somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বার্জারের নতুন ভিডিও: আসুন, প্রজাপতির পাখায় রাসায়নিক রং মেখে দিই

১১ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৯:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কখনো প্রজাপতি ধরেছেন?প্রজাপতির পাখা থেকে হাতের আঙুলে ফুলের রেণুর মতন উঠে এসেছে রং। মনে আছে? প্রজাপতির পাখার রং অমল শৈশবে আমি চোখের পাতায় মেখেছি। কিন্তু কেমন হবে যদি প্রজাপতির পাখায় বার্জারের রং মেখে দেয়া হয়? মানে ভ্রমরের পাখনার রং যেহেতু ক্ষণস্থায়ী, যেহেতু ফুলের রেণুর মতন দানা-দানা হয়ে উঠে আসে আঙুলের কোল জুড়ে তাই পাখনার সেই রং-কে দীর্ঘস্থায়ীত্ব দেয়ার কথাটা আমাদের তো ভাবাই উচিত। নাকি বলেন?

জানি, আপনার কাছে এই উর্বর আইডিয়াটা অতীব উদ্ভট ঠেকছে। ঠিক এরকমই একটি উদ্ভট ধারণাকে তথ্যচিত্রের ঢঙে বিজ্ঞাপন বানিয়ে সম্প্রতি বাজারে ছেড়েছে একটি বেণিয়া কোম্পানি।

বার্জার নামে রং-এর কারবারে রত একটি মাল্টিনেশনাল পেইন্ট কোম্পানি বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে নতুন একটি ভিডিও কন্টেন্ট বানিয়েছে। সেখানে তাদের মোদ্দা কথা হলো, আমাদের আল্পনা শিল্পীরা প্রাকৃতিক যেসব উপাদান দিয়ে রং তৈরি করেন সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী নয়। তাই, প্রাকৃতিক রং-এর বদলে বার্জার দিয়ে মাটির দেওয়ালে আল্পনা আঁকার হাইব্রিড আইডিয়া হাজির করেছে বেণিয়া গোষ্ঠী বার্জার।

জানিনা, তথ্যচিত্রধাঁচে নির্মিত এই বিজ্ঞাপনটি টিভিতে প্রচার হয় কিনা। টিভি আজকাল খুবই কম দেখা হয়। দেখলেও, শুধু সংবাদ ছাড়া সাধারণত আর কিছু নয়। তাই, বার্জারের এই ভিডিও কন্টেন্টটা টিভিতে দেখাচ্ছে কিনা, জ্ঞাত নই।

ভিডিওটি আমি দেখেছি ফেসবুকে। ৪/৫ দিন হলো। এরকম একটি কন্টেন্ট টিভিতে যদি প্রচার হয় তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো প্রচারের জন্য ছাড়পত্র পায় কী করে? বাংলাদেশে কি বিজ্ঞাপনের কন্টেট বা বিষয়বস্তু দেখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই?

এটি যদি টিভিতে প্রচারিত না-ও হয়, তবু কথা আছে। কারণ বিজ্ঞাপনটি অনলাইনে দেখানো হচ্ছে। এই লেখাটি লেখার সময় বার্জারের বিজ্ঞাপনটিতে আবার ঢু দিয়ে দেখলাম। এরইমধ্যে ২৩ লাখের বেশি বার এটি দেখা হয়েছে। যদি এটি টিভিতে প্রচার না হয় তাহলে ধরেই নেয়া যায়, হয়তো সোশাল মিডিয়া মার্কেটিং-এর জন্যই তথ্যচিত্রের ধাঁচে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করা হয়েছে।


বিজ্ঞাপনের মূল বিষয়বস্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের টিকোইল গ্রামের আল্পনা শিল্প। প্রাকৃতিক উপায়ে বিভিন্ন বস্তু যেমন মাটি, চক ও ইত্যকার উপাদান যা নিত্যদিনের দৈনন্দিন জীবনে সহজে প্রাপ্য তা দিয়ে রং বানিয়ে মাটির দেওয়াল জুড়ে আল্পনা আঁকেন টিকোইলের মানুষ। মূলত নারীরাই এর প্রধান শিল্পী। এমনি চলছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।


