somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘জর্জরিত মানবাত্মার সর্বশেষ বিশ্বাসের স্তম্ভ’

১৩ ই অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আল মাহমুদ অর্জন করে নিয়েছেন এক অনন্য আসন। প্রতিভার শক্তিতে বাংলা কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস সাহিত্যে তিনি যে অবদান রেখেছেন; কালের বিচারে তা এরই মধ্যে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। কবিতার বাইরে আল মাহমুদ যেসব কাজ করেছেন বা এখনও করে চলেছেন, তার নিজের ভাষায় সবই ‘কবির কাজ’। এককভাবে ছোটগল্পে তিনি যে কাজ করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যের কোনো কোনো বিখ্যাত ছোটগল্পকারের এক জীবনের কাজের সমতুল্য। আবার উপন্যাস সাহিত্যে এককভাবে তিনি যে কাজ করেছেন, সেটাও বাংলা সাহিত্যের কোনো কোনো বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের এক জীবনের কাজের সমান। ছড়াসাহিত্যে তিনি যে অবদান রেখেছেন তাও এক কথায় অনন্য, অসাধারণ। এর বাইরেও তিনি রচনা করেছেন বহু প্রবন্ধ, অজস্র ব্যক্তিগত রচনা, অগ্রজ-অনুজ ও সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের ওপর মূল্যায়নধর্মী রচনা, একাধিক ভ্রমণকাহিনী এবং সংবাদপত্রের জন্য অগণিত কলাম। তার নিজস্ব মূল্যায়নে সারাজীবন ধরে তিনি যা-ই করেছেন, সবই ‘কবির কাজ’। সে কারণেই আল মাহমুদ কবি এবং তার নিজের ভাষায়—‘কবি ছাড়া আমি আর কিছুই নই।’
বাংলা সাহিত্যে এক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এত দীর্ঘকাল ধরে, এত বয়স পর্যন্ত সৃজনী শক্তির পরিচয় আর কোনো কবি দিতে পারেননি। প্রতিভাবান কবিদের অনেকেই মারা গেছেন অল্প বয়সে। যারা বেঁচে ছিলেন তাদের মধ্যে নজরুল হয়ে গেছেন নিষ্ক্রিয়, জসীমউদ্দীনের মতো কবিও হয়ে গেছেন বৃত্তাবদ্ধ। অনেকেই সৃজনী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন পঞ্চাশে কিংবা ষাটে এসে। শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। তিরিশের কবিদের ক্ষেত্রে তো ঘটেছেই। আল মাহমুদ এক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম। তিনি এখনও তার সৃজনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। বর্তমানে তিনি যেসব পদ্যধর্মী কবিতা লিখে চলেছেন—এসব কবিতার মধ্যেও তার সৃজন-প্রবণতা উছলে উঠছে।
আল মাহমুদের জীবন যেমন বহু-বিচিত্র বাঁক বদল করেছে, তার কাব্য কিংবা সাহিত্যও বদল করেছে বহু-বিচিত্র বাঁক। এককালের এই মার্কসবাদী কবি ক্রমেই নিমজ্জিত হয়েছেন অধ্যাত্মবাদের গভীরে। কিন্তু তার কাব্য ও সাহিত্যে একটি বিষয় শুরু থেকে শেষাবধি বজায় থেকেছে, এ বিষয়টি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, পুঁজিবাদ বিরোধিতা। তার সুবিখ্যাত ‘সোনালি কাবিন’ সনেট সিরিজ থেকে শুরু করে ‘উড়ালকাব্য’র ‘ঈগল থাকবে ইতিহাস থাকবে না’ শিরোনামের কবিতা পর্যন্ত আমরা তাকে প্রবলভাবে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে দেখি। একদা সোনালি কাবিনে তিনি সাম্যবাদের কথা উচ্চারণ করেছেন—
মাত্স্যন্যায়ে সায় নেই, আমি কৌম সমাজের লোক
সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে,
কোনো সামন্তের নামে কোনোদিন রচিনি শোলোক
শোষকের খাঁড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের ’পরে।
এই সাম্যবাদের ধ্বনি বদলে গেছে তার কণ্ঠে ভিন্ন রূপে। উড়ালকাব্যে তিনি বিদ্রূপধ্বনি উচ্চারণ করেছেন বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলোর প্রতি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছে, তখন এ কবিকে আমরা উচ্চারণ করতে দেখেছি এই বিদ্রূপাত্মক শোলোক—
‘পুঁজির শত্রু কোথা চীন কোথা রুশ
সবার পাছায় থাপ্পড় মারে বুশ’।
‘আমি, দূরগামী’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় আমরা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার মুখোমুখি কবিকে লড়াইরত দেখতে পাই। সম্প্রসারণবাদী ও আগ্রাসী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবেও এই কবিকে আমরা দেখি। ‘উপমহাদেশ, কাশ্মীর : ৯৩’ শীর্ষক অসাধারণ একটি নাটকীয় কবিতায় কবির উচ্চারণ—
আমেরিকা তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে এক কবি।
উপমহাদেশের জর্জরিত মানবাত্মার সর্বশেষ বিশ্বাসের স্তম্ভ।
আমেরিকা তোমার একটিই প্রশ্ন : ইসলামের কি এখন আর বিক্রি করার আছে?
