somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জবানবন্দী

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ৭:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোট্ট আমি। এতই ছোট ছিলাম যে, সহপাঠীরা পর্যন্ত সমবয়সীর মর্যাদা দিতে চাইতো না। কেপিসির ক্লাসমেট ফরহাদ লম্বায় ছিলো আমার প্রায় দ্বিগুণ। আর বনিকে আমার পাশে দাঁড় করালে মনে হতো মূষিকের পাশে পর্বত।

সেই ছোট্ট আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে অনেক দূরে, বাবা একদিন খুলনায় নিয়ে গেলো আমাকে। বয়রার যে বাসাটিতে গেলাম, তার গৃহকর্তা মাঝারি আকৃতির। না তরুণ না মাঝবয়েসী। মুখ-ভর্তি কালো চাপ দাড়ি। তার হাতে আমাকে তুলে দিয়ে বাবা বললেন, স্যার, ছেলেটা আমার ভারি দুষ্টু, পড়তে চায় না। শুনেছি আপনাদের স্কুলে দুষ্টু ছেলেরা সব সোজা হয়ে যায়। আমার ছেলেটাকে আপনাদের স্কুলে নিয়ে নেন। সেই প্রথম আমার দেখা সিরাজ স্যারের সাথে। ষোলো-সতেরো বছর আগের কথা।

কদিন আগে স্যারের সাথে আবার দেখা হলো ঢাকায়। চেহারায় প্রৌঢ়ত্বের সব ছাপ স্পষ্ট। দাড়ি সবই সাদা। চুলেও রূপালি ছোপ। সাথে তাসিন কাদির স্যার। আরো জনা দুয়েক শিক্ষক ছিলেন। তাদেরকে অবশ্য আমি শিক্ষক হিসেবে পাইনি। সিরাজ স্যার বললেন, তোমাদের কলেজের রজত জয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি আমরা। তোমাদের সবাইকে নিয়ে দুদিন ধরে হৈচৈ, আনন্দ করবো। কনসার্ট হবে। আতশবাজি পোড়াবো। নাহ্‌! আমারই বোঝার ভুল। স্যারের বয়স বাড়েনি এতটুকু।

পরিবর্তন নেই তাসিন কাদির স্যারেরও। সেই আগের মতোই। চোটপাট অব্যাহত। ক্লাসে যেমন কথায় কথায় চড়-থাপ্পড়ের হুমকি দিতেন, এখনো দেন। তাসিন স্যারের বয়েস মনে হয় আগের চাইতেও কমেছে। সমানে আড্ডাবাজি, স্টাইলিশ স্মার্ট-ফোন, ফেসবুকে সরব উপস্থিতি। আজকালের টিনেজাররাও মনে হয় পেরে উঠবে না তার সাথে। সেলিম হায়দার চৌধুরী, মলিন কুমার বসু, শঙ্কর প্রসাদ বনিক, মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, বদরুল আমিন, আব্দুল মালেক, তাসরিনা বেগম, আহম্মদ আলী মুনসি, খান আলালউদ্দিন, কিনুরাম মণ্ডল, শাহেদুল হক - পাবলিক কলেজের ওয়েবসাইট ঘেঁটে প্রিয় সব শিক্ষকের ছবিই পেলাম। কই, কারোতো খুব বেশী পরিবর্তন নেই। শুধু টিবি ম্যাডামের (তাসরিনা বেগম) চোখে চশমা লেগেছে। শাহেদ স্যারের দাঁড়ি গজিয়েছে। ফেসবুক প্রোফাইলে দেখলাম বেনিয়াজ জামান স্যারও বেশ স্টাইলিশ একটা দাঁড়ি রেখেছেন। কদম-ছাঁট চুলে কিনুরাম স্যারকে একটু রোগামত লাগছে। মুনসি স্যারও বদলেছেন, আরো ইয়াং হয়েছেন তিনি। ফেসবুক প্রোফাইলে তার নাম ‘পথিক কবি’। তবে আমূল বদলে গেছি আমি। মাথায় টাকের আবির্ভাব ঘটেছে। জামা ছিঁড়ে পেট বেরিয়ে আসবো আসবো করছে। স্যার, খুব বেশিদিন তো হয়নি, পাবলিক কলেজ ছেড়েছি! এক যুগইতো মোটে! তাতেই স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে কলেজের ছেলে-ছোকরারা পর্যন্ত আংকেল বলে ডাকে। অথচ, আপনারা কি সবুজ! হিংসায় গা-টা একেবারে জ্বলে যাচ্ছে।