কিন্তু বার্জার তার বণিকী বুদ্ধি নিয়ে সেই গ্রামে ঢুকেছে। মাছের মায়ের পুত্র শোকের মতন বার্জার বিজ্ঞাপনে মেকী দরদ ঝরিয়ে বলেছে, এইসব রং (যা প্রাকৃতিক নানা উপাদান থেকে টিকোইল গ্রামের মানুষেরা তৈরি করে) বেশি দিন স্থায়ী হয় না। তাই, গ্রামের নারীদেরকে বার্জার দু’টো করে রং-এর কৌটো উপহার দিয়ে এসেছে।

অথচ বার্জার এই ভিডিওটা বানানোর আগে একবার ভেবেও দেখার চেষ্টা করেনি যে, আল্পনার দর্শনের সাথে স্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী রং-এর সম্পর্ক সম্পূর্ন বিপরীতমুখী।

আল্পনা শুধুই মেঝে ও দেওয়াল রাঙানোর একটি পন্থা নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে আরো গভীর বিশ্বাস। পূজো-আর্চায়, মাঙ্গলিক উপাচারে আল্পনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মুসলিমদের চেয়ে তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরের মেঝে ও দেওয়ালে আল্পনার প্রচলন যুগ-যুগ ধরেই বেশী দেখা যায়।

আল্পনা যে শুধু বাংলাদেশেই হয় তা নয়। পাশের দেশ ভারতেও এর ঐতিহ্য রয়েছে। শান্তিনিকেতনে আল্পনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষভাবে ভেবেছেন। আল্পনার শেকড় প্রোথিত আছে আরো গভীরে। আফ্রিকা হতে হাজার-হাজার বছর আগে ধীরে-ধীরে মানুষ ছড়িয়েছে দুনিয়াব্যাপী। মানুষ তো আর শুধু তার শরীরটা নিয়ে যায় না। শরীরের ভেতরে একটা মন আর মাথার ভেতরে একটা মগজ এবং মগজের ভেতরে কিছু বিশ্বাস, বোধ, স্মৃতি ও মনের ভেতরে কিছু মায়া নিয়ে যায়।

আফ্রিকানদের মধ্যে গৃহ রাঙানোর একটি চল ছিল বলে জানা যায়। তাদেরই পরম্পরায় এই আল্পনা বা ঘরের দেওয়ালের নকশা বা গৃহের দেওয়ালের গায়ে বিবিধ পশু-পাখির ছবি নানানভাবে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে থাকতে পারে বলেও ধারণা করা হয়। আদিবাসী বা সনাতনী সমাজের মানুষের মাঝে আজো নকশা বা আল্পনার চল রয়ে গেছে। আমাদের সাঁওতাল সমাজেও এই সংস্কৃতি চলমান। আজকের দুনিয়াতেও বুর্কিনা ফাসো থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়েতে মাটির ঘরের দেওয়াল ও মেঝেতে নকশা আঁকার চল রয়েছে।

আজকের বাংলাদেশেও এই সব আল্পনা শুধুই দেওয়াল জুড়ে আঁকিবুঁকি নয়। বরং বাস্তুশাস্ত্রের সাথেও জড়িত। আল্পনার রং তৈরির উপাদানগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে চালের গুঁড়ো বা চাল গুঁড়ো করে তা দিয়ে গুলিয়ে বানানো রং। আজও লক্ষী পূজোয় চালের গুড়োর এই রং অবিচ্ছেদ্য উপাদান।

এছাড়াও লাল মাটি, হলুদ, খড়িমাটি, কাঠকয়লা, পাতিলের কালি, সিঁদুর, পোড়ামাটি ও নীল-এর মতন বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি করা হয় আল্পনার রং।

