আগে বাবা হ তারপর বুঝবি………….!
আমার সারাটা জীবনে বাবার মুখ থেকে যতবার যত নীতি বাক্য শুনেছি, সব থেকে বেশি বার শুনেছি উপরোক্ত কথাটি-ই। সেসময় বাবার মুখ হতে কথাটা শুনতে যেমন বেশ বিরক্ত লাগত তেমনি সন্তানের প্রতি পিতার কর্তব্যগুলোও বেশ স্বাভাবিক মনে হত। বাবার সাথে সাথে সাবলীল কোন সম্পর্ক আমাদের দুই ভাইয়ের কারোর-ই ছিল না বরং তার কথায় বিরক্তির মাত্রা আমাদের চরমে উঠত। শত শাসন আর অনুশাসনেও, আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল আমাদের মা। অথচ সারাটা জীবনে সন্তানেদের একবারও শাসন না করা পিতাকে আমরা বিন্দুমাত্র পাত্তা দিতে চাইতাম না। আমাদের সামান্য বয়স হবার পর, বাবা কোন কথা বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতাম আমরা। অথচ শহরের হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেনী পড়ুয়া নির্বোধ বালকটির মাথায় কখনো এই প্রশ্নটা একটি বারের জন্যেও আসত না যে, শহরের অফিসে মিটিং করতে আসা পিতা, মিটিংএ দেয়া বিরানীর প্যাকেট টা কেন নিজে না খেয়ে তার হোস্টেলে থাকা সন্তানের জন্য বয়ে নিয়ে আসত বারেবার।
তারপর কেটে গিয়েছিল অনেকগুলো বছর। আমার ভাবনাতে কখনো একটি বারের জন্যেও আসে নাই যে, চাকুরীটা ছেড়ে দেবার পর শুধু এক কৃষিকে অবলম্বন করে সংসার আর রাজধানীতে সন্তানকে পড়ানোর খরচ জোগাতে তাকে কি পরিমান হিমশিম খেতে হয়েছিল। সেটা কস্মিনকালেও তিনি আমাদের বুঝতে দেন নাই। জগত সংসারের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চরম ভাবে ঋনী হয়ে পড়া আমার পিতা, শত অভাব আর দুঃশ্চিন্তার মাঝেও স্বপ্ন দেখে চলতেন, তার সন্তানেদের মানুষের মত মানুষ হয়ে ওঠবার স্বপ্ন। একটা সোনালী সুদীনের স্বপ্ন।
সোনালী সেই সুদীনগুলো আমার পিতাকে আমি ফেরত দিতে এখনো পারি নাই, সত্য। তবে ঋনগ্রস্থ পিতাকে আমি করতে পেরেছি ঋনমুক্ত। আর একই সাথে তার সন্তানকে পিতা বানানোর মনো-কামনায়, আমিও হয়েছি আজ পিতা।
পিতা হিসেবে নিজেকে আবিস্কার করার পর জীবনের সকল স্বপ্নগুলো আজ যেন শ্রেয়ান আর নীর কে ঘিরে। তাদের শত আবদার আর অভাব-অভিযোগ মেটাতে নিজেকে নিয়োজিত করি, এমনকি আকাশের চাঁদটা পর্যন্ত। আর এর জন্য ত্যাগ করে চলেছি সংসারের তাবত আরাম-আয়েশ আর স্বাচ্ছন্দ্য গুলো। তাদের চোখে মুখে সামান্য তৃপ্তির আভা-ই যেন পরম সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য, এর বাইরেই আর কিছুই নেই।
বাবা, হঠাত করেই আজ তোমাকে খুব বেশি মনে পড়ছে। না, সন্তান হিসেবে নয়। একজন পিতা হিসেবে আরেক পিতাকে- যারা কিনা সন্তানের ভবিষ্যত উৎকণ্ঠায়, আবদার আর অভাব-অভিযোগ পূরনে আর সংসারের বোঝা টানতে টানতে একদিন নিজেকে যন্ত্র-পিতায় রুপান্তর করেন। আমরা, সন্তানেরা অনেক অবিচার করে ফেলেছি তোমার উপরে। ক্ষমা করো আমাদের।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:২৯