অনেকের মতই হতে চেয়েছিলাম এই এক জীবনে। কিন্তু কারও মতই হইনি। কিন্তু একজন মানুষ সবসময় আমার মতই হতে চেয়েছেন এবং আমার মত করেছেন সবকিছু। আমি যখন খুব ছোটবেলায় ঘুমাতে যেতাম, সেই মানুষটাও ঘুম না পাওয়া সত্ত্বেও ঘুমাতে যেত আমার জন্য। আমি যখন খেতে চাইতাম না একজন মানুষ বিরামহীন আমার পেছনে দৌড়াত; অদ্ভুতভাবে আমাকে খুশি করার জন্য খেত সেসব তিক্ত যত খাবার। খিদেয় একজন মানুষের পেট জ্বলে যাচ্ছে কিন্তু আমরা যতক্ষন বাসায় যেতাম না ততক্ষন তিনি ভাত ছুঁয়েও দেখতেন না। বাসায় উৎসব, কিন্তু একজন মানুষ একটা দানাও ছুঁয়ে দেখবেন না যতক্ষন না শেষ মানুষ টি পর্যন্ত খাচ্ছে, শেষ রাত্রিতে তার প্লেটে থাকবে রান্নার পুড়ে যাওয়া অংশের উচ্ছিষ্ট। যার পুরো জীবন টাই উৎসর্গ করেছেন তার সন্তান দের সামান্য আনন্দের জন্য, হাসির জন্য, যার কোন ব্যক্তিগত জীবন ছিলনা সেই মানুষটি “মা”।
আমার নিকটাত্মীয় কিংবা বোনদেরকে আজকে যখন দেখি একটা বাচ্চার জন্যই এত এত শিক্ষক- অঙ্কের, গানের, ছবি আঁকার, ধর্ম শেখার জন্য হুজুর, আবার বই পড়তে ব্রিটিশ কাউন্সিল। আমি তখন অবাক হয়ে ভাবি, এই এক জীবনে আমার মা কতগুলো শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন? জীবনে প্রথম কবিতা মায়ের কাছে শেখা, মজা করে অঙ্ক করা মায়ের কাছে শেখা, রবিন্দ্রনাথ আর নজরুল কে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মা, প্রথম বাংলাদেশের পতাকা আঁকতে শিখিয়েছিলেন মা, ধর্ম একজন মানুষ কে নৈতিক হতে শেখায়,সংযত করে এই উপলব্ধির বীজ প্রথম বুনে দিয়েছিলেন মা। আমার কাছে সবচেয়ে বড় আর আন্তরিক শিক্ষকটির নাম আমার মা জোবায়দা লুৎফুন্নাহার কাদেরী।
এই দূর পরবাস থেকে মাকে ফোন দিলেই মুঠোফোনে সবার আগে যেই কথাটি শুনতে হয় সেটি হল- তুই দেশে ফিরে আসবি তো? প্রতিদিন একবার করে বাবা মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করি দেশে ফিরে যাওয়ার। কারন তারা বিশ্বাস করেন- দেশকে অনেক কিছু দেয়ার বাকি আমাদের প্রজন্মের। আমার মা বিশ্বাস করেন দেশের প্রতি আমার যে ঋণ তা আমার শরীরের সমস্ত রক্তের ফোয়ারাতেও শোধ হবেনা। এভাবেই আমার এবং আমাদের মাঝে দেশাত্মবোধের আর দেশকে ভালবাসার শেকড় প্রোথিত করে দেন আমাদের সেই চিরকালের বনফুলের পাপড়ি মায়েরা।
যখনই কোথাও বন্যা বা ঘুর্নিঝড় হত- সাথে সাথে আমার মায়ের প্রশ্ন- কিছু না করে বসে আছ কেন? ঈদের বোনাস মায়ের হাতে দিলে তার প্রথম কথা- এই টাকা দিয়ে তোমাদের বাড়ী বাঁশখালির অনাথ শিশুদের ঈদের কাপড় কিনে দেব। কতটা উদার, মানবিক আমাদের মায়েরা! কখনও তারা জাহানারা ইমাম হয়ে রুমি কে যুদ্ধে পাঠান, কখনো সুফিয়া খাতুন হয়ে শহীদ আজাদের স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে আজীবন ভাত না খেয়ে থাকেন , কখনও রমা চৌধুরীর মত রাস্তায় খালি পায়ে হেটে বেড়ান কারন মাটির নিচে যুদ্ধে হারানো তার সন্তানে শুয়ে আছে। আমাদের মায়েরা আজও গ্রাম থেকে নগরে টলমল করে থাকা অশ্রুবিন্দু।
