somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

|| মা-কে বলছি ||

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১০:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মা, কেমন আছো মা? চুপটি করে লুকিয়ে বসে আছ বুকের ভেতরে, হৃদয়ের গভীর গহনে। কথা বলনা, শুধু দেখ। তোমার সাথে বলা আমার সব কথা কি শুনতে পাও? মা, আমি যে আমার না-বলা কথাগুলো অনুক্ষণ তোমার সাথেই বলি।
তোমার হাসিমাখা মুখ আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়, শান্তির পরশে আমার না ঘুমানো চোখ দুটো বুজে আসে ঘুমের আবেশে। ফিসফিস করে বলি “আমার মা সবার সেরা, আমার মা সবার চেয়ে ভালো, আমার মা সবথেকে সুন্দর, আমার মা সর্বশ্রেষ্ঠ মা” ।
আসলে প্রতিটি সন্তানের কাছেই তো তার ‘মা’ সর্বশ্রেষ্ঠ মা। মায়ের যে কোন বিকল্প নেই, নেই কোন তুলনা। মায়ের মত সহনশীল, মায়ের মত কোমলমতি আর কে আছে?
তবু, এত কোমলমতি মা আমার এতটা কঠোর কেমন করে হতে? ছোটবেলায় যখনি কোন অনুযোগ বা নালিশ নিয়ে হাজির হয়েছি অথবা খেলতে গিয়ে সমবয়সী কারও সাথে ঝগড়া বেঁধেছে, বিষয়টা তোমার গোচরে এলেই, প্রথমপ্রশ্ন “তুমি কি করেছো?” আগে আমাদের সত্য স্বীকার করাতে, শাসন করতে, তারপর অন্য বিষয়। আর সেই কোন ছোটবেলাতেই শিখে গিয়েছিলাম কালো বন্ধুকে 'কালো' বলে বিদ্রুপ করা যাবে না, এক চোখ নষ্ট বন্ধুটিকে 'কানা' বলে কখনই গালি দেয়া যাবে না। এমনকি ঝগড়ার সময় সে মারলে, তার প্রত্যুত্তরেও না। এমনি করেই হ্য়তো অবচেতনেই 'নৈতিকতা' বিষয়টি গেঁথে গিয়েছে তোমার সন্তানদের অন্তরে। এখনও তাই এই নষ্ট সময়ের নষ্ট থাবা বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটতে পারেনি তোমার সন্তানদের, কিংবা আমাদের সন্তানদের। বাকি আল্লাহ্‌র ইচ্ছা।
মা চোখ বুজলেই দেখি তোমার সেই আলোময় দ্যুতি ছড়ানো মুখ। সারাদিন আমাদের সুখের জন্য কাজ করতে, এতটুকু সময় পেতে না বলে নিজের বিনোদনের সময়টি বের করে নিয়েছিলে রাতের বেলা, ঘুমানোর সময়টিতে। মফস্বল শহরে তখন বৈদ্যুতিক আলো ছিলনা। সব কাজ সেরে আমাদের সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তুমি তোমার বিনোদনের আয়োজন করতে। তোমার শিয়রের কাছে একটা চেয়ার, তার উপর জলচৌকি, তারও উপরে হারিকেন বাতি রেখে তুমি বই পড়তে। কত রকমের বই যে তুমি পড়তে! বই পড়ার, জ্ঞান অর্জন করার এ তীব্র আকাঙ্খা সারাদিনের ক্লান্তির পড়ও তোমাকে ঘুমুতে দিত না। সেই কেরোসিনের আলো আলোকিত করত তোমাকে, আর তোমার সেই আলোকিত জীবনের দ্যুতি আলোকিত করেছে পরবর্তী তিনটি প্রজন্মকে। বই পড়ে পড়েই তুমি হয়েছিলে যুগের চেয়ে আধুনিক, শব্দ ও তথ্য ভান্ডারে সমৃদ্ধ। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় তাই বাংলা বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান খুব সহজে পেয়ে যেতাম তোমার কাছেই।

