somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নারীর মুক্তি, নরের মুক্তি

২১ শে নভেম্বর, ২০২০ ভোর ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘ইন্টারন্যাশনাল ম্যান্স ডে’ বা আন্তর্জাতিক নর দিবস পালন নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলায় বলা হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস’। কিন্তু ইংরেজী 'ম্যান' শব্দের বাংলা অনুবাদে 'নর' বলতে যা বোঝায় 'পুরুষ' বলতে ঠিক তা নয়। ক্রমে ক্রমে 'পুরুষ' হয়ে উঠতে হয়। ঠিক যেভাবে ক্রমে নারী হয়ে উঠে কমনীয়-রমণীয় 'মেয়ে মানুষ' অথবা 'রমণী'।

'পৌরুষ', 'ব্যাটামি', 'মর্দামি', 'কর্তৃত্বপরায়নতা', 'নিয়ন্ত্রনবাদীতা', 'ঔদ্ধত্ব'-- ইত্যাদির মিশ্রনে নির্মিত হয় পুরুষ চরিত্র। এসকল পুরুষবাচক বৈশিষ্টাবলী যে পুরুষের মধ্যে তুলনামূলক কম বা অনুপস্থিত সমাজে সেসব পুরুষ-এর 'হীন' অবস্থা বোঝাতেই তৈরি হয়েছে 'কাপুরুষ' ও 'নপংসুক' শব্দাবলী।

পুরুষ যতদিন তার হাত থেকে না ফেলবে নারীকে নিয়ন্ত্রনের চাবুক ততদিন তার কাঁধ থেকে নামবে না সংসারের ভার টানার জোয়াল। পুরুষ যতদিন নারীর পায়ে পড়িয়ে রাখবে বেড়ি, ততদিন সেও থাকবে একই জিঞ্জিরে বাঁধা। নারীর মুক্তি বিনে নরের মুক্তি নাই। এই সত্য যত দ্রুত 'পুরুষ' আদমীরা অনুধাবন করবে ততই দ্রুত সুগম হবে পুরুষের স্বাধীনতা।

আচার্য শুক্রদেবের কথা মনে আছে তো? বৃহস্পতির পুত্র কচ — যে কিনা ছিল শুক্রাচার্যের শত্রুর সন্তান — তাকে শুক্রদেব মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র শিখিয়েছেন। কিন্তু নিজের কন্যা দেবযানীকে শেখাননি। শেখাবেনই-বা কেন! শেখানোর কথা তো শুক্রের কল্পনাতেও আসেনি। কারণ ‘কন্যা’কে সঞ্জীবনী মন্ত্র শেখানোর মতন গুরুত্বপূর্ণ মনে করার চলই সেই আমলে ছিল না।

সেই আমলে নারীর জন্য ছিল গৃহকোণ। নারীর জন্য ছিল দ্রৌপদীর মতন বিনা প্রতিবাদে পাঁচ ভাইয়ের ভাগের বস্তু হয়ে জীবন কাটানোর বাস্তবতা। নারী মানে নরের ছায়া। নারী বীর নয়, সেবিকা। নারী শক্তিমান নয়, ছলনাময়ী। আর সাবিত্রীর মতন যে নারী বেছে নিয়েছে স্বাধীনচেতা বীরের জীবন তার পথ হয়েছে বন্ধুর।

সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনী আজও লোকে বলে। কিন্তু সাবিত্রীর গল্প বলতে গিয়ে লোকে 'পতিঅন্তপ্রাণ' এক স্ত্রী'র গল্পই স্মরণে আনে শুধু। সাবিত্রীর এই চিত্রায়ন বড় খণ্ডিত। শুধু খণ্ডিতই নয়, খুব উল্টো চিত্রও বটে। স্বাধীনচেতা সাবিত্রী ছিলেন তেজস্বী, লড়াকু, বিদ্বান ও সুপণ্ডিত। তাঁর পাণ্ডিত্য ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বের সামনে সেকালের রাজ'পুরুষেরা' দাঁড়াতে সাহস করেনি।

'ঘরের সুন্দরী বধূ' হিসেবে নারীর যে চরিত্র তার সাথে সাবিত্রী ছিল শতভাগ উল্টো। আশৈশব পিতার 'আস্কারা' বা ভালোবাসা এবং অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে বড় হয়েছে সাবিত্রী। কন্যা বিবাহ উপযুক্ত হয়েছে। অথচ কোনো রাজপুত্র রাজকুমারীকে পাবার বাসনা ব্যাক্ত করছে না। বিষয়টি সাবিত্রীর পিতা অশ্বপতিকে ভাবিয়েছে। অবশেষে তিনিই একদিন সাবিত্রীকে পাঠান পাত্র সন্ধানের অভিযানে।

