somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রবাসে সন্তানদের বাংলা শেখানোর চ্যালেঞ্জ

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সকাল ১০:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাঙ্গালীর মাতৃভাষাগত প্রাণ। ভাষার জন্য রক্ত দেয়া জাতি আর আছে কিনা আমার জানা নেই। বাঙ্গালী জাতির পরিচয়টাও মূলতঃ ভাষার কারনে, রক্তের মিলের কারনে নয়। অনেক জাতির লোকেরাই বিভিন্ন উপলক্ষে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করে। আস্তে আস্তে তারা এখানকার ভাষা ব্যবহার করতে করতে বাঙ্গালী হয়ে গিয়েছেন। এজন্য বাঙ্গালীরা বিভিন্ন রক্তের, রঙের, আকৃতির এবং উচ্চতার। শুধুই ভাষাতেই একতা। তাই এ ভাষার প্রতি তাদের বিরাট ভালবাসা। বাঙ্গালীরা যেখানেই থাকেননা কেন ভাষার প্রতি দরদ তাদের সবসময়ই থাকে। যারা বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য চলে এসেছেন তারাও চান মাতৃভাষার নিয়মিত চর্চা করতে। তারা চান তাদের সন্তানরাও – যারা অনেকেই বাংলাদেশের নাগরিক নয় – বাংলা শিখুক। কিন্তু বিদেশে সন্তানদের বাংলা শেখাতে গিয়ে তারা পড়েন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো হলঃ বাংলার আঞ্চলিক ভাষার বিভিন্নতা, অনেক প্রবাসী বাঙ্গালীর বাংলা সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের অভাব, বাংলা শিখানোর প্রতিষ্ঠানের অভাব, আর সর্বোপরি পরিবেশের প্রভাব।

বাংলা ভাষার আঞ্চলিক বিভিন্নতার কারণে অনেক সময় বিদেশে বাংলা শেখানো মুশকিল হয়ে পড়ে। অনেক পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের সাথে শুধুমাত্র নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। ফলে ঐ সব ছেলেমেয়েরা শুদ্ধ বাংলা শিখতে পারেনা। যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা তাদের পিতা-মাতার কাছে শুদ্ধ বাংলা শেখার সুযোগ পায়না তারা পরবর্তীতে আর সাধারণত শুদ্ধ বাংলা বলতে পারেনা। ফলে তারা লজ্জায় আর বাংলা বলতেও উৎসাহিত হয়না। এদের কারনে আবার অন্য বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরাও বাংলা শিখার ঝামেলায় পড়ে।

কোন কোন বাবা-মা তাদের সন্তানদের সাথে শুদ্ধ চলিত বাংলায় কথা বলেন। ফলে তারাও শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে শুরু করে। কিন্তু যখন সে বাচ্চারা অনান্য বাংলাদেশী বাচ্চাদের সংস্পর্শে আসে বাঙ্গালীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসার মাধ্যমে তখন তার ভাষাতেও পরিবর্তন হতে শুরু করে। তার ভাষা আস্তে আস্তে আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট হতে থাকে। ‘চ’, ‘ছ’ এবং ‘স’ সবগুলোই ‘স’ এর মত করে সে উচ্চারণ করতে থাকে। ‘জ’, ‘য’ এর উচ্চারণ করা হয় বাংলায় অবর্তমান ইংরেজী ‘z’ বা আরবী ‘zay’ মত করে। যাবে, খাবে, ইতাদির স্থলে সে বলতে শুরু করে যাবা, খাবা ইত্যাদি। তাকে যতই বুঝিয়ে বলা হোক যে ওভাবে বলাটা শুদ্ধ নয়, সে শুনতে নারাজ। তার বক্তব্য হলো তার সব বন্ধুরা তার বাবা-মার মত করে বাংলা বলেনা। তাই সেও বলবেনা, বরং তার অন্যান্য বাংলাদেশী বন্ধুদের মত করেই সে বলবে। এটা বিরাট এক সমস্যা।