গৃহকে পবিত্র করার নিমিত্তে কাদামাটি দিয়ে লেপা-পোছা করার চল ছিল। পবিত্র করার অংশ হিসেবে গোবর জল ছিটিয়ে দেয়ার চল দেখেছি হিন্দু বাড়িতে। বিভিন্ন পূজো-আর্চায় তাই অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই এসেছে আল্পনা। অর্থাৎ আল্পনা ব্যাপারটা ঋতুর মতই। ষড়ঋতুর এই দেশ। ঋতুর বদল ঘটে। নতুন ঋতু। নতুন ফুল-ফল। নতুন রঙ। নতুন পার্বণ। সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আসে নতুন আল্পনা। এটি অনেকটা যেনো গৃহের নবায়ন।

নবায়নের এই কৃষ্টি বার্জারের চোখে পড়েনি। বরং চটজলদি কিছু একটা করে চমক লাগিয়ে দিতে পারাতেই তাদের আনন্দ।

প্রাকৃতিক রং দিয়ে আঁকা আল্পনার কৃষ্টিকে বার্জার তো গুরুত্ব দেয়ই-নি, উল্টো প্রাকৃতিক ‘রং দীর্ঘস্থায়ী নয়’ বলে যে অসংবেদনশীল আচরণ করেছে বার্জার তাতে আমি মর্মাহত।

বার্জারের উপলব্ধি করা উচিত ছিল, সব বস্তুরই একটি নিজস্বতা থাকে। সিঁদুর রোজ সিঁথিতে পড়েন সধবা নারী। রোজ তা স্নানের সময় ধুয়ে যায়। কিন্তু ধুঁয়ে যাবার পরেও আবার নতুন করে সিঁথিতে উঠে নতুন রং। এ যেনো জীবনেরও নবায়ন। কিন্তু বার্জারের বণিকীমার্কা দীর্ঘস্থায়িত্বের দর্শন অনুসরণ করলে এখন হিন্দু ধর্মাবলম্বী সধবা নারীদেরো রোজ এই স্বল্পস্থায়ী সিঁদুর পড়া উচিত নয়। এখন সধবা নারীদেরো হয় সিঁথিতে একটা লাল রঙের উল্কি করে নেয়া উচিত অথবা বার্জারের মতন দীর্ঘস্থায়ী কোনো একটা কিছু দিয়ে পেইন্ট করে নেয়া উচিত।

অথবা ভাবা যাক, লিপস্টিকের কথা। লিপস্টিক তো প্রায় নারীরাই অহরহ দেন। রোজ-রোজ নতুন নতুন রঙে ঠোঁট রাঙানোর দরকারটা কী? বার্জারের মতন কোনো একটা কর্পোরেট কোম্পানির কাছ থেকে একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নিয়ে নিলেই হলো। অথবা ধরা যাক, আমাদের দাদী-নানী বা দাদা-নানা যারা সুরমা পড়েন তাদের কথা। তাদেরো আর রোজ-রোজ সুরমা পড়ার হ্যাঁপায় যাবার দরকার নেই। বার্জারের মতন কোনো একটা বণিক কোম্পানিকে বললেই তারা এমন একটা জাদুকরী কিছু বানিয়ে দেবে যা দিয়ে একবার চোখে কাজলের টান দিলে ছয় মাসেও আর সেই রেখা মুছবে না।

এই সিঁদুর, লিপস্টিক আর সুরমার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের ধারনাগুলো আপনাদের কাছে খুব উদ্ভট ঠেকছে? জী। ঠিক এরকমই উদ্ভট বার্জারের আল্পনা বিষয়ক দীর্ঘস্থায়ী রঙের বুদ্ধিটাও। আল্পনার যে চেতনা, আল্পনার যে অনন্যতা সেই বিষয়টির দিকে দৃকপাতই করেনি বার্জার। যদি তারা আল্পনার দর্শন ও চেতনাকে সম্মান করতো, যদি তারা আল্পনার অনন্যতা বা ইউনিকনেস নিয়ে ভাবতো তাহলে এতো অংসবেদনশীল বিজ্ঞাপন তারা কী করে বানায়? বার্জারের কেমিকেল রং দিয়ে মাটির মেঝে ও দেওয়ালে আল্পনা আঁকার বণিকী বুদ্ধিটা কেবল উদ্ভটই নয়, পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্যও ক্ষতিকর।


