somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন ভোগবাদী মন্ত্রী ও একজন মরমী কবি আ হ ম দ বা সি র

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৯:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত ২০০৯ সালের ২১ ডিসেম্বর ছিল মরমী কবি হাসন রাজার (১৮৫৪-১৯২২) ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী। হাসন রাজা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ওইদিন ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে হাসন উত্সবের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত গবেষক ও শিক্ষাবিদ আবুল আহসান চৌধুরী। উত্সবের আলোচনা পর্বে মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হাসন রাজাকে ‘ভোগবাদী মানুষ’ বলে অভিহিত করেন। মন্ত্রী ভোগবাদকে খুব ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, ‘যদি ভোগ-উপভোগই না থাকে, তাহলে জীবনের দর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না।’ তিনি হাসন রাজা সম্পর্কে দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিকৃত বলে উড়িয়ে দেন। মন্ত্রী বলেন, ‘দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দর্শন দিয়ে হাসন রাজাকে বোঝা যাবে না, তাকে বুঝতে হবে ভোগের দর্শন দিয়ে।’
একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে ওই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। এ বিষয়ে ২৩ ডিসেম্বর দৈনিক আমার দেশ-এর ‘সোনালি রুপালি’ বিভাগে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। ‘ঢাকায় হাসন উত্সব’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনটিতে মন্ত্রীর বক্তব্যটি ধারণ করা আছে। প্রতিবেদনে ওই অনুষ্ঠানের সভাপতি হাসন-লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। আবুল আহসান চৌধুরী মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রায় বিপরীত বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করেই তিনি বলেছেন, ‘হাসন রাজার জীবনে একটি অদ্ভুত বৈপরীত্য ছিল। একদিকে জমিদার হিসেবে তার মধ্যে ছিল সামন্ত মানসিকতা, অন্যদিকে কবি হিসেবে তাঁর মধ্যে ছিল মরমী, বৈরাগ্য চেতনা। সামন্ত প্রভাবের কারণেই তাঁর মধ্যে ভোগের মানসিকতা ছিল।’
আবুল আহসান চৌধুরীর বক্তব্য থেকে জানা গেল, এই ভোগবাদী মানসিকতাকে এক সময় অতিক্রম করেছিলেন হাসন রাজা। তাঁর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে মরমী ও ত্যাগী মানসিকতা। সে কারণেই হাসন রাজা গণমানুষের সম্পদ হয়ে উঠেছেন। ভোগবাদী চেতনা নয় বরং হাসনের মরমী চেতনাই তাঁকে গণমানুষের কবি ও শিল্পীতে পরিণত করেছে।
আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সামহয়্যার ইন ব্লগে পোস্ট করা হলে ব্লগার এটিএম মোস্তফা কামাল তার মন্তব্যে বলেন, ‘আমি জানি না মন্ত্রী মহোদয় দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের কথা উড়িয়ে দিলেন কিসের ভিত্তিতে? আমার মতে, সিলেটের কৃতী সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের পর বৃহত্তর সিলেটের কৃতী সন্তান দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফই আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তাঁর পাণ্ডিত্য ঈর্ষণীয়। তদুপরি দেওয়ান আজরফ হাসন রাজার দৌহিত্র।’
হাসন রাজার ইন্তেকালের পর এদেশে শত শত মন্ত্রী মন্ত্রিত্ব করেছেন, হাসন রাজা কিন্তু একজনই। সুতরাং কোন মন্ত্রী হাসন রাজাকে নিয়ে কী বক্তব্য দিয়েছেন তাতে হাসন রাজার কিছু আসে যায় না, এমনকি হাসন ভক্তদেরও এতে কিছু যায় আসে না। তারপরও তিন বছর আগে প্রদত্ত একজন মন্ত্রীর একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করার কারণ একটাই, আর এ কারণটি হচ্ছে একজন ভোগবাদী মন্ত্রী ও একজন মহান মরমী কবির পার্থক্য চিহ্নিত করা এবং ভোগবাদ কীভাবে আমাদের মননকে বিকৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তার নজির উপস্থাপন করা। হাসনের জীবনের যে অদ্ভুত বৈপরীত্যের কথা আবুল আহসান চৌধুরী বলেছেন, সে বৈপরীত্যের কথা সবাই বলে থাকেন। সামন্ত মানসিকতা হাসনকে অর্থহীন ভোগবাদে নিমজ্জিত করেছিল এবং ভোগবাদী সঙ্কটে পতিত হাসন আত্ম-উদ্ধারের পথ খুঁজে নিয়েছেন মরমী চেতনায় সঞ্জীবিত হয়ে। কোনো ভোগবাদীর পক্ষে কি লেখা সম্ভব—
লোকে বলে রে, ঘরবাড়ী বালা না আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার
বালা করি ঘর বানাইয়া ক’দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার।