আমার কখনই দুঃখ বা আক্ষেপ হয়নি এই ভেবে যে আমার মা চিকিৎসক, বিজ্ঞানী বা শিক্ষক নন। আমি গর্ব বোধ করি আমার মা এবং তার মত লক্ষ লক্ষ গৃহিণী মা কে নিয়ে- যারা চিকিৎসক, বিজ্ঞানী বা শিক্ষক নন । কিন্তু তারা জন্ম দেন বিজ্ঞানীর, তৈরি করেন একজন প্রকৌশলী কে, ভিত্তি গড়ে দেন একজন চিকিৎসকের, চেতনা বুনে দেন আগামীদিনের নেতার মাঝে। আজকের মা দিবসে পৃথিবীর সব নিঃস্বার্থ, আত্মত্যাগী আর নির্মোহ মায়েদের জন্য অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
আমি জানি পত্রিকায়, ফেসবুকে, টুইটারে বা ব্লগে মাকে নিয়ে লিখলে অনেক বেশি নেকামো আর কৃত্রিমতা হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের মত কিছুটা রক্ষণশীল আর আটপৌরে বাঙালী পরিবারে মাকে কখনও মুখ ফুটে বলা হয়না ভালবাসার কথা, কোথায় যেন একটা দূরত্ব, একটা সংকোচের পর্দা। ভালবাসা প্রতিদিনের তবে আজ একদিনের জন্য হলেও পুরো পৃথিবীকে চিৎকার করে বলতে চাই –মা, তুমি অসাধারন , তুমি বৃষ্টির পর শেষ বিকেলের কোমল আকাশকে ধারন কর, তুমি ভোরের ঠান্ডা বাতাসের মত স্নিগ্ধ, তুমি আমার রক্তের প্রতিটি কণিকার প্রবাহের সাথে মিশে আছ। বড্ড বেশি ভালোবাসি তোমাকে।
আজ বিশ্ব মা দিবস। কাতালগঞ্জের বত্রিশ নাম্বার বাসাটিতে একজন মা অধীর প্রতীক্ষায় বসে থাকবে। মুখে হয়ত কিছুই বলবেনা কিন্তু মনে মনে অপেক্ষা করবে- বিকেল হলেই তার ছোট্ট ছেলেটি আড়ং কিংবা নবরুপা থেকে কেনা একটা আকাশী রঙের মিহি সুতোয় বোনা শাড়ী নিয়ে এসে মায়ের হাতে দেবে। কিন্তু পৃথিবীটা খুব নির্মম। তার সেই অযোগ্য, হতভাগা ছেলেটা বড় বিজ্ঞানী আর অনেক বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্নে মাকে ছেড়ে জুলিয়া গিলার্ডের দেশে এক উজ্জ্বল শহরে বসে আছে। আমরা নিজেদের নিয়ে এতই ব্যস্ত যে আমাদের পেছন ফিরে তাকানোর সময় নেই, আজীবন নিজেকে উৎসর্গ করা মানুষ টিকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। এখন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি মা, অনেক বেশি স্বার্থপর!
(লেখক : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক এবং বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত।)
দৈনিক পুর্বকোনে ১২।০৫।২০১৩ তে প্রকাশিত মা দিবসের বিশেষ লেখা-
Click This Link
এখন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি মা ...এখন আমি অনেক স্বার্থপর
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১২টি মন্তব্য ৯টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
মিশন: কাঁসার থালা–বাটি
বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।