শাহ আবদুল করিম : বাউল নন কিংবদন্তি লোকসঙ্গীত স্রষ্টা --
‘বাবার দেহ বাবার মায় বাবার দোহাই দিয়ে বেড়াই
পিতা পুত্রে আলাপ নাই যে ভাল
ইতিপূর্বে মাতৃগর্ভে দেখা হয়েছিল।’
এই গানে ‘পিতা’কে, ‘পুত্র’কে মাতৃগর্ভে পিতা-পুত্রে কিভাবে দেখা হয়েছিল তার ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু বাউল তত্ত্বের আত্মা-পরমাত্মা সম্পর্কের বিষয়ে যারা জানেন তারা পিতা-পুত্র অর্থাৎ স্রষ্টা-সৃষ্টির দেখা হওয়ার বিষয়টি, মাতৃগর্ভে পরমাত্মার অংশ হিসেবে আত্মার আগমন ইত্যাদির বাউল ব্যাখ্যাও পেয়ে যান। শাহ আবদুল করিমের কোনো গানে এমন তাত্ত্বিক রহস্যের দর্শন মেলে না। বাউলসাধক ছাড়াও অনেক লোককবি দেহতত্ত্বের গান লিখেছেন। তেমন একটা অতি জনপ্রিয় গান ‘মন আমার-দেহ ঘড়ি-সìধান করি-কোন মিস্তরী বানাইয়াছে
একখান-চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া জনম ভইরা ঘুরতে আছে।’
এই গানের যে নির্মাণশৈলী, দেহঘড়ি-সìধান করি-কোন মিস্তরী, কিংবা চাবি মাইরা-দিছে ছাইড়া-জনম ভইরা ইত্যাদি মধ্যমিল বা অনুপ্রাসের ব্যবহার এবং ছন্দের যে নির্ভুল ঝঙ্কারের শক্তিমত্তা দেখতে পাই তা-ও শাহ আবদুল করিমের গানে অনুপস্খিত। এমনকি এই গানে দেহতত্ত্বের খুঁটিনাটি বিষয় বাউল দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে শাহ আবদুল করিমের কোনো গানে তেমনটি দেখা যায় না। এই গানের রচয়িতা দারোগ আলী বয়াতিও বাউল নন, বয়াতি। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক অজ্ঞতার কারণে কিছু শিল্পী এবং কিছু প্রচার ও প্রকাশমাধ্যম বয়াতির গান, বিচ্ছেদি, ধামাইল, ভাবগান, এমনকি জারিগানকেও বাউলগান হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। শিল্পীরা ব্যক্তি, কিন্তু মাধ্যমগুলো তো এক-একটি প্রতিষ্ঠান! শিল্পীদের কাছ থেকেও আমরা সচেতনতা আশা করি, তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব আরো বড়। ভুল তথ্য দেয়ার বা ভুল শেখানোর অধিকার তো কারো নেই। এমন কথা ভাবাও ঠিক নয় যে, এসব ভুল বুঝতে পারার মতো মানুষ এ দেশে নেই। যারা বোঝেন না তারা বিভ্রান্ত হন এবং যারা বোঝেন তারা এই অজ্ঞতার সাড়ম্বর প্রচার দেখে হাসেন। কোনটি বাউলগান এবং কোনটি বাউলগান নয় তা বলে দেয়ার মতো বিজ্ঞজন এ দেশে অনেকেই আছেন। তার মধ্যে আবুল আহসান চৌধুরী, খোন্দকার রিয়াজুল হক, অধ্যাপক আনোয়ারুল করিম, ড. লুৎফর রহমান, খোন্দকার রফিউদ্দিন, মোহাম্মদ এন্তাজ উদ্দিন প্রমুখ গবেষক ও পণ্ডিত জন অতি বিশিষ্ট। মাধ্যমগুলো এই সব বিজ্ঞজনের পরামর্শ নিলেই তো বিভ্রান্তি ছড়ানোর ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারেন।
লোককবি শাহ আবদুল করিমের যে বিশালতা আছে সে দিকে চোখ না দিলে তার প্রতি একেবারেই সুবিচার করা হয় না। তার সমগ্র জীবনাচরণ এবং তার রচনাগুলো পর্যালোচনা করলে প্রথমেই যে বিশালতা চোখে পড়ে তা হলো তিনি অসাম্প্রদায়িক। কমরেড বরুণ রায়ের সংস্পর্শে এসে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাম্যবাদী। সাধক কমরউদ্দিন, রশিদ উদ্দিন প্রমুখের প্রেরণায় তিনি মরমি গান রচনা করেছেন অনেক। এক কথায় তাকে অসাম্প্রদায়িক-সাম্যবাদী মরমি লোককবি বলা যায়। জীবনে প্রচুর গণসঙ্গীত রচনা করেছেন তিনি। ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী তাকে প্রতিবাদী গণসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার বাল্যকালের অবস্খা, বাউল মতে দীক্ষিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট অনুকূল ছিল। কিন্তু তিনি সে পথে পা বাড়াননি। আত্মনিমগ্ন সাধক হওয়ার চেয়ে দু:খ-কষ্ট দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার পথকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। তবে এসব ক্ষেত্রে তার হাতিয়ার ছিল তার গান। অবশ্য বাল্যকালে যে গানের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা ছিল ভাবের গান, মরমি গান। তার সেই মরমলোক ও বাস্তবের রূঢ়তার যে সঙ্ঘাত, তার কবি ও শিল্পী-মানস গঠনে সে দোটানার প্রভাবও দেখা যায়। তার রচনাকর্ম সম্পর্কে সবচেয়ে নির্দ্বিধায় যে কথাটি বলা যায় তা হলো স্বত:স্ফূর্ততা, সততস্ফূর্ততা ও শত স্ফূর্ততা। যখন যে বিষয়ে তিনি লিখেছেন অকৃত্রিমভাবে লিখেছেন। কাব্যের দাবি পূরণ করল কি না, শৈলীতে নিখুঁত হলো কি না অথবা ছন্দ-মিল ঠিক হলো কি না, সর্বোপরি প্রকরণগত শুদ্ধতা থাকল কি না, তারও পরোয়া তিনি করেননি। যা বলার তা সুরের মধ্যে পড়লেই হলো, তিনি লিখে ফেলেছেন; যদিও বাংলা লোকসঙ্গীত শাহ আবদুল করিমের জন্মের বহু আগে থেকেই কাব্যকলায় পারঙ্গম হয়ে উঠেছে এবং ভাবসম্পদ কাব্যের দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে সাধুজন থেকে সুধীজন সবাইকে আকৃষ্ট করেছে। শাহ আবদুল করিম, তার ভাবসম্পদকে মোটামুটি সুরারোপ যোগ্যতায় কিংবা সুরনির্ভরতায় প্রায় সরাসরি প্রকাশ করেছেন। তার ভাষা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই আঞ্চলিক, আর এই কারণে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অন্যত্র, এমনকি সিলেট বেতারেও তার গানের প্রচলন বা জনপ্রিয়তা তেমন ছিল না সত্তর দশক পর্যন্ত। তবে তার বিচিত্র জীবন সম্পর্কে ক্রমে ক্রমে একটি আলোচনা আশির দশকের শেষ দিক থেকে বেশ পল্লবিত হতে থাকে। এই আলোচনা এবং কৌতূহল দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সিলেট অঞ্চলের মানুষ অধ্যুষিত লন্ডনের বাঙালি সমাজেও ছড়িয়ে পড়ে। ২০০০ সাল-পরবর্তী সময়ে সুনামগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের লোকসঙ্গীতশিল্পীদের কণ্ঠে তার ভাবের গানগুলোর ব্যাপক বিস্তৃতি শুরু হয়। বিলাতে গমনাগমনের ব্যাপকতায় কণ্ঠে কণ্ঠে তার গানও লন্ডনসহ বিলাতের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এখানে প্রতিষ্ঠিত টিভি কেন্দ্র চ্যানেল এস, তার মৌলভীবাজারের স্টুডিওতে আঞ্চলিক লোকসঙ্গীতশিল্পীদের কণ্ঠে নানা ধরনের লোকসঙ্গীত ধারণ করে লন্ডন থেকে প্রচারের ব্যবস্খা করে। এই সব লোকসঙ্গীতের মধ্যে শাহ আবদুল করিমের বেশ কিছু গান লন্ডনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেসব গানের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘কোন মিস্তিরি নাও বানাইলো কেমন দেখা যায়/ ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও’, ‘বসন্ত বাতাসে/বìধুর বাড়ীর ফুলের গìধ আমার বাড়ী আসে’, সখী কুঞ্জ সাজাওগো/ আজ মম প্রাণনাথ আসিবে’, ‘আসি বলে গেলো বìধু আইলো না’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। একই সময়ে লন্ডনে পাশ্চাত্য যন্ত্রসঙ্গীত ব্যান্ড-বাদ্য লাগিয়ে, কম্পিউটরের নানা অপকসরত সংযোজন করে ভোকউর জাতীয় বিকৃতি সহযোগে তার কিছু গান অ্যালবাম হিসেবে প্রকাশ হয়। মরমি গানের ভাব বোধহীন এক শ্রেণীর তরুণের কাছে সেগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়। শাহ আবদুল করিমের ভাবের গান পরিণত হয় মাদকসেবী তারুণ্যের উত্তাল নৃত্যের গানে। শাহ আবদুল করিমের মূল সুর থেকে এসব গানের সুরও অনেক বিকৃত। তার পরও কোন কৌশলে জানি না এই অপকীর্তির কৃতবিদ্যাধররা শাহ আবদুল করিমের অনুমোদন লাভ করে। কোনো সম্ভাবনাকে শুভশক্তি ব্যবহার না করলে তা অপশক্তির খপ্পরে পড়াই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রেও সম্ভবত তা-ই ঘটেছে। শাহ আবদুল করিম সম্পর্কে শুভ শক্তির টনক নড়েছে অনেক পরে। ২০০১ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। এর সামান্য আগে-পরেই তিনি স্খানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সম্মাননা লাভ করেন।
শাহ আবদুল করিমের ভাবের গান জাতীয়ভাবে পরিচিত হয়েছে অনেক পরে। কিন্তু তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান এবং গণসঙ্গীত আনেক আগে থেকেই স্বীকৃত। ১৯৫০-এর দশক থেকেই তিনি জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জনসভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। সেই সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সেই সব জনসভায় তিনি গাইতেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এবং শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদে উচ্চকিত গান। ১৯৫০-’৬০এর দশকেই জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে যে স্বীকৃতি তিনি লাভ করেছেন, তাকে ‘বাউল’ বলে উল্লেখ করলে তা অস্বীকার করা হয়। কারণ বাউলের সাধনার গানের সাথে প্রতিবাদী গণসঙ্গীতের কোনো সম্পর্কই নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, বিচিত্র ধরনের লোকসঙ্গীত স্রষ্টা শাহ আবদুল করিম ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তার বৈচিত্র্যই তার বৈশিষ্ট্য। সেই বৈশিষ্ট্য ধরেই তার কীর্তি প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হোক। আর যেন আমরা কোনো ভুল বিশেষণে তাকে বিশেষিত না করি। তার আত্মার অবমাননার দায় কাঁধে না নিই। আরো বড় কথা তার সব ধরনের গানেরই যেন চর্চা হয় এবং তার ভাবের গানের কথা ও সুর বিকৃত করে তা যেন বাজারে দাঁড় না করায় কেউ তাকে ভাঙিয়ে ব্যবসা করার নিকৃষ্ট লোভে। তার দেহসত্তার মৃত্যু হয়েছে, তার আত্মসত্তা অমর হোক।
লেখক -- মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
মিশন: কাঁসার থালা–বাটি
বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ
কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।