খুব দুষ্টু ছিলাম স্যার। তাসিন স্যারতো এখনো কথায় কথায় খোঁচা মারেন। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে এখন একা একাই হেসে গড়িয়ে পড়ি। কি দুরন্তই না ছিলাম! প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসের সামনে যে কাঁঠাল গাছটি (এখনো আছে নিশ্চয়ই), একবার আমি, মানিক আর জয়ন্ত বিকেল বেলায় টানাটানি করতে করতে গাছ থেকে বড় একটা কাঁঠাল ছিঁড়ে ফেললাম। এত বড় কাঁঠাল নিয়ে কি করি এখন? একটু পরেই দেখি ক্লাসের জুনায়েদ আলী মোল্লা (এখন সে জুনায়েদ সাকি, একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক) একটা সাইকেল চালিয়ে মাঠে এসেছে খেলতে। সাথে সাথে বুদ্ধি পেয়ে গেলাম। জুনায়েদতো হোস্টেলে থাকে না। ও চাইলেই বাইরে যেতে পারে। উঁচু দেয়ালের ওপাশে সাইকেল ঠেক দিয়ে জুনায়েদ উঠে দাঁড়ালো তার ওপর। আর আমরা কাঁঠাল করে দিলাম পাস্। এক সপ্তাহ পর টিফিন ক্যারিয়ারে পাকা কাঁঠাল নিয়ে জুনায়েদ হাজির হোস্টেলে। গেটের মোটা হাসান ভাই যথারীতি তাকে আটকালে জুনায়েদ বললো, ‘মা পাঠিয়েছে বন্ধুদের জন্য’। সেবার হাসান ভাইও অবশ্য ভাগ পেয়েছিলো চোরাই কাঁঠালের।

আরেকবার কলেজের গাছগুলোতে আম ধরেছে খুব। দুপুরবেলা হাসান ভাই হোস্টেলের গেট খুলে রেখে ঝিমুচ্ছে। এই ফাঁকে আমি, মানিক আর গাজী সালাম বেরিয়ে পড়লাম আম অভিযানে। টার্গেট হোস্টেল আর কলেজ বিল্ডিংয়ের মাঝামাঝি জায়গায় যে গ্যারেজটা, সেখানে থাকা মাঝারি সাইজের একটি আমগাছ। গ্যারেজ লাগোয়া একটি ঘরে তখন হোস্টেলের স্টুয়ার্ড আকবর স্যার থাকতেন। তার জানালার সাথেই গাছটা। আর সেই জানালা খুলে রেখে ভাত-ঘুম দিচ্ছেন আকবর স্যার। নাসিকা গর্জনে বুঝলাম, এ নিদ্রা ভাঙবার নয়। তাই প্ল্যানমতো মানিককে চড়িয়ে দিলাম গাছে। আমার আর সালামের দায়িত্ব নিচ থেকে আম ক্যাচ নেয়া। কিন্তু কপালে খারাবি ছিলো সেদিন। চিকন একটা ডাল থেকে আম পাড়তে গিয়ে মানিক ডাল ভেঙে পপাত ধরণীতল। আর ঘুম ভেঙে আকবর স্যার হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘ক্যাডা? ওইখানে ক্যাডা?’ আর আমরা তো পড়িমড়ি ছুট। সেবার অবশ্য শেষে রক্ষা হয়নি। রাতে ডিনারের পর ব্যাপক উত্তম মধ্যম খেতে হয়েছিলো।
খুব ছ্যাচঁড়াও ছিলাম স্যার। শুক্রবার হোস্টেলের ডাইনিংয়ে থাকতো পোলাও-মাংস-কাবাবের ডিনার। যদি কোনোদিন আগেভাগে খার পেতাম, রান্না একটু কম হয়েছে, সাথে সাথে রুমে রুমে খবর চলে যেতো, ‘আজ সবাই ঠেসে খাবি। খাবার শর্ট ফেলতে হবে’।