বার্জারের মতন কেমিকেল পণ্য শহুরে ইট-কংক্রিটের জন্য আবশ্যকীয় বটে। কিন্তু টিকোইল গ্রামে যেখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রাকৃতিক উৎস হতেই মানুষেরা জীবনের রং-রূপ সংগ্রহ করছেন তাদের জন্য বার্জারের রং ক্ষতিকর।


টিকোইল গ্রামের ঘরগুলো মাটির। মাটির দেওয়ালের গায়ে প্রাকৃতিক রং দিয়ে আল্পনা আঁকেন সেখানকার সহজাত শিল্পীরা।

বস্তুগুণ বলে একটি কথা আছে। একেক বস্তুর একেক ধর্ম। কংক্রিটের দেওয়াল বা টিনের বেড়ার জন্য বার্জারের মতন কেমিকেল মিশ্রিত রং হয়তো প্রটেকশান বা সুরক্ষা দিতে পারে এবং সৌন্দর্য বর্ধক হিসেবেও কাজ করতে পারে। কিন্তু ইনগ্রেডিয়েন্ট বা উপাদান হিসেবে মাটি আর কংক্রিট এক নয়। তাই, মাটির দেওয়ালে ক্যামিকেল বা রাসায়নিক মেশানো বার্জার বা অন্য কোনো কোম্পানির রঙ আদতে ক্ষতিকর ও অদরকারী।

মাটির সাথে রাসায়নিক মেশানো রং প্রাকৃতিক রং-এর মতন কিছুতেই কাজ করবে না। আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই। আপনি নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। বার্জার বা আর কোনো কোম্পানি থেকে কোনো একটা রঙের কৌটো নিয়ে নিজেদের উঠোনের এক কোণে একটু জায়গা ভালো মতন লেপে-পুছে নিন। সেটি শুকিয়ে গেলে সেই রং দিয়ে আল্পনা বা যা মনে চায় তেমন নকশা আঁকিবুঁকি করুন। রং শুকানোর জন্য অপেক্ষা করুন। তারপর দেখুন।


রঙ দিয়ে আঁকা আল্পনার গা-টা হবে অমসৃন। আল্পনা যত শুকাবে সেটি তত ফাটা-ফাটা হবে। দুই দিন যেতে না যেতেই রোদে ও বৃষ্টিতে সেই রাসায়নিক রং-এ আঁকা নকশাগুলো তার সৌন্দর্য হারাবে। কিন্তু মাটির দেওয়ালে প্রাকৃতিক রং দিয়ে যে নকশা আঁকা হয় সেটি পানির সাথে মিশে মাটির গায়ে বসে যায়। মাটির দেওয়ালের উপরে আলগা কোনো আস্তরণের মতন লেগে থাকে না। এই মাটির দেওয়াল আবার লেপে নিলেই সেই প্রাকৃতিক রং ঢাকা পড়ে যাবে।

কিন্তু বার্জারের মতন রং যেটি দেওয়ালের উপর আলগা আস্তরণ হিসেবে লেগে থাকে সেটি দেওয়াল লেপার পরেও মুছবে না। বরং বিদঘুটেভাবে দাঁত বের করে হাসবে। আর এই আস্তরণ তুলতে হলে কিছুটা মাটিসহ দেওয়াল থেকে ঘষে-ঘষে তুলতে হবে। তাই, বার্জার বা এরকম অন্য যে কোনো কোম্পানির রং মাটির দেওয়ালের জন্য মোটেও উপকারী কিছু নয়। বরং ক্ষতিকর।

