॥এক॥
সকাল সাড়ে ছয়টার মত বাজে।বিছানায় চিত্
হয়ে শুয়ে আছে সজল। আধো ঘুম আধো
জাগ্রত।
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার বাবা রহিম
চৌধুরীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে।বাবাকে
যমের মতো ভয় পায় সে।ছোটবেলায় একটা
অপরাধের জন্য বাবা তাকে অনেক মারে।এই
তার বাবার
হাতে প্রথম এবং শেষ মার খাওয়া।এর পর
থেকেই কেন যেন বাবাকে ভয় পায় সজল।
প্রায়ই বাবাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে সে।
সবগুলো স্বপ্নই
প্রায় একরকম।সব স্বপ্নেই সে দেখে বাবা
তাকে শাসাচ্ছেন। আজ সে দেখছে-বাবা
কাচা বাশেঁর কঞ্চি হাতে তাকে ভীষণ
বকছে।যেকোন সময়ই
তার পিঠে পরতে পারে কঞ্চিটা।স্বপ্নের
মধ্যেই সে ভাবে এই ঢাকা শহরে কাঁচা
বাঁশের কঞ্চি কোথায় পেলেন বাবা? ভয়ে
ভয়ে জিজ্ঞেসও
করে ফেলে সজল।প্রশ্ন শুনে "খামোশ" বলে
চেঁচিয়ে উঠেন রহিম সাহেব।
কঞ্চিটা উঠে আসতে থাকে সজলের দিকে।
ভয়ার্ত সজলের চোখ কঞ্চিটার দিকে।
কঞ্চিটা শাঁ শাঁ করে আসতে থাকে সজলের
দিকে ।
কঞ্চি পিঠে পরার আগেই ঘুম ভেঙে যায়
সজলের।
বিছানা থেকে সটান উঠে পরে সে।হাতের
উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘামখানা মুছে
বের হয়ে যায় প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করতে।
প্রাতঃক্রিয়া শেষে সজলের নিয়মিত
অভ্যাস হচ্ছে চা পান করা।মা রেহানা
চৌধুরী চা নিয়ে হাজির হোন সজলের রুমে।
সজল চায়ের কাপে চুমুক দেয়।রেহানা চৌধুরী
বলে উঠেন, তোর বাবাকে তোর ফুফুর বাড়ি
থেকে নিয়ে আয়।
লোকটা দুইদিন ধরে ওখানে।সজল একটু ইতস্তত
করে।"মা আমি কেন?অন্য কাউকে বলনা।"-
বলে সজল।তুই ছাড়া অন্য কেউটা কে আছে
এই বাড়িতে?-রেহানা বেগমের তড়িৎ জবাব।
আরো কি কি যেন বলতে চায় সজল,কিন্তু
কোন কথাই তার টিকল না।অবশেষে যেতেই
হল তাকে। নিজের প্রিয় গাড়িটা নিয়ে
বেড়িয়ে পরে সজল।
॥দুই॥
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফুফুর বাড়িতে পৌঁছে
যায় সজল।একটু যেন আতঙ্কিত,একটু অন্যমনস্ক।
ভয়ের একটা স্পষ্ট ছাপ ছড়িয়ে রয়েছে পুরো
মুখখানা জুড়েই।হালকা নাস্তা করে বাবাকে
নিয়ে বের হয়ে যায় সজল।সজলের মুখে ভয়ের
ছাপ আরও বাড়ছে।ও যেন কিছু বলতে চাচ্ছে
কিন্তু পারছে না।হঠাৎ রহিম সাহেব বলে
উঠলেন,"কেমন আছিস তুই সজল?"চমকে উঠে
সজল।বাবা সচরাচর এমন প্রশ্ন করেন না।তাও
আবার "তুই" সম্বোধনে!বাবা সবসময় সজলকে
"তুমি" করে বলে।"ভা-ভাল বাবা"-সজল উত্তর
দেয়।তারপর আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা।
মৌনতা আবার রহিম সাহেবই ভাঙ্গেন।
-আচ্ছা,তুই আমাকে এত ভয় পাস কেন?
-ক-কই?তোমাকে ভয় পাওয়ার কি আছে?
-আমিও তো সেটাই বলছি।আমাকে ভয়
পাওয়ার কি আছে?আমি জানি তুই আমাকে
ভয় পাস ঠিক ঐদিনটার পর থেকেই যেদিন
আমি প্রথম তোর গায়ে হাত তুলেছিলাম।
-কি যে বল তুমি বাবা।
-জানিস ওইদিন আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
তোকে ছোট্ট একটা কারনে মেরেছিলাম।
আমার মনটা সেদিন ভাল ছিলনা।আমাকে
মাফ করে দিস তুই।
সজলের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরতে
থাকে।রহিম সাহেব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে
সজলের দিকে চেয়ে থাকেন।হঠাৎ করে সজল
অন্যমনস্ক হয়ে যায়।তার মনে একটা
অস্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে,"মৃত মানুষ কি
কাঁদতে পারে?"সজলের ভাবনায় ছেদ পরে
রহিম সাহেবের প্রশ্নে,"কি আমাকে মাফ
করবিনা?"
