ মুক্ত বাংলাদেশ বলতে কেবলমাত্র স্বল্প পরিসরে মানুষের প্রত্যক্ষ উপকারের সাথে সংশ্লিষ্ট বাঁধ ছাড়া সকল প্রকার ক্ষতিকর বাঁধ মুক্ত বাংলাদেশকে বোঝানো হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ একদিন বাঁধমুক্ত হয়ে তার প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারবে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×