পাত্র সন্ধানে গিয়ে বনের মধ্যে সাবিত্রীর সাথে সত্যবানের দেখা। সেই দর্শনের পর সত্যবানকেই মনে-মনে পতি রূপে গ্রহণ করেন তিনি। এমনকি আর মাত্র এক বছর সত্যবানের আয়ু আছে জেনেও তাকেই করেছে মাল্যদান। এর পরের গল্প প্রায় সবাই জানে। বছর অতিক্রান্ত হলে নির্ধারিত দিনে যম এসে সত্যবানকে নিয়ে যায়। কিন্তু নিজের প্রেম দিয়ে যমের কাছ থেকে কী রূপে সাবিত্রী সত্যবানকে ফিরিয়ে এনেছিল সেই কাহিনী আজও পতি-প্রেমের উপমা হিসেবে লোকমুখে ফেরে।

এই ভূভারতে আজও স্বাধীনচেতা পণ্ডিত সাবিত্রীদের জীবন মহাভারতে বিধৃত সাবিত্রীদের চেয়ে খুব আলাদা নয়। তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে না পারলে তাদেরকে পরিত্যাগ করা বা এড়িয়ে চলাই অব্যার্থ নীতি। এমনকি খনার মতন জিভ কেটে নিতেও দ্বিধা করে না পৌরুষের তীব্র অহং-এ তাড়িত ভূ-ভারতের 'পুরুষ'।

একবিংশ শতকের পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি পাল্টে গেছে। মানুষ চাঁদে নেমেছে। মানুষ মঙ্গলে যাবার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। অথচ এই একবিংশ শতকেও বাংলাদেশে নারীর জন্য রাখা হয়েছে সতী-সাবিত্রী-সীতার মানদণ্ড।

পৃথিবীতে পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে পৃথিবীর উন্নত দেশের নারী-পুরুষের মনোজগতেও। এই বাংলা তথা ভূভারতের 'পুরুষ'প্রজাতির হার্ডওয়্যার তথা তাদের জীবন-যাপন-পোশাক-আশাক-আর্টিফ্যাক্টস ব্যাবহারের ধরণ-ধারণেও আমূল বদল এসেছে। কিন্তু নারীপ্রশ্নে ভূভারতের পুরুষগোত্রের 'সফটওয়্যার' আজও আপডেট করা হয়নি। নারী প্রশ্নে তাদের মগজ আজও পাঁচ হাজার বছরের পুরনো সফটওয়্যারেই চলছে। কে না জানে, ল্যাপটপ যত ভালোই হোক, সফটওয়্যার আপডেট না দিলে বারবার হ্যাং করবে, কাজে বিড়ম্বনা হবে।

বাংলা তথা ভূভারতে অধিকার প্রশ্নে নারীরা উচ্চকিত থেকে উচ্চকিততর হচ্ছে। আরো হবে। হওয়াটাই নিয়তি। এই শতকের আসন্ন দিনগুলোতে নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন নানান রূপে হতেই থাকবে। কারণ নারী প্রশ্নে পুরুষের মনোজগত আপডেট করা হয়নি। পুরুষেরা নারীদেরকে রীতি-নীতি-আইন-কানুনের প্রাচীর দিয়ে আজও ঘেরটোপে রাখতে চান। আর তাতেই বাঁধছে লড়াই।

এখনই সময়। বাংলা তথা ভূভারতের পুরুষের মগজের সফটওয়্যার আপডেট দেবার উদ্যোগ নিতে হবে। নারীর স্বাধীনতা মাপার বাটখারা হাতে নিয়ে ওজন মাপতে-মাপতে পুরুষ যে নিজের জন্যই রচনা করছে বন্দীত্বের গোলকধাঁধা এই সত্য তাকে বুঝতে হবে। নরের মুক্তি নারীর পায়ে বাঁধা। এই ভূখন্ডে মানুষ হিসেবে নারীর পূর্ণ মর্যাদা যতদিন প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন পুরুষকেও বইতে হবে পৌরুষ-এর জোয়াল। ততদিন সে মন খুলে কাঁদতেও পারবে না। প্রকাশ্যে কাঁদলেও লোকে বলবে, ‘মেয়েদের মতন কেঁদো না’

পুরুষের হাত থেকে নারী মুক্তি পাক। পৌরুষের মায়া-শৃঙ্খল হতে মুক্তি পাক নর। নর ও নারীর প্রেমে পৃথিবীতে বসন্ত আসুক। পরস্পরকে পাশে নিয়ে জীবনের জ্বরা ও জীর্ণতা মোকাবেলা করুক নর ও নারী।

১৯.১১.২০
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০২০ ভোর ৪:৫৯
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×