পড়তে ভালবাস। তাই ঈদে প্রথম আলোর ঈদসংখ্যাটা পাঠাতাম। খুশি হতে। কিন্তু, শেষদিকে চোখের আলো কমে আসছিল বলে এত ছোট লেখা পড়তে পারতেনা। তবুও পড়ার নেশা, জানার নেশা, বোঝার নেশা কাটেনি তোমার। সেবার অসুস্থ্ হয়ে বারডেম হাসপাতালের ১৫১৯ নম্বর কেবিন তোমার ঠিকানা। ভাই-বোন পালা করে সর্বক্ষণ তোমার কাছে থাকছেই। চাকুরী, সংসার, অসুস্থ স্বামী কত বাহানা হতভাগী আমার। তোমাকে দেবার মত সময় কই মা? তাই নিজে থেকেই বেছে নেই 'শুক্রবার-টা'। সারাদিন থাকি তোমার সঙ্গে। মাথার কাছে বই, ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ। তারমধ্যে হুমায়ুন আহমেদের "ভূতের গল্প" ও আছে তোমার কাছে। মাথার যন্ত্রণা আর চোখের ক্ষীণ আলো বন্ঞিত করছে তোমাকে বই পড়ার আনন্দ থেকে। আবদার করলে- ভূতের গল্প সবগুলো পড়ে শোনাতে হবে। তোমার পাশে বসে এক এক করে পড়ে যাই, আবার মাঝে মাঝে গল্পের মত করে বলি। মনোযোগী শ্রোতা তুমি। কিন্তু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, সেই তৃপ্তি আর আনন্দ তুমি পাচ্ছ না। নিজে পড়ে রসাস্বাদন করার আনন্দ কি অন্যের পড়া থেকে পাওয়া যায় মা? অথচ তোমাকে পড়ে শোনাতে আমার যে কি ভাল লেগেছিল তা বোঝাতে পারবো না। এখন আর কাউকে আমার বই পড়ে শোনাতে হয়না, হ্য়না কবিতার ছন্দে দোলায়িত করতে। সেই ভাল লাগা আমি আর ফিরে পাব না।
তোমার কাছে একটা ঋণ আমার রয়ে গেল মা। কথা দিয়েছিলাম তোমার চিরচেনা প্রিয় ছড়া, কবিতাগুলো সংগ্রহ করে তোমাকে দেব, পড়ে শোনাব। সেই- "ভোর না হতে কাস্তে হাতে আমরা চলি মাঠে", কিংবা "পার হয়ে কত নদী কতযে সাগর, এই পাড়ে এলি তুই শিশু যাদুকর" -এমন জানা অজানা কত কবিতা। সংগ্রহ শুরু করেছিলাম মা, কিন্তু শেষ করার আগেই তুমি চলে গেলে, অভিমান মা?
হাসপাতালের বেডে শুয়ে তোমার একান্ত একটা আকাঙ্খার কথা বলেছিলে আমাকে-তোমার সবকটি সন্তান যদি তোমাকে একসাথে ঘিরে থাকতো! একজনতো সেই কবেই গত হয়েছে কিশোরী বেলায়, আর বার জন। এটা যে তোমার শেষ ইচ্ছা বুঝতেই পারিনি মা, কাউকে বলিও নি। সেই অপরাধ, সেই অনুতাপ দগ্ধ করছে আমাকে- অহর্নিশ।
কিন্তু সবাই একসাথে হয়েছিলাম মা। সুদূর আমেরিকা থেকে তোমার ছেলেরা উড়ে এসেছিল। বারজন একসাথে তোমার ঘরে, তোমার বিছানায় তিনদিন কাটিয়েছি। তুমি কি দেখেছো মা? শূণ্য শয্যা, শূণ্য গৃহ, শূণ্য শহর- ধিক্ দিয়েছে আমাকে। যখন আমাদের মাঝে ছিলে তখন সবাই মিলে একসঙ্গে একঘন্টা সময় তোমাকে দিতে পারিনি। অথচ তুমি নেই, তিনদিন তোমার শূণ্য শয্যাকে সময় দিচ্ছি। নিজেকে প্রশ্ন করি, "জীবিত মানুষের চেয়ে মৃত মানুষের মূল্য বেশী?" এটাই হ্য়ত রূঢ় বাস্তব। ক্ষমা করো জননী আমার।
খুব জানতে ইচ্ছে করে 'কেমন আছো?' মন বলে নিশ্চয়ই ভাল। যে মায়ের বারটি সন্তান সৎপথে থেকে সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে প্রতিদিন পাঁচওয়াক্ত পরম করুনাময়ের কাছে মাগফেরাত কামনা করছে, সেই 'মা' কি ভাল না থেকে পারে? নিশ্চয়ই ভাল আছ। প্রতিদিন শতবার বলি, "ভাল থেকো, ভাল থেকো, ভাল থেকো" ।

|| মা-কে বলছি ||
শাহানা বেগম
সিনিয়র শিক্ষিকা
বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ বিদ্যালয়
____________________________________
[লেখাটি লেখিকার অনুমতিতে আমার ব্লগে প্রকাশিত]
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১০:৫২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×