ডাইনিংয়ে গরুর হাড্ডি খাওয়ার জন্য কি না করেছি। এ নিয়ে হাতাহাতি মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। যেদিন হাড্ডি ভাগে পড়তো, সেদিন খাওয়া শেষে হাড্ডিটা রুমে নিয়ে যেতাম, আরাম করে ‘মজ্জা’ চুষবো বলে। কেউ কেউকে এও বলতে শুনেছি, ‘তাইতো বলি, কুকুর এতো মজা করে কেনো হাড্ডি খায়!’ তবে হাড্ডি খেতে সবচাইতে বেশী ভালোবাসতেন স্টুয়ার্ড আকবর স্যার। এজন্য আমরা হোস্টেল বয়রা তাকে আড়ালে আবডালে ‘আকবর-ডি’ ডাকতাম। (আকবর স্যার, কথাটা আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য লিখছি না। বিলিভ মি। আপনার প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আমার মনে সবচাইতে বেশী। কারণ, সারাক্ষণ হোস্টেলে থাকতেন বলে আপনার ভালোবাসাই সবচে বেশী পেয়েছি আমরা।) আকবর স্যার কারো উপর খেপে গেলে হুমকি দিতেন: ‘তোমার আকাশে কিন্তু মেঘ জমতাছে। অখনি বৃষ্টি নামবো!’ এটা ছিলো তার সবচেয়ে হিট ডায়লগ। তবে কারো উপর কোনোদিন সেই বৃষ্টি নামতে দেখিনি।

মলিন স্যার তখন হাউস মাস্টার। হাউসের মধ্যেই তার কোয়ার্টার। স্যারের ছিলো খুব ভুলো মন। সারাক্ষণ পত্রিকা পড়তেন। আমরা যে কত তার এই ভুলো মনের সুযোগ নিয়েছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। হাউস টিউটর ছিলেন সিরাজ স্যার। মলিন স্যার আর সিরাজ স্যারের হাতেই শুধু ছিলো হাউস থেকে বের হওয়ার ‘লিভ পাস’ দেয়ার ক্ষমতা। মলিন স্যারের কাছ থেকে লিভ পাস সই করানো ছিলো পাথর নিংড়ে পানি বের করার মতোই কঠিন। কিন্তু সিরাজ স্যার হাউস টিউটর হওয়ার পর, নানা অজুহাত তুলে বাইরে গিয়ে সিনেমা দেখাটা আমরা প্রায় নিয়মই বানিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু দিনকয়েক যেতে না যেতেই আমাদের দু নম্বরি ধরে ফেললেন সিরাজ স্যার। আমরা কি কম! সিরাজ স্যারের সইটা ছিলো অনেকটা টিক চিহ্নের মতো। সেটা জাল করা শুরু করলাম এবার। মলিন স্যারের সই আগেও টুকটাক জাল করেছি। কিন্তু সিরাজ স্যারেরটা ছিলো একদম ডালভাত। গেট-ম্যানরা ধরতেই পারতো না। ১৯৯৬-৯৭ সালে সিরাজ স্যারের সই জাল করে গেট থেকে বের হওয়া এক একপর্যায়ে এত ভয়ানক আকার ধারন করেছিলো, যে থ্রি-ফোরের পোলাপানও এই কাজ করতে শুরু করলো। অতিষ্ঠ হয়ে সিরাজ স্যার শেষ পর্যন্ত তার সই বদলে ফেলতে বাধ্য হন।

