গত ৭ই জুলাই সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র আয়োজিত টিপাই মুখ বাধ শীর্ষক সংলাপে গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকির সূচনা বক্তব্য প্রকাশিত হল।
আন্তর্জাতিক নদী সংক্রান্ত নিয়মাবলী কিংবা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের সমঝোতা কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে আন্তর্জাতিক সীমানার সামান্য উজানে বরাক ও তুইভাই নদীর সংযোগস্থলে ৫০০ মিটার ভাটিতে বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে ভারত সরকার। ১৬২.৮ মিটার উঁচু ও ৩৯০ মিটার লম্বা এই বাঁধের পরিকল্পনার সমস্ত কিছু ভারত সরকার সম্পন্ন করেছে সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে, বাংলাদেশকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখে, একতরফাভাবে। ১৯৯৫ সালের আগে বেশ কয়েকটি স্থান বাঁধ নির্মাণের জন্য খোঁজাখুজির পর ভূ-প্রকৃতিগঠন প্রতিকূল হওয়া এবং বিপুল কৃষি জমি ধ্বংস হবার কারণ দেখিয়ে সেগুলোকে বাতিল করা হয়। কিন্তু ১৯৯৫ সালে একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আরেকটি এলাকা বর্তমানে নির্মিতব্য টিপাইমুখ বাঁধের এলাকায় এটা নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভারত সরকার। সেই বছরেই মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রীসভায় বাঁধের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্তের কথা জানান। ১৯৯৮ সালে মনিপুরের পার্লামেন্টে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এভাবে বাধার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারত সরকার ১৯৯৯ সালে নর্থ-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার কো-অপারেশন (নেপকো) এর কাছে তা হস্তান্তর করে। ২০০১ সালে মনিপুরের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আন্দোলনকে অস্ত্রের মুখে দমন করতে সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং মনিপুরের প্রেসিডেন্টের বা কেন্দ্রীয় শাসন জারি করা হয় এবং নেপকোর প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেয়া হয়। ২০০৩ সালে নেপকো প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনে এবং প্রকল্পের নাম টিপাইমুখ মাল্টিপারপাস ব্যারেজ থেকে টিপাইমুখ হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট করে। "বর্তমানে এই প্রজেক্টের নাম বদলিয়ে যেহেতু হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট করা হয়েছে কাজেই তা শুধু্ বিদু্ত উত্পাদনে ব্যবহৃত হবে ", "জলাধারের পানিতে অন্য কোন কাজে ব্যবহারের জন্য উত্তোলন বা গতিপথ পরিবর্তন করা হবে না", "শুধু ভূপৃষ্ঠে প্রবহমান পানির ক্ষয়হীন ব্যবহার হবে এতে, নদীর গতিপথ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না" ইত্যাদি কথাবার্তা পিনাক রঞ্জন সহ ভারতীয় শাসকশ্রেণী প্রচার করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের এই প্রচার অসত্, কপটতাপূর্ণ ও মিথ্যা। কেননা ক্ষয়যু্ক্ত ও ক্ষয়হীন যে ধরনের ব্যবহারই বাঁধ দিয়ে করা হোক না কেন, তাতে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। একদিকে তারা সত্য গোপন করছেন, আর অন্যদিকে মিথ্যা বলছেন। ভারতীয় শাসকশ্রেণী বাংলাদেশকে যখন বলছে এই বাঁধ জলবিদু্ত উত্পাদন ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহৃত হবে না তখনই ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে জনগণকে বলা হচ্ছে যে, প্রাথমিকভাবে এই বাঁধ জলবিদু্ত উত্পাদন ও বন্যা থেকে রক্ষার জন্য নির্মিত হলেও পরবর্তীতে সেচ ও অন্যান্য সুবিধা তা থেকে পাওয়া যাবে। স্মরণীয়, ফারাক্কা বাঁধ প্রথম যখন