সন্তানদের বাংলা শেখানোর ক্ষেত্রে অন্য আরেকটি সমস্যা হলো অধিকাংশ পিতামাতার নিজেদেরই বাংলা সম্পর্কে অজ্ঞতা। কিছু এলাকার লোক আছেন যারা মনে করেন তাদের ভাষাটাই বাংলা থেকে আলাদা। ফলে তারা বাংলা শেখানোর পরিবর্তে ছেলেমেয়েদের তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষাই শুধু শেখান। তাদের মতে তাদের অঞ্চলের ভাষা এক আর সারা বাংলাদেশের ভাষা অন্য আরেকটি। ফলে তারা নিজেদেরকে বাঙ্গালীই ভাবেননা। সুতরাং শুদ্ধ বাংলা শেখানোর কোন প্রয়োজনীয়তা তারা উপলব্ধি করেননা।

ভাষা সংক্রান্ত অভিভাবকদের দুর্বলতার আরেকটি দিক হল, অনেক প্রবাসী বাংলাদেশীই শুদ্ধ করে বাংলা বলতে এবং লিখতে পারেননা। বাংলা বর্ণগুলোর শুদ্ধ উচ্চারণ অধিকাংশ বাংলাদেশী পিতামাতাই ঠিক মত করতে পারেননা। একবার এক বাচ্চাকে দেখলাম সে তার চাচাকে ডাকছে এভাবে, “সাস্‌সু” [sassu]। জিজ্ঞেস করাতে সে বলল সে তার চাচাকে ডাকছে। বলা হলো ওটা সাস্‌সু নয় চাচ্চু। তার বক্তব্য হলো বাবা-মা তাকে ওভাবে উচারণ করতে শেখায়নি। একটি পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে বাংলাদেশী বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পাঠানো অসংখ্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পড়ার সুযোগ হয় আমার প্রতি সপ্তাহে। এতে শিক্ষিত লোকদের বাংলা লেখা পড়তে গেলে বিরক্তিতে মন ভরে যায়। অসংখ্য বানান ভুল, অসম্পূর্ণ বাক্য, অশুদ্ধ বাক্য গঠন, ইত্যাদি অতি সাধারণ ব্যাপার। কখনো কখনো তারা কি ব্যক্ত করতে চেয়েছেন তার পাঠোদ্ধার করতেই হিমশিম খেতে হয়। ভাবতে তখন কষ্ট হয় যে আমরাই এক জাতি যারা মাতৃভাষার অধিকারের দাবীতে জীবনের কুরবানী দিয়েছি। এই দুর্বল ভাষাজ্ঞানের অধিকারী পিতা-মাতারা তাই সহজেই তাঁদের সন্তানদের বাংলা শেখাতে পারেননা।

বাংলাদেশী বাঙ্গালীদের বাংলা উচ্চারণের দুর্বলতার কারন হলো দেশেই বাংলা উচ্চারণ রীতি শেখানো হয়না স্কুলে। ফলে বিভিন্ন এলাকার লোকজন নিজের মতো করে বাংলা পড়তে শেখেন। অনেক অঞ্চল আছে যেখানে ‘প’ ও ‘ফ’ এর একই উচ্চারণ এবং ‘চ’ ও ‘ছ’ এর একই উচ্চারণ করা হয় ‘স’এর ঢঙে; পার্থক্য করা হয় শুধু ছোট আর বড় বলে। একই অবস্থা ‘দ’ ও ‘ধ’, ‘ড’ ও ‘ঢ’ এবং আরো অনেক বর্ণের বেলায়। দন্ত্য ‘স’ তার নিজস্ব উচ্চারণ হারিয়ে বাংলায় হয়ে গিয়েছে তালব্য ‘শ’ এর ন্যায়। ফলে সমস্যা বেড়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক কোন ব্যবস্থা থাকলে হয়তো বাংলা ভাষা শেখানো কিছুটা সহজ হত। কিন্তু প্রবাসের বিভিন্ন জায়গাতেই এরকম প্রতিষ্ঠানের রয়েছে বিরাট ঘাটতি। কোথাও প্রতিষ্ঠান থাকলেও তার সমর্থনের রয়েছে মারাত্মক অভাব। যথাযথ সমর্থন না পেয়ে উদ্যোক্তারা শেষ পর্যন্ত ঝিমিয়ে পড়েন। আর তাদের বাংলা শেখানোর উদ্যোগে পড়ে ভাটা।

সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি প্রবাসীদের ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা চর্চার পেছনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাহলো পরিবেশ। অনেক বাচ্চারা কথা বলতে শুরু করে সুন্দর বাংলা দিয়ে, কিন্তু একটু বড় হলেই আর ওরা বাংলা বলতে চায়না এবং এতে অনভ্যস্থ হয়ে পড়ে। এ সমস্যাটা সবচেয়ে বেশী প্রকট হয়ে পড়ে যখন তারা স্কুলে যেতে শুরু করে। স্কুলের ভাষা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইংরেজী, বলেই বাচ্চারা সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাদের বন্ধু এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে ঐ ভাষায় কথা বলতে তারা এত বেশী অভ্যস্থ হয়ে পড়ে যে তারা আর কোনভাবেই বাংলা বলতে পারেনা। বরং বাংলা বলতে জোর করার মানে হয় তাদেরকে আযাবে নিক্ষেপ করার মত। স্কুল ছাড়াও তারা প্রতিদিন মিডিয়ার, বিশেষ করে টেলিভিশনের মুখোমুখি থাকছে ঘন্টার পর ঘন্টা, যার ভাষা বাংলা নয়। সেখানেও তারা বাংলা বিমুখ হয়ে গড়ে উঠে।

কিছু কিছু অভিভাবক আছেন যারা বাংলা শেখা বা বলার জন্য সন্তানদের কোন পরিবেশই দেননা। তাঁরা তাদের সন্তানদের মাতৃভাষাই বানিয়ে দেন ইংরেজী। কারন তাদের বাচ্চারা কথা বলতে শুরু করলেই তাঁরা তাদের সাথে ইংরেজীতে কথা বলা পসন্দ করেন, যদিও বাচ্চারা বড় হয়ে তাদের বাবা-মায়ের ইংরেজী উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি করতেও দ্বিধা করেনা। এশ্রেণীর অভিভাবকরা বুঝেননা যে এখানকার বাচ্চারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ইংরেজী শিখবে। ইংরেজী তাদেরকে বলে শেখাতে হবেনা; বরং তাদের যা বলে শিখিয়ে অভ্যেস করাতে হবে তা হলো মাতৃভাষা।

প্রকৃত ব্যাপার হল বিদেশে সন্তানদের বাংলা শেখানো অত্যন্ত কঠিন একটি বিষয়। তবে আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠা থাকলে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিলে সন্তানদের মোটামুটি চলনসই বাংলা শেখানো সম্ভব। এক্ষেত্রে পিতামাতাকে সচেতনভাবে পারিবারিক পরিবেশে বাংলার চর্চা করতে হবে। আঞ্চলিকতা বাদ দিয়ে শুদ্ধ চলিত বাংলায় সন্তানদের সাথে ঘরে নিয়মিত কথা বললে তারা তখন অন্য বাঙ্গালী ছেলেমেয়েদের সাথে বাংলা কথা বলার সমস্যায় পড়বেনা। ফলে বাংলা বলতে তারা উৎসাহিত হবে। নাহলে তারা বাঙ্গালীদের ভাষার বিভিন্নতা দেখে এ ভাষা বলা থেকে বিরত থাকবে। এছাড়াও তাদের জন্য শিক্ষণীয় অথচ আকর্ষণীয় বাংলা মিডিয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যা দেখে তারা বাংলা শিখতে পারবে ও বলতে উৎসাহিত হবে। আর সরকারী পর্যায়ে বাংলাদেশী কুটনৈতিক মিশনগুলো বাংলা শেখানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা দিতে পারে অথবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতা দান করতে পারে।
নিউ ইয়র্ক, ১ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সকাল ১০:১৮
২৯টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×