হোস্টেলে দুটো ‘ভালো’ জিনিসের খুব চল ছিলো। একটা হলো ‘গণ’ দেয়া। গণ মানে হলো গণধোলাই। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার রাতে, যাকে গণ দেয়া হবে, তাকে একটা রুমে ডেকে নেয়া হতো। রুমে ঢোকার সাথে সাথে লাইট অফ, দরজা বন্ধ। একজন একটা লেপ দিয়ে শিকারকে ঢেকে দিতো। বাকি সবাই এসে তার ওপর দুমাদুম কিল-ঘুষি চলতো অনেকক্ষণ। গণ’র শিকার আমিই বেশী হতাম বলেই হয়তো হোস্টেলের এই ভালো জিনিসটা আমার খুব অপছন্দের ছিলো। আরেকটা অপছন্দের জিনিস ছিলো, ‘নামকরণ’। আমি শিয়োর, পাবলিক কলেজের হোস্টেলে প্রত্যেক ছেলেই পিতৃপ্রদত্ত নামের বাইরে একটা নতুন ‘নিক নেম’ পেতো। আর যথারীতি এর সবচাইতে বড় শিকার ছিলাম আমি। বনির নাম ছিলো ‘মোটা’। মানিকের নাম ‘কালা’। জয়ন্ত কখনো ‘মালু’ কখনো ‘সরকার বাবু’। মেহেদীর নাম ছিলো ‘ডোম’, সাইফুদ্দিনকে ডাকা হতো ‘বাঁকা’। জহিরের নাম ‘গুরুল’। ‘ফান্টু’ হাসান, ‘ঘুম’ আরিফ, ‘ক্যাপ্টিন’ ফিরোজ, ‘ধুর’ মনি, ‘ক্যামা’ মফিজ, ‘গেঁদো’ শাকিল, ‘ভাইপো’ ফয়সাল, ‘লেডিস’ সোহেল কত পদের নাম যে ছিলো! সবচেয়ে বেশী নাম ছিলো সম্ভবত আমার। অড়হর, আহার, কচু, কীট। আরো ছিলো হয়তো, এখন আর মনে নেই। কীট নামটা দিয়েছিলো আমাকে সিরাজ স্যার । শানে নুযূল বলি। সিরাজ স্যারের কাছে ইংরেজি পড়তাম। একদিন কথায় কথায় ইংরেজ কবি জন কীটসের নাম উঠেছে। আমি যেনো কি একটা ফোড়ন কেটেছি। সিরাজ স্যার তখন ভরা মজলিশে বলে উঠলেন, ‘কি হে! তুমিও কি কীট হতে চাও নাকি?’ আর কোথায় যাই! আমার নাম হয়ে গেলো কীট। এ নামটাই মনে হয় বন্ধুদের সবচেয়ে প্রিয় ছিলো, কারণ এখনো তারা আমাকে এই নামেই ডাকে। স্যারদেরও অবশ্য নাম দিতাম আমরা। কিন্তু সেটা এখানে বললে, এই লেখা ছাপা হওয়ার সম্ভাবনা নেই হয়ে যাবে।

আমার পুরো পাবলিক কলেজের শিক্ষা জীবনে এমন কোনো দিন নেই যেদিন কোনো না কোনো কারণে পিটুনি খাইনি। সবচে বেশী পিটুনি খেয়েছি সকালে ঘুম থেকে ওঠা এবং নামাজ পড়া নিয়ে। সকালে যাতে নামাজ পড়ার জন্য বেশী আগে উঠতে না হয়, এজন্য হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর পাজামা এবং পাঞ্জাবী পরেই ঘুমুতাম। নামাজের পরই সকালের পিটিতে যেতে হতো। পিটির কাপড় পড়তে যাতে আলাদা করে ঝামেলা না করতে হয়, এজন্য পাজামার নিচে হাফপ্যান্ট। এই পিটি ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা। এমন দিনও গেছে, সারাদিন ঠিকঠাক সব নিয়ম কানুন মেনে চলেছি। বেশী বেশী পড়াশোনা করেছি। পরদিন পরীক্ষা। তাই পড়ার তালে কখন যে রাত এগারোটা অর্থাত‌ঘুমুতে যাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে খেয়াল করিনি। সেদিন হাউস মাস্টারের পিটুনি খেয়েছি দেরী করে ঘুমুতে যাবার অপরাধে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ। পাবলিক কলেজের শেষ দিন। বিকেলে চিরতরে কলেজ ছেড়ে চলে যাব। সেদিন দুপুরেও টিবি ম্যাডাম (তাসরিনা বেগম) পিটাতে পিটাতে স্কেল ভেঙে ফেলেছিলেন।

এমন হাজারো অম্লমধুর অভিজ্ঞতা আমার পাবলিক কলেজকে ঘিরে। লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। এদিকে সিরাজ স্যার সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছেন, ‘লেখা জমা দিচ্ছ না কেনো’? একটা ঘটনা দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই (এটা না লিখলে এই বুড়ো বয়সেও তাসিন স্যারের পিটুনি খাওয়ার চান্স আছে)।