দেয়া হয় তা ছিল কলকাতা বন্দরকে পলি জমার হাত থেকে কোলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার নিরীহ প্রস্তাব। সেই ফারাক্কার প্রভাব আমাদের সকলেরই জানা। কাজেই টিপাইমুখ বাঁধের পরিণতিও সহজেই অনুমেয়। আর টিপাইমুখ বাঁধ যেখানে হচ্ছে তার আরও কিছুটা উজানে ফুলের তালা নামক স্থানে নদীর গতিপ্রবাহকে সরিয়ে দিতে ব্যারেজ করা হচ্ছে। যা ভারতের নদী সংযোগ মহাপরিকল্পনার সাথে যুক্ত এবং এর লক্ষ্য ভারতের খরা সমস্যার সমাধান। অর্থাত্ "এই বাঁধ শুধু বিদু্ত উত্পাদনে ব্যবহৃত হবে"- পিনাক রঞ্জনের এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করার কোন কারণ নেই। বিশেষত ফারাক্কার টাটকা স্মৃতি যখন আমাদের মনে দগদগে ক্ষত হিসেবে হাজির আছে।
দ্বিতীয়ত, বাঁধ মাত্রেই নদীর গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে, জীব বৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রতিবেশ হুমকির সম্মুখীন হয়। জলবিদু্তের জন্য নির্মিত বাঁধে তা হয় না এই কথাটাও সত্যি নয়। Foundation for water and Energy education বিভিন্ন জলবিদুত কেন্দ্রের নির্মিত বাঁধের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে জলবিদুত প্রকল্প ভাটি অঞ্চলের পানির গতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করে। উপরিভাগের পানির তাপমাত্রা বাড়ায়, নিচের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমায়। পানিতে দ্রবীভূত নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ায়। উজানে পানির স্তরের উচ্চতা বাড়ায়। ভাটিতে কমায়। যার মিলিত প্রভাবে বিপুল পলি পড়ে নদীর তলদেশ উঁচু হয়, (গতির ১ মাত্রা হ্রাসে ১৬ গুণ বেশি পলি পড়ে) মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রজাতির জন্য পরিবেশকে অনুপযুক্ত করে তোলে, প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে, ভূমির ক্ষয় ঘটায়। এদের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে, নদীর প্রবাহের পরিমাণ ও বাঁধের আকারের উপর। [দ্রষ্টব্য: How a hydroelectric project can affect a river] কাজেই টিপাইমুখের মতো বৃহত্ বাঁধ নির্মাণের ফলে তা নদীর গতিপ্রবাহের উপর কোন প্রভাব করবে না বলা, হয় মূর্খতা নয় জেনেশুনে মিথ্যাচার। বিখ্যাত লেখক ভারতীয় পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অরুন্ধতী রায় চমত্কারভবে বাঁধ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলেছেন এভাবে -
"বড় বাঁধের শুরু হর্ষধ্বনিতে আর শেষটা কান্নায়। একসময় ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী, মতাদর্শ নির্বিশেষে সবাই প্রবল উচ্ছ্বাসে বড় বড় বাঁধকে স্বাগত জানিয়েছে। বাঁধকে নিয়ে কাব্য করা হয়েছে সেই সময়। এখন আর হয় না। এখন বড় বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। উন্নত বিশ্বে এগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এগুলো উপকার যা করে তার চাইতে ক্ষতিই করে বেশি। বড় বাঁধ সেকেলে, অগ্রহণয়োগ্য, অগণতান্ত্রিক। সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার, কে কি পাবে, কতটুকু ফলাবে তা ঠিক করে দেবার হাতিয়ার। কৃষকের জ্ঞান তার কাছ থেকে কেড়ে নেবার নিশ্চিত পদ্ধতি। গরীবের পানি, সেচ আর জমি বড়লোকদের হাতে উপহার দেবার উদ্ধত পথ। এগুলোর জলাধার মানুষকে করে গৃহহীন, নিঃস্ব। প্রতিবেশগত বিবেচনায় চরম দুর্দশা সৃষ্টিকারী। এগুলোকে মাটিকে বানায় আবর্জনা। বন্যা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, খরা আর রোগ বিস্তার এগুলোর পরিণতি। বড় বাঁধের ভূমিকম্প প্রবণতা সৃষ্টিরও যথেষ্ট প্রমাণ আছে।"
['দি গ্রেটার কমন গুড'-অরুন্ধতী রায় ১৯৯৯]
[পরবর্তী সংখ্যা সমাপ্য]