শুধু তাই নয়, কেমিকেল মেশানো এই রং পরিবেশের জন্যেও ক্ষতিকর। কারণ নারীরা বার্জার দিয়ে রং করার পর সেই রঙের কৌটো, ব্রাশ ও তাদের হাত যে পুকুরে ধুয়ে পরিষ্কার করবেন সেখানেও মিশবে রাসায়নিক। সেই পুকুরের মাছ তথা পুকুরের বাস্তু সংসারে রাসায়নিক রঙের পার্টিকেলস বা উপাদানগুলো হবে ফরেন ইনগ্রেটিয়েন্টস। এটি প্রাকৃতিক সংসারে যেকোনো প্রাণের জন্যই ক্ষতিকর; মাটির জন্য, পানির জন্য, পানিতে থাকা মাছের জন্য।

এখন বার্জার হয়তো বলে বসতে পারে যে, তারা এমন রং সরবরাহ করবে যা দিয়ে মাটির দেয়ালে রং করলে সেই রং-ও দেওয়ালের গায়ে মিশে যাবে প্রাকৃতিক রঙের মতই। তা অবশ্য ঠিক। প্রকৃতিকে বিনষ্ট করেই বণিকেরা টিকে থাকছে। তাই, প্রাকৃতিক উপায়ে শত-শত বছর ধরে টিকে থাকা শিল্পকে প্রশংসা না করে রঙের ‘স্থায়িত্ব কম’ বলে খুঁত খুঁজে বের করে সেখানে নিজে দুই কৌটো রং দিয়ে খুব মহৎ সেজেছে বার্জার। আদতে টিকোইল গ্রামের মানুষদেরকে মাগনা রাসায়নিক রং দেয়ার নামে তাদের প্রাকৃতিক জীবনে বিষ ঢুকানোর বন্দোবস্ত করেছে বার্জার।

বিতর্কিত যে তথ্যচিত্রধর্মী বিজ্ঞাপনটি নিয়ে আমি লিখছি সেটির ডিউরেশান বা বিস্তৃতিকাল ৫ মিনিট। বার্জার যদি সত্যিকার অর্থেই টিকোইল গ্রামের শিল্পীদের শ্রদ্ধাই জানাতে চাইতো সেটির আরো নানান উপায় ছিল। নারীরা কিভাবে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান যেমন চাল, লাল মাটি, পোড়ামাটি, খড়িমাটি দিয়ে রং তৈরি করছেন শুধু সেটির উপরেই একটি তথ্যচিত্র বানিয়ে তারা বার্জারের সৌজন্যে প্রচার করতে পারতো। আরেকটু ধৈর্য ধরে, সময় নিয়ে, কাজ করলে বার্জার দেখাতে পারতো একটি বাড়িতে বছরে গড়ে কয় বার আল্পনা বদল হয়। বিভিন্ন পূজো-আচ্চায় কেমন করে বদলে যায় অঙ্কনের বিষয়বস্তু সেগুলোও উঠে আসতে পারতো।

সারা পৃথিবী এখন অর্গানিক জীবনের সন্ধান করছে। প্রাকৃতিক জীবন ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। আজকের আধুনিক পৃথিবীর বেশিরভাগ অসুখ ও অশান্তির মূলে রয়েছে প্রকৃতিকে বিনষ্ট করা এবং প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাওয়া। এমনকি এই যে বিরাট নগর সভ্যতা। সেগুলোও এই প্রকৃতিকে বিনষ্ট করে ক্ষতের মতন দাঁড়িয়েছে ধরণীর বুকে। গাছ কেটে, বন ধংস করে, জলাশয় বিনষ্ট করে উন্নয়নের নামে মানুষ নিজের জন্য বানিয়েছে অসুখের ফাঁদ।