১৯৯৭ সাল। স্যারদের সব ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে স্টার মার্ক পেয়ে এসএসসি পাশ করেছি। ওই বছর পাবলিক কলেজে সায়েন্স থেকে ৫০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৪০ জন স্টার পেয়েছে। সে বছর সর্বাধিক সংখ্যক পুরনো ছাত্র পাবলিক কলেজেই উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সুযোগ পেয়েছে, কারণ সেসময় পাবলিক কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাশ করলেও কলেজ শাখায় ভর্তি হওয়ার জন্য বাইরের ছাত্রদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার করার মতো একটা খারাপ নিয়ম ছিলো। একারণে বছরের পর পর বছর নিষ্ঠার সাথে পাবলিক কলেজে পড়া চালিয়ে গেলেও অনেকেই কলেজ সেকশনে ভর্তির সুযোগ পেতো না। কঠিন সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে এবং নিয়ম ভঙ্গ করলে সাথে সাথে টিসি, এমন বন্ডে আমার গার্জেন সই করার পর নতুন করে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলাম প্রিয় পাবলিক কলেজে। শুধু একটা বিষয়ে একটু মন খারাপ হলো, আমার কলেজ নম্বর ১৪৩৬ বদলে হয়ে গেছে ২০১৫। ক্লাস শুরুর পরপরই নিয়ম অনুযায়ী ইলেভেনের ছাত্ররা কক্সবাজারে গিয়েছি শিক্ষা-সফরে। আমাদের দায়িত্বে ছিলেন শংকর প্রসাদ বনিক, নুরুজ্জামান, তাসিন কাদির আর বেনিয়াজ জামান স্যার। কলেজ সেকশনের ছাত্র আমরা। ভাবের ওজনে চলাই দায়। কলেজে পড়ি বলেই হয়তো এবারের শিক্ষা-সফরে স্যারদের চোখ এড়িয়ে অনেক নিষিদ্ধ কাজ করার চেষ্টাও করছি কেউ কেউ। কক্সবাজারে আমরা ছিলাম ইসলামিয়া হোটেল নামে একটি হোটেলে। এক একটা রুমে দুজন থাকবে। আমার পার্টনার ছিলো ‘ঘুম’ আরিফ। যাইহোক, শীতের রাত, মশার অনেক উপদ্রব। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে একটি কয়েল ধরিয়ে খাটের পাশে রেখেছি। মাঝরাতে প্রচণ্ড গরম আর দম আটকানো অবস্থায় ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে দেখি, আমার গায়ের লেপটি মাটিতে পড়ে জ্বলন্ত কয়েলের সংস্পর্শে এসে আগুন ধরে গেছে। ঘুম আরিফকে অনেক ঠেলাঠেলি করে না তুলতে পেরে কোনোমতে একার চেষ্টায় আগুন নেভালাম। কিন্তু ততক্ষণে খাটের একাংশ, লেপ ও ম্যাট্রেসের কিছুটা পুড়ে গেছে। পরের দিন হোটেল ছাড়ার সময় ১৪০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত ম্যাট্রেসটা ঘাড়ে নিয়ে হোটেল ছাড়লাম। তাসিন স্যারের ধারণা, কয়েল নয়, অন্য কিছুর আগুনে ঘটেছে এই দুর্ঘটনা। শাস্তি হিসেবে আমাকে বলা হলো ওই ম্যাট্রেস খুলনা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হবে আমাকে। সেবার কক্সবাজার থেকে সবাই অনেক কেনাকাটা করলেও আমার একমাত্র শপিং ছিলো ওই ম্যাট্রেসটি। আমার গ্রামের বাড়ির চিলেকোঠায় এখনও রাখা আছে ফোমের সেই ম্যাট্রেস।

আমাদের ব্যাচ নিয়ে কোনো আশা ছিলোনা স্যারদের। তাসিন স্যারতো দেখলেই বলতেন ‘তোদের ফিউচার নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে’। স্যার, সন্দেহ আমারও ছিলো। এখন সেটা আরো বদ্ধমূল হয়েছে। জ্ঞানের সন্ধানে গিয়েছিলাম আপনাদের কাছে। ফিরে এসেছি। দেশের সেবা করার কথা। কি করছি?

(এই লেখাটি আমার স্কুল এবং ছোটবেলার হোস্টেলজীবনের স্মৃতিচারণ। সম্প্রতি স্কুলের রিইউনিয়ন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্যুভেনিরে ছাপা হয়েছে। যারা স্যুভেনিরের ছাপা কপি পাননি, তাদের জন্য...)
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×