-তোমাকে আমি মাফ করব কি?দোষ তো
আমারই ছিল।বরং তুমি আমাকে মাফ করে
দাও বাবা।আমি তোমাকে অনেক কষ্ট
দিয়েছি।-বলেই সজল ব্রেক কষে।বাবার
পায়ে পরে যায় সজল।রহিম সাহেব ডুকরে
কেদে উঠেন।এতদিন পরে তার মনের একটা
বোঝা নেমে পড়ল।তার সামনে ভেসে উঠল
পুরনো স্মৃতি।
-সজল,তোর মনে আছে,ছোটবেলা তুই
প্রতিদিন সকালে আমার কাধে উঠে দাঁত
ব্রাশ করতি?
-হুম।তুমি আমাকে পিঠে তুলে বুকডন দিতে।
-ছোটবেলাই খুব বেয়ারা স্বভাবের ছিলি।
একদিন তোর ফুফু-ফুফারা বেড়াতে এল।তারা
যাওয়ার সময় পিছন ধরলি তাদের।আমি জোর
করে তুলে নিয়ে আসলাম,আর তুই খামচে
খামচে আমার পিঠ ছুলিয়ে দিয়েছিলি।
-হুম বাবা,মনে আছে।তারপর তুমি মুখ গোমড়া
করে বসেছিলে।ছুলে যাওয়া জায়গা গুলো
দিয়ে হালকা রক্ত বের হচ্ছিল।আমার খুব
খারাপ লাগছিল তখন।
-তারপর তুইই তো নারকেল তেল এনে লাগিয়ে
দিয়েছিলি।সত্যি বলতে সেদিন আমার খুব
ভালো লেগেছিল।ছুলে যাওয়া স্থানের ব্যথা
ভুলে গিয়েছিলাম তোর নরম হাতের ছোঁয়া
পেয়ে।
ঠিক সেই সময় রহিম সাহেবের মোবাইলে
একটা কল আসে।তিনি মোবাইল খুলে দেখেন
সজলের নাম্বার থেকে কলটা
আসছে।"কিরে,তোর মোবাইল কি তোর সাথে
না?"-রহিম সাহেব জিজ্ঞেস করেন।সজল
নিশ্চুপ।রহিম সাহেব আবার জিজ্ঞেস করেন।
সজল এবারও নিরুত্তর।মোবাইল বেজে চলছে।
রহিম সাহেব কলটা রিসিভ করেন-হ্যালো।
ওপাশ থেকে মধ্যবয়স্ক কন্ঠ বলে উঠে,এই
নাম্বারের মালিক আপনার কি হন?
-জ্বী আমার ছেলে।
-দেখুন আপনারী ছেলে আর এ পৃথিবীতে
নেই।
আপনি শিগ্রই সদর হাসপাতালে চলে আসুন।
রহিম সাহেবের হাত থেকে মোবাইলটা পরে
যায়।থরথর করে কাপতে থাকেন তিনি।চোখ
দুটো সজলের দিকে।সজলের চোখ দিয়ে
পানি পরছে।সে বলে উঠে,"যা শুনেছ সব সত্যি
বাবা।বাড়ি থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ
আমার বুকে তীব্র ব্যথা অনুভুত হয়।আমি
কোনমতে গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে পৌছাই।
ব্যাথা তখন দ্বিগুণ বেড়েছে।আমি অজ্ঞান
হয় হয় অবস্থায় হঠাৎ তোমার মুখখানা ভেসে
উঠল আমার সামনে।আমি যেন একটু শান্তি
পেলাম।ব্যাথা অনেকটা কমে গেল।আমি
চোখ বুজলাম।চোখ খুলে নিজেকে খুব পাতলা
মনে হল।আবিষ্কার করলাম আমি আমার দেহ
থেকে আলাদা।তারপর কেমন করে যেন গাড়ি
সহ ফুফুর বাড়ি পৌঁছে গেলাম!হাসপাতালে
কেউ আমাকে দেখছিল না।কিন্তু ফুফুর
বাড়িতে সবাই আমাকে দেখতে পেল!আমি
দ্বিধায় ছিলাম।তারপর তোমাকে নিয়ে
এখানে চলে এলাম।"রহিম সাহেব এখনও
কাঁপছেন।চোখ বুজে বুজে আসছে।মনে হয়
জ্ঞান হারাবেন।সজল বাবাকে জোরে
ঝাকি দেয়।"বাবা তুমি জ্ঞান হারাচ্ছ।"রহিম
সাহেব চোখে ঝাপসা দেখতে পান,একটা
ছায়ামূর্তি তাকে বলছে,"বাবা তুমি জ্ঞান
হারাচ্ছ।জ্ঞান ফেরার পর হয়তো তুমি আর
আমাকে দেখতে পাবেনা।শুধু এতটুকু জেনে
রাখো,আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি
বাবা।অনেক ভালবাসি।"রহিম সাহেবের চোখ
বুজে আসে।তিনি বলতে গিয়েও বলতে
পারেননা,"আমিও তোকে অনেক ভালবাসি
বেটা,অনেক বেশি ভালবাসি।"তার আগেই
তিনি জ্ঞান হারান।
(সমাপ্ত)
[লেখকের(আমার) কথা:-ভৌতিকতা মানেই
যে ভয়ঙ্কর বীভৎস কোন কাহিনী হতে হবে
এমনটা নয়।ভৌতিকতারও একধরনের সৌন্দর্য
রয়েছে।আর ভৌতিকতার সৌন্দর্য প্রকাশের
একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস এই গল্প।]