কলকারখানার ধোঁয়ায় আজ আমাদের বায়ুতে দূষণ। কলকারখানার বর্জ্যে আজ আমাদের পানিতে দূষণ। উন্নত বিশ্ব তাদের প্রকৃতিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। আমাদের মতন গরীব এবং নগদ-নারায়ণ-লোভী মানুষের দেশে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো জাহাজ ভাংতে পাঠাচ্ছে। আমাদের দেশে গার্মেন্ট শিল্পও এই জাহাজ ভাঙা শিল্পের মতন ক্ষতিকর।

গার্মেন্টের জিন্সের জন্য যে পরিমান ভূগর্ভস্থ পানি খরচ করছেন শিল্প-মালিকেরা এর খেসারত ভবিষ্যতে বহন করবে পুরো ঢাকাবাসী তথা সমগ্র দেশ। গার্মেন্টস শিল্প থেকে উৎসারিত শত-শত টন শিল্প বর্জ্য প্রতি বছর মিশছে বাংলাদেশের মাটি, পানি ও নদীগুলোয়। এই সর্বাঙ্গীন দূষণের খেসারত একদিন আমাদের দিতেই হয়। খেসারতের দিন এলে, এখন যে নগদ পয়সার ফুটানি আমরা মারছি সেই দিন এই রেমিটেন্স যথেষ্ট হবে না। তখন হয়তো আমরা রোগে ভুগে মরবো। বায়ু ও পানির দূষণজনিত রোগে মরবো।

এরকম মহাবিপর্যের আশঙ্কার মধ্যেও চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের দূর গ্রামে একটি মায়াবী আলোকবিন্দুর মতন টিকে আছে টিকোইল গ্রাম। সেখানে মানুষ আজো অর্থগৃধ্নুদের মতন এতোটা দূষিত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত নয়। তারা, প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান যেমন লাল মাটি, খড়িমাটি ও অন্যান্য ইত্যকার উপদান মিশিয়ে রং বানায়। মাটির দেওয়াল রাঙায়। সেই রঙীন দেওয়ালে হেলান দিয়ে বউ-ঝিরা হয়তো দেখে পূর্ণিমা রাতের জোছনা। কিন্তু বার্জার সেখানেও দূষণ নিয়ে হাজির হয়েছে।

অবশ্য বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের সামগ্রীক প্রচার-নীতি নিয়েই আমাদের ভাবা উচিত। হরলিক্স এর বিজ্ঞাপনে যে সকল ভুয়া কথা-বার্তা ও রিসার্চ বা গবেষণার কথা বলা হয়, ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপনে রং উজ্জ্বল করার যে জোরালো দাবী করা হয় সেগুলো নিয়েও ভেবে দেখার সময় বয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপনে কোনো পন্যের গুণগান করা হবে, সেটিকে আকর্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরা হবে এটি স্বত:সিদ্ধ সত্য। বিজ্ঞাপন যে সত্য নয়, সেটি যে এক রাশ বানোয়াট কথার সমাহার এটি সাধারণ মানুষেরাও জানে। আর জানে বলেই বেশির ভাগ মানুষই বিজ্ঞাপনে উপস্থাপিত তথ্যকে বিশ্বাস করে না।

২০১০ সালে অ্যামেরিকার ২০৯৮জন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির উপরে একটি জড়িপ চালিয়েছিল মার্কিন প্রতিষ্ঠান এডউইক মিডিয়া/হ্যারিস পল। সেই জড়িপের তথ্য থেকে জানা যায়, শতকরা মাত্র এক ভাগ মানুষ বিজ্ঞাপনকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। সেই জড়িপেই জানা যায় যে, শতকরা ১৩ ভাগ মানুষ তারা কখনোই বিজ্ঞাপনের কোনো কথা সত্য বলে মনে করে না এবং বিশ্বাস করে না। আর এর মাঝখানে আরো ৬৫ ভাগ লোকের কথা জানা যায়। যারা কখনো-কখনো হঠাৎ-হঠাৎ বিজ্ঞাপনের তথ্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ এই ৬৫ ভাগ মানুষও বেশির ভাগ সময়েই বিজ্ঞাপনকে অবিশ্বাস করেন।