আমরা বিনিময় করি বিশ্বাস। আমাদের আছে ঈমান। আমেরিকা
তুমি কি জানো ঈমান কি?
ডলারের স্তূপ
তোমার কৃেকৗশল
তোমার একচেটিয়াবাজি থেকে হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া
নিউক্লিয়ার ওয়েপন।
আর তোমার হাতের পাঁচ জাতিসংঘের সিন্দুকে যা নেই
আমাদের লেনদেন সেই বিশ্বাসে
বিশ্বাস, যা নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে জাতিগুলোর
স্বাধীনতার দীর্ঘশাস, কাশ্মীর।
একদিকে তিনি ধারণ করেন বাঙালি কৌম সমাজের হাজার বছরের ইতিহাস ও এর লোকজ আত্মা, অপরদিকে প্রবল সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধিতা। কবিতার শব্দ চয়নে তার লোকজ উত্তরাধিকার বারবার চমকে দিয়েছে বাংলা কবিতার পাঠকদের। তবে একথা স্পষ্ট যে, আল মাহমুদ পূর্ববাংলার কৃষিজীবী ও মত্স্যজীবী সমাজে প্রচলিত শব্দ সম্ভারকেই তার কবিতায় অধিক হারে ব্যবহার করেছেন। তার কথাসাহিত্যেও চিত্রিত হয়েছে এ সমাজই। পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলার মধ্যকার নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক পার্থক্যের কথা তিনি কখনও বিস্মৃত হননি। ভাটি বাংলা, রাঢ় বাংলা তার কাছে সব সময়ই সুস্পষ্ট পার্থক্যসহ হাজির থেকেছে। এসব কার্যকারণই তার কবিতাকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। কাব্যের ইতিহাস ও সমাজের ইতিহাসকে তিনি সমান্তরাল সচেতনতায় উপলব্ধি করেছেন।
এই কবির কবিতা শুধু নয়, তার গল্প-উপন্যাসও এই পূর্ববাংলারই সমাজ বাস্তবতার দলিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার গল্প-উপন্যাসে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ফলে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সেই অভিজ্ঞতার নির্যাসই তার গল্প-উপন্যাসের বহু প্লটের বিস্তার ঘটিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নেই। এককভাবে এ ইতিহাসের গর্বিত উত্তরসূরি পূর্ববাংলা কিংবা বাংলাদেশের মানুষ। আল মাহমুদের সঙ্গে যোগ রয়েছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের। তার প্রথম প্রকাশিত রচনা একটি ছোটগল্প হলেও মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত তিনি কথাসাহিত্যে তেমন কোনো কাজ করেননি। মুক্তিযুদ্ধ তাকে কথাসাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে বলে মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরেই তিনি ব্যাপকভাবে কথাসাহিত্য রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
এদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসেও তিনি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। নিজের পেশাগত দক্ষতার জোরে প্রুফ রিডার থেকে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছিলেন তিনি। এক্ষেত্রেও তিনি সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, আধিপত্যবাদ, পুঁজিবাদ ও দুঃশাসনের মুখোমুখি হয়েছেন। কারাবরণ করেছেন দীর্ঘ প্রায় এক বছর।
আল মাহমুদের প্রতিভাশক্তি, দীর্ঘ জীবন ও বিচিত্র সৃষ্টিশীল কর্মের মূল্যায়ন করা অত সহজ কাজ নয়। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন কিংবা এটা তার পাওয়া উচিত। কিন্তু নোবেল পুরস্কারের ইতিহাস এ কথার সমর্থন দেয় না। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি-সাহিত্যিকরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত কোথায়? এটা হয় না। জেনে-শুনে কেউ তাকে নোবেল পুরস্কার দেবে না, দেয়া উচিতও হবে না তাদের পক্ষে। আল মাহমুদের নাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবানদের কাতারেই উচ্চারিত হবে। যে কবি তার নিজের মাথাকে ‘দিক নির্ণায়ক বৃক্ষের মতো উঁচু হয়ে উঠেছে’ দেখতে পান; আর জানান দেন—
আমার মাথার জন্য অশ্রুসজল আবেদনে কাঁপছে
ভ্রমরকৃষ্ণ একজোড়া চোখের পাতা :
তার সন্তানদের কেউ যেন ‘বেঈমানের বাচ্চা’ না বলে।
দূর মফস্বল শহরের এক দুর্বল বৃদ্ধা তার সান্ধ্য প্রার্থনার জায়নামাজ বিছিয়েছে :
প্রভু, আমার ছেলের ঘাড় পাথরের মতো শক্ত করে দাও।
সাবধান, আমার মাকে কেউ যেন গোলামের গর্ভধারিণী না বলে।
এই আল মাহমুদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে কি?
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×