আধুনিক বাঙালি পাঠকের কাছে হাসন রাজাকে যিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত করিয়েছেন সেই প্রভাত কুমার শর্মা এ প্রসঙ্গে লিখেছেন—‘তাঁহার ঘরবাড়ি ভালো ছিল না। লোকে সেই লইয়া বলাবলি করিত। তাই কবি বলিতেছেন—বিদেশে দালান কোঠা তৈরি করিয়া কি হইবে? শূন্যের মধ্যে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করিয়া কি লাভ? হঠাত্ কোন দিন এই দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইব কে জানে? যদি জানিতাম এখানে কয়দিন থাকিব, তবে সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করিতাম।— কিন্তু হায়! জীবন যে অনিশ্চিত? তাসের ঘরের মতো কখন যে ভূমিসাত্ হইবে কে জানে? আয়নায় চাহিয়া যে দেখি আমার চুল পাকিয়া গিয়াছে। কানের কাছে যে ঘণ্টা বাজিয়াছে, আর ত দেরি নাই।’
প্রভাতকুমার লিখেছেন, “তাঁহার বাড়ি দেখানো সম্বন্ধে একটি সুন্দর গল্প আছে। ঘটনাটি সত্য। কয়জন বিদেশী ভদ্রলোক এখানে আসিয়া তাঁহার বাড়ি দেখিতে যান। বাড়ির সম্মুখে গিয়া হাসন রাজা সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—‘আপনারা কি চান?’ ভদ্রলোকেরা তাঁহাকে না চিনিয়া বলিলেন, ‘আমরা হাসন রাজা সাহেবের বাড়ী দেখতে এসেছি।’ মরমী কবি অত্যন্ত আগ্রহের সহিত বলিলেন, ‘আসুন আসুন, আমি আপনাদের তার বাড়ী দেখিয়ে দিচ্ছি।’ এই বলিয়া তাঁহাদের একটা মজের পাশে লইয়া গেলেন। সেখানে তাঁহার কবর তৈরি হইতেছিল; সেই চিরদিনকার বাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘ঐ দেখুন আমার বাড়ী।”
এই যে হাসন রাজা, তিনি তার যৌবনে যথেষ্ট ভোগবাদী ছিলেন, একথা অস্বীকার করা যায় না। তখন তার চোখে নেশা লেগেছিল, যে কারণে তিনি লিখেছেন—‘নেশা লাগিলরে/ বাঁকা দু’নয়নে নেশা লাগিলরে’। এই নেশার ঘোর হাসনের কেটে গিয়েছিল এবং হাসন বাস্তবতায় ফিরে এসেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভোগের ভ্রম। সেই ভ্রম তিনি শুধরে ছিলেন বলেই আজকের হাসন রাজা লোকের এত প্রিয়। নেশার ঘোর কেটে যাওয়ার পরই হাসন বলে ওঠেন—‘চন্দ্র সূর্য নহে বন্ধুর রূপের সমতুল/তাদের সঙ্গে তুলনা যে হাসন রাজার ভুল’ কিংবা ‘কিসের বাড়ি কিসের ঘর কিসের জমিদারী?/সঙ্গের সঙ্গীরা কেউ নাই তোর, কেবল একেশ্বরী।’ অথবা ‘চাই না আমি ভাই বন্ধু/চাই না মোসলমান হিন্দু/কেবল চাই তোমার চরণ রে’ কিংবা ‘হাসন রাজা কুমতি ছাড়/এখন তুমি হুঁশ কর/পরকে ছাড়িয়া আপন ধর/তাঁর গুণাগুণ গাও।’
হাসন আগাগোড়াই ছিলেন একজন কবি। তাঁর মধ্যে কবিত্ব ও সামন্তের সংঘাত ছিল।
একদা মৃত্যুচেতনা তাঁকে এই সংঘাতের হাত থেকে উদ্ধার করল। যে কারণে হাসনের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘মরণ কথা স্মরণ হইল না হাসন রাজা/তোর মরণ কথা স্মরণ হইল না।’ কিংবা ‘একদিন তোর হইব মরণ রে হাসন রাজা/একদিন তোর হইব মরণ।’
প্রভাত কুমার লিখেছেন, ‘তাঁহার বাড়ির লোকের কাছ হইতে জানা গিয়াছে, মাছি ও পিঁপড়ার প্রতিও সদয় ব্যবহার করিতেন। বাস্তবিক দয়াগুণ তাঁহার চরিত্রের একটি বিশেষত্ব ছিল। তাঁহার হৃদয়ের বিপুল শক্তি কাজ করিবার স্থান পাইত না, ছুটিয়া চলিবার ধারা পাইত না, তাই ক্ষণিকের বিদ্যুতের মতোই কেবল তাহা দেখা দিয়া মধ্যে মধ্যে মানুষের চক্ষুতে ধাঁধা লাগাইয়া দিত, কিন্তু এই দয়াগুণ তাঁহার মধ্যে কোনো আকস্মিক বিকাশ ছিল না। পূর্বপুরুষের মধ্যে যাহা প্রাচ্যশিক্ষার গুণে ধর্মপ্রাণতার ও ধর্মোদারতার ভিতর দিয়া প্রকাশ পাইত, হাছন রাজাতে তাহাই অশিক্ষার ফলে প্রতিভার খেয়ালের মতো ফুটিয়া উঠিত।’
হাসন রাজার এই পরিচয়ও আমাদেরকে জানান দেয় যে, তার অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষায় কখনও ভোগবাদ ছিল না। সামন্ত ও কবিত্বের সংঘাতের মধ্যেই তিনি ভোগবাদী হয়ে উঠেছিলেন এবং এই সংঘাতের চূড়ান্ত পরিণতিতে তার মরমী চেতনা ভোগবাদের বিপরীতে এক উচ্চ পর্যায়ের আধ্যাত্মিকতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।
হাসন ‘কুমতি’ ছেড়ে ‘সুমতি’তে ফিরে এসেছেন। তিনি নিজেকে নিজে কমান্ড করেছেন ‘কুমতি’ ছাড়ার জন্য। ফলে স্বচ্ছন্দে ‘কুমতি’ ত্যাগ করে ‘সুমতি’তে ফিরতে পেরেছেন হাসন। দুর্ভাগা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী নিজের ‘কুমতি’ কীভাবে হাসনের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন—ভাবতে অবাক লাগে। এই দুর্ভাগারাই আমাদের দুর্ভাগ্যের উত্সমূল হয়ে আছে। হায়, আমাদের বাল্যশিক্ষা—‘ভোগে সুখ নাই ত্যাগেই প্রকৃত সুখ’!
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×