মানুষ জানে যে, বণিকের পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর নিমিত্তে ভালো-ভালো কথার সমাহার ঘটানোই বিজ্ঞাপনের কাজ। কিন্তু সেই গুণগাণ করতে গিয়ে কোনো মিথ্যে তথ্য বা সত্যের ঢং-এ আজগুবি তথ্যের উপস্থাপন, গবেষণা থেকে প্রাপ্ত বলে মেকী তথ্য উপস্থাপন করা যাবে কিনা তা নিয়ে ভেবে দেখা জরুরী হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, বিজ্ঞাপনে হেট্রেট স্পিচ বা ঘৃণাসূচক বক্তব্য ছড়ানো, পরিবেশ ও প্রকৃতি বিরোধী বার্তা দেওয়া এবং লিঙ্গবৈষম্য মূলক কথাবার্তা প্রচার করা হচ্ছে কি হচ্ছে না— ইত্যকার বিষয়েও কিছু নীতিমালা বা দিকনির্দেশনা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।

বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের জগত এখন যথেষ্টই বিস্তৃত। ছোটো বড় মিলিয়ে কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে বিজ্ঞাপন নির্মাণ করছে। কোটি-কোটি টাকার বাণিজ্য বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে চলছে। টেলিভিশনের অন-এয়ার টাইমের অর্ধেকেরো বেশি সময় জুড়ে থাকছে নানান পন্যের বিজ্ঞাপন। তাছাড়া আছে বেশ কিছু এফএম রেডিও। সেগুলোতেও শত শত বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। কিন্তু এইসব বিজ্ঞাপন প্রচারের কোনো নীতিমালা আমাদের আছে বলে শুনিনি। তাই, ভরদুপুরেও বাংলাদেশে প্রচার হয় কনডমের মতন জন্মনিরোধক পণ্যের বিজ্ঞাপন। যেই সব বিজ্ঞাপন অপ্রাপ্তবয়স্ক বিদ্যালয়গামী শিশুরাও দেখছে।

বিদেশে বিজ্ঞাপন প্রচারের কিছু নিয়ম-নীতি আছে। একঘন্টায় কতক্ষণ বিজ্ঞাপন দেখানো যাবে, শিশুরা যখন টিভি দেখে তখন এডাল্ট বা বয়স্কদের বিজ্ঞাপন বা আসল পুরুষ বা লাগবা বাজি টাইপ বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে কিনা সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। নইলে, বার্জার কোম্পানির টিকোইল গ্রামের মতন উদ্ভট ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিজ্ঞাপন টিভি বা রেডিও বা অনলাইনে প্রচার হতেই থাকবে। আর অলক্ষ্যে বেনিয়ার হাতের খেলনা হয়ে উঠবে আমাদের আবেগ ও ঐতিহ্য।

টিকোইলের আল্পনার দর্শন, চেতনা ও কৃষ্টিকে সম্মান না করে আজ অসংবেদনশীল আচরণ করেছে বার্জার। কাল আমাদের অন্য কোনো আবেগের জায়গাকে নিয়ে বেসাতি করবে অন্য কোনো বণিকের কোম্পানি। আর এমনটি তো হয়ে আসছেও। বাণিজ্যিক স্বার্থে আমাদের ভাষা দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সব কিছুই বিজ্ঞাপনের আবেগ হয়ে উঠেছে; হয়ে উঠেছে পণ্য বিক্রির হাতিয়ার। ফলে, এখনি সময়। কোনটুকু আবেগ আর কোনটুকু আবেগকে পুঁজি করে বেনিয়ার বেসাতির বিস্তৃতির কূটকৌশল, তার মাঝে সুক্ষ্ম লাইনটা স্পষ্ট করার সময় এসেছে।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১:১৪
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×